August 21, 2025

মসির ধারায় অসির ধার (38)

সঞ্জীব মুখার্জী 

 

“There will be no withdrawal of troops without written orders and these orders shall never be issued.”                

                                                                      -Field Marshal Sam Manekshaw

 

জুলাই মাসের শেষের দিকে কারগিলের যুদ্ধে ইতি টানার পর হয়তো সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং সামাজিক জীবনযাত্রা পূর্বাবস্থায় এসে স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়ে গিয়েছিলো, কিন্তু যে পরিমান ক্ষয়ক্ষতি এ যুদ্ধের পরিনাম হিসাবে আমাদের দেশকে বহন করতে হয়েছিল তা পূরণ করতে অনেক বেশি সময় লেগে গিয়েছিলো।  সামরিক এবং জৈবনিক ক্ষয়ক্ষতি পাকিস্তানের ও তো কম কিছু হয়নি।  শুধু তাই নয়, পাকিস্তানকে উপরোক্ত ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া আর একটি যে বড় ধাক্কা লেগেছিলো তা হলো পাকিস্তানকে চুক্তিভঙ্গ করে এবং নিয়ন্ত্রণ রেখাকে উল্লঙ্ঘন করে ভারতের মাটিতে অনুপ্রবেশকারীদের পাঠিয়ে তাদের দুরভিসন্ধিকে সিদ্ধ করার প্রচেষ্টার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্তরে সমালোচনা এবং তীব্র নিন্দার সম্মুখীন হতে হয়, বিশেষ করে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিন্টন পাকিস্তানের এই কার্যকলাপের জন্যে তীব্র সমালোচনা করেছিলেন।  সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্থ, অস্ত্র এবং উপকরণের ক্ষয়ক্ষতি আবার পুনরুদ্ধার করা যাবে কিন্তু দেশরক্ষার্থে যে সমস্ত বীর সৈনিক তাদের শেষ রক্তবিন্দুটি দিয়েও লড়ে গিয়েছেন শত্রুনাশের অঙ্গীকারকে বাস্তবায়িত করতে, এমন কি যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে এতটুকু কুন্ঠা বোধ করেননি তাঁরা, তাঁদের ক্ষতিপূরণ কি কোনো বস্তুবাদী অথবা পার্থিব মূল্যের বিনিময়ে সম্ভব?  সেটা হয়তো সম্ভব না হলেও একটা কথা তো অনস্বীকার্য যে শত্রুর কবল থেকে দেশকে মুক্ত করে অক্ষত অবস্থায় দেশ কে দেশবাসীর হাতে তুলে দেওয়াটা আমাদের প্রাথমিক দায়ীত্ব এবং কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে, তাই এ দায়ীত্ব এবং কর্তব্য পালনার্থে যদি প্রাণ পর্যন্ত বলিদান করতে হয় সেটা একজন সৈনিকের কাছে বড় কিছু ব্যাপার নয়।  পাক সেনা সমর্থিত অনুপ্রবেশকারীদের শেষ ব্যক্তিটির আমাদের হাতে হয় বধ না হয় নিয়ন্ত্রণ রেখার অপর পারে তার বিতাড়নের ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে সুনিশ্চিত করে আমাদের পোস্টগুলিকে আবার আমাদের দেশের সামরিক প্রথাগতভাবে অস্ত্রে, সৈনিকে এবং যুদ্ধোপকরণের দ্বারা সুসজ্জিত করতে আরো সপ্তাহ দুয়েক অতিবাহিত হয়ে গেলো।  পাক অনুপ্রবেশকারীদেড় একটি ব্যক্তি তো অনেক দূরের কথা, এমনকি তাদের ছেড়ে যাওয়া শেষ খড়কুটোটি পর্যন্ত আমাদের কোনো পোস্টে অবশিষ্ট না থাকে তারও সুনিশ্চিতকরণ আমাদের দেশের সেনাবাহিনী করেছিল।  তবে কারগিলের যুদ্ধ একদিকে যেমন আমাদের বহুমুখী ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছিল অন্যদিকে তেমনি আমাদের দেশের সামরিক ব্যবস্থার কাছে একটি বহুমূল্য শিক্ষার ও উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল।  যে সমস্ত ভুল বা ত্রুটি আমাদের সেনাবাহিনী জেনেশুনে অথবা অজান্তে করেছিল সেগুলির থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই ভুল গুলিকে শুধরে নিয়ে সেগুলির যেন ভবিষ্যতে আর কখনো পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে অতিরিক্ত ভাবে সজাগ থাকার সুশিক্ষা এ যুদ্ধ আমাদের দিয়ে গেলো।  যুদ্ধের পূর্বে খালি করে দেওয়া আশপাশের গ্রামের বাড়িগুলিতে ততদিনে আবার ফিরতে শুরু করেছে গ্রামবাসীরা।  উভয় দেশের মধ্যে বোমা বিনিময়ের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামবাসীদের ও কম হতে হয়নি, কত লোকের ঘরের ছাত উড়ে গিয়েছে, আংশিক অথবা পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে কত গ্রামবাসীদের বাড়ি তার কোনো ইয়ত্তা নেই। সরকারী অনুদানে মেরামত করে সেগুলিকে পুনরায় বাসযোগ্য করে তবে সেগুলিকে তুলে দেওয়া হয় নিরীহ নির্দোষ গ্রামবাসীদের হাতে। পাক অনুপ্রবেশকারীদের হাত থেকে আমাদের পোস্টগুলিকে পুনরুদ্ধার করা কালীন আমাদের সেনাবাহিনী সেই সমস্ত পোস্টগুলি থেকে বাজেয়াপ্ত করে তাদের দ্বারা স্টক করা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, বহুমূল্য খাদ্যদ্রব্যে ভরপুর রসদ ভান্ডার, পোশাক পরিচ্ছদ, ইত্যাদি।  এগুলির মধ্যে অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ আমাদের দেশের একটি বিশেষ ডিপোতে রাখতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় যেখানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক অপারেশনের দ্বারা শত্রু, উগ্রবাদী এবং দেশ বিরোধী তত্ত্বের কাছ থেকে উদ্ধার করা হাথিয়ার এবং গোলাবারুদ জমা করে রাখা হয়।  আর উদ্ধার করা খাদ্যদ্রব্য এবং পোশাক পরিচ্ছদ যেগুলি কার্যোপযোগী সেগুলি আশপাশের গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয় এবং অকেজো জিনিসপত্র পুড়িয়ে নিঃশেষ করে দেওয়া হয়।

 

১৯৯৯ সালের আগস্ট মাসের প্রথম দিক। নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এই অঞ্চলগুলিকে বিশেষ করে কারগিল, দ্রাস, বাটালিক, মাস্কো, ইত্যাদি আমাদের সেনাবাহিনী দ্বারা আরো শক্তপোক্ত করে সুরক্ষিত করে দেওয়া হলো যাতে করে পাক সেনা আমাদের দেশকে দ্বিতীয়বার ঐরকম স্পর্ধা আর দেখাতে না পারে। কারগিল সেক্টর থেকে যুদ্ধের জরুরি অবস্থার কারণে বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্যযোজনে আসা সৈনিকরা ধীরে ধীরে তাদের নিজের নিজের জায়গায় ফিরতে শুরু করেছে।  আমাদের ব্যাটালিয়ন অর্থাৎ রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্টের ৩য় ব্যাটালিয়ন, নাগা রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়ন এবং গোর্খা রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়ন সহ ৫৬ মাউন্টেন ব্রিগেড নিজের স্থানে অর্থাৎ শ্রীনগরের নিকটে বারামুল্লা জিলায় প্রস্থান করে গেলো। কারগিল যুদ্ধের জন্য বন্ধ থাকা সৈনিকদের ছুটিও একটু একটু করে খুলতে শুরু হয়েছে।  কিন্তু হুড়োহুড়ি করে ভিড়ের মধ্যে ছুটি না গিয়ে একটু রয়ে সয়ে ছুটি যাবার কথা ভেবে কিছুদিন বাদে আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল মেহরা কে ছুটি যাবার কথা বললাম।  সেই মার্চ মাসে এক জরুরী পরিস্থিতি বাবদ দিল্লী থেকে কোনোরকমে জবা এবং তৃষাদের আমাদের বাড়িতে রেখে এসেছিলাম, তাই কারগিল যুদ্ধের পর ছুটি গিয়ে বাড়ির সকলকে এবং বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা করার জন্য মনের ভিতর একটি প্রবল ইচ্ছে হচ্ছিলো আর সেই ইচ্ছের প্রবলতাকে ইন্ধন জুগিয়ে দ্বিগুন করে দিচ্ছিলো কারগিল যুদ্ধের জয়লাভের আনন্দ।  সশরীরে একটি যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সেই যুদ্ধের চাক্ষুষ সাক্ষী হওয়ার যে আনন্দ সে কথা ভাষায় প্রকাশ্য নয়।  তাই বাড়ি গিয়ে সবাই যখন এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার এবং তার জয়লাভের অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞেস করবে তখন তাদেরকে বুক ফুলিয়ে সেইসব অভিজ্ঞতার কথা শোনাবো এইসব ভেবে মনে মনে খুব রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম।  ইতিমধ্যে আমাদের সেনাবাহিনী “অপারেশন বিজয়” সফলভাবে জয়লাভ করার অব্যবহিত পরই বাড়িতে কার্গিল অঞ্চলের কোনো এক PCO থেকে ফোন করে আমার সর্বাঙ্গীন কুশল জানিয়ে আমার জন্য চিন্তা করতে না করেছিলাম আর সেই সঙ্গে তার কিছুদিন পরে আমার ছুটি যাবার কথাটাও বাড়িতে সকলকে জানিয়েছিলাম।  যেদিন ছুটি যাচ্ছিলাম, জম্মু তাওয়ী স্টেশনে ট্রেনে ওঠা থেকে আরম্ভ করে আমার হোম স্টেশন সিউড়ী পৌঁছনো পর্যন্ত কথায় কথায় যাকেই মুখ ফস্কে বলে ফেলেছি যে আমি কারগিল যুদ্ধ ফেরত ব্যস সেখানেই শুরু সহযাত্রীদের অনুরোধ আসা সেই গল্প শোনানোর জন্য।  তাদের সকলকে গল্প শোনাতে ভালো তো লাগছিলো কিন্তু গল্প শোনাতে শোনাতে আমার মুখ তখন এটি পরিশ্রান্ত যে পরের দিকে তাদের এড়িয়ে চলতে বাধ্য হয়েছিলাম।  শুধু তাই নয়, জম্মু তাওয়ী থেকে সিউড়ী পর্যন্ত সারাটি ট্রেন জার্নি সহযাত্রীদের কেউ না কেউ ভালোবেসে বা সম্মানের খাতিরে চা থেকে আরম্ভ করে জল খাবার, লাঞ্চ, ডিনার, সবকিছু তাঁরা আমায় একপ্রকার জোর করেই খাইয়ে যাচ্ছিলেন, শত বাধা দেওয়া সত্ত্বেও তাঁরা সেসব মানছিলেন না, যুক্তি দিচ্ছিলেন যে তাঁরাও দেশভক্ত কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে আমাদের সহযোদ্ধা হয়ে লড়ার সামর্থ্য তো তাঁদের নেই তাই আমাদের মতো সৈনিক যদি তাঁদের দেওয়া খাবারকে তাঁদের স্নেহের উপহার হিসাবে গ্রহণ করে তাহলে হয়তো তাঁদের সেই ইচ্ছের আংশিক আপূর্তি হবে।  এরপর আর কিছু বলার থাকতে পারে না। আসলে এর পূর্বে কোনোদিন এরকম হয়নি তো তাই মনের ভিতর একটা সংকোচ কাজ করছিলো আর তার জায়গা থেকে কারোর দেওয়া খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করতে ইচ্ছে করছিলো না তা সে যতই সম্মানের হোক আর যতই ভালোবাসার হোক না কেন।  কিন্তু শেষপর্যন্ত তাদের সেই সমস্ত স্নেহের উপহার স্বীকার করতেই হলো, উপেক্ষা করতে পারিনি আমি তাদের।  বাড়ী পৌঁছনোর পর ও সেই একই ঘটনা।  আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব প্রত্যেকেই যখন যেখানে সুযোগ পেয়েছেন আমায় গোল করে ঘিরে ধরে আমার মুখ থেকে কারগিল যুদ্ধের চরম অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চেয়েছে।  আমিও অক্লান্তভাবে তাঁদের শুনিয়ে গেছি সেই সব গল্প। শুনতে শুনতে আবেগে তাঁদের কারোর চোখদুটো অশ্রুসিক্ত হয়ে গিয়েছে আবার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে কেউ বা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে আমার মুখের পানে। সব কিছু শোনার পর কৌতুহল বশতঃ কেউ কেউ আবার যুদ্ধ সংক্রান্ত নানান প্রশ্নও রেখেছেন আমার সামনে, আমিও তাঁদের সব কৌতূহলের তৃষ্ণাকে মিটিয়েছি যথাযথ উত্তরের মাধ্যমে।  আমার ছোট্ট মেয়ে তৃষা সেও কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল না আমার গল্পের শ্রোতাদের মধ্যে, যখনই সুযোগ পেত ফাঁকে ফুকুরে ঢুকে পড়তো আর বসে পড়তো শ্রোতাদের আসরে।  কারোর মুখ থেকে শোনা প্রশ্নকে নকল করে আমার ছোট্ট মেয়ে আধো আধো কথায় আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “বাবা, যুদ্ধে কত জনকে মেরেছো তোমরা?”  প্রশ্নটা সেদিনকার মতো তুলে রেখেছিলাম ওই ভেবে যে যেদিন আমার মেয়ে বুঝতে শিখবে “কাউকে মারা” আর “শত্রুকে বধ করার” পার্থক্যটুকু সেদিন আমি তাকে বুঝিয়ে এর সদুত্তরটি দেব।  তাই হাঁসতে হাঁসতে অন্য কিছু দিয়ে ভুলিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিলাম তার সেই প্রশ্নটি।  তবে সেদিন সত্যিই একটা জিনিস উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতার চেয়ে সেই অভিজ্ঞতার গল্প পুনরাবৃত্তিমূলকভাবে অন্যদের ব্যাখ্যা করার অভিজ্ঞতা কোনো অংশে কম নয়।  ছুটির দিনগুলো সবাইকে নিয়ে খুব আনন্দসহকারে কেটে গেলো।  এবার আবার ফিরে যাবার পালা।  তাই ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বেরোনোর দু একদিন আগে ই জবা আমার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে আমার প্রস্তুতি পর্বটা সামলে নিয়েছিল।  নির্ধারিত দিনে বাড়ীর সকলকে প্রণাম করে তৃষাকে কোলে নিয়ে একটু আদর করে দূর্গা দূর্গা করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেলাম।  বেরোবার সময় বাবা মাদের সেই সতর্কবাণী, “সাবধানে যাস আর পৌঁছেই PCO থেকে একটা ফোন করে দিস”।  মাথা নেড়ে সায় দিয়ে রিকশায় ওঠার উপক্রম করলাম।  দেখাদেখি আমার মেয়ে বলে উঠলো, “বাবা আবার কখন ছুটি আসবে?”  “খুব তাড়াতাড়িই এসব বেটা” বলে অভয় দিয়ে রিকশায় উঠলাম।  রিকশাও রওনা দিলো আমায় নিয়ে সিউড়ী স্টেশনের উদ্দেশ্যে।  এবার ঠিক ছিল সিউড়ী থেকে হাওড়া, সেখান থেকে  রাজধানী এক্সপ্রেসে করে নিউ দিল্লী আর সেখান থেকে ফ্লাইট ধরে সোজা শ্রীনগর আর সেই অনুযায়ী রাজধানী এক্সপ্রেসে এবং ফ্লাইটে আমার রিজার্ভেসনের ব্যবস্থাও করা ছিল।

 

শৈলশহর বারামুল্লা, কাশ্মীর

 

ছুটি কাটিয়ে বারামুল্লাতে পৌঁছে আমার ব্যাটালিয়নে জয়েন করার পর পর জানতে পারলাম যে উচ্চতর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের ব্যাটালিয়নকে ৬ সপ্তাহের জন্য একটি বিশেষ এক্সারসাইজে যেতে হবে।  এবার আমাদের এক্সারসাইজের লোকেশন নির্ধারিত ছিল বারামুল্লা থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরত্বে অবস্থিত গুলমার্গ নামক যে বিখ্যাত পর্যটন স্থানটি আছে সেখান থেকে আরো প্রায় ৮০ কিমি দূরত্বে একটি ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ অথচ স্বল্প জনবসতি বিশিষ্ট একটি দুর্গম পার্বত্যাঞ্চলে অবস্থিত “চোড়খুড” নামক স্থানে।  কারগিল যুদ্ধের সাফল্যমন্ডিত বিজয়ের পর আমাদের সেনাবাহিনীর মধ্যে নেমে এসেছিল একটি শান্তির বাতাবরণ আর সেই সঙ্গে দূরীভূত হয়েছিল সবারির কপাল থেকে দুশ্চিন্তার বলিরেখাও।  সবাই ভেবেছিলাম এবার কিছুদিন একটু আরামে দিন কাটানো যাবে।  হয়তো একটু শান্তিপূর্ণভাবে দিন কাটাতে শুরু করেছিলাম আমরা সবাই।  কিন্তু খুব বেশি দীর্ঘস্থায়ী হলোনা সে শান্তিপূর্ণ দিনযাপন।  একটা শেষ হতে না হতেই আর একটা হাজির।  ওই যে কথায় বলে না “হোয়েন ইন পিস, প্রিপেয়ার ফর ওয়ার”।  নির্ধারিত দিনে সকালবেলা আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিয়ে কনভয় রওনা দিলো এক্সারসাইজের লোকেশন “চোড়খুড” অভিমুখে।  একঘন্টা যাত্রা করার পর আমরা পৌঁছে গেলাম গুলমার্গে।  সেখানে নেমে ব্রেকফাস্ট সেরে নেওয়ার জন্য একঘন্টার হল্ট।  গুলমার্গে আমাদের কনভয় যেখানটাতে দাঁড়িয়েছিল তার থেকে নাতিদূরত্বে বর্ণাঢ্যে পরিপূর্ণ একটি মাঝারী অথচ নজর কেড়ে নেওয়া ঘর দেখতে পাওয়া গেলো যার সামনেটিতে কাঠের খুঁটিতে একটি বোর্ড লাগানো রয়েছে তাতে লেখা আছে “ববি হাট”, ও তাহলে কি এই সেই সুবিখ্যাত “ববি হাট” যার ভিতর ববি সিনেমাতে “হাম তুম এক কামড়ে মে বন্দ হো আউর চাবী খো জায়ে” গানটির শুটিং হয়েছিল।  স্পটটিকে কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না তাই কোনোরকমে তাড়াতাড়ি করে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েই ছুটলাম ঘরটির দিকে।  পর্যটন স্থল হওয়ার জন্য ঘরটিকে দেখাশোনা করার জন্য কয়েকজন কেয়ার টেকার রয়েছে।  কিন্তু আমাদের দেখে কেউ আটকালো না আর আমরাও বিনা বাধায় ঢুকে পড়লাম ঘরটিতে।  তড়িঘড়ি করে যতটা পারলাম ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখলাম।   খাট বিছানা আসবাবপত্র যেমনকার তেমনি সাজানো রয়েছে এবং প্রতি বছর রংচং করে ঘরটিকে ঝকঝকে তকতকে করে রাখা হয়।  কেয়ার টেকার দের একজন ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব কিছু দেখালো এবং বললো যে এই ঘরটিকে একটি “হেরিটেজ হোম” হিসাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে।  কিছুক্ষনের মধ্যেই সেখান থেকে কনভয়ের “চোরখুডের” উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা কিন্তু রাস্তায় কোথাও ধস নামার ফলে আমাদের গুলমার্গেই  অপেক্ষা করতে হলো আর সেই সুযোগে গুলমার্গের চারিদিকটাও বেশ ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখলাম।

 

কয়েক ঘন্টা সেখানে থাকার পর রাস্তার ক্লিয়ারেন্স পাওয়া গেলো এবং তার কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের সকলকে নিয়ে কনভয় সেখান থেকে আবার রওনা দিলো।  গুলমার্গেই অপেক্ষা করাকালীন আর্লি লাঞ্চ সেরে নিয়েছিলাম।  মাঝখানে কনভয় আর কোথাও থামবেনা।  এখান থেকে “চোরখুড” এর দূরত্ব ৮০ কিমি মতো তাই দূরত্ব অনুযায়ী ভেবেছিলাম ঘন্টা দুয়েক লাগার কথা।  গুলমার্গ থেকে চলার পর কনভয় সমতল ছেড়ে পাহাড়ি কিন্তু পাকা রাস্তা ধরলো, সেটা দিয়ে আরো আধ ঘন্টা চলার পর ভীষণ এবড়োখেবড়ো আর ছোট ছোট প্রস্তরবহুল রাস্তা শুরু হয়ে গেলো।  পাকা রাস্তার তো বালাই নেই।  একটা পাহাড় শেষে আর একটি পাহাড়।  খাড়া চড়াই দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে আমাদের কনভয়ের গাড়িগুলি বেশ কয়েকটি পাহাড় পেরিয়ে ধীর গতিতে সন্তর্পনে অগ্রসর হচ্ছে।  খুব ঘন জঙ্গলে ভর্তি রাস্তার দুধার।  প্রচন্ড ভঙ্গুর রাস্তা, তার কোথাও ঝর্ণার জলে তৈরি কাদায় ভর্তি আবার কোথাও বালিতে পূর্ণ।  রাস্তার দুরবস্থার ফলে কোথাও কোথাও কনভয়ের গতিবেগ এতই ধীরে যে মনে হচ্ছিলো গাড়িথেকে নেবে পদযাত্রা করেই বোধ হয় আগে পৌঁছনো যাবে।  এইভাবে চলতে চলতে আমরা পৌঁছলাম পাহাড়ের উপর একটি ছোট সমতল ভূমিতে যাকে বলা হয় “প্লাটিউ”।  কনভয়ের গাড়িগুলি থেকে সবাইকে নামতে বলা হলো।  বুঝতে পারলাম এটাই আমাদের এক্সারসাইজের লোকেশন “চোরখুড” আর এখানে ৬ সপ্তাহ মতো থেকে আমাদের ওয়ার এক্সারসাইজ করতে হবে।  হাতঘড়িতে দেখি তখন রাত্রি ৮ টা বাজে।  চতুর্দিক ঘনজঙ্গলে ঘেরা পাহাড়টি সমতল থেকে অনেক উচ্চতা বিশিষ্ট, তাই কনভয় থেকে নামার পর সেখানে বেশ শীত শীত করছিলো।  একেবারেই পান্ডববর্জিত স্থান।  আশেপাশে কোথাও কোনো গ্রাম অথবা জনবসতি চোখে পড়ছে না, আর পড়বেই বা কি করে, চারিদিকে যা কালো ঘন অন্ধকার।  সেই অন্ধকার ভেদ করা প্রচুর জোনাকি পোকার উজ্জ্বল আলোর বিন্দুগুলির সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার অবিরাম ডাক মিলিয়ে সে রাতকে করে তুলেছে আরো ভয়ঙ্কর।  আমাদের সঙ্গে বিশাল ক্ষমতার জেনারেটার ও রয়েছে কিন্তু দিনের আলো ছাড়া তার বিছিয়ে জেনেরেটরকে সেটআপ করা সম্ভব নয়।  তাই আপাততঃ রাতটুকু কাটানোর জন্য সঙ্গে রাখা হ্যাচাক লাইট অথবা লণ্ঠনের ব্যবহার করতে হবে।  তাছাড়া সকলের কাছে নিজস্ব টর্চ লাইট ও রয়েছে।  যে যেখানে জায়গা পাবে সেখানে তাঁবু খাটিয়ে রাতটুকু কাটাবে।  সকলের নৈশ ভোজনের জন্য কুক হাউস সেট করা অনিবার্য নইলে এতগুলো সৈনিকের পেটের জোগাড় কি করে হবে, পেট তো মানবে না।  নাঃ রাস্তায় ধস নামায় আমাদের অনেক দেরি হয়ে গেলো এখানে পৌঁছতে, নইলে আমাদের এখানে দুপুর দিকে পৌঁছে যাবার কথা আর দুপুরে পৌঁছে গেলে সব কিছু সুষ্ঠূ ভাবে সেট করে ফেলা যেত।  কিন্তু আক্ষেপ করে আর কি হবে।  একটা রাতের ব্যাপার তাই কোনোরকমে রাতটা তো কাটাতেই হবে, তারপর যা করার তা কালকেই করা হবে।  কাল দিবালোকে জেনারেটার সেট ও হয়ে যাবে আর সব বন্দোবস্ত সুচারু রূপে হয়ে যাবে।  বড় ছোট নানান আকারের তাঁবু।  তাদের কোনোটায় ৮ – ১০ জন করে থাকবে, কোনোটায় ৪ – ৬ জন করে থাকবে আবার কোনোটায় ২ জন করে থাকবে।  আমাদের তাঁবুটা ২ জনের থাকার তাঁবু তাতে আমি থাকবো এবং আমার এক সহকর্মী সৈনিক যাঁর নাম সামশের সিং তিনি থাকবেন। একটা লণ্ঠন পেলাম সেটা জ্বালিয়ে আমাদেরই দুটো জুনিয়র সৈনিক কে ডেকে আমাদের তাঁবু খাটালাম। আমাদের জলের বোতলগুলো দেখলাম খালি, রাত্রিতে খাবার পর তো খাবার জল লাগবে।  জুনিয়র দুটোকে জলের বোতলগুলো দিয়ে বললাম কাছের কোনো ঝর্ণা থেকে জল নিয়ে আসতে।  কিছুক্ষন পর ছেলেদুটি ফিরে এসে জলভর্তি বোতলগুলি আমাদের তাঁবুতে রেখে গেলো।  লণ্ঠনের অস্পষ্ট অনুজ্জ্বল আলোতে জলগুলো দেখে বুঝতে পারলাম যে একটু অস্বচ্ছ হলেও মোটামুটি কাজ চালাবার জন্যে ঠিক আছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে ডিনার রেডি। বোতলের জলে মুখ হাত ধুয়ে ডাল রুটি ভাত তরকারী সহযোগে রাত্রির ভোজন সেরে কোনোরকমে বেডিংটা খুলে ফেললাম। সঙ্গে নিয়ে আসা চারপাই চারপাই গুলি অন্য কয়েকটি ট্রাকে লোড করা আছে, দিনের বেলা ছাড়া রাত্রির অন্ধকারে সেগুলি আনলোড করা সম্ভব ছিল না তাই চারপায়  শুয়ে পড়লাম।  সারাদিনের জার্নির ধকল তাও আবার ঐরকম রাস্তা। টিমটিমে আলোর লণ্ঠনটি তাঁবুর মাঝামাঝি এক জায়গাতে রেখে আর মাথার কাছে টর্চ লাইট টি রেখে ক্লান্তিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে।  হঠাৎ ঘুম ভাঙলো ডান হাতের তালুতে এক তীব্র যন্ত্রনায়, কি যেন ফুটলো হাতের তালুতে।  যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে কখন যে অস্ফুট আর্তনাদ করে ফেলেছি তা নিজেই জানিনা।  ততক্ষনে পাশে শুয়ে থাকা সামশের সিং ও জেগে গিয়েছে, উঠে উঠেই আমায় জিজ্ঞেস করলো, “মুখার্জী সাব কেয়া হুয়া?”  আমি ও জেগে গিয়ে বিছানায় বসে পড়েছি।  যন্ত্রনায় কাতরাতে কাতরাতে তাঁকে উত্তর দিলাম যে হাতে কিছু সজোরে ফুটেছে আর তার জন্য তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে।  পাশে রাখা টর্চটা জ্বালিয়ে প্রথমে হাতের তালুটা দেখি আর তখন দেখতে পাই তালুর এক জায়গায় একটি গর্ত তার চারিদিকটা লাল হয়ে গিয়েছে, ঠিক যেন হুল ফোটার গর্ত। বাম হাত দিয়ে ডান হাতের কব্জির কাছটাতে শক্ত করে ধরে যন্ত্রণায় ডান হাতের পাঞ্জাটাকে দোলাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, যা বাব্বাঃ এত রাত্রে কে হুল ফুটিয়ে গেল?  এতক্ষনে আমার সহকর্মী বন্ধুটি সামশের সিং ও সক্রিয় হয়ে গিয়েছেন।  তিনি তাঁর টর্চটা হাতে নিয়ে সেটা জ্বালিয়ে আমার বিছানার উপর একটু ঘোরাতেই মধ্যরাত্রিতে যেটা চোখে পড়লো সেটা দেখে শুধু আমার কেন যে কোনো লোকেরই হাড় হিম হয়ে যাবার কথা।  টর্চের আলোয় দেখি বিছানার উপর একটা দিকে ইয়া বড় একটি কালো কুচকুচে জংলী কাঁকড়া বিছা দাঁড়িয়ে আছে যার সামনের দাঁড়া দুটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়ার ভঙ্গীতে আর পিছনের উর্ধমুখী লেজ আক্রমণাত্মক ভঙ্গীতে।  যদিও ওটা তো ততক্ষনে আমাকে হুল ফুটিয়ে বিষ ঢেলে দিয়েছে কিন্তু হাবভাব এমন যে পারলে আবার একবার হুল ফোটায়।  ওটাকে দেখে আমি ততক্ষনে একলাফে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি।  সেটা দেখে নিমেষের জন্যে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত চলচিত্র “সোনার কেল্লাতে” দেখানো কাঁকড়াবিছেটার কথা মনে পড়ে গেলো যেটিকে দুস্কৃতিকারীরা ফেলুদার বিছানায় ছেড়ে দিয়েছিলো এবং প্রচন্ড তৎপরতার সঙ্গে ফেলুদা সেটির থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে তাকে একটি কাছের পাত্রে বন্দী করে ফেলেছিলো।  আমার আশেপাশে কাঁচের কোনো গ্লাস অথবা পাত্র থাকলে আমিও তাকে হয়তো বন্দী করে ফেলতাম।   এইসব সাতপাঁচ ভাবছি আর তালুর যন্ত্রণা ভোগ করছি, হঠাৎ শামশের সিং পাশে পড়ে থাকা আর্মির মোটা সোলের একটি জুতো তুলে সপাটে এক আছাড় কাঁকড়া বিছেটির উপর, কি টিপ্, ব্যস এক আঘাতেই একটু ছটফট করে তার ভবলীলা সাঙ্গ, কয়েক মূহুর্ত পূর্বের দর্পে এবং দম্ভে পরিপূর্ণ কাঁকড়া বিছেটির শরীরটি জুতোর আঘাতে থেঁতলে পিষে গিয়ে একটি দলায় পরিণত হয়ে পড়ে আছে।  এদিকে আমার ডান হাতটা একটু একটু করে ফুলতে শুরু করেছে, গাটাও জ্বর জ্বর করতে শুরু করেছে ততক্ষনে।  সঙ্গে থাকা “স্নেক বাইট কিট” থেকে ঔষধি লোশন বের করে সামশের সিং আমার হাতের হুল ফোটানোর জায়গাটা ভালো করে ধুয়ে দিলেন।   “স্নেক বাইট কিট” যেকোনো সৈনিকের জীবনে একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যেখানেই যাই না কেন আমরা সঙ্গে এই বস্তুটি বাধ্যতামূলকভাবে থাকবেই বিশেষ করে বনে জঙ্গলে পাহাড়ে পর্বতে যুদ্ধে এক্সারসাইজে।  কয়েকটি তাঁবু ছেড়ে একটি তাঁবু তে যেটি ডাক্তারের তাঁবু সেখান থেকে একজন নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট কে মাঝরাত্রিতে জাগিয়ে ওষুধ পত্র নিয়ে আসলেন সামশের সিং।  সেগুলি খাওয়ার পর একটু রিলিফ পেতে শুরু করলাম।  সামশের সিং কে অসংখ্য ধন্যবাদান্তে বিছানাটা ঝেড়েঝুড়ে আবার শুয়ে পড়লাম।  বলাই বাহুল্য বাকি রাতটুকু জেগে ঘুমিয়ে কোনোরকমে কাটালাম।  সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানা গোটাতে গিয়ে দেখি তাঁবুতে যেখানে আমরা দুজন বিছানা পেতে শুয়ে ছিলাম সেখানে চারিদিকটা গবাদি পশুর নানান ধরণের   হাড়গোড় ছড়িয়ে রয়েছে। গত রাত্রিতে ওখানেই বসে খাবার খেয়েছি আর ওখানেই বিছানা পেতে শুয়েছি।  “ভোজনং যত্রতত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে”   এই শব্দাবলী যে আমাদের সৈনিক জীবনে কতখানি যথার্থ ছিল তা সেদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।  আর্মিতে এক্সারসাইজ চলাকালীন CGI Sheet (করোগেটেড গ্যালভানাইজড আইরন) দ্বারা যে ধরণের বাথরুম টয়লেট আমাদের জন্য তৈরি করা হয় সেগুলি সেটআপ করতে আরো দু একদিন লেগে যাবে, অগত্যা সকাল বেলায় উঠে ক্যাম্প সাইট থেকে দূরে ওপেন এরিয়াতে গেলাম।  গত রাত্রিতে জুনিয়র দের পাঠিয়ে যেখান থেকে খাবার জল আনিয়েছিলাম সেই জায়গাটা চিনিয়ে দেবার জন্যে সেই জুনিয়রদের মধ্যে একজনকে সঙ্গে নিয়ে আমি এবং সামশের সিং সেখানে গেলাম, আর সেখানে গিয়ে ছেলেটি আমাদের সামনে একটু দূরে একটি খাল বা নালা দেখিয়ে বললো যে গত রাত্রে তারা নাকি ওই নালা থেকে জল নিয়ে গিয়েছিলো।  খালটির কাছে গিয়ে দেখি অনেকটা তলানিতে কয়েক জায়গায় জমে থাকা জল যার গভীরতা খুব বেশি না হলেও এক কুনুই।  আরো খানিকটা কাছে গিয়ে নাতিস্বচ্ছ জলের উপর থেকে তলাটা দেখতে পেলাম আর তাতে যা ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পেলাম তার কথা আজ পর্যন্ত আমিভুলতে পারিনি।  জলের তলার মাটিতে দেখি ছোট বড়ো মিলিয়ে প্রচুর পরিমানে জলজোঁক অর্থাৎ “ওয়াটার লীচেস” কিলবিল করছে।  তাহলে কি গতরাত্রিতে এই নালার জল আমরা অম্লান বদনে খেয়েছি, জলের সঙ্গে দু একটা ছোট সাইজের জোঁক আমাদের পেটে চলে যায়নি তারই বা কি গ্যারান্টি।  সে সব কথা ভাবতে গিয়ে তীব্র ঘৃনায় গা যেন ঘিন ঘিন করে উঠলো, মনে হলো গত রাত্রির খাবার যেন উঠে আসবে।  কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়েছিলাম সেদিন।  সাথের জুনিয়র ছেলেটিকে আমি এবং শামশের সিং খুব করে বকলাম।  ছেলেটিও কৃতকর্মের জন্য অনুতাপ প্রকাশ করছে।  কিন্তু তখন আর বকেই বা কি হবে আর অনুতাপ করেই বা কি হবে। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে।  “চোরখুড” পৌঁছনোর পর এক দিনের মাথাতেই একেরপর এক এত সব অঘটন ঘটে গেলো যে তার জন্য নিজেরই উপর ক্ষোভ হচ্ছিলো।  প্রথমে কাঁকড়া বিছের কামড় তারপর পশুর হাড়ের উপর বসে খাওয়া শোওয়া আর শেষকালে কিনা জোঁক মিশ্রিত জল…।  কাঁকড়া বিছের হুল ফোটানোর ব্যাথায় আমি তখন বেশ কাতর।  সকালে ভালো করে দেখে টেখে আমাদের ক্যাম্পের ডাক্তার আমায় আরো খাবার এবং লাগাবার ওষুধপত্র দিলেন।  বিষের বিষক্রিয়া থেকে সুস্থ হতে আমার দিন চার পাঁচেক লেগেছিলো।  সময়ে যদি চিকিৎসা না হতো তাহলে কি হতো কে জানে।

 

         আমার সাথে হওয়া ঘটনাগুলোর কথা ধীরে ধীরে ব্যাটালিয়নের সবাই জানতে পারলো এবং এরই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল মেহরা আরো কড়াকড়ি ভাবে পুরো ব্যাটালিয়নকে আদেশ দিলেন যে কেউ চারপাই ছাড়া নিচে শোবেন না আর জল কেবল আমাদের ব্যাটালিয়নের নিজস্ব জলট্যাঙ্কের থেকে নিয়েই ব্যবহার করবে বিশেষ করে খাওয়ার জন্য।  আমার সাথে ঘটে যাওয়া সেদিনের জলের ঘটনা টিকে আমি দুর্ঘটনাই বলবো, কেননা আমরা যেখানেই যাই না কেন তা সে যুদ্ধক্ষেত্রই হোক আর এক্সারসাইজই হোক আর অপারেশনই হোক, আমাদের কনভয়ে সম্পূর্ণ লটবহর থাকে, সেদিন ও ছিল, কিন্তু রাত্রিতে পৌঁছনোর ফলে আমরা ওগুলির সদ্ব্যবহার করতে পারিনি।  দু-তিন দিনের মধ্যে আমাদের এক্সারসাইজের ক্যাম্প সাইট সর্বাঙ্গীন ভাবে সেট হয়ে গেলো এবং আমাদের এক্সারসাইজের কার্যাবলী নিয়মানুযায়ী চলতে লাগলো।  কিন্তু সেখানে থাকাকালীন দিন কয়েক পর আমার সাথে একটা অঘটন ঘটে গেলো, অবশ্য সেটাকে অঘটন বললে খুব ছোট করে বলা হবে, আসলে সেদিন আমি অবশ্যম্ভাবী, মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী বিপদের মুখ থেকে কোনোরকমে রক্ষা পেয়েছিলাম।  সে ঘটনার কথা আমি জীবনে কোনোদিনও ভুলবো না।  তবে শিরদাঁড়া শীতল করে দেওয়ার মতো এই ঘটনার গল্প নিয়ে খুব তাড়াতাড়িই ফিরে আসবো আপনাদের কাছে আর তার সঙ্গে আপনাদের বলবো আমাদের এক্সারসাইজ সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পর কিভাবে আমাদের ব্যাটালিয়ন ভারতবর্ষের দুর্গমতম, শীতলতম এবং কঠিনতম স্থান যার নাম “সিয়াচেন গ্লেশিয়ার” সেখানে প্রবেশ করেছিল।  ভয়াল ভয়ঙ্কর তুষারের প্রান্তর সেই “সিয়াচেন গ্লেশিয়ার”, যেখানে কাকপক্ষীটির পর্যন্ত দেখা পাওয়া যায় না, যেদিকে তাকাও মরুভূমির মতো ধূধূ করছে শুধু শ্বেতশুভ্র বরফ, সেখানে প্রতিটি পদই কত বিপজ্জনক ভয়াবহ এবং যেখানকার জীবনযাত্রা কতটা ঘাত-সংঘাত পূর্ণ তার কাহিনীও বলবো আপনাদের।  ততদিন আপনারা ভালো থাকবেন, সুরক্ষিত থাকবেন, আর হ্যাঁ, অবশ্যই পড়তে থাকবেন “জেলার খবর সমীক্ষা”।  জয় হিন্দ।                                                                                                                                                      ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *