August 21, 2025

বিকল্প  যখন কল্পকে ছাড়ায়

সুজয় বাগচি

বিকল্প কথাটা কেমন আপেক্ষিক। আমরা সবেরই বিকল্প খুঁজি। কখনো পাই কখনো হারাই। তবুও আমরা খুঁজতে থাকি। জীবন চলমান, আদি অনন্ত কাল থেকে বৈতরণীর মতো বয়ে চলেছে কখনো  সোজা পথে কখনো বা বিকল্প বন্ধুর পথে। আগেই বললাম বিকল্প আপেক্ষিক তবে বিকল্প মাঝেমাঝে আসলকেও ছাড়িয়ে যায়। বিনোদনের জগতে এমন ঘটনা আকছার ঘটে থাকে। একজন অভিনেতাকে নিয়ে ছবি শুরু হল, কিন্তু ছবি শেষ হল না, মাঝ পথে থেমে গেল। ছবি শেষ করতে তখন বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হয়। অভিনেতা বদলালো, ছবি শেষ হল, এমন ঘটনা কত ঘটেছে। শুধু অভিনেতা কেন, পরিচালক, সঙ্গীতপরিচালক থেকে শুরু করে প্রডিউসার পর্যন্ত বদলে যেতে পারে, তাঁর বা তাঁদের বিকল্পদের নিয়ে ছবি শেষ হয়েছে,  এমন ঘটনাও খুব কম নেই। কিন্তু বিকল্প আসলকে ছাপিয়ে গেছে, কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে এমন খুব একটা দেখা যায় না। এমনই এক বিকল্পের কিংবদন্তী হয়ে ওঠার ঘটনা বলি

 

সত্তর দশকের গোড়ার দিকে সিকিমের এক বৌদ্ধ পরিবারের তরুণ যিনি নৈনিতাল থেকে স্কুলের পড়া শেষ করে দার্জিলিংয়ে আসেন কলেজ করতে। স্বপ্ন দেখতেন সেনাবাহিনীতে যোগদান করবেন। এই স্বপ্ন সফল করার পথে তিনি এক ধাপ এগিয়ে গেলেন যখন পশ্চিম বঙ্গ সরকার প্রদত্ত Best Cadet award পেলেন।  একসময় সুযোগ এলো পুনায় Armed Forces Medical Collage-এ ভর্তি হওয়ার। কিন্তু কি হ’ল তিনি বিকল্প পথ ধরলেন। পুনাতেই Flim and Television institutute of India-এ ভর্তি হলেন। এখানে প্রচুর বন্ধু পেলেন যারা পরবর্তী সময়ে সিনেমা জগতে প্রচুর নাম করেছেন। অতঃপর চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। B.R. Ishara-র “জুরুরত” তার প্রথম ছবি। ১৯৭১ সালে তৈরি তবে মুক্তিপায় ১৯৭২ সালে। সবচেয়ে বড় সুযোগ আসে সেই বছরই গুলজার সাহেবের “মেরে আপনে” থেকে। তারপর আর  পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ডাক পেলেন ‘সিপ্পী ফিল্মস’ থেকে তাদের বিগ বাজেটের ছবির লিড রোলের জন্য। এর আগে ‘সিপ্পী ফিল্মস’-এর বহু ছবি সুপার ডুপার হিট হয়েছে। ‘সিপ্পী ফিল্মস’-এর নতুন ছবির পরিচালনা করবেন রমেশ সিপ্পী,  যার আগের দুটি ছবি ‘সীতা আউর গীতা’(১৯৭২) ও আন্দাজ (১৯৭১) Block Buster হয়েছে। এই নতুন ছবির গল্প ও চিত্রনাট্য সেলিম-জাভেদ জুটির। ছবিতে সুর দিচ্ছেন রাহুল দেববর্মণ।

কিন্তু সেই সিকিমের ছেলেটি রাজি হলেন না। শোনা যায় জয়া ভাদুড়িও তাকে অনুরোধ  জানান কিন্তু তিনি রাজি হননি। আসলে তিনি মানে “ড্যানী”  তার আগেই কথা দিয়ে ছিলেন ফিরোজ খানকে তাঁর নতুন ছবি ‘ধর্মাত্মা’-র জন্য এবং ফিরোজ খান তাঁর ছবির লোকেশান রেখেছেন আফগানিস্তানে। শুটিঙের জন্য সব বুক করে ফেলে ছিলেন। “ড্যানী”   তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন — “আমি বুঝতে পেরেছিলাম ‘শোলে’ আমার জীবনের মাইল ফলক হবে, কিন্তু আমার কাছে কথার দামটা অনেক বেশি মূল্যবান।”

 

রমেশ সিপ্পী তার ছবির লোকেশান ঠিক করছেন কর্ণাটকে। সেখানে ‘রামগড়’ নামে  একটা বড় গ্রাম বানিয়েছেন কিন্তু ভিলেন কোথায়? “শোলে” ছবির পুরো ‘ইউনিট’ ড্যানীর বিকল্প খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে উঠল ……

 

ওরা একটু খুঁজতে থাকুক ততক্ষণ আমি ড্যানীর বিকল্পের পূর্ব পরিচয়টা দিয়ে দি –

 

জাকারিয়া খানের দুই ছেলে। নিজে প্রচুর ছবি দিলীপ কুমারের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। সুন্দর দেখতে লম্বা ফর্সা, সারা ভারত তাঁকে “জয়ন্ত” (পাশের ছবিতে) নামেই চেনে।তাঁর বিশেষ কয়েকটি ছবি হল “অমর”,”মেমদিদি” এবং “নাজনিন”। এই “নাজনিন” ছবিতে তাঁর এগারো বছরের ছেলে কে সুযোগ দেন। নাজনিন হিটও হয়। এটা ছিল ১৯৫১ সাল, ১৯৫৭ সালের আবার সুযোগ পান “অব দিল্লি দূর নেহি”। এরপর কে আসিফের সহযোগি হিসাবে যুক্ত হন এবং “লাভ & গড” ছবিতে একটি বড় রোল পান। ছবি বন্ধ হয় এবং কে আসিফ মারা যান। আবার সুযোগ পান ১৯৭৩ সালে খুব ছোট্ট রোলে, ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে চেতন আনন্দের “হিন্দুস্থান কী কসম” ছবিতে। সহ অভিনেতা হিসাবে পান চেতন আনন্দ, বিজয় আনন্দ, রাজ কুমার, বলরাজ সাহানির মতো অভিনেতাদের। ছবি হিট হয় এবং মদন মোহন এর সুরে একটি গান কালজয়ী হয়। তবে “জয়ন্ত”-এর বড় ছেলের খোঁজ কেউ রাখেননি।

 

এবার আসল কথায় ফিরি….

সিপ্পী হাউজ হন্যে হয়ে খুঁজছে  তাদের নতুন ছবির ভিলেনকে।সেলিম খান, মানে  সলমান খানের বাবা, যিনি এই ছবির সহ-লেখক ও সহ-চিত্রনাট্যকার তিনি ‘হিন্দুস্থান কি কসম’ দেখে মার্ক করলেন সেই ছেলেটিকে। রমেশ সিপ্পীকে বলে একটু সময় চাইলেন। সেলিম খান নিজে যোগাযোগ করলেন, পুরো ঘটনা বললেন এবং উদ্যোগ নিলেন কিভাবে তাকে এই চরিত্রে ফিট করা যায় । নিজেদের আঁকা চরিত্র ক্যানভাসে ফোটাতে চাইলেন ।পড়তে দিলেন তরুণ ভাদুড়ি মানে জয়া ভাদুড়ির বাবার লেখা চম্বলের ডাকাতদের নিয়ে লেখা “অভিশপ্ত চম্বল” বইটি। সাতদিন পর রমেশ সিপ্পী ড্যানী-র বিকল্প ভিলেনএর সঙ্গে মিট করলেন ও মুগ্ধ হলেন। কর্নাটক যাবার আগে ভরা হাউসে সকালের সামনে সেই বিকল্প অভিনেতা বলতে হল সেই ডায়লগ সঙ্গে নিজস্ব ম্যানারিজম “সো যা নেহি তো গব্বর আ জায়ে গা”। আসমুদ্র হিমালয় পাগল হয়ে গেল গব্বর সিং ওরফে আমজাদ খানের উপর। “শোলে” হিন্দী ছবির ইতিহাস সৃষ্টি করল। আর আমজাদ খান (নীচের ছবিতে) নিজের প্রচেষ্টায় খ্যাতির উর্দ্ধ সীমায় পৌঁছে গেলেন।

 

 

ড্যানীর ধর্মাত্মা মুক্তি পেলে সাফল্য পেল তবে শোলের তুলানায় খুবই কম।

ড্যানী শোলের আগে একই রকম গল্প নিয়ে ফিরোজ খানের “খোট্টে সিক্কে” ছবিতে অভিনয় করেন, তবে ভিলেন নয়। আবার শোলের অনেক বছর পরে “আঁধী তুফান” (আধুনিক শোলে) ছবিতে  অভিনয় করার জন্য ডাক পান। আর সুযোগ ছাড়েননি। ধর্মেন্দ্রের পরিবর্তে মিঠুন চক্রবর্তী, অমিতাভ বচ্চনের পরিবর্তে শত্রুঘ্ন সিন্হা, ঘোড়ার পরিবর্তে বাইক আর আমজাদ খানের পরিবর্তে ড্যানী।

 

হায় রে ভাগ্য ছবিটি চলে নি। তবে এটা অনস্বীকার্য ড্যানীর জন্যেই আমজাদ খান শোলের গব্বর সিং হতে পেরে ছিলেন। ড্যানী নিজেও একটা নজির বিহীন ঘটনা ঘটালেন এবং প্রমাণ করলেন তার কাছে কথার দাম আগে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *