August 21, 2025

হাওড়া জেলায় রাজ্যপ্রাণী বাঘরোল সংরক্ষণে বিকল্প পথের সন্ধান

সায়ন দে

ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যাণ্ড, কম্বোডিয়া সহ সামগ্রিক দক্ষিণ এশিয়ার জলাভূমি অঞ্চলে বৃহৎ মার্জার বা বিড়াল গোষ্ঠীর একমাত্র নিশাচর প্রাণী যা জলে ডুবে তার শিকার ধরে, জমির ইঁদুর, ছুঁচো, সাপ, ব্যাঙ ও বিষাক্ত জীবজন্তু খেয়ে আমাদের উপকার করে ও স্থানীয় বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করে, হাওড়া জেলায় গ্রামেগঞ্জে যাকে কেউ বলে মাছবাঘা, কেউ বলে মেছোভাম, কেউ বলে বাঘাভাম, গোবাগা কিংবা মেছো বিড়াল, তা হল পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণী Fishing Cat বা বাঘরোল। এর বৈজ্ঞানিক নাম – প্রায়োনাইলুরাস ভাইভেররিনাস (Prionailurus viverrinus)। আমাদের রাজ্যে হাওড়া, হুগলি, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, আর উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পাওয়া যায় এদের। আবার হাওড়া জেলার মধ্যে আমতা ১ ও ২, পাঁচলা, ডোমজুড়, শ্যামপুর ১ ও ২, বাগনান ১ ও ২, জগৎবল্লভপুর এবং উদয়নারায়ণপুর ব্লকের বিস্তীর্ণ জলাজঙ্গল এলাকায়  এদের বেশি দেখা মেলে। তবে মানুষের সীমাহীন লোভ, শিকার, চোরাচালান, অরণ্য-জলাভূমি নাশের ফলে বাসস্থান সংকোচন, পরিবেশ দূষণ, সরকারের উদাসীনতা – এই সব কারণে দ্রুত এই প্রাণীটির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ফলে বাঘরোল-কে বাঁচাতে আমাদের দ্রুত বিকল্প ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন, এবং সেই কাজ শুরুও হয়েছে সম্প্রতি হাওড়া জেলায়।

বিপন্নতার জন্যই বাঘরোল ২০১২ সাল থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণী বা State Animal। আবার International Union for Conservation of Nature (IUCN) এর Red List বা লাল তালিকায় বাঘরোল ২০১৬ সাল থেকে Vulnerable বা সংকটাপন্ন প্রজাতি হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। ১৯৭৫ সালে ওয়াশিংটন সম্মেলনে ঠিক হওয়া বিপন্ন পশুপাখি ও উদ্ভিদদের আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংক্রান্ত নজরদারির চুক্তি বা Convention on International Trade in Endangered Species (CITES) এর চতুর্থ অধ্যায়ের (Article IV) দ্বিতীয় পরিশিষ্ট (Appendix II) অনুসারে আন্তর্জাতিক ব্যবসা ও চোরাচালানের ক্ষেত্রে এখনই বিপজ্জনক নয়, তবে ভবিষ্যতে আশঙ্কার সম্ভাবনা আছে – এমন প্রাণীদের তালিকায় রয়েছে বাঘরোল। বাঘরোলের ব্যবসার কোন আন্তর্জাতিক বাজার নেই, তাই এটা কোন অর্থকরী প্রাণী নয়, মুক্ত পরিবেশে থাকার যোগ্য। ১৯৭২ সালের ভারতীয় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুসারে বাঘরোল প্রথম তালিকাভুক্ত (Schedule I) প্রাণী। অর্থাৎ এই আইন অনুসারে বাঘরোল একটি বিপন্ন প্রজাতি, যার আশু সংরক্ষণ প্রয়োজন। এই প্রাণী শিকার, চোরাচালান ও ব্যবসা করা বেআইনি। এই আইন ভাঙলে জেল ও জরিমানা দুই-ই হতে পারে। এই আইন অনুসারে বাঘরোলকে স্বাভাবিক অবস্থায় ভারতে শিকার করা নিষিদ্ধ।

বিপন্ন বাঘরোল সংরক্ষণের বিকল্প ভাবনা

সামগ্রিক পরিবেশ সুরক্ষার প্রশ্নেই আমাদের বিকল্প ভাবনাচিন্তা করার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে। যেভাবে চলছে, সেভাবে আর পরিবেশ প্রকৃতির অবক্ষয়কে রোখা সম্ভব নয় – এটা আজ সবাই মেনে নিয়েছেন। প্রকৃতির বিপন্ন বন্যপ্রাণী হিসাবে বাঘরোলের সংরক্ষণের জন্যেও তাই শুরু হয়েছে বিকল্প পথের সন্ধান। আজ থেকে ২০ বছর আগেও বাঘরোল নিয়ে মানুষের সচেতনতা, বা বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান ছিল না সেভাবে। গ্রামাঞ্চলে বাঘরোল সহ বিভিন্ন নিশাচর বন্যপ্রাণী নিয়ে আজও আতঙ্ক, কুসংস্কার ও গুজবের শেষ নেই। তবুও ২০১০ সালের পরে হাওড়া জেলাকে কেন্দ্র করে যেভাবে বাঘরোল নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে এবং বিভিন্ন পরিবেশ সংগঠনের তৎপরতা দেখা দিয়েছে তাতে করে এই প্রাণীটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যে যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হতে হচ্ছে তা সঠিকভাবে চিহ্নিতকরণ ও তা সমাধানের নানা উপায়ের অনুসন্ধান করা এখন সম্ভব হচ্ছে কিছুটা হলেও। এখন সেই সমস্যাগুলোর নিরিখে উদ্ভূত বিকল্প সম্ভাবনা ও পদক্ষেপগুলোর কথাই আলোচনা করব।

জলাভূমি সংরক্ষণ

বাঘরোল মূলত জলাজমি, বিশেষ করে খড়িবন, বেতবন, বাঁশবন, উলুবন প্রভৃতি জল কেন্দ্রিক ঝোপঝাড় ও ক্ষেতখামারে বসবাস করে। অনেক ব্যক্তিগত ডাঙা ও সরকারি জলা এলাকায় বাঘরোলদের এই আবাসস্থলগুলো পড়ে। সরকারি জলা এলাকায় দলিল দস্তাবেজে সেগুলি সংরক্ষিত হলেও বেশিরভাগ

জলাজমিগুলিই Wasteland বা পতিত জমি হিসেবে চিহ্নিত। ফলে সেগুলি ভরাট করা যায় সহজেই। সেগুলি সহজেই বাস্তুজমিতে রূপান্তরিত করে নেওয়া যায়, সেখানে ঘরবাড়ি, কলকারখানা তৈরি করে নেওয়া যায়। হাওড়া জেলায় বর্তমানে এই সমস্যা চরম। জলাভূমি রাতারাতি চুরি হয়ে যাচ্ছে, প্রোমোটারদের দখলে চলে যাচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন ও শিল্পাঞ্চলের স্বপ্ন পূরণের তোড়ে জলাভূমি বুজে যাচ্ছে অবাধে। এইভাবে আবাসস্থল হারিয়ে ফেলার সমস্যাই বাঘরোলের বেঁচে থাকার পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায়। তাই কিভাবে বিকল্প পথে এই জলাজমিগুলো বাঁচিয়ে রাখা যায়, সেটাই গবেষক ও পরিবেশকর্মীদের কাছে সবচেয়ে চিন্তার বিষয়।

প্রাথমিকভাবে যে বিকল্প উপায়গুলি গ্রহণ করা যেতে পারে তা হল –

  • জেলার বিভিন্ন প্রান্তে থাকা পতিত জলাজমি চিহ্নিতকরণ ও সেখানে স্বাভাবিক জঙ্গল তৈরি করে বাঘরোল সহ সামগ্রিক জীববৈচিত্র্য প্রতিস্থাপন। ব্যক্তিগত, সাংগঠনিক ও সরকারী উদ্যোগে এ বিষয়ে প্রকল্প নির্মাণ ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে।
  • জলাভূমি বাঁচিয়ে উন্নয়ন ও পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের ভাবনা নিয়ে জনমত তৈরি ও সরকারকে এ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করানো যেতে পারে।
  • গ্রামীণ এলাকায় জলাভূমিগুলো হল প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার। তাই জলাভূমিগুলোকে আরো বেশি বেশি বিভিন্ন অর্থকরী উৎপাদনমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। পান চাষ, বাঁশ খড়ি, বেত, দেশীয় মাছ, শাক সব্জি, গেঁড়ি, শামুক, ঝিনুক চাষ বৃদ্ধি করে সেগুলোকে বাজারমুখী করে তোলা, যাতে জলাভূমির উপযোগিতা বজায় থাকে ও তা নষ্ট করে জলাভূমিকে বসতি বা শিল্পাঞ্চলে পরিণত করতে মানুষ বাধ্য না হয়। এ ব্যাপারে কৃষি ও মৎস্য দরফরকে জলাভূমির চাষীদের চাষের পদ্ধতি শিখিয়ে, রোজগার বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট করতে হবে।
  • খাদ্যের উৎপাদনে জলাজমিতে প্রভূত সম্ভাবনা রয়েছে। জলাজমিতে হওয়া জলজ ও আধা জলজ ঘাস ও লতা অতি উৎকৃষ্ট মানের পশুখাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা সম্ভব। পশুপালন ও হাঁস মুরগী পালনে জলাজমির কোনো বিকল্প হয়না। এইভাবে জলাভূমি বাঁচলে স্বাভবিকভাবেই বাঘরোল বাঁচবে।

২। বাঘরোলমানুষ সংঘাত নিরসন ইকো ট্যুরিজম

বাঘরোল মারা যাবার একটি বড় কারণ হল মানুষের বাঘরোলকে বাঘ ভাবা আর তা নিয়ে গুজব ও আতঙ্ক। তারওপর বেশিরভাগ জলাজমিগুলো মানুষের বসবাসের এলাকার কাছেই। জলাজমি কমে যাওয়ার ফলে, বা বর্ষাকালে জলাজমিতে জল বেশি উঠে আসার ফলে বাঘরোল মানুষের বসতি এলাকায় চলে আসে। খাবার হিসাবে হাস মুরগি ছাগল খেয়ে নেয়, মানুষ তাড়াতে গেলে ওরাও প্রাণের ফলে দাঁত খিঁচিয়ে তেড়ে আসে অনেক সময়। ক্ষতিগ্রস্ত ও আতঙ্কিত চাষিরা তাই বাঘরোল বাগে আনতে পারলে এদের পিটিয়ে মারে। এই ঘটনা হাওড়া জেলায় প্রচুর ঘটেছে। তাছাড়া অবৈধভাবে ফাঁদ পেতে ধরা, বাঘরোলের মাংস খাওয়া, বিষপ্রয়োগ করে মারা – এগুলো আটকাতে বাঘরোলের প্রতি আতঙ্ক কাটিয়ে চাষি ও সাধারণ মানুষদের ভালোবাসা তৈরি করতে বিকল্প ভাবনা ভাবতে হবে। এক্ষেত্রে যা যা করা যেতে পারে –

  • বাঘরোল  নিয়ে  সচেতনতা   বৃদ্ধি  এবং  এই  প্রাণীটির  প্রতি   আগ্রহ, উৎসাহ ও  ভালোবাসা  তৈরি  করতে  বাঘরোল-কে  ঘিরে ইকো ট্যুরিজমের ভাবনা ভাবা যেতে পারে।  গ্রামীণ হাওড়ায়  আমতা ২ নং ব্লকের  কলবাঁশ  গ্রামে ২০১৫ সালে সেজে  উঠেছিল  দেশের  সেরা   বাঘরোল পর্যটন কেন্দ্র বা Fishing Cat Heritage Homestay,  যার নাম ‘বাঘরোল বাসা’, পনেরো বিঘে জমির উপরে বিরাট পুকুর এবং সবুজে ঘেরা ১৭ শতকের পুরনো স্থানীয়    ঘোষ বাড়ির   এক জমিদারি দালানকোঠাকে নতুন করে সাজিয়ে এই প্রোজেক্ট করেছিলেন বন ও বন্যপ্রাণী গবেষক শান্তনু প্রসাদ,   ফরেস্ট   ডুয়েলারস    নামক সংগঠন সহ একদল বন্যপ্রাণী প্রেমী মানুষজন। পরিকল্পনায় ছিল বাঘরোল দর্শন, হোম স্টে, গ্রামীণ   আমেজ আস্বাদন সহ আরও কত কি। মিলেছিল ভারত সরকারের পর্যটন দফতরের ছাড়পত্রও। কিন্তু ২০১৯ সালে এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায় জমির মালিকদের সঙ্গে ঝামেলায়।
  • বাঘরোলের স্বাভাবিক আবাসস্থলের ক্ষতি না করে, পশুপালকদের ছাগল মুরগি ভেড়া খেয়ে নেওয়ার দোষে বাঘরোল-কে পিটিয়ে না মেরে যাতে তারা এখান থেকেই কোনভাবে আয় করতে পারে, এমন বিকল্প জীবিকার সন্ধান দেওয়া যেতে পারে। জলাভূমি, পরিবেশ প্রকৃতি সংরক্ষণ সংক্রান্ত নানা কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানুষের প্রকৃতি বাঁচানোর আগ্রহ তৈরি, বিশেষ করে খেটে খাওয়া মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির নিবিড় সম্পর্ক যা হারিয়ে যেতে বসেছে সেটা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা, এতেই বাঘরোল-মানুষ সংঘাত প্রতিরোধ হওয়া সম্ভব। ২০১২ সালের পরে হাওড়ার আমতা ২ ব্লকের সারদা নামক গ্রামে জয়দেব প্রধান সারদা প্রসাদ তীর্থ জনকল্যাণ সমিতি নামক একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে ছাগল তহবিল গড়ে তোলা হয়েছিল। এই উদ্যোগে গ্রামের পিছিয়ে পড়া পরিবারকে গর্ভবতী ছাগল দেওয়া হত, তারা একটা ছাগলের বদলে ছাগল তহবিলে দুটো ছাগল ফিরিয়ে দিত। বাকি ওই ছাগলের বাচ্চাদের পোষা ও বিক্রি করে আয় করার সুযোগ থাকত ওই পরিবারগুলোর। বাঘরোলে যদি কারো ছাগল খেয়ে নিত, তাহলে এই ছাগল তহবিল থেকে ছাগল দেওয়া হত। এতে আর বাঘরোল মারার প্রবণতা তৈরি হত না ক্ষতির দিক থেকে। এই রকম আরো অনেক সৃজনশীল ভাবনা ভাবা যেতে পারে।

৩। বাঘরোল নিয়ে গবেষণা, ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফি

বাঘরোল কে চেনাতে ও সামগ্রিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন ফটোগ্রাফি, ক্যামেরা ট্র্যাপিং ও ডকুমেন্টারি ফিল্ম তৈরি করার পরিকল্পনা খুব আকর্ষণীয় হতে পারে।

 

২০১০  সাল  থেকে  বাঘরোল  গবেষক  তিহাসা আঢ়্য ও তাঁর দলবল হাওড়া জেলায় বাঘরোল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। এই জেলা থেকেই কার্যত শুরু হল বাঘরোলকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপ্রাণি হিসাবে স্বীকৃতি দেবার লড়াই। ২০১১ সালে তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থা WWF এর আর্থিক সহায়তা পেতে তৈরি করলেন – Status Survey of Fishing Cats (Prionailurus viverrinus) in Howrah and Hooghly, W. Bengal নামক প্রতিবেদন।  তারপর  The  Fishing  Cat    Project   সংগঠনের মাধ্যমে তিনি বাঘরোল শুমারি, গবেষণা, সংরক্ষণ নিয়ে কাজ শুরু করেন।

 

২০ আগস্ট ২০১৮   সালে   জনপ্রিয়   অ্যানিম্যাল   প্ল্যানেট   চ্যানেলে   সম্প্রচারিত   হয়েছিল   বন্যপ্রাণ   তথ্যচিত্র   নির্মাতা ও   জাতীয়   পুরষ্কারে   ভূষিতা আকাঙ্খা   সুদ   সিং   এর  তৈরি   করা ভারতের   সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং   শহর-লাগোয়া   অসংরক্ষিত   এলাকার   আটটি   প্রজাতির বণ্যপ্রাণীকে   নিয়ে   তথ্যচিত্র   সিরিজ   ‘On The Brink’   যেখানে    ২৭   আগস্ট   দ্বিতীয়   এপিসোডে  আমাদের রাজ্যপ্রাণী বাঘরোল কে তুলে ধরা হয়েছিল। এ    রাজ্যে বাঘরোলের   গুরুত্বপুর্ণ বিচরণক্ষেত্র হাওড়ার   আমতা,   উলুবেড়িয়া, পাঁচলা   এলাকায়   শ্যুট   করা   হয়েছিল   এই    তথ্যচিত্র।    বাঘরোল কে নিয়ে  থেকেই সংশ্লিষ্ট চ্যানেলে আকাঙ্খার নির্মাণে বাঘরোল সমীক্ষক তিয়াসা আঢ্য এবং স্থানীয় বন্যপ্রাণ   সংরক্ষণ   আন্দোলনের কর্মী ইন্দ্রজিৎ আদকের সহায়তা পেয়েছেন   আকাঙ্খারা।   তাঁরা কলবাঁশ গ্রামের বাঘরোল বাসা তে   অনেকদিন থেকেও ছিলেন এই কাজের জন্য।

২০১৯ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওয়াইল্ড চ্যানেলে Wild Cats of India এই সিরিজে ভারতের

ট বিড়াল প্রজাতির প্রাণীদের ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক নানা প্রতিকূলতায় কিভাবে বেঁচে রয়েছে তা নিয়ে তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়েছিল। এই তথ্যচিত্রটির একটি এপিসোড ছিল Master of Disguise, সেখানে পশ্চিমবঙ্গে বাঘরোলের বেঁচে থাকা নিয়ে দেখাতে গিয়ে হাওড়া জেলার পাঁচলা থানার দেউলপুর গ্রামে বাঘরোল নিয়ে কাজ করা শুভজিৎ মাইতির সঙ্গে রাতে থেকে ইনফ্রারেড ক্যামেরাতে বাঘরোলের গতিবিধির ছবি তুলেছিলেন বন্যপ্রাণী ফটোগ্রাফার সন্দেশ কাদৌর। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে এই তথ্যচিত্রটি বিশ্বজুড়ে এবং ২৮ শে ফেব্রুয়ারি এটি Disney+ Hotstar ওটিটি প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচারিত হয়।

  • বাঘরোল নিয়ে গবেষণা, পত্রপত্রিকায় লেখালেখি, বই প্রকাশ, সেমিনার ও প্রকল্প নির্মাণ করা যেতে পারে। পরিবেশবিদ প্রদীপ রঞ্জন রীত ছোটদের জন্যে লিখেছেন পরিবেশের ছড়া নামক বই। এতে ফিসিং ক্যাট নামে ছড়া আছে। আরো এরকম ছড়া লেখা যেতে পারে। বাঘরোল কে নিয়ে কোন ভালো বাংলা বই নেই, তাই সে নিয়েও গবেষক ও লেখকরা ভাবতে পারেন। অঙ্কন শিল্পীরা ছবি এঁকে পোস্টার বানিয়ে বার্তা দিতে পারেন। নিউজ চ্যানেলে বাঘরোল-কে নিয়ে প্রতিবেদন হচ্ছে, আরো বাড়ানো যেতে পারে।

৪। সচেতনতা কর্মসূচী পরিবেশ সংগঠনের ভূমিকা

  • বাঘরোল সহ বহু বিপন্ন বন্যপ্রাণীর স্বাভাবিক আবাসস্থল জলাভূমির গুরুত্ব ও সংরক্ষণ করা নিয়ে মানুষকে সচেতন করা যেতে পারে।
  • বাঘরোলের পরিচিতি, বাঘ ভীতি সহ বিভিন্ন ভুল ধারণা নিরসন ও বাঘরোলের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা কর্মসূচী গ্রহণ করা যেতে পারে।
  • বাঘরোল সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী হত্যা রুখতে প্রচার ও নজরদারি চালানো করা যেতে পারে।
  • স্কুল, কলেজ, পাড়ায় পাড়ায় প্রোজেক্টার, ছবি, পোস্টার, ব্যানার সহযোগে সচেতনতা শিবিরের আয়োজন – স্বেচ্ছাসেবী ও পরিবেশ সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে।

হাওড়া জেলার আমতা ১ ও ২ ব্লক, পাঁচলা, শ্যামপুর ১ ও ২, বাগনান ১ ও ২, জগৎবল্লভপুর এবং উদয়নারায়ণপুর ব্লকের বিস্তীর্ণ জলাজঙ্গল এলাকায় এখনও ভালো পরিমাণে রয়েছে এই বাঘরোল। ২০১২ সালের পর থেকে আমতায় প্রদীপ রঞ্জন রীত মহাশয়ের নেতৃত্বে গ্রিন চেন মুভমেন্ট এবং ২০১৭ সাল থেকে জেলা জুড়ে হাওড়া জেলা যৌথ পরিবেশ মঞ্চ নামক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মিলিত প্রচেষ্টায় সচেতনতা শিবির, স্কুলে স্কুলে ক্যুইজ, লিফলেট বিলি, প্রচার অভিযান, মৃত ও আহত বাঘরোল উদ্ধার ইত্যাদির সুফল হিসাবে বাঘ ভেবে একে মেরে ফেলার ঘটনাগুলো আগের থেকে অনেকটাই কমেছে। তবে এখনও অনেক সচেতনতার প্রয়োজন দীর্ঘদিনের ভ্রান্ত ধারণা মুছে বাঘ ও বাঘরোলকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলাদা করে চেনা এবং একে সংরক্ষণ করার কাজে সাফল্য পাওয়ার জন্য।

৫। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার

  • সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে বাঘরোল সংরক্ষণ, জলাভূমি সংরক্ষণ নিয়ে জনমত তৈরি, সচেতনতা বৃদ্ধি, আলোচনা, ভ্রান্তি দূর করা ইত্যাদি কাজে বিশেষ দল নির্মাণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রেও বিভিন্ন সংগঠনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে Fishing Cat Conservation Alliance নামে যৌথ মঞ্চ তৈরি করে ২রা ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস কে স্মরণে রেখে গোটা ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাঘরোল নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে Fishing Cat February পালন করা হচ্ছে ও #FishingCatFebruary ক্যাম্পেন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করা হচ্ছে। এটা একটা ভাল দিক।

 

  • ওয়েব পেজ, ইউটিউব ভিডিও, ফেসবুক লাইভ, অনলাইন ক্যুইজ করে এ বিষয়ে চর্চা যত বাড়ানো যাবে ততোই মানুষ এই প্রাণীটিকে জানবে, বুঝবে ও ভুল ধারণাগুলো ভাঙবে।

শেষ দশ বছরে হাওড়া জেলা সহ গোটা বিশ্ব জুড়েই বাঘরোল চর্চা, বাঘরোল সংরক্ষণ ও গবেষণায় জোয়ার এসেছে। হাওড়া জেলায় বাঘরোল নিয়ে কাজ করতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলি একেবারে মাঠে নেমে কাজ করছে। স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যেও সচেতনতা জাগছে। তাই আমরা আশা করতেই পারি, সামনের দিনগুলোতে আমরা আমাদের রাজ্যপ্রাণীকে বিকল্প পথের সন্ধান করে বাঁচাতে সফল হব। আর যদি না পারি, ক্ষতি আমাদেরই।

 

সমাপ্ত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *