August 21, 2025

সুরাসুরে রাবন

সঞ্জীব মুখোপাধ্যায়

 

“Myths can’t be translated as they did in their ancient soil. We can only find our own meaning in our own time.”

 

বাঙালীদের বর্ষশ্রেষ্ঠ এবং পক্ষব্যাপী প্রধান উৎসব দুর্গাপূজার আনন্দমুখরিত দিনগুলি কেমন যেন চোখের পাতা ফেলতে না ফেলতেই কেটে গেলো, তার একটু টেরও পাওয়া গেলো না। মনে হচ্ছিলো ‘ইস যদি আরো কটা দিন পেতাম, তবেই যদি আনন্দ উপভোগের মাত্রাটি পূর্ণতা লাভ করতো, এমনই মন এবং বিচারাধারার অধিকারী আমরা বাঙালীরা।  যদিও প্রতি বছর এমনটাই হয়ে থাকে, কিন্তু চাওয়ার তো আর শেষ নেই আর নেই কোনো সীমানা এ তো গগনের মতো অসীম অশেষ, আর সব চেয়ে বড় কথা হলো চাইলেই যে সব আশা আকাঙ্খা সবসময় পূরণ হবে তারও তো কোনো মানে নেই। তবে হ্যাঁ, দুর্গাপুজো যেতে না যেতেই আসন্ন কালীপূজা এবং ভাইফোঁটার আনন্দমিশ্রিত দিনগুলির অপেক্ষা এবং আশ্বাস যেন দুর্গাপুজোর দিনগুলির কেটে যাওয়ার বিষাদের উপর যেন কিছুটা হলেও একটা হাল্কা বেদনাপ্রশমনকারক মলমের মতো কাজ করে। এই দুর্গাপূজা এবং কালীপূজা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্যান্য রাজ্যগুলিতে ও অল্পবিস্তর হয়ে থাকে। সারা দেশ জুড়ে এই পূজাগুলির উৎসব সমসাময়িক এবং সার্বিকভাবে পালিত হলেও কিন্তু এই উৎসবগুলির পদ্ধতিগত ধ্যানধারণা, রীতিনীতি এবং সংস্কৃতিতে কোথাও না কোথাও কোনো না কোনোভাবে কিছু তারতম্য কিন্তু বদ্ধমূল। আজ আমি আপনাদের সামনে তারই আলোচনা করবো আর তার সঙ্গে এসবের সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক এবং বিরল একটি ঘটনার কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরবো যা আপনাদের সকলকে আশ্চর্যচকিত করে দেবে।

পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা মহালয়ার দিন থেকে শুরু হলেও পূজার আসল উৎসবের দিনগুলি সপ্তমী থেকে দশমী পর্যন্ত চারটি দিন। কিন্তু উত্তরভারতের রাজ্যগুলিতে বিশেষ করে দিল্লী, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব, গুজরাট, ইত্যাদি রাজ্যগুলিতে কিন্তু একটানা নয় দিন ধরে একই তীব্রতার সঙ্গে এই দুর্গাপূজার উৎসব পালিত হয় যাকে এই রাজ্যগুলিতে “নবরাত্রি” বলে অভিহিত করা হয়। কেউ কেউ আবার একে “নবরাত্রা” বলেও ডাকে। এই “নবরাত্রি” পশ্চিমবঙ্গের মতো মহালয়ার পর দিন থেকে শুরু হয় এবং নয়টি রাত্রি ব্যাপী অর্থাৎ নবমী পর্যন্ত পালিত হয় তাই এই উৎসবের নাম “নবরাত্রি”। আমাদের রাজ্যে দুর্গাপূজার এই দিনগুলিতে রসনা পরিতৃপ্ত করার জন্য আমাদের ঘরে ঘরে মাছ মাংসের নানান ধরণের পদ রান্না করে পরিবেশিত হয় আর তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্নের ছড়াছড়ি তো থাকেই, শুধু ঘরেই নয়, আমরা এই দিনগুলিতে পূজার মণ্ডপগুলিতে ঘুরতে ঘুরতে কতকিই না খেয়ে থাকি। কিন্তু উত্তর ভারতের এই রাজ্যগুলিতে রাজ্যবাসীরা এই নয়টি দিনের উৎসব অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এবং ধার্মিক ভাবে পালন করেন, সকল প্রকার আমিষ খাবার যথা মাছ, মাংস, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন, ইত্যাদি কঠোরভাবে বর্জন তো করেনই এমন কি সাধারণ চাল, ডাল, আটা, ইত্যাদিও পর্যন্ত ব্যবহার করেন না, এই দিনগুলিতে গমের আটার বদলে ব্যবহার করেন ‘কুটু’ নামক একটি শস্যের আটা, ধানের চালের বদলে ব্যবহার করেন এক ধরণের ঘাসের বীজ যাকে বলা হয় ‘সাওয়া চাল’ আর এগুলির সাথে চলে নুনহীন আলুর পাঁপড়, রোস্ট করা শালুকফুলের বীজ দিয়ে তৈরী গুড়ের নাড়ু ইত্যাদি সহযোগেই তাঁরা এই নয়টি দিন কাটান। আপনারা হয়তো অনেকেই ভাবছেন যে তাহলে উত্তর ভারতের এই রাজ্যবাসীদের কাছে এই “নবরাত্রি”-র ব্যাপারটা উৎসবের না শাস্তির। এঁদের কাছে খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা এরকম হলেও এই রাজ্যগুলিতে তৃতীয়া থেকে নবমী পর্যন্ত সাত রাত্রি ধরে যেখানে যেখানে বড় ফাঁকা মাঠ আছে সেখানে সেখানে অনুষ্ঠিত হয় “রামলীলা”, প্রতি রাত্রিতে মঞ্চস্থ হয় রামায়ণের একটি করে কান্ড, এইভাবে সাতটি রাতে সাতটি কান্ড নাটকের মতো অভিনয় করে প্রদর্শিত হয় আর তা দেখার জন্য রাজ্যবাসীদের এতই ভিড় হয় যে রামলীলা ময়দানগুলিতে তিল ধারণের জায়গাও থাকে না।  নবমীতে রামায়ণের সবকটি কান্ড হয়ে গেলে দশমীর রাত্রিতে ওই রামলীলা ময়দানে বাঁশ, কাঠ, পুরু কাগজ, দড়ি, আতশবাজী, ইত্যাদি দিয়ে নির্মিত দশ মস্তক সম্পন্ন একটি অত্যন্ত উচ্চতা বিশিষ্ট রাবনের প্রতিকৃতির উপর অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করে দহন করা হয়।  যখন রাবন পোড়ে তখন রাবনের প্রতিকৃতির মধ্যে উপস্থিত আতশবাজী গুলি ও ফাটতে থাকে আর তাতে যে দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা সত্যিই নয়নাভিরাম। আপনাদের অনেকেই হয়তো চলচ্চিত্রে এই ধরণের দৃশ্য দেখে থাকবেন, তবে এটাই উত্তর ভারতের প্রথাগত সংস্কৃতি।

পরমশক্তি দেবী দুর্গার আরাধনার কয়েকদিন পরে ঠিক একই ভাবে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গ যখন আর একটি মহাশক্তির আরাধনায় মেতে ওঠে, সব কিছু ভুলে নানান রূপে আবির্ভাবী শুম্ভ, নিশুম্ভ এবং রক্তবীজ নামক অপরাজেয় অসুরদমনি মা কালী, মা শ্যামা, ইত্যাদির পূজার আয়োজনে সবাই নিজেদের লিপ্ত করে ফেলে ঠিক ওই দিন উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে এই পর্বটি প্রচন্ড তীব্রতার সঙ্গে পালিত হয় “দিওয়ালি” অথবা “দীপাবলি” নামক উৎসবের মধ্যে দিয়ে। কথিত আছে ঐদিন শ্রীরামচন্দ্র রাবনকে বধ করে লঙ্কা বিজয় করে অযোধ্যাতে ফিরে আসেন আর তাঁর ফিরে আসার ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে এবং ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে স্বাগতম জানানোর জন্য এই রাত্রিটি একটি আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন করা হয়, ঘরে ঘরে ঘিয়ের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করা হয় আর তার সঙ্গে পূজন করা হয় দেবী লক্ষ্মীর।

এই ঘটনাগুলির কথা বলতে গিয়ে এবং অসুররাজ রাবনকে নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এবার আমাকে সেই ঘটনাটির কথায় আসতে হয় যা আপনাদের অনেকেই হয়তো অবাক করে দেবে। আপনারা হয়তো অনেকেই মনে করেন যে রাবনের জন্ম কোথায় হয়েছিল? আমি আপনাদের বলি রাবন লঙ্কাতে তাঁর সাম্রাজ্য স্থাপন করলেও তিনি কিন্তু ছিলেন আপাদমস্তক ভারতীয়, অবশ্য সেটা জন্মসূত্রেই।  পুরানে বর্ণিত আছে যে দিল্লীর সন্নিকটে নোয়েডা এবং গ্রেটার নোয়েডার মাঝখানে অবস্থিত “বিসরাখ” নামক একটি গ্রামে রাবন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শুধু তাই নয়, রাবনের জন্মের পর তাঁর ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ এবং ভগিনী সূর্পণখা ও এই বিসরাখ গ্রামটিতেই জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। শোনা যায় যে বিখ্যাত মুনি শ্রী বিশ্রভা যিনি রাবনের পিতা ছিলেন তিনি ভগবান শিবের তপস্যা করার জন্য এই গ্রামে একটি সুবিশাল শিবলিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন এবং শিবের আরাধনা করার জন্য এই গ্রামে থাকতেন, তাঁরই নামানুসারে “বিসরাখ” নামে এই গ্রামটির নামকরণ করা হয়। পুরানে এও বলা আছে যে রাবন এবং তাঁর ভাই কুম্ভকর্ণের শৈশব “বিসরাখেই” কেটেছিল। একটু বড় হওয়ার পর দুই ভাই মিলে এই গ্রামেই শিবের তপস্যা করেন এবং তপস্যায় ভগবান শিবকে সন্তুষ্ট করে তপস্যার ফলস্বরূপ তাঁরা লঙ্কা নামক স্বর্ণমন্ডিত দেশটিকে নিজের দখলে পেয়ে যান। সেই সময় লঙ্কার রাজা ছিলেন রাবনের বৈমাত্রেয় ভাই কুবের। কিন্তু ভগবান শিবের বরে বলীয়ান হয়ে রাবন এবং কুম্ভকর্ণ দুই ভাই মিলে কুবেরকে লঙ্কা থেকে বিতাড়িত করেন এবং রাবন লঙ্কাকে তাঁর নিজের সাম্রাজ্য বলে ঘোষণা করেন। বিসরাখ গ্রামটি আজও সত্যিকারে বিদ্যমান এবং সেখানে স্থাপিত তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট শিবলিঙ্গটি একটি বিশাল মন্দিরে আজও বিদ্যমান। কয়েক বৎসর পূর্বে ভারতের পুরাতাত্ত্বিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এই শিবলিঙ্গটির রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে চারপাশে খনন করে তাতে বহু পুরাতন যুগের ধাতব মুদ্রা, বেশ কিছু বিরল ইঁট এবং একটি অদ্ভুত গুহার সন্ধান মেলে। আর সব চাইতে কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হলো যে শিবলিঙ্গটির উচ্চতা মাটির উপর তিন ফুট হলেও লিঙ্গটির দৈর্ঘ্য মাটির নিচে প্রায় ৮ ফুটের মতো। বিসরাখ গ্রামে গেলে আজও সেখানে দেখতে পাবেন অসুররাজ রাবনের স্মরণার্থে “নবরাত্রিতে” কোনো মেলা খেলা হয় না, কোনো রামলীলা অনুষ্ঠিত হয়না আর রাবনের প্রতিকৃতিকে দহন ও করা হয় না, বরং এখানে অসুররাজ রাবন শ্রদ্ধার সঙ্গে পূজিত হন।  অবাক লাগছে, তাই না? আমাদের জীবনে এইরকম অনেক ঘটনার কথা আমরা শুনতে পাই অথবা আমাদের সামনে ঘটে দেখি, কিন্তু এর পিছনে কি যুক্তি কি তর্ক তা আমরা খুঁজে দেখার চেষ্টা করিনা বা খোঁজার চেষ্টা করলে বিফল হই। শেষপর্যন্ত সেগুলিকে আমাদের ধার্মিক বিশ্বাসমূলক মনস্তত্বের উপরই ছেড়ে দিই, সারাক্ষন শুধু ভাবি যে এটাই সত্যি, এটাই বাস্তব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *