বিকল্প বিনোদন – OTT

পারমিতা সরকার
বিকল্প বলতে আমরা সেটাই বুঝি যা কিনা সচরাচর বা সাধারণত করা কাজ বা বিষয় বা পদ্ধতি থেকে আলাদা কিছু। যখন সাধারণ বা গড়পড়তা পদ্ধতি ব্যর্থ হয় কিংবা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে, তখনই প্রয়োজন হয় তার বিকল্প ব্যবস্থার। তাই বলা যেতে পারে যে প্রয়োজন এবং সেইসঙ্গে সাধারণ পদ্ধতির অভাব জন্ম দেয় বিকল্প ব্যবস্থার। ঠিক এইরকমই এক বিকল্প ব্যবস্থা বা বিকল্প পদ্ধতি হল OTT। এই কথার অর্থ হলো over the top, অর্থাৎ কোনো কিছু যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয়, তখন তাকে বলা যেতে পারে এক কথায় OTT। এই পদ্ধতিটি কিন্তু ভারি মজাদার। এখানে চোরে কামারে সাক্ষাৎ হয় না কিন্তু সিঁদকাঠি হস্তান্তর হয়ে যায়। মানে সমস্ত রকম কেবেল অপারেটর, ব্রডকাস্ট এবং স্যাটেলাইট ট্রান্সমিশনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে OTT পৌঁছে যায় সরাসরি দর্শকের নাগালে। প্রাথমিকভাবে এর নাম ছিল subscription-based video-on-demand (SVoD), পরে তার নতুন নাম হয় OTT। 2011 সালে কানাডাতে প্রথম আত্মপ্রকাশ করে OTT, Canadian Radio-Television and Telecommunications Commission (CRTC) প্রথম স্বীকৃতি দেয় একে।
এবার আসি OTT নিয়ে কিছু আলোচনায়। এখানে লাইভ স্ট্রিমিং শব্দটা খুব জনপ্রিয়। এতে দর্শক পছন্দের অনুষ্ঠান সরাসরি দেখতে পারে সম্প্রচার হওয়ার সময়ই। কিন্তু এতে আর নতুনত্ব কোথায়। সবক্ষেত্রেই তো অনুষ্ঠান সম্প্রচারের সময়ই তা দেখা যায়। আসলে নতুনত্ব হলো সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানটি ইন্টারনেটে পরবর্তীকালেও থেকে যায়, যা কিনা দর্শক তার ইচ্ছামত যতবার খুশি দেখতে পারে। কিছু OTT service যেমন iTunes স্ট্রিমিং শেষ হওয়ার আগে পর্যন্ত তা দেখতে দেয় না, আবার বেশ কিছু OTT যেমন Netflix, Hulu, Disney+ বা Amazon Prime স্ট্রিমিং চলাকালীন তা দেখতে দেয়। এবার বলি OTT র নাগাল দর্শক কিভাবে পেতে পারে। ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায় এরকম যেকোনো ডিভাইস থেকে OTT অ্যাক্সেস করা যায়। অ্যান্ড্রয়েড অথবা iOS, যেকোনো স্মার্ট টিভি, স্মার্ট সেট টপ বক্স, যেকোনো গেমিং কনসোল অথবা যেকোনো ধরনের কম্পিউটার যাতে কিনা ইন্টারনেট সংযোগ আছে তার সবেতেই OTT চলবে।
এবার আসি সেই কথায় অর্থাৎ এটিকে বিকল্প বলছি কেন। বিনোদনের প্রাথমিক অডিও ভিজুয়াল মাধ্যম ছিল চিরাচরিত সেই চলচ্চিত্র। যা কিনা এক সময় সিনেমা হলগুলোর মাধ্যমে আপামর জনসাধারণকে আনন্দ দিয়েছে। ক্রমশ মানুষের ব্যস্ততা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার ফলে বিনোদন চলে এলো আমাদের ঘরের ভিতর। সেও ছিল এক রকমের বিকল্প। টেলিভিশনের রূপ নিয়ে, সপ্তাহান্তে সিনেমা প্রদর্শনী অথবা মাঠে না গিয়েও পছন্দের খেলা দেখা, দীর্ঘদিন ধরে মানুষের হাতের মুঠোয় বিনোদনকে এনে দিয়েছিল। এর ফলে ধীরে ধীরে রুগ্ন হতে থাকে সিনেমা হল গুলি। এরপর নব্বইয়ের দশকে আত্মপ্রকাশ করে কেব্ল টেলিভিশন, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। একসঙ্গে অজস্র চ্যানেল, বিবিধ অনুষ্ঠান, খেলা, গান, সেই সঙ্গে নতুন নতুন সিনেমা। দিশেহারা হয়ে যায় দর্শককূল। ওদিকে কফিনে শেষ পেরেক পড়ে সিনেমা হলগুলোর। কিন্তু তাতেও মন ভরে না দর্শকদের। বিনোদন হতে হবে আরো ব্যক্তিগত। একসঙ্গে সবাই মিলে বিনোদনের পরিবর্তে চাহিদা বাড়ে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ব্যক্তিগত বিনোদনের। সেই সময় ক্রমশ সহজলভ্য হতে থাকছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। আর কি, তাকেই ব্যবহার করে গড়ে ওঠে এই নতুন বিকল্প পদ্ধতি। সিনেমা বদলে যায় ছোট ছোট অনেক পর্বে নতুন আকারে বানানো ওয়েব সিরিজে। অনেকটা টিভি সিরিয়ালের আদলে। যদিও স্পনসর দের আনুকূল্যে তৈরি হওয়ার ফলে চেহারায় ও গুণমানে পিছনে ফেলে দেবে যেকোনো আধুনিক সিনেমাকেও। OTT প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে এই ধরনের ওয়েব সিরিজ গুলির প্রধান মাধ্যম। ঠিক যখন এই নতুন মাধ্যমটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, সেই সময় শুরু হয় অতিমারি। গৃহবন্দী মানুষ হয়ে ওঠে ইন্টারনেট ব্যবহারে বাধ্যতামূলকভাবে দক্ষ। স্বাভাবিকভাবেই ইন্টারনেট ভীতি কেটে যাওয়ায়, মানুষ তার বিনোদন খুঁজতে থাকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। খুব স্বাভাবিকভাবেই বিকল্প হিসাবে উঠে আসে OTT। আর একবার এর আনন্দ পেয়ে যাওয়ার পর দর্শক আপনা আপনি ছুটতে থাকে এর মোহে। এই বিরাট ক্রেতার বাজার ধরতে ক্রমশ এগিয়ে আসছে বড় বড় কোম্পানি গুলি । এমনকি নতুন নির্মিত ছায়াছবিও এখন মুক্তি পাচ্ছে সরাসরি OTT প্লাটফর্মে। তবে একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে গুণগত উন্নতি সাধনে বিকল্প ব্যবস্থার এই দৌড় কিন্তু অপরিহার্য। আর যাই হোক, মাত্র আড়াই ঘণ্টার মধ্যে বাঙালি দর্শকদের প্রিয় ফেলুদাকে আটকে না রেখে গল্পকে প্রাধান্য দিয়ে অনেকগুলি পর্বে ভেঙে দেওয়ায় বোধহয় ভালোই হয়েছে। সেই সঙ্গে বহু নতুন কলাকুশলী সুযোগ পেয়েছে তাদের প্রতিভাকে তুলে ধরতে। শুধুমাত্র অভিনেতা অভিনেত্রী নয়, অনুষ্ঠান গুলির সঙ্গে জড়িত সকলের কথাই বলছি। আর যেটা না বললেই নয় সেটা হল, মানুষ কাজ পেয়েছে। এই কঠিন সময় দাঁড়িয়ে সেটার গুরুত্ব কিছু কম নয়।