চলমান যানবাহনের কথকতা

সুকান্ত মুখোপাধ্যায়
আমাদের নিত্যকার জীবনে কত বিচিত্র জিনিসেরই না দেখা মেলে। এই যেমন বাস, মিনিবাস অটো, ট্যাক্সি, রিক্সা, আধুনিক টোটো এইসব নানা ধরনের যানবাহনের পেছনে লেখা থাকে নানাজাতের লিপি যার মাধ্যমে দৈনন্দিন ক্লান্তিকর জীবনে মেলে একটু হাসির রসদ। ‘দেখবি R জ্বলবি, লুচির মত ফুলবি’ কিংবা ‘ পিছু ধোরনা কিছু পাবেনা’ এইজাতীয় বাক্যবন্ধ মনে ভাবনা জাগায় সত্যিই তো এইসব লেখার পেছনে কারা আছে বা কোন ভাবনা কাজ করছে। শুধু লেখাই নয় বিশেষ কিছু শব্দবন্ধও জড়িয়ে থাকে এই পেশায় যুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে। থাকে নানা ধরনের ছবি। সে Danger, Keep Safe Distance এর দু’পাশেই হোক বা বৃষ্টির জল আটকাবার জন্য পিছনের ঝুলন্ত দুই রবারের ফালির ওপর। দুটো হাড়ের ওপর কঙ্কালের মাথা বা বিকট দানবের মুখ, উড়ন্ত ঈগল বা বাজপাখি এসবই আমাদের নিত্যকার যাতায়াতের পথে চোখে পড়ে। তবে যা মন টানে তা হল নানাজাতের হরেক কিসিমের ছড়া, কবিতা, গানের লাইন, জ্ঞানদায়ক বাণী বা উপদেশ বা নিছকই কাব্য।
কিছু লেখা ভাড়া, মালিক বা গাড়ি সংক্রান্ত যেমন —
‘দিচ্ছি দিচ্ছি করবেন না’ (অর্থাৎ ভাড়াটা তাড়াতাড়ি মিটিয়ে দিন)
‘রাগ করলে হবে সোনা
জল বাদে সবই কেনা’
‘মানুষ আপন টাকা পর
যত পারবি মানুষ ধর’ (বেশি প্যাসেঞ্জার, সেল, বেশি কমিশন)
‘ফুল হ্যায় গোলাপ কি খুশবু দিজিয়ে
গাড়ি হ্যায় মালিক কি ভাড়া দিজিয়ে’ ( মালিকের কাছে ভাড়া গোলাপের সুগন্ধের মত তাই উঠেই ভাড়া দিয়ে দিন)
‘পান বিড়িতেও খরচা হয়
হিসাব রাখি কি
যত ঝঞ্জাট বাস ভাড়াতে
বিবেক বলে কি’ ( দার্শনিক উক্তি বটে)
‘সেল বেশি আয় কম
কভি খুশি কভি গম’ (হিন্দী গানের লাইনকে ব্যবহার করে লেখা)
‘ডিজেলের দাম লাফিয়ে বাড়ে
তার ওপরে সেস
এইভাবে চলে চলে মালিক হল শেষ’ (অসামান্য যুক্তি)
‘আমি আপন তুমি পর
যত পারিস আমায় ধর'( গাড়িই প্যাসেঞ্জারের ঈশ্বর। দর্শন করতে গেলে তো গাড়িতে চাপতেই হবে)
‘বাগানের ঝরা ফুল আকাশের তারা
আমি কি থাকতে পারি তোমাকে ছাড়া'( প্যাসেঞ্জার ছাড়া কি গাড়ির রোজগার হয়)
‘কচ্চি কি রাণী পিচ কে রাজা
মালিকসে মিলনা হ্যায় তো গাড়ি মে আ যা’ (মালিক কখনো গাড়িতে থাকেই না তার দেখা মিলবে কোথায়)
‘প্যাসেঞ্জার লক্ষ্মী ড্রাইভার পেঁচা
যে যা বলে বলুক, কন্ডাক্টর তুই চেঁচা'( প্যাসেঞ্জার চিরকালই তাড়া দেবে পাত্তা দিলে কি চলে)
লরির পেছনে আবার একটু অন্যরকমের লেখা–
‘মালিক কা দৌলত ড্রাইভার কা পসিনা
চলতি হ্যায় গাড়ি রোড পে, মহব্বত কি হাসিনা’
‘তোমার ডিজেল আমার জল
