চারখোলের চার রাত (দ্বিতীয় পর্ব)
অংশুমান সরকার
রাস্তার বর্ণনা আর দেব না। যারা পশ্চিম সিকিমে বা এদিকে রিস্যপে গেছেন তারা নিশ্চয়ই আন্দাজ করে নিতে পারবেন। তবে রাস্তার এতটা বেহাল অবস্থা বোধহয় আর কোথাও দেখিনি। আমাদের ড্রাইভার কাশিম এর মতে এই রাস্তা নাকি বিগত পনেরো বছরেও সারানো হয় নি। তবে প্রকৃতি সমস্ত অভাব পূর্ণ করে দিচ্ছিল তার অপরূপ ছটায়। একটা কথা বলা দরকার, এদিকে দুটো রাস্তায় আসা যায়। একটা সেবক সেতু ধরে (যেটা আমাদের করা সম্ভব হয়নি, কারন শিলিগুড়ির সাফারিটা অন্য দিকে পড়ে) আরেকটা হল বাগরাকোট হয়ে, অর্থাৎ যেদিক দিয়ে আমরা গেলাম। এই দ্বিতীয় রাস্তাটা অপেক্ষাকৃত ছোট, খারাপ এবং খাড়াই। তাই হঠাৎ করে altitude change হয়। আর যথারীতি এর কুফলগুলো প্রভাব ফেলতে থাকে। মানে, গা-বমি করা, মাথা ধরা, কান বন্ধ হয়ে যাওয়া – এই সব। আমরা তাই এর জন্য যথাযত precaution নিয়েই রেখেছিলাম। সারাক্ষণ সবার মুখে ছিল – চিউয়িং গাম। বারে বারে জল খাওয়া চলছিল ইত্যাদি। চারখোলে পৌঁছলাম প্রায় বিকাল ৫টা নাগাদ। অনেকক্ষণ ধরে সমানে চড়াই উঠতে উঠতে আন্দাজ করছিলাম যে – এত উপরে যখন উঠতে হচ্ছে তখন view টা নিশ্চয়ই ভালো হবে। কিন্তু ভাবতে পারিনি যে এমন মন ভরানো প্রায় 360° Panaromic view দেখতে পাব। তখন সূর্যাস্ত হতে চলেছে, গাড়ি থেকে নেমেই হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, বিশাল পাহাড়ের সারি, শিরশির করে হাওয়া দিচ্ছে, তার মধ্যে চোখের সামনে দেখছি কাঞ্চঞ্জঙ্ঘার চুড়োয় সূর্যের শেষ আলো পড়ছে। সব মিলিয়ে অপার্থিব একটা পরিবেশ। বিপ্লব কানের কাছে ফিসফিস করে বলল – ‘It’s a perfect twilight…’
রিসোর্টের ম্যানেজার বিকাশবাবুর সঙ্গে ফোনে আগেই আলাপ হয়েছিল। আমরা শিলিগুড়িতে থাকতেই ভদ্রলোক ফোন করে রাতের খাবারের অর্ডার নিয়ে নিয়েছিলেন। ভদ্রলোক আমাদের হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন, সেই সঙ্গে এও জানালেন যে উনি আলিপুরদুয়ারের লোক, এখানে একা আছেন টানা গত ছ’মাস। তাই বাঙালি দেখলেই ওনার খুব আনন্দ হয়। বোধহয় আরও একটু আলাপ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমাদের তখন মন টানছে রিসোর্টের উপরে উঠে চারিদিকটা একবার ভালো করে দেখতে। আমরা নিয়েছিলাম চারটে কটেজ। পাহাড়ের ঢালে ঢালে কটেজগুলো সাজানো। ডাইনিং হলের ছাতের উপর উঠে তবে কটেজগুলোয় যেতে হয়। কোন রকমে মালপত্র ঘরে ফেলে, সেই ছাত থেকে অবাক বিস্ময়ে আমরা চোখ ভরে নিতে লাগলাম পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা সূর্যের শেষ আলো।
এই বার আসল মজার কথাটা বলি – এখানে ফোনের কোনও নেটওয়ার্ক কাজ করে না। একেবারেই যে করে না ঠিক তা নয়। কিন্তু গোটা এলাকায় কখন কোনখানে আপনি নেটওয়ার্ক পাবেন তা এক রহস্য। হাতে মোবাইল নিয়ে চলতে চলতে দেখবেন – এই আছে, এই নেই। আমরা একটা উঁচুমত ভিউ পয়েন্ট খুঁজে পেয়েছিলাম, যেখান থেকে মোটামুটি পাওয়া যায়। রাতে দু-দুটো কম্বল নিয়েও ঠাণ্ডায় কাঁপা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার ছিল না। পাহাড়ি জায়গায় সাধারণত প্রথম দিনটা ঠাণ্ডা একটু বেশিই লাগে, তারপর দিন থেকে সয়ে যায়। তবে কটেজের ঘরগুলো বেশ গরম, সেটা হয়ত সারাদিন রোদ্দুর লাগে বলে। যাই হোক – পরদিন একটু ভোরে উঠবো বলে ঠিক করে রেখেছিলাম, ইচ্ছা ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যোদয় দেখব। হিসাব মত সাড়ে পাঁচটা নাগাদ অ্যালার্ম দিয়েও রেখেছিলাম, কিন্তু একে সারাদিনের ক্লান্তি আর তারসঙ্গে সেই রকম ঠাণ্ডা। তাই কখন অ্যালার্ম বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়েছি তা বুঝতেই পারিনি। পারমিতার ডাকে ধড়মড় করে উঠে মোবাইলে দেখি ছ’টা বাজে। তাড়াহুড়ো করে কাঁচের জানলার পর্দা সরিয়ে যা দেখতে পেলাম তা ভাষায় বর্ণনা করা আমার কর্ম নয়। এটুকু বলতে পারি – আমি টাইগার হিল থেকে, আরিতার থেকে, কালুক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘায় সূর্যের প্রথম আলো পড়তে দেখেছি। কিন্তু জানি না কেন মনে হল – এত সুন্দর বোধহয় কোথাও দেখিনি। ততক্ষণে আমার মেয়ে রাই ঘর থেকে বেরিয়ে হইচই ফেলে বাকি সকলের ঘুম ছুটিয়ে দিয়েছে। আর আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে রয়েছি সেই মিনিটে মিনিটে পরিবর্তনশীল সেই আলোর খেলার দিকে।
সেই দিনটা কোথাও যাবার ছিল না, তাই তাড়া নেই। প্রদীপ আমার মতই ভোরে ওঠে, একটু কফি পাওয়া যাবে কি না খোঁজ করতে তলায় নেমে দেখি রিসোর্ট প্রায় খালি। রান্নাঘরে যে ছেলেটি রান্না করে তার নাম আমীর। সদাহাস্যময় তরুণটি কে জিজ্ঞেস করলাম যে আমরা তার রান্নাঘর একটু ব্যবহার করতে পারি কি না? একগাল হেসে বলল – ‘জি সাব, লেকিন হাম কো কেয়া করনা পড়েগা?’ ব্যস, আর আমাদের পায় কে? মুহূর্তের মধ্যে রান্নাঘর আমাদের দখলে, নিমেষের মধ্যে – কফি, ম্যাগি, ডিমসেদ্ধ দুধ-কর্ণফ্লেক্স রেডি। এখানে একটা কথা বলা দরকার, এখানে খাবারের দাম খুব বিরাট কিছু বেশি নয়। মোটামুটি পাহাড়ে যেমন হয় প্রায় তেমনই। আর পরিমাণটাও বেশ ভালই। আগেই খবর নিয়েছিলাম যে আমাদের রিসোর্টের পাশেই আরেকটা হোটেল আছে – Blue Pine Retreat। সেটার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা, যেখানে দোলনা ইত্যাদি আছে। ব্রেকফাস্ট সেরে, খুদে গুলোকে নিয়ে চলে গেলাম সেখানে। বেশ খানিকটা ছেলেমানুষি বাঁদরামি করার পর মনে পড়ল যে আগামীকাল লাভা-লোলেগাঁও যেতে গেলে গাড়ির ব্যবস্থা করা দরকার। কারন, এখানে সিন্ডিকেট এর গাড়ি ছাড়া চলে না। এদের রেট ফিক্সড থাকে তাই ঠকবার ভয় নেই। অবশ্য কেউ যদি পুরো ট্যুরের জন্য গাড়ি একটানা রেখে দেন তার কথা আলাদা। যাই হোক, বিকাশ বাবু এখানের সিন্ডিকেটে ফোন করে আমাদের গাড়ি বুক করে দিলেন পরের দিন লাভা-লোলেগাঁও যাবার জন্য। গাড়ি পিছু রেট ৩২০০/- টাকা। সকাল ন’টার সময় আসবে গাড়ি।
রোদপিঠ করে আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় বিকাশবাবু এসে বললেন – আজ তো আপনাদের কোনও প্রোগ্রাম নেই, তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে যান না – ওই দিকের পথটায়। একটা ছোট গ্রাম আছে, একটু দূরে একটা টাওয়ার আছে। রাস্তাটা খুব সুন্দর। এমনিতেই আমরা যেখানে যাই সেই জায়গাটা পায়ে হেঁটে চষে না ফেলে শান্তি পাই না। সুতরাং এই প্রস্তাবে রাজি না হবার কোনও কারন ছিল না। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে পড়লাম Trekking এ। রিসোর্টের একজন, নাম চান্দা আমাদের সঙ্গে চলল গাইড হয়ে। আমি, বিপ্লব একটু গুইগাই করছিলাম – ‘সবে খেয়ে উঠলাম, এতটা হাঁটা’। প্রসেনজিত আবার এই সব বিষয়ে খুব উৎসাহী। বলল – এমন virgin nature ও নাকি আর কোথাও দেখেনি। তাই একে যতটা সম্ভব উপভোগ করে নিতে হবে। হাঁটা শুরু হতেই প্রান বেরিয়ে যাবার উপক্রম – শুরুটাই বেশ খাড়াই পথ। অবশ্য পথ না বলাই ভাল। পাহাড়ের গায়ে পাশাপাশি দু-তিন জন হাঁটতে পারে এমন একটা রাস্তা। রাস্তা যত এগোতে লাগলো ততই তার অসাধারণ রূপ সামনে আসতে লাগল। চান্দাদিদি দূরে পাহাড়ের গায়ে কয়েকটা বাড়ি দেখিয়ে বললেন – ‘উস গাঁও মে জায়েঙ্গে সাব’। শুনে তো আমি হতবাক ! বলে কি? ওই অত দূরে? আরও হতভম্ব হয়ে গেলাম পারমিতা, লতা, রিম্পা আর সেই সঙ্গে খুদেগুলোর আনন্দ দেখে – ‘হ্যাঁ, যাব তো। কি মজা! কতদূর যাব!’ ইত্যাদি ইত্যাদি…
যারা চারখোলে যাবেন, তাদের বলছি – আর যাই করুন না কেন, এই Trek টা করবেন। আর প্রান ভরে শ্বাস নেবেন, দেখবেন প্রকৃতির একটা নিজস্ব গন্ধ আছে, যেটা আমরা সচরাচর পাই না। পাহাড়ি গ্রামটায় গেলাম, দেখলাম সেখানে তারা সেখানে আখের গাছ করেছে, কৃত্রিম উপায়ে মৌচাক বানিয়ে মধু উৎপাদন করছে, পাহাড়ি ছাগলের লড়াই দেখলাম, আরও কত কি। প্রদীপ আর আমার গিন্নি দেখলাম আলাপ জমিয়ে তাদের থেকে বেশ কিছু আখ জোগাড় করেছে। খেয়ে দেখলাম – বেশ মিষ্টি।
ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমাদের এই ‘চারখোলে রিসোর্টে’ বাচ্চাদের জন্য একটা খুব সুন্দর মিনি লাইব্রেরী আছে, রিসেপশান এ। সেখানে দেখলাম ইশপের গল্প, টিনটিন, ক্ষীরের পুতুল আর ছোটা ভীমের সাথে সাথে, রবিনহুড আর রাস্কিন বন্ড ও আছে। সেখানে আমাদের দলের পুঁচকে গুলো অনেকটা সময় কাটাত। আর আছে একটা বেশ বড় ১০ বিছানার ডরমিটরি, যেখানে আমাদের আড্ডা চলত রোজ রাত এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত।
(ক্রমশ)