মসির ধারায় অসির ধার (6)

সঞ্জীব মুখার্জী
“There are no secrets to success. It is the result of preparation, hard work and learning from failure.” – Colin Powell
দেখতে দেখতে ১০ নভেম্বর নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছিলো। পরীক্ষার প্রস্তুতি, দুর্গাপুজো, কালীপুজো, ভাইফোঁটা এইসবের মধ্যে দিয়ে দিনগুলো এমনই এক দুরন্ত গতিতে কেটে গেলো যে টেরও পেলাম না। যদিও দুর্গাপুজো এবং কালীপুজোতে আনন্দ উপভোগ যথাসম্ভবই করেছি তবে তা পরীক্ষার প্রস্তুতিকে অব্যাহত এবং অক্ষুন্ন রেখেই। আর সবচেয়ে বড় কথা, এসবের মধ্যে আমি পেয়ে গেলাম কার্তিকদার সাহচর্য, গাইডেন্স এবং তত্ত্বাবধান যেটা আমার পরীক্ষার প্রস্তুতিকে আরো অনেক উন্নত মানের করে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। আর বলাই বাহুল্য এর জন্য আমি কার্তিকদার কাছে চিরকৃতজ্ঞ ছিলাম, আছি এবং থাকবো। কার্তিকদা আমায় ‘ফিজিক্যাল এফিসিয়েন্সি টেস্ট’গুলোর প্রত্যেকটি ‘টেস্টের’ কৌশল নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ভালো ভাবে রপ্ত করিয়ে দিয়েছিলো। সিউড়িতে আমাদের বাড়ির কাছেই একটি ক্লাবঘর ছিল, যার সামনে একটি ছোট্ট ফাঁকা জায়গা ছিল, আর সেই ফাঁকা জায়গাটিতে ছিল হরাইজন্টাল বার, প্যারালাল বার, রিংস আর ব্যায়ামের আরো নানান রকমের সরঞ্জাম, যেগুলিতে আমি সকাল এবং বিকাল দুই বেলাই প্রাকটিস করতাম। কার্তিকদা এসে হাজির হতো ঠিক সময়মতো আর আমার ভুলত্রুটিগুলো যত্নসহকারে ধরিয়ে দিয়ে সেগুলোকে নিখুঁত করে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতো। দৌড়ের প্রাকটিসটা শুধু সকাল বেলায় করতাম এমনকি সেটাও করতাম আমি কার্তিকদার উপস্থিতিতেই অর্থাৎ কার্তিকদা আমার সাথে সাথে প্রতিদিন সকালবেলা চার থেকে পাঁচ কিলোমিটার করে দৌড়োতো। মাঝে মাঝে আমি ভাবতাম, কার্তিকদা দিন কুড়ি ছুটি নিয়ে এসেছিলো পুজো কাটাতে কিন্তু বেশিরভাগ সময় তো তার কাটতো আমার প্রস্তুতি নিয়েই। আমি প্রায়ই কার্তিকদাকে ব’লতাম যে আমার এই সবের জন্য তোমার পুজোর ছুটির আনন্দটাই মাটি হয়ে গেলো দেখছি। তার উত্তরে কার্তিকদা আমায় বলতো, “দ্যাখ শঙ্কু পুজো তো আমি বছর বছর পাবো কিন্তু তোর আর্মি জয়েন করার ব্যাপারে আমি যদি তোর এতটুকু কাজে লাগতে পারি তাহলে সেটাই হবে আমি আমার ছুটির সার্থকতা।” যতবার কার্তিকদা এটা আমায় বলতো ততবারই কথাটা আমার হৃদয় স্পর্শ করে যেত, কৃতজ্ঞতায় ন্যুব্জ হয়ে যেতাম আমি কার্তিকদার কাছে। আমার প্রস্তুতির প্রতি কার্তিকদার আন্তরিকতা এবং নিষ্ঠা দেখে মাঝে মাঝে আমি এমন বিভ্রান্তিতে পড়তাম যে আমার মনে হতো আমি আর্মিতে জয়েন করতে যাচ্ছি না কার্তিকদা যাচ্ছে আর্মি জয়েন করতে। এটাও কার্তিকদা আমায় বলত, “বরং এতে আমারই একটু স্বার্থ লুকিয়ে আছে।” আমি বলতাম, “তোমার স্বার্থ?” কার্তিকদা বলতো, “জানিস না? দ্যাখ, তুই আর্মি তে জয়েন করলে আমারই দল ভারী হবে, আর্মির একজন বন্ধু-কাম-ভাই পাবো আমি, আমাদের এলাকায় আমি ছাড়া আর্মিতে চাকরি করা তেমন তো কেউ নেই, তাই তোর ‘আর্মিতে জয়েনিং’টা হলে সেদিক থেকে আমিই লাভবান হবো।” কার্তিকদার মুখ থেকে এইরকম কথা শোনার পর আমি চুপ করে যেতাম, একটি কথাও সরত না আমার মুখ থেকে। এমনকি কার্তিকদা আমাকে এটাও বলেছিলো যে যদি ১০ নভেম্বরের আগে ওর ছুটিটা শেষ না হয়ে যেত তাহলে কার্তিকদা আমার কলকাতায় পরীক্ষা দেওয়ার সময় আমার সাথে থাকতো।
এইভাবেই বেশ চলছিল আমার প্রস্তুতির কাজ। আমার প্রস্তুতির দিনগুলোর মধ্যে থেকে একটি দিনের একটা ছোট্ট মজার ঘটনা আপনাদের বলি হয়তো ভালো লাগবে। কালীপুজোর কয়েকদিন পর প্রতিদিনের মত সেদিনও ভোরবেলা আমি দৌড়ের প্র্যাক্টিসের জন্য বেরিয়ে পড়েছিলাম, কার্তিকদাও আমার দৌড়ের অনুশীলনীতে যোগ দিয়েছিলো। এককথায়, আমি ও কার্তিকদা একসাথেই দৌড়চ্ছিলাম আর দৌড়তে দৌড়তে আমরা সিউড়ি থেকে একটু outskirt এর দিকে চলে গিয়েছিলাম যেমনটি আমরা প্রতিদিন করতাম। কিছুটা দূর গিয়ে সেখানে একটা বড়োমত পুকুর পড়ে, সেই পুকুরের কাছে পৌঁছে দেখি পুকুরের পাড়ে দুটো লোক নিজেদের মধ্যে খুব বচসা করছে। একে চারিদিকে কুয়াশা তার উপর আবার ভোরবেলা তাই সেই আলোয় দূর থেকে খুব একটা ভালো করে দেখা যাচ্ছিলো না যে লোকগুলো কে বা কারা। প্রচন্ড সাহস ছিল কার্তিকদার আর কৌতুহলটা ছিল তার থেকেও বেশি যার ফলস্বরূপ কার্তিকদা সোজাসুজি লোকদুটোর কাছে গেলো। কার্তিকদার সাথে সাথে আমিও ছিলাম। কাছে গিয়ে লোক দুটোকে চেনার চেষ্টা করলাম, কিন্তু বুঝতে পারলাম যে তাদেরকে না তো আমি চিনতাম আর না চিনতো কার্তিকদা। লোকদুটোর পড়নে ছিল পুরোনো ছেঁড়াফাটা টি-শার্ট, পাজামা আর পায়ে ছিল হাওয়াই চপ্পল। লোক দুটোই মাঝবয়সী আর গরিব বলেই মনে হচ্ছিলো। শরীরের গঠন দেখে বেশ শক্ত সামর্থ মালুম হচ্ছিলো। তাদের পায়ের কাছে রাখা ছিল দুটো মাঝারি সাইজের বস্তা যেগুলো জিনিসপত্রে ভর্তি। আমি একা থাকলে হয়তো পাশ কাটিয়ে চলে যেতাম কিন্তু কার্তিকদা থাকার জন্য ঘটনাটা একটু অন্যরকমই ঘটলো। কাছে যাওয়ার পর কার্তিকদা সরাসরি তাদেরকে জিজ্ঞেস করলো যে তারা কারা আর এই ভোরবেলায় তারা কি নিয়ে ঝগড়া করছে আর কেনই বা ঝগড়া করছে। আমাদের দুজনকে হঠাৎ দেখে ওরা একটু হকচকিয়ে গেলো। তারপর আমতা আমতা করে বললো তারা নিকটস্থ কোনো এক গ্রামের বাসিন্দা আর তারা অন্য কোনো শহরে কোথাও কাজ করে খায়। পুজোর পর তারা ছুটি নিয়ে ফিরছে আর ইঙ্গিতে সঙ্গের বস্তাগুলি কে দেখিয়ে বললো যে ওতে তাদের পরিবারের জন্য কাপড় চোপড় আর জিনিসপত্র নিয়ে ফিরছে। এই বলেই তারা দুজনেই বস্তাদুটো মাথায় তুলেই দৌড়ে পালাতে আরম্ভ করে। এতক্ষন পর্যন্ত ব্যাপারটা ঠিকঠাকই ছিল কিন্তু তাদের দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করতেই কার্তিকদার সন্দেহ হয় আর ঠিক তখনই কার্তিকদাও শুরু করে তাদের পিছনে ধাওয়া করতে। কার্তিকদার দেখাদেখি আমিও তাদের পিছনে ধাওয়া করি। পুকুরের পাড় থেকে নেমে রাস্তা ধরে দৌড়াতে শুরু করে ওরা, আর খুব জোরেও দৌড়াচ্ছিলো। ওরা দৌড়োচ্ছে আর আমাদের ওয়ার্ন করছে, বলছে আপনারা আমাদের পিছন করা ছেড়ে দেন, আমাদের কাছে চাকু আর ধারালো অস্ত্র আছে, আমাদের পিছনে আসলে আপনাদের উপর চাকু চালিয়ে দেব। এই কথা শুনে কার্তিকদার সাহস আর রাগ দুটোই বেড়ে যায় সেই সঙ্গে আমারও। ওরা তো আর জানেনা যে আমাদের একজন অলরেডি আর্মির একজন পোড় খাওয়া লোক আর একজন ‘উড বী আর্মি পার্সন’। দুজনের মাথায় দুটো বস্তা থাকায় খুব একটা স্পীডে দৌড়োতে পারছিলো না ওরা। কিছুটা দূর ধাওয়া করার পর কার্তিকদার নাগালের মধ্যে একটি লোক আসতেই হটাৎ কার্তিকদা ঝাঁপিয়ে পরে তার উপর, ধরে ফেলে তার গেঞ্জির কলার আর সেই সঙ্গেই আমায় আর একজনকে দেখিয়ে বলে, “শঙ্কু কুইক, ক্যাচ হিম, ডোন্ট লেট্ হিম গো”। আমিও কার্তিকদার ‘ওয়ার্ড অফ কম্যান্ড’ পাওয়ার সাথে সাথেই আর কার্তিকদার সাহসে বলীয়ান হয়ে আর একজন এর কোমরে জড়িয়ে ধরে ফেলি। সে যখন আমাকে ছাড়িয়ে পালাবার চেষ্টা করে তখন আমি তাকে জোরে ঝটকা মেরে মাটিতে ফেলে দিই। মাথায় তার বস্তা থাকার দরুন টাল সামলাতে না পেরে সে ধড়াম করে মাটিতে পড়ে যায় আর দূরে ছিটকে পড়ে মাথার ভারী বস্তাটা। পড়ে যাওয়ার পর আমি লোকটিকে উঠতে না দিয়ে ওকে চিৎ করে ওর বুকের উপর বসে পড়ি আর মারি লোকটার মুখে সজোরে দুটি ঘুষি, নাক ফেটে যায়, ঠোঁটের অনেকটা কেটে যায় আর সেই সঙ্গে বেরিয়ে আসে নাক মুখ দিয়ে রক্তের ধারা। লোকটার কলার ধরে ঝাঁকরে ঝাঁকরে বারংবার জিজ্ঞেস করি, পালাচ্ছিলি কেন বল। কানে আসে কার্তিকদার প্রসংশা সূচক মন্তব্য, ‘শঙ্কু ইউ হ্যাভ ডান এ গ্রেট জব’। বস্তাটা মাটিতে পড়ার সময় তার থেকে ভারী বাসনপত্রের আওয়াজ, যেমনটি ঠিক কাঁসা বা পিতলের বাসনে হয়, তেমনটি আওয়াজ হয়েছিল। “মেরে ফেল্লে গো, আমাকে মেরে ফেল্লে”, বলে আমি যাকে মাটিতে ফেলে চেপে ধরে রেখেছি সেই লোকটি তখনও আর্তনাদ করে চলেছে। একইভাবে অন্য লোকটির সাথে শুরু হয়ে গিয়েছিল কার্তিকদার চরম ধস্তাধস্তি। শেষপর্যন্ত কার্তিকদাও লোকটিকে জোরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এবং ফল একই হয়। তার মাথা থেকেও ভারী বস্তাটা দূরে ছিটকে পড়ে আর একইভাবে তার বস্তা থেকেও একইরকম ভারী বাসনপত্রের আওয়াজ হয়। কার্তিকদা তারপর তাকে মাটি থেকে উঠিয়ে লাগাতার কয়েটি ঘুষি মারে। ওই ঘুষিবৃষ্টিতে লোকটি আবার মাটিতে পড়ে যায় আর পড়ে গিয়েই নিজেকে কার্তিকদার হাত থেকে বাঁচাতে বলতে শুরু করে, বাবু আমাদের ছেড়ে দেন, আমরা খুব গরীব, জীবনে আমরা কখনো এই কাজ করব না, ইত্যাদি। তাতে কার্তিকদা আর আমার সন্দেহ আরো বেড়ে যায় এবং লোকদুটোকে আমরা জেরা করতে শুরু করি। ইতিমধ্যে দিনের আলো ভালোভাবে ফুটতে শুরু করেছে, সেইসঙ্গে শুরু হয়েছে লোকজনের আনাগোনা। এমনকি বেশ কিছু লোক জড়োও হয়ে যায়। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে লোকদুটো তাদের অপরাধ স্বীকার করে। আমাদের জেরার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে লোকদুটোর বাড়ি সিউড়ির পাশে খটঙ্গা নামের একটি গ্রামে আর তারা দুজনেই দাগী চোর। দারিদ্রতার বশবর্তী হয়ে তারা চুরি করেই তাদের এবং তাদের পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করে। তারা ওই রাতে চুরি করে সিউড়ির একটি কাঁসার বাসনের দোকানে এবং ভোর রাতে তারা চুরি করা মাল নিয়ে ওই পুকুরের পাড়ে সেগুলি ভাগ বাটোয়ারা ও করে ফেলে। কিন্তু ভাগ করার সময় চুরির মাল ভাগ করা নিয়ে বাধে তাদের মধ্যে তর্কাতর্কি যেটি একটি সিরিয়াস বাগবিতণ্ডার রূপ ধারণ করে। তাদের কথা অনুযায়ী এই বাগবিতণ্ডা নাকি মারপিটে পরিণত হতো যদি না আমরা সেই সময় সেখানে এসে পড়তাম। ততক্ষনে ঘটনাস্থলে অনেক ভিড় জমে গেছে আর সেই সঙ্গে জমে গেছে পুরো ব্যাপারটা। কার্তিকদা আর আমার সাহসিকতা দেখে আর বামাল সমেত চোর ধরতে সফল হওয়াতে উপস্থিত সকলেই আমাদের প্রসংশায় পঞ্চমুখ। ‘বাহঃ! বাহঃ!’ রব পড়ে গেছে চারিদিকে। কেউ আমাদের বলছে যে, তোমরা কতো বড় জীবনের ঝুঁকি নিয়েছো, যদিও ওরাও দুজন আর তোমরাও দুজন, কিন্তু ওরা চোর, ওদের কাছে ছুরি চাকু থাকতেও পারতো আর তোমরা ছিলে একেবারেই নিরস্ত্র, ওরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তোমাদের অনেক বড়ো ক্ষতি করে দিতে পারতো। ভিড়ের মধ্যে আবার কেউ বলছে এই চোর দুটোকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে, আবার কেউ তাদেরকে বেঁধে পেটানোর পরামর্শ দিচ্ছে। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে কিছু লোকতো তাদের আরো কয়েকটি চড় থাপ্পড় মেরেই দিলো। যাই হোক, এইসবের মধ্যে ঠিক হলো যে আর দেরী না করে ঘটনাস্থল থেকে কয়েকটি সাইকেল জোগাড় করে কয়েকজন মিলে চোরদুটোকে সাথে করে ওই বাসনের দোকানে যাওয়া হবে আর দোকানের মালিককে তার চুরি যাওয়া জিনিস পত্র গুলোসব ঠিক ঠিক আছে কিনা তা যাচাই করে ফেরত দেওয়া হবে, তারপর দোকানের মালিক যদি চায় তাহলে চোর দুটোকে ছেড়ে দেওয়া হবে নচেৎ তাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া নিশ্চিত। আমাদের তখনকার মতো দৌড়ের প্রাকটিস মাথায় উঠলো। তখন হিট অফ দা মোমেন্টে যদিও লোকদুটোকে আমি আর কার্তিকদা মিলে মারধোর করলাম বটে তবে পরে আমার কিন্তু খুব মায়া হচ্ছিলো লোকদুটোর উপরে। যাই হোক চোর দুটোকে ধরে দোকানের মালিকের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। ঘটনাস্থল থেকে যখন ওই বাসনের দোকানে আমরা সবাই পৌঁছলাম তখন সময় অনেকটাই পেরিয়ে গেছিলো। চোরদুটোই আমাদের দোকান চিনিয়ে নিয়ে গেলো, আসলে ‘মার্কেট এরিয়া’তে বেশ কয়েকটিই বাসনের দোকান ছিল, কিন্তু তাদের মধ্যে কোন দোকান থেকে চুরি করেছে সেটা তো চোর দুটোই জানতো তাই। দোকানে পৌঁছে দেখি সেখানে হুলস্থুল পড়ে গেছে আর বেশ কিছু লোক জড়ো হয়ে রয়েছে। পরে জানতে পারলাম যে সকাল বেলায় দোকানদার দোকান খুলতে গিয়ে দেখে যে দোকানের প্রধান দরজা অর্থাৎ কোলাপ্সিবল গেটটার তালাগুলো ভাঙা আর সেই দেখে তো তার আক্কেল গুড়ুম। তারপর দোকানে ঢুকে দেখে ক্যাশবাক্স খোলা আর বেশ কিছু জিনিস উধাও। কাশবাক্সে টাকা পয়সা কিছু না থাকার জন্য চোর কিছুই পায়নি তবে বাসন পত্র বেশ কিছু চুরি গেছে। দোকানদার হয়তো পুলিশে খবর দিতেই যাচ্ছিলো, ইতিমধ্যে আমরা সেখানে হাজির হই আর আমাদের সবাইকে ঐভাবে দেখে দোকানদারটা ও একটু থতমত খেয়ে যায়। দোকানদারকে সব খুলে বলার পর সে তো আক্ষরিক ভাবেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। তারপর একটু ধাতস্থ হওয়ায় তাকে বস্তাদুটো ফেরত দেওয়া হলো আর বলা হলো সে যেন ওই বস্তাগুলো থেকে চুরি যাওয়া জিনিসগুলো এক এক করে মিলিয়ে দেখে আর আমাদের ‘কন্ফার্ম’ করে, আর সেই সঙ্গে আমাদের এটাও যেন বলে যে চোর দুটোকে কি করা হবে। দোকানদার বাসনপত্র মিলিয়ে দেখে আমাদের বললো যে সব ঠিক ঠাক আছে। আরো যারা সঙ্গে ছিল তারা কার্তিকদা এবং আমাকে দেখিয়ে বললো যে এরাই চোর দুটোকে ধরেছে এবং কিভাবে ধরেছে সেটাও বলে। দোকানদার সব শুনে টুনে আর বিশেষ করে আমাদের অদম্য সাহসিকতার গল্প শুনে আমাদের উপর ভীষণ খুব খুশি হয় আর কার্তিকদা আর আমার জন্য জলখাবারের অর্ডার দিতে যায়। আমরা তৎক্ষণাৎ বাধা দিয়ে বলি ওসবের কোনো প্রয়োজন নেই। দোকানদারটা আমাদের বললো যে যদি সে ভবিষ্যতে যদি আমাদের কোনও কাজে লাগতে পারে তাহলে সে ভীষণ খুশি হবে। ও হ্যাঁ, বস্তা গলো থেকে বা ওদের কাছ থেকে কোনোরকম চাকু ছুরি না বের হলেও তালা ভাঙার কয়েকটি সরঞ্জাম তাদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয় যেগুলো দিয়ে ইচ্ছে করলে ওরা আমাদের আঘাত হানতেই পারত। চোরদুটোকে কি করা হবে সেটা দোকানদার কে আবার জিজ্ঞেস করলে দোকানদার বললো আপনারা তাদের ধরেছেন তাই আপনাদের যা ইচ্ছে তাই করুন। কার্তিকদা বললো, এদেরকে পুলিশে দেওয়াই উচিত নাহলে সুযোগ পেলেই এরা আবার চুরি করবে। চোর দুটোর করুণ অবস্থা দেখে আমার খুব মায়া হচ্ছিলো তাদের উপর, নাক মুখ থেকে ঝরে আসা রক্ত শুকিয়ে গেছে মুখমন্ডলেই, পরনের কাপড় ধুলোয় ধুলোময়। ঐসব দেখে আমার খুব কষ্ট হয়, কেননা ঐরকম অভিজ্ঞতা তার আগে আমার কখনো হয়নি। কার্তিকদা কে আমি বলি, জিনিসগুলো যখন সব ফেরত পাওয়া গেছে আর ওরা শাস্তিও যথেষ্ট পেয়েছে তখন ওদের ছেড়ে দেওয়াটাই ঠিক হবে। আমি বাসনের দোকানের মালিককে বললাম ভবিষ্যতে ঐধরণের কাজ আর না করার ওয়ার্নিং দিয়ে এদের ছেড়ে দেবেন, তবে তার আগে যে আপনি যে খাবারটা আমাদের জন্য আনাতে যাচ্ছিলেন, সেটা আনিয়ে এদের দুজনকে খাইয়ে দিন, কেননা সকাল থেকে বেচারাদের মার ছাড়া আর কিছুই খাওয়া হয়নি। শুনে কার্তিকদা আমায় টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বললো, “শঙ্কু জীবনে অনেক বড় হ তুই, ঈশ্বর তোকে অনেক আশীর্বাদ করুন।” চোখ ফেটে তখন আমার জল বেরিয়ে আসছে, অশ্রুসিক্ত চোখে আর ধরা ধরা গলায় কার্তিকদাকে শুধু আমি এইটুকুই বলতে পেরেছিলাম, কার্তিকদা আশীর্বাদ করো যেন আমি আর্মিতে জয়েন করতে পারি। কার্তিকদা স্নেহপূর্ণ হাতটা আমার পিঠে বোলাতে বোলাতে বলে, পাগল ছেলে, সব হবে – চিন্তা করিস না। এদিকে লোকদুটো সকরুণ চোখে কৃতজ্ঞতাভরা দৃষ্টি নিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আমার আর কার্তিকদার দিকে। হাত দুটোকে জোড় করে আশ্বাস দেয় আমাদের, বলে আপনাদের জন্য এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম, তবে কথা দিচ্ছি বাবু এ ভুল আর জীবনে করব না, খেটে খাবো কিন্তু চুরি আর কক্ষনো করব না। আমরা যে যার ঘরের দিকে রওনা দিই। যেতে যেতে কার্তিকদা বলে, সকালের প্রাকটিসটা তো পন্ড হলো, বিকালে কিন্তু দেখা হচ্ছে ক্লাব ঘরের মাঠে।
পুরো ঘটনাটা একদিকে যেমন আমার মনকে নাড়া দিয়েছিলো তেমনি আর একদিকে আমার আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিলো আর সেই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই সম্পন্ন করলাম প্রস্তুতির বাকি দিনগুলি। এরই মধ্যে কার্তিকদারও ছুটি শেষ হয়ে গেলো, ফিরে গেলো কার্তিকদা নিজের কর্মস্থলে। যাবার আগে দিয়ে গেলো আমায় আর্মিতে জয়েন করার অনেক অনেক শুভেচ্ছা। যেতে যেতে বলে গেলো, সুখবরের অপেক্ষায় রইলাম। কার্তিকদার চলে যাওয়ার পর আমার প্রস্তুতির বাকি দিনগুলি কার্তিকদাবিহীনই বলা চলে। ভারাক্রান্ত মন নিয়ে একা একাই করতাম সকাল বিকালের প্রাকটিস। একসময় এসে গেলো আমার কলকাতায় ফাইনাল রাউন্ডের পরীক্ষা দিতে যাবার দিন। ঠিক করলাম ৭ কিংবা ৮ নভেম্বরেই হাওড়া যাবো। কেননা দু এক দিন আগে সেখানে গেলে পরীক্ষার ভেন্যুটা মালদার মতো আগে থেকে দেখে নেওয়া হবে আর সেই সঙ্গে বড়মাসীর বাড়িতে থাকাটাও হবে দিন তিন চারেক। বাড়িতে পিসির বিয়ে পূর্ব নির্ধারিত তাই আমাকে ১২ ই নভেম্বরে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতেই হবে। সেই প্ল্যান মতো ৬ তারিখের রাত্রেই গুছিয়ে নিলাম সবকিছু যা যা পরীক্ষার সময় লাগবে আর ৭ নভেম্বর সকাল বেলায় ঠাকুরমা, বাবা, মাদের প্রণাম করে দুর্গা দুর্গা বলে সিউড়ি স্টেশন থেকে ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ধরে হাওড়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম…
ক্রমশঃ