মসির ধারায় অসির ধার (৮)

সঞ্জীব মুখার্জী
“Before you criticize someone, you should walk a mile in their shoes. That way when you find yourself criticizing them, you are already a mile ahead of them and, of course, you have their shoes.” – Jack Handey
১২ই নভেম্বর ১৯৮৫, সকাল বেলায় হাওড়া স্টেশনে আমার ভাই জহর আমায় সিউড়ি যাবার ট্রেনটা ধরিয়ে বাড়ি ফিরে গেলো। জানালার ধারে বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। বেশ জোর গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেনটা। যে সব স্টেশনে ট্রেনটার স্টপেজ নেই সেগুলি সমান দ্রুতগতিতে উল্টোদিকে পেরিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনটা ডাইরেক্ট সিউড়ি যাবে না, আমাকে সিউড়ি যেতে গেলে রামপুরহাট আর বোলপুরের মধ্যে একটা স্টেশন, সাঁইথিয়াতে নেমে সেখান থেকে আবার বাস ধরে তবে সিউড়ি যেতে হবে। আমাকে ট্রেনে বসিয়ে জহরের চলে যাওয়ার পর মনটা বেশ খারাপ করছিলো। কয়েকটা দিন বড়মাসীর বাড়িতে পরীক্ষা, গল্প গুজব, আড্ডা আর রকমারি খাওয়াদাওয়ার মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো, ইচ্ছে করছিলো আরো কয়েকটা দিন থেকে যেতে, কিন্তু নিরুপায়, বাড়িতে পিসির বিয়ে। মনে মনে ভাবছি অনেক আত্মীয় স্বজনরা সব আসবে পিসির বিয়েতে, অনেকদিন পর সকলের সাথে আবার দেখা হবে। এইটা ভেবে মনটা একটু স্বান্ত্বনা পাচ্ছিলো। এদিকে ফোর্ট উইলিয়ামে ফাইনাল রাউন্ডের শারীরিক এবং লিখিত দুটো পরীক্ষাই বেশ ভালো গেছিলো তবু মনের সংশয় যেন কাটছিলো না। কি হয় কি হয় একটা ভাব। পাশ করবো তো? ভালো খবর আসবে তো রিক্রুটমেন্ট-এর হেডকোয়ার্টার থেকে? এইসব নানান চিন্তার জট মাথার মধ্যে পাকাচ্ছিলো। ঐসব কথা ভাবতে ভাবতে আর জানালার ধারে বসে ট্রেনের বাইরেটা দেখতে দেখতে বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেলো টেরও পেলাম না। ট্রেনটা বর্ধমান স্টেশনে এসে ঢুকলো। ট্রেনটি দাঁড়াতেই বেশ কিছু যাত্রী হুড়হুড় করে ট্রেনে কামরার মধ্যে উঠে পড়লো আর সেই সঙ্গে ঢুকে পড়লো কয়েকটি হকারও। হকাররা কেউ লুচি তরকারি, কেউ চা, কেউ ফল আবার কেউ ডিমসেদ্ধ বিক্রি করছিলো। অনুভব করলাম খিদে তো একটু পেয়েছে, তাই একজন হকারের কাছ থেকে লুচি তরকারি কিনলাম তারপর আর একজনের কাছে চা। ইতিমধ্যে ট্রেনটি ছেড়ে দিয়েছে। বর্ধমানে ওঠা যাত্রীরা তখন নিজের সিট খুঁজতে আর তার মধ্যে নিজেদের এডজাস্ট করে বসতে ব্যস্ত। চা সহযোগে লুচি আর তরকারি খেয়ে একটু পেটটা ঠান্ডা হওয়ার পর কখন যে জানালার শিকগুলোতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি তার খেয়াল নেই। শীতকালের রোদ্দুর মাখা ঠান্ডা হাওয়াতে ছোট্ট অথচ একটি সুন্দর ঘুম হওয়ার পর হটাৎ সেটি ভাঙলো যাত্রীদের হৈচৈ এ। পরের স্টেশনটি বোলপুর, সেখানে নেমে যাওয়ার জন্য যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি শুর হয়ে গেছে আর তারই কলরব। মনে পড়লো, আরে পরের স্টেশন-ই তো সাঁইথিয়া, যেখানে আমায় নামতে হবে। যাইহোক, আরো কিছুক্ষণ যাওয়ার পর ট্রেনটি সাঁইথিয়া স্টেশনে ঢুকলো। জিনিস বলতে তো আমার কাছে একটি মাঝারি সাইজের ব্যাগ যেটা আমার ঠিক মাথার উপরের তাকে রাখা ছিল। স্টেশনে ঢোকার আগেই আমি আমার ব্যাগটা নামিয়ে ট্রেনের দরজার কাছে চলে গেলাম। সাঁইথিয়া থেকে বাস ধরে সিউড়ি বাসস্ট্যান্ড আর তারপর সেখান থেকে বাড়ি। যখন আমি বাড়ি পৌঁছলাম তখন প্রায় সাড়ে বারোটা কি একটা বাজে। বাড়ি ঢুকে দেখি বাড়িতে তখন হৈহৈ কান্ড রৈরৈ ব্যাপার। পুরো বাড়িটাই সব আত্মীয় স্বজনে ভর্তি। এক এক করে সকলের সাথে দেখা এবং সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপ। তখন দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাই স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া করে সমস্ত অতিথিদের সাথে বেশ জম্পেশ করে গল্প হল। তারপর যখন তারা জানলো যে আমি কলকাতা থেকে আর্মি জয়েন করার জন্য পরীক্ষা দিয়ে সদ্য ফিরছি তখন এককথায় সকলের সাথে গল্পের মত্ততা যেন আরো বেড়ে গিয়েছিলো। সকলের কৌতূহল মেটাতে মেটাতে সারা দিনের বেশিরভাগটাই কেটে গেলো। সন্ধ্যে হয়ে রাত্রি নেমে এলো। তারপর বর এবং বরযাত্রীর আগমন, বাড়ির বর্ধিষ্ণু হইহুল্লোড়, রাত্রির নৈশভোজ, পরদিনের বরবধুর গমন, কনেযাত্রীর আনন্দ, ইত্যাদি নিয়ে আরো দুটো দিন এতো ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কেটে গেলো যে বুঝতেও পারলাম না। তারপর দু এক দিনের মধ্যে ধীরে ধীরে বাড়িও খালি হতে লাগলো। সমস্ত আত্মীয় স্বজন যারা বিয়েতে এসেছিলো তারা এক এক করে যে যার বাড়ি ফিরে গেলো। কেটে গেলো আরো কয়েকটি দিন।
একদিন হটাৎ সকাল বেলায় দেখি বাড়ির দরজার কড়া নেড়ে পোস্ট অফিসের পিয়ন একটা ইনল্যান্ড খামের মতো চিঠি দিয়ে গেলো। চিঠিটা হাতে নিয়ে দেখলাম, বেশ অদ্ভুত রকমের দেখতে। ঐরকম ইনল্যান্ড লেটার তার আগে কক্ষনো দেখিনি। প্রথমটা ভাবলাম, পিয়ন কি ভুল করে দিয়ে গেলো নাকি চিঠিটা? নাঃ ঠিকানা তো আমারই। তাহলে কেইবা পাঠালো আমাকে ঐরকম চিঠি। ভাবতে ভাবতে চিঠিটাকে উল্টে দেখলাম পিছন দিকটায় প্রেরকের নাম আর ঠিকানা লেখা আছে। সেটা পড়তেই মন আনন্দে নেচে উঠলো। চিঠিটা পাঠিয়েছে কার্তিকদা। সৈনিক চিঠি। তা সৈনিকদের কি ঐরকম চিঠি হয় নাকি? ইনল্যান্ড খামটির সামনে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম একটা সাইড এ একটা বক্স বানানো আর তাতে লেখা আছে “FREE ON ACTIVE SERVICE” আর তার পাশটিতে হেলমেট পড়া সৈনিকের ছোট্ট একটা ছবিও রয়েছে। যাইহোক চিঠিটার একটা সাইড থেকে খুব সন্তর্পনে ছিঁড়লাম আর তারপর চিঠিটা পড়তে শুরু করলাম। নানান রকমের কথা লিখে পাঠিয়েছে কার্তিকদা, কেমন আছি, শরীর চর্চা আগের মতো চালিয়ে যাচ্ছি কিনা, কিরকম ঠান্ডা পড়েছে, কি সমাচার, ইত্যাদি। কিন্তু এসবের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ খবর কার্তিকদা যেটা জানতে চেয়েছে সেটা হলো ফোর্ট উইলিয়ামে আমার পরীক্ষা কেমন হলো সেটা আর পরীক্ষা পরবর্তী সেখান থেকে কোন খবর এসেছে কিনা। নিজের নাম ঠিকানাটা ভালো করে লিখে আমাকে উত্তরও পাঠাতে লিখেছে কার্তিকদা। কয়েকদিন ধরেই কার্তিকদার কথা মনে মনে ভাবছিলাম, তা দেখি কার্তিকদার চিঠি এসেই হাজির। ঠিক করলাম কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে তারপর কার্তিকদাকে চিঠির উত্তরটা পাঠাবো।
আরো কয়েকটা দিন কেটে গেলো। শীতটা এর মধ্যে একটু একটু করে বেশ জাঁকিয়ে পড়তে শুরু করেছে। একদিন সকালে আমাদের বাড়ির বারান্দার রোয়াকে বসে একটু রোদ পোয়াচ্ছিলাম আর আমার পাশের বাড়ির এক জেঠতুতো দাদা, যাকে আমি ছোড়দা বলে ডাকতাম, তার সাথে গল্প করছিলাম। গল্পটা হচ্ছিলো মূলতঃ ক্রিকেট নিয়েই। এখন যেমন সারাটা বছরই ক্রিকেট খেলা হয় তখন কিন্তু সেইরকম ছিল না। বরং সেই সময়তে শুধু শীতকালেই ক্রিকেট খেলাটা হতো। সেই বছর অর্থাৎ ১৯৮৫ তে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এসেছিলো ভারত সফরে। টেলিভশন ও সেই সময় সকলের বাড়িতে থাকতনা। ছাদের উপর এন্টেনা দেখে সনাক্ত করা হতো যে কার কার বাড়িতে টিভি আছে। আর সেই সব বাড়িতেই হতো ফুটবল আর ক্রিকেট প্রেমীদের খেলা দেখার ভিড়। ভিড়ের ঠ্যালায় কারোর বাড়িতে খাট ভাঙতো তো কারো বাড়িতে চেয়ার। আর তারপর সেই বাড়ির লোকেদের আদর আর আপ্যায়নের ঠ্যালা সামলানোই দায় হতো আগন্তুক দর্শকদের পক্ষে। সৌভাগ্য বশতঃ ছোড়দাদের বাড়িতে টিভি ছিল আর তার জন্য আমরা বাড়িতে বসেই ক্রিকেট ফুটবল ম্যাচ দেখতাম, আমাদের অন্য কোথাও যেতে হতো না। ওই সমস্ত বিষয় নিয়েই আমি আর ছোড়দা গল্প করছিলাম আর নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করছিলাম সেদিন সকালের রোদ্দুরে বসে।
ছোড়দার নাম চন্দন, চন্দন মুখার্জী, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে কয়েক বছর আগেই পাশ করে বেরিয়ে ছোড়দা তখন সিউড়িতেই PWD অফিসে অস্থায়ী কর্মচারী রূপে কর্মরত। আমার থেকে বয়সে দু তিন বছরের বড় হলেও আমরা দুজন বন্ধুর মতোই ছিলাম। পাশাপাশি বাড়ি আমাদের, তাই ছেলেবেলা থেকে একসাথেই মানুষ হয়েছি আমরা। একসাথে ফুটবল খেলা, ক্রিকেট খেলা, ক্যারম বোর্ড খেলা, ক্লাবে আড্ডা মারা, পাড়ার লোকেদের গাছে ঢিল মেরে আম পেয়ারা পারা, দুষ্টুমি করে পাড়ার লোকেদের অতিষ্ট করা, ইত্যাদি ছিল আমাদের দুজনের দৈনিন্দিন জীবনের কার্যকলাপ। আমার আর ছোড়দার সম্পর্কের কেমিস্ট্রিটা এককথায় এতই সবল ছিল যে দুনিয়ার কোনো শক্তিই আমাদের আলাদা করতে পারতো না। যা কিছু করতাম দুজনে একসাথেই করতাম, যেখানে ছোড়দা যেত আমিও ছোড়দার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে যেতাম। এমনকি পাড়ার লোকেরা আমাদের শঙ্কু-চন্দনের জুটি বলেই আখ্যা দিয়েছিলো। আমাদের দুজনের মধ্যে যদি একজনকে একা কোথাও দেখা যেত তো পাড়ার লোকে জিজ্ঞেস করতো আরে অপর জনটি কোথায়। একে অপরের জন্য প্রাণপাত করতাম আমরা। আমাদের দুজনের জুটিকে পাড়াতে ত্রাস বলা হতো কেননা আমরা দুজন একসাথে থাকলে কখন যে কি করে বসবো আর তার সুফল কুফল যে কি হবে সেটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল সকলের কাছে । তবে হ্যাঁ, দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন, এই নীতিতেই বিশ্বাসী ছিলাম আমি এবং ছোড়দা। পাড়ার লোকে আমাদের জুটি ভাঙার নানান ভাবে চেষ্টা করতো কিন্তু কোনোদিন তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। এমনই ছিল আমাদের বন্ধুত্বের গভীরতা। তবে ছেলেবেলাতে শুধু অনিষ্টই করিনি পাড়াতে, বড়ো হওয়ার সাথে সাথে অনেক সমাজ সেবা মূলক কাজ কর্মও করতাম নিজেদের পাড়াতে এমনকি আশে পাশের পাড়াতেও। যেমন ধরুন কোনো গরিব লোক অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় ভুগছে, কেউ তাকে দেখার নেই, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চাঁদা তুলে সেই লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, তার জন্য ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করে দেওয়া; তারপর, কোনো বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাদের সন্তানরা দেখছে না, তাদের জন্য পাড়ার সমস্ত লোককে ডেকে, মিটিং করে, সেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের জন্য সঠিক ব্যবস্থা করে দেওয়া; পাড়ার বা পাশের পাড়ার কোনো দরিদ্র পরিবারে কেউ মারা গেলে যদি টাকা পয়সার অভাবে মৃতদেহের সৎকার করতে পারছে না, পাড়ার সকলের কাছ থেকে তাদের সামর্থ অনুযায়ী অর্থ সাহায্য একত্রিত করে সেই মৃতদেহের সৎকার থেকে আরম্ভ করে তার শ্রাদ্ধ শান্তি করানো, এইসব ছিল আমাদের সমাজ সেবার উদাহরণ। তাই পাড়াতে আমায় আর ছোড়দাকে স্নেহও করতো সকলে আর সেইজন্য আমাদের করা ছোটোখাটো অনিষ্ট বা জ্বালাতনকে তারা খুব একটা আমল দিতো না।
প্রসঙ্গক্রমে একটা ছোট ঘটনার কথা মনে পরে গেলো যেটা আপনাদের না বলে পারছিনা। তার জন্য একটু ফ্ল্যাশ ব্যাকে যেতে হবে আমাদের। একবার কি হয়েছে, আমরা প্রতি বছর পাড়াতে সরস্বতীর পুজো করতাম আর যেদিন সরস্বতী পূজা হতো তার ঠিক আগের দিনটিতে পাড়ার সমস্ত সমবয়সী ছেলেরা মিলে সারা রাত জেগে প্যান্ডেল করতাম। প্রতিবারের মত সেবারেও রাত্রি জেগে প্যান্ডেল করার ধুম। সরস্বতী পুজোর সময়টা হয় ঠিক শীত যাবার মুখে আর সেই সময় খেজুরের গুড় হয়। আমাদের পাশের পাড়াতে একটি ফাঁকা জায়গাতে বেশ কয়েকটি খেজুরের গাছ আর একটি লোক সেই গাছ গুলোর প্রতিটিতে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটি করে মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে যেত যাতে সারা রাত ধরে খেজুরের রস চুঁইয়ে সেই হাঁড়িতে সংগ্রহ হয়, তারপর দিন সেই লোকটি সমস্ত মাটির হাঁড়িগুলোকে গাছ থেকে পেরে সেই রস থেকে গুড় তৈরী করে খেজুরের গুড় বিক্রি করতো। সেবার আমি, ছোড়দা আর অন্যান্য ছেলেরা মিলে ঠিক করলাম যে সরস্বতী পুজোর আগের রাত্রিতে সেই গাছ থেকে খেজুরের রস চুরি করবো। তার প্রস্তুতি হিসাবে দিনের আলোতেই সব কিছু ঠিক ঠাক করে জায়গাটা দেখে এলাম। আমাদের মধ্যে কে গাছে চাপবে, কে টর্চ লাইট দেখাবে, কে রসের হাড়ি সামলাবে সবকিছু ঠিক। পরিকল্পনা মতো মধ্যরাত্রিতে যখন আমরা খেজুরের রস চুরি করতে যাই তখন দেখি অলরেডি সেখানে অন্য একটি দল পৌঁছে গেছে আর তাদের মধ্যে একজন গাছে চেপে রসের হাঁড়ির দড়ি খোলার চেষ্টা করছে আর নিচে থেকে একজন টর্চ দেখাচ্ছে আর বাকি ছেলেরা দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার রাত্রি। ছেলে গুলোকে চিনতেও পারছি না যে তারা কারা। আমাদের প্ল্যান তো ভেস্তে গেলো। তাহলে কি করা যায়। এইসব ভাবতে ভাবতে ঠিক করে ফেললাম যে যদি আমরা খেজুরের রস খেতে না পাই তাহলে ওদেরকেও খেতে দেব না। কিন্তু কি করে। এইরকম ভাবছি হটাৎ ছোড়দার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেলো। ছোড়দা আমায় বললো যে আমি যখন বলবো ঠিক তখনি তুই টর্চ টার ফোকাস ঠিক খেজুরের রসের হাঁড়ির উপর ফেলবি তবে দেখিস তোকে যেন ওই দলের কেউ দেখতে না পায়। আমি বললাম, চারিদিকে যা অন্ধকার ছোড়দা, কেউ আমায় দেখতে পাবেনা। যে কথা সেই কাজ। ততক্ষনে ছোড়দা কয়েকটি মাঝারি সাইজের পাথর কুড়িয়ে আমাকে ফিসফিসিয়ে বললো, শঙ্কু টর্চটা মার্। আর আমি টর্চের আলো ফেলি সেই হাঁড়ির উপর যেটিকে পারতে অলরেডি অন্য দলের ছেলেটি গাছে উঠেছিল। খেজুর গাছটা খুব একটা উঁচু ছিল না। তাই টর্চের আলো ফেলতেই দেখি ছোড়দা প্রথম ঢিলটা ছুঁড়লো। অব্যর্থ নিশানা ছোড়দার, পাথরটা সজোরে হাঁড়িতে লাগলো, রসভর্তি হাঁড়িটা চুরমার হয়ে গেলো আর পুরো রসটাই পড়বি পড় ওই হাঁড়ি পারতে গাছে চাপা ছেলেটির মাথায় আর পুরো শরীরে। গাছে চাপা ছেলেটি হতচকিত হয়ে চিৎকার করে গালি গালাজ করতে লাগলো। আর নিচে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারাও বলাবলি করতে লাগলো, কে রে?, কে রে? কাজ সেরে ততক্ষণে আমরা পগার পার। ঘটনাটি ঐরকম ঘটে যাওয়ার জন্য ওই রাতে আমাদের প্যান্ডেল করা বন্ধ থাকলো। মাঝ রাত্রিতেই আমরা যে যার বাড়ি ঢুকে গেলাম। পরদিন জানতে পারলাম যে ওই দলটি অন্য আর একটি পাড়ার। আর এও জানতে পারলাম যে ছেলেটির মাথায় রসের হাঁড়িটি ভেঙে পড়ে সেই ছেলেটি তখন রীতিমতো অসুস্থ, কারণ একেই শীতের মধ্য রাত্রি তার উপর ঐভাবে খেজুরের রসে স্নান। কিন্তু কেউ অদ্যাবধি জানতে পারেনি যে সেই খেজুরের রসের হাঁড়ি ভাঙার কাজটি কে করেছিল। অবশ্য আজ আপনারা জানলেন।…
আর একটা ছোট্ট ঘটনার কথা বলি আপনাদের। আমরা যে প্রতি বছর সরস্বতী পূজা করতাম সেটা পাড়ার সকলের কাছে চাঁদা তুলেই করতাম। সেবার কোনো কারণে চাঁদা খুব একটা ভালো ওঠেনি আর আমরা খুব নিরাশায় ছিলাম যে এবার কি করে সরস্বতী পুজোটা হবে। পাড়া ঘুরে চাঁদা তুলতে তুলতে আমি, ছোড়দা সহ আরো কিছু ছেলে মিলে একজনের বাড়িতে গেলাম যাঁর নাম শিবরাম দাস। শিবরাম দাস হাই স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক এবং আমাদের সকলেরই সুপরিচিত। কিন্তু চাঁদা চাইতেই তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন আর চাঁদা না দিয়েই আমাদেরকে একপ্রকার পত্রপাঠ বিদায় করলেন। একজন শিক্ষকের কাছ থেকে অন্ততঃ সরস্বতী পূজার চাঁদার জন্য এইরকম ব্যবহার পাবো সেটা আশাতীত ছিল। সেই কথা বলতে বলতে আর মন খারাপ নিয়ে যখন সেই শিক্ষকের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি তখন হঠাৎ ছোড়দা বাকি সবাইকে ছেড়ে আমার হাতটা চেপে ধরে আমাকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সেই শিক্ষকের বাড়ির ধারে বাগানের দিকে যেটা দেখালো সেটা আর কিছু নয়, তিন চারটি গোলাপ গাছের টব আর প্রতিটি টবেই ধরে রয়েছে ইয়া বড় বড় গোলাপ। দেখতে দেখতে বাইরে চলে এলাম। বাইরে এসে ছোড়দাকে প্রশ্ন করলাম, “গোলাপ গাছ দিয়ে কি হবে ছোড়দা?” ছোড়দা, “বুঝলি শঙ্কু, সরস্বতী পুজোটা মনে হচ্ছে আমাদের ভালো করেই হবে।” আমি কিন্তু তখন ও মাথা মুন্ডু কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তাকিয়ে রয়েছি ছোড়দার পানে। মনে কিন্তু একটাই প্রশ্ন, “কিন্তু কি করে?” তখন ছোড়দা যে প্ল্যান টা আমাকে বললো সেটা হলো যে আমরা সরস্বতী পুজোর ঠিক আগের রাতে ওই গোলাপ গাছ চারটে চুরি করবো, বিক্রি করবো আর বিক্রি করে যে টাকাটা পাবো তা দিয়ে আমাদের অনায়াসে পুজোটা হয়ে যাবে। কিন্তু চুরির গোলাপ গাছ বিক্রিই বা করবো কাকে আর কিনবেই বা কে। ছোড়দার অভয় বাণী, “সব হয়ে যাবে, আমি যা যা বলবো তুই ঠিক তাই তাই করবি।” আমি ছোড়দার বিশ্বস্ত এবং আজ্ঞাকারী সেনাপতির মতো মাথা নেড়ে সায় দিলাম আর বললাম, “ছোড়দা তুই জিনিয়াস।” এবার আমাদের গোলাপ গাছের খদ্দের ঠিক করার পালা। ঠিক করলাম আমাদের পাড়াতে বা আশপাশের পাড়াতে বিক্রি করা ঠিক হবে না। আমাদের খদ্দের খুঁজতে হবে আমাদের পাড়া থেকে বেশ দূরেই। তাই খুবই সংগোপনে বেরিয়ে পড়তাম আমি আর ছোড়দা বিকাল বেলায় সাইকেলে করে। অনেক খোজ খুঁজি করার পর আর গোলাপ গাছের অনেক বর্ণনা দেওয়ার পর অবশেষে খদ্দের ঠিক হলো। এটাও ঠিক হলো গাছগুলো ক্রেতাকে মধ্য রাত্রিতেই তার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে “হোম ডেলিভারি”। সময়মতো গোলাপ গাছগুলি সরস্বতীপুজোর ঠিক আগের রাতেই উঠিয়ে নেওয়া হলো সেই শিক্ষকের বাড়ি থেকে আর কথামতো পৌঁছে দেওয়া হলো ক্রেতার বাড়িতে মধ্য রাত্রিতেই। “ক্যাশ অন ডেলিভারি” টাকাটাও পেয়ে গেলাম ওই রাত্রিতেই। অপারেশন সাকসেসফুল। পরদিন সকাল বেলায় গোলাপ ফুলসমেত গোলাপ গাছ দেখতে না পেয়ে সেই শিক্ষকের যা বিলাপ সেটা আর আপনাদের নাইবা বললাম। সন্দেহটা ছিল আমাদের উপরই, কিন্তু তিনি নিরুপায়, কোনো প্রমাণ রাখিনি আমরা। হয়তো শিক্ষক মশাইয়ের আক্ষেপের পরিমানটাও কম ছিল না, হয়তো তিনি ভাবছিলেন এর চাইতে এদের কিছু চাঁদা দিয়ে দিলেই ভালো হতো, হয়তো এতবড়ো ক্ষতিটা হতোনা, ইত্যাদি। কিন্তু তখন সেসব অতীত, যাকে কক্ষনো ফেরানো যাবে না। বলাই বাহুল্য ওই টাকাটা দিয়ে আমাদের চাঁদার ঘাটতি কিছুটা পূরণ হয়েছিল আর সেবারের সরস্বতী পুজোটাও ভালো ভাবেই হয়েছিল। ও হ্যাঁ, আর একটা কথা। সেদিনের ঘটনার পর আর কক্ষনো মতিচ্ছন্ন হয়নি শিবরাম স্যারের। পরবর্তী পুজোগুলোতে আমাদের আর কক্ষনো খালি হাতে ফেরাননি শিবরাম স্যার, চাঁদাটাও অন্যান্যদের থেকে একটু বেশিই দিতেন। আমরাও তাঁর সাথে এমন ভাবে ব্যবহার করতাম যেন ভাজা মাছটি উল্টেও খেতে জানিনা।
যাইহোক, এবার ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। ছোড়দার সাথে গল্প করতে করতে হটাৎ লক্ষ্য করলাম খাকি উর্দি পড়া পোস্ট অফিসের পিয়ন সাইকেলে করে আমাদের বাড়ির বারান্দার সামনে এসে দাঁড়ালো ঠিক যেখানটায় বসে আমি আর ছোড়দা গল্প করছিলাম। পিয়নটি এসে আমাদের সামনে দাঁড়াতেই আমাদের গল্প থেমে গেলো। পাশের পাঁচিলের গায়ে সাইকেলটিকে দাঁড় করিয়ে পিয়নটি আমাদের সামনে এল। হাতে তার একগুচ্ছ চিঠিপত্তর। তার মধ্যে থেকে একটি খাম বের করে আর একটা রেজিস্টার বের করে আমাদের উদ্দেশ্যে বললো সঞ্জীব কুমার মুখার্জীর নামে রেজিস্ট্রি চিঠি আছে। পিওনের হাতের খামটি দেখে আপাতঃ দৃষ্টিতে খুব চেনা চেনা বলে মনে হলো। তারপর মনে পড়ে গেলো আর একটা ঝিলিক খেলে গেলো মনে। আরে খাম টা তো আমারই নিজের হাতে ঠিকানা লিখে কলকাতায় ‘আর্মি রিক্রুটমেন্ট হেডকোয়ার্টারে’ জমা দিয়ে আসা বাদামি রঙের ‘সেলফ এড্ড্রেস্ড ইনভেলাপ’। সর্বাঙ্গে একটা টান টান উত্তেজনা। ঠিক যেন সাসপেন্স থ্রিলার। পিয়ন-এর গলার আওয়াজে সম্বিৎ পেলাম। নাও, রেজিস্টারে সই করে চিঠিটা রিসিভ করে নাও। চিঠিটা হাতে ধরিয়ে পিয়ন সাইকেলটি নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো। হাতে খামটি ধরে তার চলে যাওয়াটা দেখছিলাম। হটাৎ ছোড়দা বলে উঠলো, “কিরে শঙ্কু, কিসের চিঠি?” “বাদামি রঙের খাম দেখে মনে হচ্ছে কোনো সরকারি বিভাগ থেকে এসেছে।” আমি বললাম, “ছোড়দা, তোকে বলেছিলাম না যে আমি কলকাতায় আর্মিতে জয়েন করার ফাইনাল রাউন্ডের পরীক্ষা হয়ে যাওয়ার পর সেখানে একটা ডাক টিকিট লাগানো সেলফ এড্ড্রেস্ড ইনভেলাপ জমা দিয়ে এসেছিলাম, এটা সেটাই দেখছি।” ছোড়দা বললো, “ও আচ্ছা, তো খুলে তো দ্যাখ খামটার ভিতর কি আছে।” আমি ছোড়দাকে বললাম – ছোড়দা আমার সাহস হচ্ছে না রে খামটা খুলতে – প্রচন্ড ভয় ভয় করছে, কি যে খবর আছে খামটির মধ্যে। তখন ছোড়দা বললো, “তোর ভয় করছে তো আমাকে দে আমিই খুলি খামটা” বলে ছোড়দা আমার হাত থেকে খামটা আমার হাত থেকে একরকম কেড়ে নিয়ে খামটার উপর চোখ বোলাতে লাগলো।
ক্রমশঃ