যেথা ইচ্ছা সেথা চল'( ডিজেল তো প্যাসেঞ্জারের পয়সায় কেনা গাড়ি চলবে ড্রাইভারের মর্জিমাফিক রুটে)
‘বন্ধুত্ব বাড়িতে ব্যবসা গাড়িতে’ ( হক কথা)
‘যতই করবি চালাকি
পরে বুঝবি জ্বালা কি’ (ড্রাইভার কন্ডাক্টরদের সাথে ঝামেলা করলে রক্ষা আছে)
‘ঝর্ণা ঝরে পড়ে পাহাড় থেকে
আকাশ থেকে নয়
খাতির রেখ আমার সাথে
গাড়ির সাথে নয়'( গাড়ি তো মডেল পাল্টাবে কিন্তু মালিক ড্রাইভার, কন্ডাক্টর চিরকাল ছিল আছে থাকবে)
কোন কোন লেখায় আছে সামাজিক বার্তা —
‘কন্যাসন্তান ঈশ্বরের দান তাকে হত্যা করা মহাপাপ’
‘ পোলিও রবিবার শিশুকে খাওয়াবার’
আবার গ্রীক ভাষাতেও লেখা দেখা গেছে হাওড়া বাগুইআটি রুটের বাসের পেছনে —
‘ইফ সারি সতো’ ( অর্থ হল ওয়েলকাম)
প্রিয় খেলোয়াড় বা দলের নামের বার্তাও আছে বৈ কি —
‘বাঘ একটাই রয়্যাল বেঙ্গল
দল একটাই ইস্টবেঙ্গল’
কিছু কিছু লেখায় আছে নির্মোহ উপদেশ বা বিয়োগ ব্যথার কথা —
‘ওরে পাগলা মা কি তোর একার’
‘যাহা আয় তাহাই ব্যয়’
‘মা টাক দিয়েছ আ–কার দাওনি’
‘স্মৃতি তুমি বেদনার’
‘কৃষ্ণ বল সঙ্গে চল’
‘দেখবি আর জ্বলবি
লুচির মত ফুলবি
পছন্দ হলে বলবি’
মাজুতে মুন্সীরহাট থেকে পাঁচারুলগামী এক ট্রেকারের গায়ে লেখা দেখেছিলাম মোক্ষম এক বাণী —
‘মহাতীর্থ তারাপীঠ
গাড়ি চলে তিন ট্রিপ’
আর এক মোক্ষম উক্তি লেখা ছিল ধূলাগড় — হাওড়া রুটের এক বাসের পিছনে —
‘যতই করো হাই ফাই
হাওড়া ছাড়া গতি নাই’
দার্শনিক লেখাও অনেক রকমের আছে —
‘গাছের পাতা সবুজ
ফুলের রং লাল
তোমার আমার ভালবাসা
থাকবে চিরকাল’
বেহালা ট্রামডিপোয় এক অটোয় লেখা ছিল —
‘ দিন যায় কথা থাকে মনে
তবু তুমি মনে রেখো
তুমি আসলে একা’
‘বেঁচে থাকা তোমায় ছাড়া
আমি হারাব জীবনের ধ্রুবতারা’
ট্যাঙ্কারের পিছনে অদ্ভুত এক লেখা —
‘জন্ম থেকেই জ্বলছি’
প্রেম ভালবাসাও বাদ যায়না মোটেও —
ডোমজুড় হাওড়া রুটের এক মিনিবাসের পেছনে লেখা দেখেছি —
‘শিশিরে কি ধান হয় জল না দিলে
দূর থেকে কি প্রেম হয় কাছে না এলে’
‘মনটা দিলাম আমার
মন পেলাম কি তোমার’
‘স্যাকরাকো সোনা দিয়া গয়না বানা দিয়া
শিবানী কো দিল দিয়া লুট লে গিয়া'( কে শিবানী কার দিল লুট করেছে জানার কোন উপায় নেই)
রিক্সার পেছনে সাধারণত ছেলে মেয়ে বা নিকট আত্মীয়স্বজনের নাম, দেব দেবীর নাম বা সিনেমার গানের লাইন লেখার আধিক্য থাকলেও কাব্যও আছে বৈ কি —
‘যেতে পারি কেন যাব
কলকাতার সেবায় রব'( শক্তি চট্টোপাধ্যায় দেখলে নির্ঘাৎ ভিরমি খেতেন)
আজকাল টোটোর পেছনে নানা লেখার সঙ্গে টোটোওয়ালারদের মোবাইল নম্বর দেওয়ার চল হয়েছে।
আমার সেই বন্ধু প্রায়ই একটা কথা বলত যে একটা বাস চালাতে গেলে উনিশ রকমের ঝক্কি পোহাতে হয়। কি রকম?
তার ভাষাতেই বলি —
‘দাদা, চাঁদা, মস্তান
থানা, পুলিশ, কোর্ট
ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, খালাসি
ট্যাক্স,ইনসিওরেন্স, পারমিট, সি.এফ,
সিন্ডিকেট, ইউনিয়ন,ফান্ড,পেটি
নেতা, নেতার বউ’।
সিন্ডিকেট মানে হল প্রতিটা বাসের রুটে দুটো করে ঘর থাকে একটা যেখান থেকে ছাড়ে আর আরেকটা যেখানে যায়। সেখানে মাইনে করা লোক থাকে যারা ঠিক করে কোন বাস কটায় ছাড়বে। এর ব্যবস্থা সব বাসমালিক মিলেই করে থাকেন নাহলে তো সময়ের হুঁশজ্ঞান থাকবে না। ফান্ড হল নিজেদের বিপদে আপদে যাহায্য করার জন্য নির্ধারিত দৈনিক চাঁদা আর পেটি ব্যাপারটা অদ্ভুত। প্রতিটি বাসের, মিনিবাসের গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য সময় বাঁধা থাকে। যেমন ধরা যাক আমাদের রামরজতলা থেকে হাওড়া যেতে একটা বাসের সময় বেঁধে দেওয়া আছে বাইশ মিনিট। তা তো আর হয় না। বাস তো ছাড়ার পর থেকেই ঢিকিস ঢিকিস করতে করতে একবার নতুন রাস্তায়, একবার দালালপুকুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বত্রিশ মিনিটে হয়ত হাওড়া পৌঁছাল। এই যে দশ মিনিটের অপব্যয় এর জন্য প্রতিটি বাসকে ফাইন দিতে হয় একটা নির্দিষ্ট হারে। সেই ফাইন জমা হয় পেটিতে। নিয়ম অনুযায়ী একটা বাসের লেট ফাইনের টাকা পরের বাসের প্রাপ্য।
বেশ ‘পেটি’ও নাহয় বোঝা গেল আর নেতা তো সহজেই বোঝা যাচ্ছে কিন্তু নেতার বউ আসছে কোথা থেকে! কেনই বা! ” বাহ সারা বছর বাস চালাচ্ছ, দু’হাতে কামাচ্ছ আর পুজোর সময় নেতার বউ বউদিকে একখানা শাড়ি দেব না তা কি হয়”! বন্ধুর জবাব। তা বছরভোর এইসব দিয়ে থুয়ে কি হাতে কিছু থাকে না লবডঙ্কা! নিশ্চয়ই থাকে নাহলে একই মালিকের চার পাঁচখানা বাস হয় কি করে! হ্যাঁ তবে লকডাউনের পর অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। বহু কর্মচারী বেকার হয়ে পড়েছেন, মালিকদের অবস্থাও সঙ্গীন তাই অনেক ড্রাইভার কন্ডাক্টর বাস ছেড়ে টোটো চালানোয় বেশি করে মন দিয়েছেন। বাসের সংখ্যা অনেক কমেছে।
যে কোন বেসরকারী বাস মিনিবাসে কমপক্ষে চারজন থাকেই। ড্রাইভার — তাদের পদমর্যাদা সবসময় একটু উঁচুতে, তাই টার্মিনাসে বাস ঢুকিয়ে তাঁরা হয় ঘুমোতে যান নয়তো তাসের আড্ডায় বসে যান পরের টার্ন না আসা,পর্যন্ত। বাসের বেলায় দু’গেটে দু’জন কন্ডাক্টর, একজন খালাসী আর মিনিবাসের বেলায় একজনই কন্ডাক্টর। এদের নিজস্ব ভাষা ইঙ্গিত আছে — ওভারটেক করার, গতি কমাবার বা পিছনের বাসকে এগিয়ে দেবার। দিনের শেষে যা টিকিট বিক্রি হয়েছে দুই গেটে সব জড়ো করে হিসেব কষা হয়। বিক্রির হার অনুযায়ী ড্রাইভার কন্ডাক্টর আর খালাসীদের কমিশন নির্ধারিত হয়। মালিকের হাতে তুলে দেবার আগে এই টাকার অঙ্কটাকে বাসীয় ভাষায় বলে ‘বাতচিত’। এই ‘বাতচিত’ এর ওপরেই দাঁড়িয়ে থাকে বাস মিনিবাসের ভবিষ্যৎ তাই এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকাই অলিখিত নিয়ম।
যাত্রার শুরুর দিকে মানে ভোরবেলা, দুপুরবেলা, সন্ধ্যাবেলা বা শেষ ট্রিপে বড়বাজার শুধু নয় নানা জায়গাতেই মাল তোলার চল আছে। মাল মানে কাপড়জামার বস্তা, ফুলের বস্তা, অন্য কোন লটে কেনা সামগ্রী এইসব বাসে করে আনলে ক্রেতাদের অনেকটাই সুরাহা হয় যদিও এটা একেবারেই আইনসিদ্ধ নয়। এই যে ভাড়ার টাকা এর পুরোটাই ড্রাইভার, কন্ডাক্টর আর খালাসীদের প্রাপ্য। মালিক জানতেই পারে না দৈনিক কত টাকার মাল তোলা হয়েছে। আর সত্যি বলতে কি জানতে চেয়ে তো লাভ নেই। কেউ সঠিক অঙ্কটা বলবে না। আশ্চর্য ব্যাপার কোন খাতাপত্তর নয় পুরো হিসেবটাই মাথায় রাখা হয় আর বাতচিত দেবার আগে ওই টাকাটা সরিয়ে রাখা হয় নিজেদের হেফাজতে।
ট্যাক্সি, রিক্সা বা টোটোর ক্ষেত্রে ‘জমা’ পদ্ধতি আছে। যাদের নিজেদের গাড়ি নেই তারা অন্যদের কাছ থেকে দৈনিক ভাড়ায় গাড়ি নিয়ে সারাদিন চালাতে পারেন, এক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট টাকা দিনের শেষে মালিককে দিতে হয়। ট্যাক্সি বা টোটোর ক্ষেত্রে যেমন ছ’শো এবং তিনশো। অর্থাৎ যিনি ভাড়া নেবেন তিনি সব খরচ খরচা বাদে ওই জমার টাকা মালিককে দিয়ে দিলে বাকী যা রোজগার হবে সেটা তাঁর নিজের।
মোটামুটি এই গেল যানবাহনের সংক্ষিপ্ত কথকতা। এখানেই শেষ নয় অবিশ্যি আরও বেশকিছু অজানা বিষয়ও আছে তবে কথকতা আর দীর্ঘায়িত করলে যেসব বিষয় আসবে তা না লেখাই ভাল। অতএব এখানেই ইতি টানা যাক।