বিকল্পই যখন পেশা
জহর চট্টোপাধ্যায়
লকডাউন তখন সবে শুরু হয়েছে। দিন কয়েক যেতেই বোঝা গেল তার আসল রূপ। কাগজে এই সময় একটা খবর দেখলাম। একটি ছেলে আমেরিকার একটি বড় হোটেলে চাকরি করে, ছুটিতে বাড়ি এসেছে, ছুটি শেষে এপ্রিল মাসে তার কাজে যোগদানের কথা ছিল। তার আগেই লকডাউন।কাজে ফেরা সম্ভব হল না, ফলে বিদেশের চাকরী গেল। এখানেও কিছু করবে এমন সংস্থান হলো না। শেষে বাধ্য হয়ে আনাজপাতি বিক্রি করতে শুরু করে।এটা গত বছর মানে ২০২০ সালের খবর।এবছর অর্থাৎ ২০২১-এর সেপ্টেম্বরের শেষ দিনে খবরের কাগজে আবার একটা খবরে চোখ আটকালো। গুসকরায় একজন উচ্চশিক্ষিত যুবক পার্শ্বশিক্ষকের কাজ হারিয়েছেন এবং সেই বেকার হয়ে পড়া মানুষটিকে তার স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছেন, সঙ্গে শিশুপুত্রটিকেও নিয়ে গেছেন।এই অবস্থায় যুবকটি হতাশায় ভেঙ্গে না পরে ভ্রাম্যমান মাছ-ভাজার দোকান খুলেছেন। সেটি খুব ভালো চলছে এবং এলাকায় বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এমন সত্যি ঘটনা আমাদের আশেপাশে বহু মানুষের জীবনে ঘটেছে।অতিমারির পরিস্থিতিতে বহু মানুষকে কাজ হারাতে হয়েছে।বাধ্য হয়ে অনেককেই নিজেদের পুরনো পেশা ছেড়ে অন্য পেশা নিতে হয়েছে। এতদিন যে কাজ করে জীবিকা সংস্থান করছিলেন হঠাৎই তাতে রুজি-রুটি সংগ্রহ করা কষ্টকর হয়ে পড়ায় বিকল্প জীবিকার সন্ধান করতে হয়েছে। কেউ আবার স্থায়ী কাজ হারিয়ে নিরুপায় হয়ে বিকল্প জীবিকা নিয়েছেন। তাই এই বিকল্প জীবিকা বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকটা অসহায়তা কাজ করছে। তবে, সবাই যে নিজের চাহিদা মত কাজ পান এমন নয়, বরং বেশিরভাগকেই কাজের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে জীবন কাটাতে হয়। খুব কম মানুষের ভাগ্যেই এমন হয় যে পছন্দের কাজ নিয়ে সারা জীবন শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারেন। প্রথাগত জীবিকাগুলোকে আমরা স্বাভাবিক জীবিকা মনে করলে তার বাইরের সব জীবিকাই তাহলে বিকল্প জীবিকা হয়ে যায়।কিন্তু বিকল্প জীবিকা বা বিকল্প পেশা বলতে আমরা এখানে কোন জীবিকা হারিয়ে বাধ্য হয়ে অন্য জীবিকা গ্রহণ করাকে বলছি না, আমরা সেইসব জীবিকা বা পেশার কথা বলব যেগুলো এক ব্যক্তির বিকল্প হিসেবে অন্য ব্যক্তি করে থাকে। সোজা কথায় বললে এখানে বিকল্প হওয়াটাই পেশা অর্থাৎ যার কাজ বা যাকে সেটা করতে হবে তার বদলে অন্য কেউ তার হয়ে এই কাজটা করে দেয় এবং এটাই তার পেশা।
করোনার প্রকোপে গত দুই বছর ধরে আমরা বহু মৃত্যুর খবর পেলাম।যে কোন মৃত্যু সংবাদই দুঃখের। যারা আপনজনকে হারিয়েছেন তাদের দুঃখের কোনও সান্ত্বনা নেই।পরিবার পরিজনের বিয়োগে তো চোখ জলে ভরে, অনেক সময় পরিচিত জনেদের বিয়োগেও চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। তবে এটাও ঠিক যে সবাই চোখের জল ঝরিয়ে কাঁদতে পারে না, বা সর্বসমক্ষে শোক প্রকাশের অবকাশ থাকে না। রাজা, মহারাজা, জমিদার বা বহু উচ্চবিত্ত পরিবারে তাই শোক প্রকাশের জন্য, চোখের জল ঝরিয়ে বিলাপ করার জন্য অন্যের সাহায্য নিতে হয়। তাদেরকে বলা হয় ‘প্রফেশনাল মৌর্নার’ বা পেশাদার বিলাপকারী। আধুনিক ভাষাতত্ত্বে এদের ‘মইরোলজিস্ট’ বলে।অন্যের হয়ে বিলাপ করেই জীবিকা নির্বাহ করে তারা।
পৃথিবীর সব দেশেই কিছু কিছু অঞ্চলে এই পেশার চল রয়েছে। তবে রকম ফেরও আছে। রাজস্থানে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে শোকের বিলাপ করার জন্য কিছু বিশেষ মহিলা আছেন।কালো পোশাকের এই মেয়েদের সাধারণভাবে ‘রুদালি’ নামে ডাকা হয়। গ্রাম বাংলাতেও এই পেশাদার বিলাপকারী আছেন, তবে অন্য রকমের।রাজস্থানের রুদালিদের মতো দল বেঁধে না হলেও ছেলেবেলায় মায়ের ঠাকুমার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে দেখেছিলাম এক ব্যক্তিকে। হাতে একটি পিতলের ঘটি এবং লোহার শলাকা।তিনি বাড়ীর এক একজনের কাছে গিয়ে মৃতব্যক্তির সঙ্গে তার সম্পর্ক জেনে নিয়ে, মৃতব্যক্তিকে সেইমত সম্বোধন করে মৃতের আত্মা কীভাবে স্বর্গে গেছে, স্বর্গে গিয়ে তিনি কি কি করছেন এসব কথা কান্নার সুরে বলে যাচ্ছিলেন এবং ঘটির গায়ে লোহার শলাকা দিয়ে নানাভাবে আঘাত করে অদ্ভুত সব শব্দ করছিলেন। এভাবে এক একজনের হয়ে সুর করে শোকগাথা গাইবার পর পারিশ্রমিকের জন্য সেইজনের দিকে হাত বাড়াচ্ছিলেন। আপনাদের কারও কারও এমন বা অন্য রকম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকতে পারে। সম্ভব হলে আপনার অভিজ্ঞতা পত্রিকাকে জানাতে পারেন।
এই পেশাদার বিলাপকারীদের ইতিহাস সুপ্রাচীন। বাইবেলে এই পেশাদারদের কথা আছে। ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর ‘আমোস ৫/১৬’তে উল্লেখ আছে ‘‘… রাস্তায় রাস্তায় সকলে ‘হায় হায়’ করছে … পেশাদার বিলাপকারীরা হাহাকার করে শোক প্রকাশ করছে।’’ প্রাচীন চীন, মিশর, রোম, মধ্য এশিয়ায় এই প্রথা প্রচলিত ছিল।মূলত সম্ভ্রান্ত পরিবারেই এদের দরকার পরে।তবে বিলাপকারীরা হয় মহিলা, পুরুষদের এই পেশায় দেখা যায় না।এর মুলে আছে এই বিশ্বাস যে বিধাতা নারীদের এমন করে বানিয়েছেন যাতে তারা দুঃখ-কষ্টের অনুভূতিগুলো ভালো করে বুঝতে পারে। তাদের মন খুবই নরম। অন্দরমহলের মেয়েদের বাড়ির বাইরে বের হতে দেওয়া যায় না। পরপুরুষের সামনে গিয়ে তারা কাঁদলে পরিবারের মাথা নিচু হয়ে যাবে। পরিবারের যেই মারা যাক, আগে তাদেরকে নিজেদের মর্যাদাটা বুঝতে হবে।কাজেই তাদের হয়ে কান্নার কাজটা করে দেয় অন্য মহিলারা।প্রাচীন মিশরে নিঃসন্তান মহিলারাই এই কাজ করতে পারত।শুধু প্রাচীনকালেই নয়, আজও এই প্রথা নানা যায়গায় টিকে আছে।যেমন, চীনে এই কাজে নাটকের অভিনেতাদের ব্যবহার করা হয়।সেদেশের সৎকারের প্রথা মেনে নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্র সহযোগে শোকপর্বটি পালিত হয়।আজকের দিনে এর সঙ্গে ‘ক্যারাওকে’র মত নানা আধুনিক অনুষঙ্গ যোগ হয়েছে। ইংল্যান্ডে ভিক্টোরিয়া সাম্রাজ্যে এই বিষয়টি বিশেষভাবে প্রচলিত ছিল। তবে, আজও এই প্রথা কোন কোন অঞ্চলে প্রচলিত আছে।আমেরিকাতেও ‘মইরোলজিস্ট’ আছে।অন্যান্য দেশের মত আমেরিকার ‘মইরোলজিস্ট’রা বিলাপ করেন না, তারা শবযাত্রায় অংশ নেয় অর্থাৎ মৃতের শেষ যাত্রায় ভিড় বাড়ায়। মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শেষ যাত্রায় মানুষের উপস্থিতির সংখ্যাটা সে দেশে প্রতিপত্তি প্রকাশের একটা মাধ্যম। ভারতের কোনও কোনও অঞ্চলে নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্র সহযোগে শেষ যাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। তাদের বিশ্বাস এভাবে শেষ বিদায় জানালে মৃতের আত্মা আনন্দের সঙ্গে স্বর্গে যাবেন। তামিলনাড়ুতে এই প্রথা দেখা যায়। ‘গ্যংস অফ ওয়াসেপুর’ ছবিতে ‘ক্যারাওকে’ বাজিয়ে হিন্দি ছবির ‘স্যাড-সঙ’ গেয়ে মৃতের শেষ যাত্রার দৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ ভারতের আরও নানা যায়গায় এই প্রথা আছে। প্রথা যখন আছে তখন তা পালনের জন্য পেশাদাররাও রয়েছে। শুধু এদেশেই নয়, অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের মধ্যে নাচ-গান-বাদ্যযন্ত্র সহযোগে শেষ যাত্রার রীতি আছে। আফ্রিকার কেঙ্গা উপজাতিদের মধ্যে ‘দোদি’ ও ‘মুতু’ নামের শোকনৃত্যের প্রচলন আছে। মালির ডোগোঁ উপজাতিরা মৃতের উদ্দেশ্যে ‘মুখোশনৃত্য’ করে। উগান্ডার ‘লুগবারা’ এবং নাইজেরিয়ার ‘আঙ্গাস’ উপজাতিদের মধ্যেও শোকনৃত্যের প্রচলন আছে। বিখ্যাত ইরানিয়ান চিত্র পরিচালক ‘বাহ্মান কিয়ারোস্তামি’র তথ্যচিত্র ‘তাবাকি’র বিষয়বস্তু এই পেশাদার বিলাপকারীরা। মার্ক মেইলি পরিচালিত ফিলিপাইনের ‘ক্রায়িং লেডিস’ ছবিটি তিনজন পেশাদার বিলাপকারী মহিলার জীবনকে দেখায়। জাপানি চিত্র পরিচালক আকিও ফুজুমুরা তাঁর ‘মিউওহারু’ ছবিতে দেখিয়েছেন একজন অভিনেত্রী কীভাবে সফল পেশাদার বিলাপকারী হয়ে ওঠেন। ভারতীয় চিত্র পরিচালক কল্পনা লাজমি রাজস্থানের পেশাদার বিলাপকারী মহিলাদের নিয়ে ‘রুদালি’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন। মহাশ্বেতা দেবীর লেখা ‘রুদালি’ উপন্যাসকে ভিত্তি করে এই ছবিটি তৈরি হয়।
এ বছর জুলাই মাসে খবরের কাগজে মিনু আক্তার নামে এক ভদ্র মহিলা পথদুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার খবর ছাপে।জুন মাসের ২৮ তারিখ রাত ৩টার সময় মহিলাকে একটি ট্রাক চাপা দেয়, মৃতদেহের দাবিদার না থাকায় বেওয়ারিশ মৃতদেহের সঙ্গে তারও সৎকার করা হয়। এই আপাত সাধারণ একটি ঘটনার পিছনে আসলে যে এক গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে পুলিশ তার সন্ধান পেয়েছে এবং তদন্তে আশ্চর্য সব তথ্য পেয়েছে। জুলাই মাসের প্রতিবেদনটি এই তদন্ত নিয়েই। তদন্তে কি জানা গেছে? চমকে দেবার মতো ঘটনা। বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতি এলাকায় মিনু আক্তার নামের মহিলাটি থাকতেন। তার স্বামী ঠেলাগাড়ি চালক বাবুল বছর পাঁচেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।স্বামীর মৃত্যুর পর প্রচণ্ড অনটনের মধ্যে পড়েন মিনু।সন্তানদের খাওয়া-দাওয়া এবং আর্থিক কিছু সহায়তার প্রতিশ্রুতিতে কুলসুমা আক্তার নামের এক মহিলার বদলি হিসাবে জেল খাটার প্রস্তাব পেয়ে তিনি রাজি হন। কুলসুমা আক্তার একজন যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত পলাতক খুনের আসামী।কুলসুমা আক্তার ‘সেজে’ মিনু আক্তার ‘স্বেচ্ছায়’ আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। প্রায় তিন বছর কারাগারে থাকার পর চলতি বছরের ১৮ মার্চ কারা কর্তৃপক্ষকে মিনু আক্তার জানান, তিনি কোনো মামলার আসামি নন। তার নাম কুলসুমাও নয়। সন্তানদের ভরণ-পোষণের আশ্বাস পেয়ে তিনি কুলসুমার বদলে জেল খাটতে রাজি হয়েছেন।উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত ১৬ জুন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্তি পান মিনু আক্তার। জেল থেকে বের হওয়ার পর মেয়ের মৃত্যুর খবর পান মিনু। গত এপ্রিলে মেয়েটির মৃত্যু হয়। মেয়ের মৃত্যু তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না, খুব কান্নাকাটি করতেন। গত ২৮ জুন সকালে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে যান। ট্রাক চাপায় আহত হওয়ার পর ভোর ৫টার দিকে মারা যান মিনু। কিন্তু তার পরিচয় তখন জানা যায়নি।পরে পুলিশি তদন্তে তার পরিচয় জানা যায় এবং জানা যায় মিনুর দারুণ কষ্টের জীবনের কথা।মিনু আক্তারের খবরটি কিন্তু ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। এমন অনেকেই আছেন যারা পেশাদারভাবে অন্যের হয়ে জেল খাটে। পুলিশ ভুল লোককে ধরে জেলে পুরে দিয়েছে এ যেমন হয়, তেমনই ষড়যন্ত্র করে কাউকে জেলে ভরে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে। কিন্তু এর কোনটাই সাজা পাওয়া ব্যক্তিটি স্বেচ্ছায় করেনি। তবে এমন লোকও আছে যারা অন্যের জেলের সাজা অর্থের বিনিময়ে নিজে খেটে দেয়। ভু-ভারতে এমন লোক অনেক আছে। আমাদের পাশের দেশ বাংলাদেশের এক বিখ্যাত অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি’ নামে একটি সিনেমার মূল চরিত্রটি এমনই এক পেশার লোক। অভিনয়ের নেশা আছে এমন এক লোক আসামীর হাঁটা-চলা-কথা বলা-হাবভাব হুবহু নকল করে মাস খানেকের জন্য জেলে ঢুকে পরে। কোর্ট থেকে জেলে যাওয়ার পথে দুজনের বদলা-বদলি হয়ে যায়। অভিযুক্ত টাকার জোরে জেলের বাইরে, আর ঐ টাকা উপার্জনের জন্য অভিযুক্তর বদলি হিসাবে সে ঢুকে যায় জেলের মধ্যে। মেয়াদ ফুরোলে আবার বাসায় ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবন। এই জেলে থাকার সময়টুকু সে জাহাজের কাজে গিয়েছিল বলে আশেপাশের লোককে জানায়। তারা জানে লোকটি জাহাজের রাঁধুনি, আর জাহাজ তো দু-এক দিনের জন্য পাড়ি দেয় না, যখনই যায় মাস খানেক লাগে।তাই কোনও সন্দেহ নেই।ঘটনাগুলো গল্পের মত শোনালেও বা অদ্ভুত গল্পে ঘটনা সাজালেও একথা সত্যি যে এই অদ্ভুত বিকল্পের পেশাই অনেকের জীবন।
এবার যে পেশার কথা বলব সেটিও উপরের পেশাটির মতই একের বদলে কাজ করা এবং অবশ্যই বে-আইনি। বলিউডের এক বাণিজ্যসফল ছবির দৌলতে এই পেশার কথা আমরা সকলেই জেনে গেছি। ছবিটির নাম বললেই সবাই বুঝে যাবেন যে কোন পেশাটির কথা বলা হচ্ছে। ছবিটির নাম ‘মুন্নাভাই এম.বি.বি.এস.’ আর পেশাটি হল অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়া।‘মুন্নাভাই এম.বি.বি.এস.’ ছবিটি ২০০৩ সালের, কিন্তু সেই পেশা আজও সমানতালে বর্তমান। গতবছর ‘জি-মেন’ পরীক্ষায় আবার মুন্নাভাইদের খবর সামনে আসে। সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে অনুষ্ঠিত এই পরীক্ষায় একছাত্রের ৯৯.৮% নম্বর পাওয়ার ঘটনায় মিত্রদেভ শর্মা নামে এক ব্যক্তি গুয়াহাটি পুলিশ স্টেশনে ঐ ছাত্রের নামে এফ.আই.আর. দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগ, ছাত্রটি সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে পরীক্ষা দেয় নি, তাঁর বদলে অন্য একজন তার হয়ে পরীক্ষাটি দেয়। পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে ছাত্রটি সেদিন পরীক্ষাকেন্দ্রে গিয়ে ‘বায়োমেট্রিক’ উপস্থিতি যাচাই করার পর বাইরে বেরিয়ে আসে এবং পরীক্ষা পরিদর্শকের সহায়তায় তার যায়গায় অন্য ব্যক্তি পরীক্ষাটি দেয়। তদন্তে আরও জানা গেছে ছাত্রটির বাবা মা দুইজনেই ডাক্তার এবং একটি বেসরকারি কোচিং সংস্থাকে এই কাজের জন্য ১৫-২০ লাখ টাকা দিয়েছেন। এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এর আগেও অসমে অন্যের বদলে পরীক্ষা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৮ সালের ২০ জুলাই তারিখে ‘প্রবেশিকা মধ্যমা’ পরীক্ষার ভারপ্রাপ্ত পরীক্ষক একটি পরীক্ষা কেন্দ্র থেকে আট জন ‘মুন্নাভাই’কে হাতে নাতে ধরেন। এখানেই শেষ নয়, এই প্রবেশিকার অন্যান্য বিষয়ের পরীক্ষাতেও জাল পরীক্ষার্থী ধরা পরে। শেষ পর্যন্ত সর্বমোট ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় যারা অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল। এখানে অসমের কথা বললেও বিষয়টা ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়েই। এবছর সেপ্টেম্বর মাসের গোড়ার দিকে ‘নীট’ বা ‘ন্যাশানাল এলিজিবিলিটি এন্ট্রান্স টেস্ট’ পরীক্ষায় ‘ডেন্টাল সায়েন্স’-এর দ্বিতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে অন্যের হয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সময় বারানসি থেকে আটক করা হয়। জেরায় সে স্বীকার করে যে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে সে অন্যের হয়ে পরীক্ষা দিচ্ছিল। একটি গোষ্ঠী তাকে এই কাজে এনেছে। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের এই মেধাবী ছাত্রীটি জালিয়াত গোষ্ঠীটির সহজ নিশানা হয়ে পরে। এক বর্ষীয়ান পুলিশ অফিসার জানাচ্ছেন এমন ঘটনা আকছার ঘটছে। গত পাঁচ বছরে দেশের নানা প্রান্ত থেকে পাঁচশোরও বেশী আটক হওয়া এমন ব্যক্তির সিংহভাগ বিহারের বাসিন্দা। এই পেশাদারদের পিছনে অবশ্য অনেক ক্ষমতাবান লোকজনও আছে। মধ্যপ্রদেশের ‘ব্যাপম’ দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর একথা প্রমাণ হয়ে গেছে। বিহার পুলিশের সুত্র থেকে জানা যাচ্ছে ‘রেলের গ্রুপ ডি’, ‘ইউ.পি.এস.সি.’, ‘এস.এস.সি.’, ‘সিভিল কোর্ট স্টাফ’, ‘কনস্টেবল’, ‘চন্ডিগড় ট্রান্সপোর্ট আন্ডারটেকিং কন্ডাক্টর রিক্রুটমেন্ট’ এইসব পরীক্ষায় বিহার-গ্যাং দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে পরীক্ষা জালিয়াতির নানান ব্যবস্থা করে থাকে।
এবারে যে বিকল্প পেশার কথা বলব সেটিও সিনেমা-টি.ভি.র দৌলতে সকলেরই পরিচিত তবে বিষয়টি এখনও সর্বজনবিদিত হয়ে ওঠে নি। এই পেশাটি হল ‘সারগেসি’ বা সোজা বাংলায় ‘গর্ভ ভাড়া’ দেওয়া। সন্তানহীন দম্পতির সন্তানলাভের পথ সুগম করতে ডাক্তার ও বিজ্ঞানীরা মিলে যে বহু বিকল্প পথ বের করেছেন তার একটি হল ‘সারগেসি’। গর্ভধানএ জটিলতা আছে এমন মহিলারা ‘সারগেসি’ পদ্ধতির মাধ্যমে সন্তান পেতে পারেন। মনে রাখতে হবে এটা সম্পূর্ণ মানবিক সেবা, পেশা কখনই নয়। তবু এই ‘গর্ভ ভাড়া’ ব্যবস্থাটা অনেকেই অর্থ উপার্জনের জন্য গ্রহণ করেন। এই প্রবণতা বন্ধ করতে সরকার ‘সারগেসি’ নিয়ম নির্ধারণ করেছেন, যাতে অন্যান্য নিয়মের সঙ্গে বলা হয়েছে যে কোনও মহিলা তার জীবনে মাত্র একবার ‘সারগেসি’ পদ্ধতিতে মা হতে পারবেন। অর্থাৎ এটাকে পেশা করা যাবে না। পেশা না হলেও সন্তান ধারনের আরও একটি বিকল্প পথের কথা এখানে উল্লেখ করতেই হয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে স্টেফনি টেলার নামের এক মহিলা কোনরকম সম্পর্ক ছাড়াই সন্তান পেতে চেয়ে ছিলেন। তিনি কোন গর্ভধারণ কেন্দ্রের দ্বারস্থ হয়ে সন্তান ধারণের পথে হাঁটেননি। যদিও তিনি কয়েকটি গর্ভধারণ কেন্দ্রে সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন কিন্তু তাদের সন্তান ধারণ করানোর মূল্য এতটাই বেশি যে বিকল্প খুলতে বাধ্য হন। তিনি যে বিকল্প পথটি গ্রহণ করেছেন সেটি হল ইন্টারনেটে শুক্রাণু বিক্রির অ্যাপ থেকে শুক্রাণু কিনে ইউটিউব দেখে সেই শুক্রাণু গর্ভে প্রবেশ করার পদ্ধতি শিখে গর্ভধান করেছেন। ই-বে থেকে প্রজনন প্রক্রিয়ার দরকারি জিনিসপত্র কিনেছেন। অর্থাৎ অনলাইনের সুযোগ নিয়ে তিনি সন্তান ধারণে করেছেন। দশ মাস পরে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন, যার নাম রাখা হয়েছে ইডেন।
আমাদের বেঁচে থাকার পথে, নিজেদের সাধ পূরণের ক্ষেত্রে কোনও প্রতিবন্ধকতা এলেই আমরা বিকল্পের সন্ধান করি। তাই অতিমারি থাক বা না থাক বিকল্পের সন্ধান হল জীবনের সন্ধান। তবে সেই সন্ধানে নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে, কোনও গর্হিত উপায় অবলম্বন করা চলবে না, তবেই সেই বিকল্প পথ সদর্থেই প্রকৃত পথ ও দৃষ্টান্ত মূলক পথ হয়ে উঠবে।