বিকল্পে নির্বিকল্প ডাক্তার

শংকর কুমার নাথ
বাজারে সব কিছুর দাম বেড়ে চলেছে, সে রান্নার গ্যাস, পেট্রোল, ডিজেল থেকে খাবার দাবার, শাক-সবজি থেকে একটি সেফটিপিন পর্যন্ত। মানুষ বিকল্প পথ খুঁজছে – – না খেয়ে থাকা যায় কিনা, বা জল খেয়ে বাঁচা যায় কিনা – – আরে বাবা জলই তো জীবন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেই জলও নাকি এরপর অমিল হলো বলে – – যেভাবে জলের অপচয় হচ্ছে, জলস্তর হু হু করে নেমে যাচ্ছে, তাতে জলেরও বিকল্প খুঁজতে হবে। কিন্তু শ্বাস নেবার জন্য বাতাস – – সেটা না হলে তো এক মিনিটও চলে না, মৃত্যু অনিবার্য। ভাগ্যিস তাতে প্রাণদায়ী অক্সিজেন রয়েছে। প্রকৃতি সম্পূর্ণ ফ্রি-তে দিয়েছে বলে তার দাম কোন সরকার বাড়াতে পারেনি। এখন যদি সেই ফ্রী-তে পাওয়া অক্সিজেনও আপনার শরীর কোন কারণে গ্রহণ করতে না পারে (যেমনটা কোভিড-১৯ এর কিছু সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে ঘটছে এখন), তাহলে তার বিকল্প ব্যবস্থা, ঐ যে ভেন্টিলেটর, সেখানে আপনার স্থান হচ্ছে, এখানে কিন্তু ঐ অক্সিজেন আর ফ্রী-তে পাবেন না। এখন মূল্য দিতে হবে। আর এমন মূল্য দিতে হবে যে, আপনার বাড়ি – ঘর, ঘটি – বাটি, সবই বিক্রি হয়ে যেতে পারে। ফলে, এই পোড়া দেশে গরীব গুর্বো মানুষগুলো সে-সব অ্যফোর্ড করতে পারে না বলে, তাদের কাছে জীবনের বিকল্প হয়ে ওঠে মৃত্যু।
এদেশের হত দরিদ্র মানুষগুলোর যখন ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ অবস্থা, তখন আধুনিক চিকিৎসা তাদের কাছেই অনেক সময়েই বিলাসিতার পর্যায়ে। তাই তারা ছোটেন বিকল্প চিকিৎসার দ্বারে – – ঐ জরি-বুটি, জ্যোতিষী, মায়ের থানে ‘চন্নামৃত’ (চরণ + অমৃত) খেয়ে রোগ থেকে উদ্ধার পেতে। এখনও দেশের একটা বড় শতাংশের ভবিতব্য এই বিকল্প চিকিৎসা। বাল্যকালে দেখেছি, খেলতে গিয়ে কেটে গেল, রক্তপাত হচ্ছে, কোথায় আধুনিক চিকিৎসা নেওয়ার সময়, পানের দোকান থেকে টুক করে খানিকটা চুন নিয়ে ক্ষতস্থানে লেপটে দেওয়া – – এই বিকল্প চিকিৎসার কিন্তু কোনো জবাব ছিল না, বা হাত পায়ের হাড় ভেঙে গেলে গাছের ডাল ভেঙে কাপড় দিয়ে বেঁধে প্রাথমিক চিকিৎসা তো এখনও প্লাস্টারের বিকল্প প্রত্যন্ত গ্রামে। আসলে মানুষ ইনোভেটিভ। উপকার হচ্ছে এমন কোন ব্যবস্থা দেখলেই, তা যাতে সস্তায় মেলে তার বিকল্প খুঁজে চলে। তাই মানুষই রোবট বানিয়ে ফেলে, সেটাকে দিয়ে মানুষেরই বিকল্প হিসেবে কাজ করিয়ে নেয়।
আবার দেখুন চিকিৎসা বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে – – যারা ডাক্তারি পড়ছেন, শবদেহ ব্যবচ্ছেদ না করে তারা কোন মতেই ডাক্তার হতে পারে না – – সারা বিশ্বেই এটি প্রযোজ্য। এই কারণেই মনুষ্য মৃতদেহর প্রয়োজন প্রতিটি মেডিকেল কলেজে। শবদেহ পেতে খুব একটা অসুবিধা ছিল না। কিন্তু যত দিন এগিয়েছে, এ – বিষয়ে নিয়মকানুন, আইন ইত্যাদি চেপে বসেছে, ফলে শবদেহ পাওয়া দুস্কর হয়ে উঠেছে দিন দিন। তাই নির্ভর করতে হচ্ছে কে কোথায় বডি দান করেছেন তার উপর। এদিকে বডিরও বাড়ন্ত হচ্ছে। ফলে মানুষ ঠিক বিকল্প ব্যবস্থা বার করে ফেলেছে, বানিয়ে ফেলেছে কৃত্রিম ভাবে মানুষের মরা – – একেবারে প্রায় নিখুঁত। আর তাই দিয়েই চলছে এ্যানাটমী শিক্ষা, সার্জারির অনুশীলন।
কি সব দিনকাল পরলো। আপনাদের মনে থাকবে, বেশ কয়েক বছর আগে একের পর এক বিকল্প চিকিৎসক ওরফে ভুয়া চিকিৎসক ধরা পড়ছিল, কোন ডাক্তারি ডিগ্রী নেই, মানুষের চিকিৎসা করে চলেছে – – এটা একটা ছোঁয়াচে রোগের মত হয়ে গেছে। একজন ধরা পড়লো, তো পর পর ধরা পড়েই চলেছে। খবরে দেখছি কখনও ভুয়ো ইঞ্জিনিয়ার, কখনো ভুয়ো আই-এ-এস অফিসার, আবার কখনও ভুয়ো সরকারি আধিকারিক, মায় ভুয়ো পুলিশ অফিসার পর্যন্ত একের পর এক ধরা পড়ছে, জেলে যাচ্ছে। কি ভয়ঙ্কর! আসলে মানুষ এখন অরিজিনাল এর চেয়ে বিকল্পকেই পছন্দ করছে বেশি। কৌতুকাবহ খবরটি হলো , ভুয়ো চিকিৎসক গ্রেফতার করার ব্যবস্থাটি যদি একশো – দেড়শ বছর আগে বলবৎ হতো, তাহলে নির্ঘাৎ বিদ্যাসাগর মশাই, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, এমনকি দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এর পিতা), বা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীদের মত প্রখ্যাত মানুষদের নিশ্চিত জেলে ঢুকতে হতো। দুর্গাচরণ বা বিজয়কৃষ্ণ এরা তো তবু মেডিক্যাল কলেজে ফাইনাল ইয়ার পর্যন্ত পড়েছেন, চূড়ান্ত বা ফাইনাল পরীক্ষাটি শুধু দেননি। তা-ও চেম্বার করে চিকিৎসা করে গেছেন। আর বাকিরা অর্থাৎ বিদ্যাসাগর মশাই, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখরা শুধুমাত্র ডাক্তারি বই পড়ে চিকিৎসা করে গেছেন মানুষের। বলতে দ্বিধা নেই ওরা বিকল্প চিকিৎসক হয়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যে সেবা- পরিষেবা দিয়ে গেছেন সে যুগে, তা এককথায় ইউনিক।
বাস্তবিক, মানুষ সবই পারে, মূল থেকে বিকল্পে। বিকল্প থেকে মূলে যেতে, কখনও ফেলিওর। তবে নির্বিকল্পের যেদিন বিকল্প নির্মিত হবে অথবা ভাইস ভার্সা, তখন নিশ্চিত, তা বাস্তব জগত ছেড়ে ছেড়ে কল্পলোকে নির্বাসিত হবে, যা আমরা হয়তো কল্পনাও করতে পারবো না।