বহুবিকল্প

জহর চট্টোপাধ্যায়
( বিকল্প তন্তু )
এক সময় জামাকাপড় তৈরি হত তুলো থেকে তৈরি সুতো দিয়ে। তবে আজ বেশীরভাগ পোশাকই তৈরি হয় তুলোর বদলে বিকল্প জিনিস থেকে বানানো সুতো দিয়ে। অর্থাৎ প্রাকৃতিক তন্তুর বদলে রাসায়নিক যৌগ দিয়ে গঠিত তন্তু থেকে কাপড় বুনে তা দিয়ে পোশাক তৈরি করা হয়। প্রাকৃতিক তন্তুর বিকল্প এই কৃত্রিম তন্তুগুলি পলিয়েস্টার, রেয়ন, স্প্যান্ডেক্স ইত্যাদি নামে পরিচিত। প্রথম কৃত্রিম তন্তু তৈরি করেন জোসেফ সোয়ান, ১৮৮০ সালে। তিনি গাছের ছাল থেকে ‘সেলুলোজ’ সংগ্রহ করে তাকে রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই কৃত্রিম তন্তুটি তৈরি করেন।
(বামদিকে) প্রাকৃতিক তন্তুর বিকল্প কৃত্রিম তন্তু (ডানদিকে)
সোয়ান এই কৃত্রিম তন্তু তৈরি করেছিলেন তাঁর তৈরি বৈদ্যুতিক বাল্বের ফিলামেন্ট বানানোর উপযোগী সরু শলাকা নির্মাণের জন্য। পরে তিনি এই কৃত্রিম তন্তু ব্যবহারের সম্ভবনা উপলব্ধি করে এটি দিয়ে কাপড় তৈরির উদ্যোগ নেন। প্রায় সমসময়ে হিলেইরি দ্য চারদোনেত নামে এক ফরাসী প্রযুক্তিবিদ কৃত্রিম রেশম তৈরি করেন। ১৮৭০ নাগাদ ফ্রান্সে রেশমকীটের মড়ক দেখা দেয়। চারদোনেত সেই সময় লুই পাস্তুরের সহযোগী হিসাবে এই মড়ক রোধের কাজ করছিলেন। এই কাজের মধ্যেই তিনি নাইট্রোসেলুলোজ থেকে কৃত্রিম রেশম তৈরির সম্ভাবনার সন্ধান পান। ১৮৮৯ সালে প্যারিসের এক প্রদর্শনীতে তিনি তাঁর এই সন্ধান প্রথমবার প্রদর্শন করেন। তবে প্রথম সফলভাবে কৃত্রিম তন্তু উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু করেন তিন ব্রিটিশ রসায়নবিদ চার্লস ফ্রেডেরিক ক্রস, এডওয়ার্ড জন বেভান এবং ক্লাইটন বিডলি। তাঁদের তৈরি কৃত্রিম তন্তুটির নাম ‘ভিস্কোস’। সেলোফেন তৈরির জন্য ব্যবহৃত ভিস্কোয়াস নামের জৈব তরল থেকে এটি তৈরি করা হয়েছিল বলে এই নাম দেওয়া হয়। পরে এটিকে ‘ভিস্কোস রেয়ন’ নামে ডাকা হয়, তবে ১৯২৪ সাল থেকে এর উৎপাদক সংস্থা এটির নাম রাখেন ‘রেয়ন’। তবে এ পর্যন্ত যেসব কৃত্রিম তন্তুর কথা বলা হল সবগুলিই কিন্তু জৈব তন্তু। প্রথম সম্পূর্ণ রসায়নজাত কৃত্রিম তন্তু বানান আমেরিকার গবেষণাবিদ ওয়ালেস হিউম ক্রাদারস (উপরের ছবিতে) এবং তন্তুটির নাম ‘নাইলন’। ১৯৩০ সালে আমেরিকার ‘ডু-পন্ট’ সংস্থার পরীক্ষাগারে তিনি বর্তমান দিনের অতি প্রয়োজনীয় এই তন্তুটি তৈরি করেন।
ভারতীয় ক্রিকেট টিম নিয়ে মানুষের এত আগ্রহ যে কোনও ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় টিম কী রকম পোশাক পরে খেলবে, তার ডিজাইন বা রঙ কেমন হবে – এসব নিয়ে আলোচনাও কিছু কম হয় না। তবে ২০১৫ সালের ভারত-অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ড ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতীয় ক্রিকেট টিমের পোশাক আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। তবে ডিজাইন বা রঙকে ছাপিয়ে উঠেছিল পোশাকের কাপড়টি নিয়ে আগ্রহ। কারণ, এই সিরিজের পোশাক তৈরির বরাত পাওয়া পৃথিবী বিখ্যাত ক্রীড়াসামগ্রী তৈরি সংস্থাটি আগেই জানিয়ে দিয়েছে ভারতীয় ক্রিকেট টিমের পোশাক তৈরি হবে ফেলে দেওয়া জলের বোতল থেকে। কে কি বুঝেছিল জানা নেই, তবে ব্যাপারটায় মোটেই চমকাবার মতো কিছু নেই। জলের বোতল যে উপাদানে তৈরি হয় সেই একই উপাদান দিয়ে কৃত্রিম তন্তুও তৈরি হয়। চমক এখানেই যে, যে হারে পানীয়ের বোতল-বর্জ্যের সংখ্যা দিনদিন বেড়ে চলেছে তা থেকে বাঁচতে সেগুলির পুনর্ব্যবহার করা ছাড়া উপায় নেই। ক্রীড়াসামগ্রী তৈরি সংস্থা ‘নাইকি’ পোশাক তৈরির ক্ষেত্রে বোতল-বর্জ্যের পুনর্ব্যবহারের পথ দেখিয়েছেন তাই এই কাজের জন্য সমস্ত রকমের সাধুবাদ তাদের প্রাপ্য।
ফেলে দেওয়া জলের বোতল থেকে তৈরি পোষাকে ২০১৫-এর ত্রিদেশীয় সিরিজে ভারতীয় ক্রিকেট দল।
( বিকল্প মহাকাশ-অভিযাত্রী )
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ৩ এপ্রিল সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকের বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে সোভিয়েত সোয়ুজ টি-১১ মহাকশযানে চেপে রাকেশ শর্মা (পাশের ছবিতে) মহাকাশে পাড়ি দেন। প্রথম ভারতীয় নাগরিক হিসাবে মহাকাশে যাত্রা করে তিনি ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেন। ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ২০ সেপ্টেম্বর তিনি একজন মহাকাশচারী হওয়ার জন্যে মনোনীত হন। ভারতের ‘ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন’ (ইসরো) এবং রাশিয়ার ‘সোভিয়েত ইন্টারকসমস’- এই দুই সংস্থার মহাকাশ কর্মসূচির যৌথ প্রকল্পের অংশ হিসেবে মহাকাশ অভিযানের জন্য উইং কম্যান্ডার রাকেশ শর্মাকে
নির্বাচন করা হয়। কিন্তু এত বড় প্রকল্পে যাতে কোন ছেদ না পরে সে জন্য রাকেশ শর্মার একজন বিকল্পও বেছে নেওয়া হয়। শরীরগত কোনও কারণে রাকেশ শর্মা মহাকাশ অভিযানে ব্যর্থ হলে তাঁর বদলি হিসাবে সেই বিকল্প মহাকাশচারী অভিযান সফল করবেন। সেই বিকল্প অভিযাত্রীর নাম উইং কম্যান্ডার রবীশ মালহোত্রা (পাশের ছবিতে)। শেষ পর্যন্ত আর বিকল্পের প্রয়োজন পড়েনি, রাকেশ শর্মাই সুস্থ শরীরে মহাকাশ অভিযানে যাত্রী হয়েছিলেন। রাকেশ শর্মার নাম আজও সকলের মনে আছে, কিন্তু তাঁর বিকল্প রবীশ মালহোত্রা স্মৃতির অতলে তলিয়ে গেছেন।
মানুষ প্রথম চাঁদে পা রেখেছে ১৯৬৯ সালে। মানুষের সেই প্রথম চন্দ্রাভিযানে যাত্রী ছিলেন তিনজন। নীল আমস্ট্রং, এডউইন অলড্রিন এবং মাইকেল কলিন্স। এদের মধ্যে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে প্রথম পা দেন এবং এডউইন অলড্রিন তারপর চাঁদের মাটিতে নামেন। তিনজন অভিযানে গেলেও চাঁদে নেমেছিলেন দুইজন। তৃতীয়জন মাইকেল কলিন্স মূল মহাকাশযানটি নিয়ে চাঁদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করেছিলেন। মাইকেল কলিন্স প্রথমে এই অভিযানে ছিলেন না। তাঁর জায়গায় ছিল জিম নভেল। অর্থাৎ তিনি বিকল্প হিসাবে এই অভিযানে যুক্ত হন। অ্যাপোলো ১১ অভিযানের অভিযাত্রীদেরও তিনজন বিকল্প অভিযাত্রী ছিল। নীল আর্মস্ট্রং এর বিকল্প ছিলেন জেমস এ. নভেল জুনিয়ার, মাইকেল কলিন্স-এর বিকল্প ছিলেন উইলিয়াম অ্যান্ডার্স এবং এডউইন অলড্রিন-এর বিকল্প ছিলেন ফ্রেড ডাবলু. হেইসে জুনিয়ার। এদের নিয়ে কোনও খবর হয় নি। কিন্তু ভাগ্যক্রমে অভিযানের অংশ হতে পেরে মাইকেল কলিন্স স্থান পেয়ে গেলেন ইতিহাসে। নীচের ছবিতে সেই তিন কিংবদন্তি মহাকাশচারী – নীল আর্মস্ট্রং, মাইকেল কলিন্স এবং এডউইন অলড্রিন।
.