August 21, 2025

ওলাবিবিতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব

পারমিতা সরকার

১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট। ভারতবর্ষ স্বাধীন হল। বিদেশী শাসনের বেড়াজাল ভেঙে ধীরে ধীরে আমরা নতুনভাবে নিজেদের পথ চলা শুরু করলাম। শৃংখল মুক্ত সেই ভারতবর্ষে হাওড়ার বেজপুকুর সংলগ্ন এলাকার কিছু মানুষ ঠিক করেন যে তারা দুর্গাপূজা করবেন। তখন এই অঞ্চল ছিল মুসলিম অধ্যুষিত, জলজঙ্গলে ঘেরা এক অনুন্নত জায়গা। কাঁচা রাস্তা তাও আবার রাত্রে আলো বিহীন। জনবসতি বলতে ছিল ১৫-১৬টি ছিন্নমূল পরিবার। আর ছিল একটি পরিত্যক্ত ব্যারাক বাড়ি। সেই ব্যারাক বাড়ির বাইরে এই কয়েক ঘর মানুষের বাস। পুজার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন পরম শ্রদ্ধেয় প্রয়াত গোপাল ভট্টাচার্য , যিনি ঠাকুরভাই নামে সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন। এমন প্রতিকূল একটি জায়গা, যেখানে অল্প কিছু সংখ্যক মানুষের বাস, তাদেরকেও প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে বসবাসের জন্য। তাদের সকলের মধ্যে একটা সংগঠন তৈরি করার জন্য এবং হিন্দুদের সকলকে একসাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকার জন্য ঠাকুরভাই মনে করেন যে এই জায়গায় প্রয়োজন একটি দুর্গাপূজার। যেমন ভাবা তেমন কাজ। সকলের মধ্যে একটা দুর্গাপুজোর উজ্জাপনের উৎসাহ সৃষ্টি করতে বেশি সময় লাগে নি তাঁর। ১৯৪৮ এর আগস্ট মাসে তৈরি হয় এই বিশাল অঞ্চলের সর্বপ্রথম সংগঠন – সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি যা পরবর্তীকালে ওলাবিবিতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব সমিতি নামে পরিচিত হয়। বর্তমানে এই পুজো ৭৫তম বর্ষে পা রাখল। প্রথম যখন পুজো শুরু হয় তখন করোগেটেড টিনের চালা, জুট মিলের চট আর কার্বাইড গ্যাসের আলোর ব্যবস্থা দিয়ে তিন দিক ঘিরে প্যান্ডেল তৈরি হতো। পাড়ার সকল সদস্যরা যে যেমন পারতো যোগান দিয়ে পুজো চলাত। প্রথম বর্ষের পুজোর খরচের কোন হিসাব না থাকলেও পঞ্চম বর্ষ থেকে একটি হিসেব পাওয়া যায়, যেখানে দেখা যায় পঞ্চম বর্ষে পুজোর খরচ হয়েছিল ৬ টাকার কাছাকাছি। ১৯৫৫ সালের পর থেকে ক্রমশ জনবসতি বাড়তে থাকে এবং এই পুজো ধীরে ধীরে উত্তরোত্তর এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৬১ সালে প্রথম স্মরণিকা অর্থাৎ সুভেনিয়ার বের হয়। এরপর ১৯৬২ সাল থেকে বস্ত্র-বিতরণ করা শুরু হয়। ধীরে ধীরে আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষজন ও বিভিন্ন ক্লাব এসে যুক্ত হয় এই পুজোর সাথে। নবমীর ভোগ রান্না থেকে শুরু করে বিজয়া সম্মিলনীতে নাটক, সংগীত অনুষ্ঠান প্রভৃতির মাধ্যমে এই পুজো ক্রমশ একটা বিশাল পরিবারে পরিণত হয়। এরপরই আসে ১৯৭২ সালের রজতজয়ন্তী বর্ষ। সেই সময় রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রভাব ফেলছে জীবনের প্রতিটি স্তরে। তৎসত্বেও শ্রী পরিতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রী রাম মজুমদার, শ্রী জহর রায়, ডঃ রমেন্দ্রনারায়ণ চন্দ্র ভৌমিক প্রমূখ ব্যক্তিত্বের নেতৃত্বে খুব ধুমধাম করেই উদযাপিত হয় রজত জয়ন্তী বর্ষ। এই বর্ষ থেকেই এখানে মায়ের মূর্তি তে ‘ডাকের সাজে’ র আরাধনা শুরু হয়। প্রথম এই মূর্তি তৈরি করেন প্রয়াত শিল্পী কেনা পাল। যা দেখতে না কি, সেই সময় বহু দূরবর্তী স্থান থেকেও মানুষজন ভিড় করেছিলেন। সেই ডাকের সাজের মূর্তি এখানে আজও চলে আসছে একই রকম ভাবে এবং মায়ের রূপের কোন পরিবর্তন হয়নি। প্রথম বর্ষ থেকেই এখানে পুজো হত বৃহন্নন্দি কেশ্বর মতে যা আজও একই ভাবে হয়ে আসছে। যদিও সচারচর এই পদ্ধতিতে পুজো বারোয়ারি পুজোর ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কারণ এই মতে পুজো করলে পূজার আচার নিয়ম অনেক নিষ্ঠা ভাবে করতে হয় এবং ঠিকমতো যোগান রেখে পুরোহিত মশাই নিজের নামে সংকল্প করে পুজো করেন। তাই এই পদ্ধতির পুজো সাধারণত বাড়ির পুজোতে পালিত হয়। সেই সময় পুজো করতেন স্বর্গীয় শ্রী শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জি মহাশয়। ৫১তম বর্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত এই পুজো করে আসছেন তাঁরই উত্তরসূরী শ্রী সোমনাথ ব্যানার্জি মহাশয় যিনি এই পুজোর উদ্যোক্তাদের মধ্যে অন্যতম একজন। এরপর ১৯৯৭ সালে এই পুজো পঞ্চাশ বছরে পদার্পণ করে। সেবছর ১লা মে মাঠে প্যান্ডেল করে দুপুর বেলা পাড়ার সবাইকে নিয়ে একটি সাধারণ সভার আয়োজন করা হয়েছিল। ইতিমধ্যেই এই পুজো ক্রমশ সাড়া ফেলেছে, হাওড়া অঞ্চল ছাড়িয়ে আরো দূরে। তাই এই পুজোর মান বজায় রাখতে সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে পুজোর আয়োজন কেমন হবে সেই নিয়েই বসেছিল আলোচনা সভা। দরকার প্রতিটা মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও অর্থনৈতিক সংগতি ‌। সেই সময় পুজোর প্রেসিডেন্ট ছিলেন শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এবং শ্রী চণ্ডীচরণ বোধক। সেই প্রথম মন্ডপ সজ্জায় এলো এক আমূল পরিবর্তন। এস এন দত্ত ডেকোরেটর পুজোর প্যান্ডেল করেছিলেন গুজরাটের অক্ষরধাম মন্দিরের আদলে। প্রয়াত শিল্পী কার্তিক পালের হাতে গড়া অপরূপ মাতৃমূর্তি এবং চন্দননগরের অপূর্ব আলোকসজ্জায় আলোকিত করেছিলেন শিল্পী বাবু বিশ্বাস। ১৯৯৮ সাল থেকেই পুজোর আমেজ এবং পুজোর উৎকর্ষ বাড়ানোর তাগিদে, জনগণের মধ্যে থিম পুজোর চিন্তাভাবনা শুরু হয়। প্রথমদিকে প্রধানত মন্দির বা রাজবাড়ী বানানো হলেও পরবর্তীকালে বিভিন্ন কল্পনা প্রসূত চিন্তা-ভাবনাও জায়গা করে নেয় থিমের পুজোয়। ঐতিহ্যবাহী এই পুজো সংকীর্ণতার গোড়ামীতে নিজেদেরকে আটকে না রেখে কালের স্রোতে গা ভাসিয়ে আধুনিকতার মোড়কে নিজেদেরকে নতুনভাবে মেলে ধরে বিভিন্ন “থিম”এর চিন্তাভাবনায়। ২০০০ সালের পর থেকেই ওলাবিবিতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি মণ্ডপ সজ্জায় এই ধরনের পরিবর্তন এনে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। রাষ্ট্রপতি পুরস্কার প্রাপ্ত শ্রী গৌরাঙ্গ কুইল্লা যিনি বর্তমানে ত্রিধারা, মুদিয়ালি প্রভৃতি কলকাতার বিখ্যাত পূজা মন্ডপের মন্ডপসজ্জার দায়িত্বে আছেন তার জীবনের পথ চলা শুরু এই পুজোর হাত ধরেই। প্রথম থিম পুজোর বিষয়ে ছিল ‘খেয়ালীর খেলাঘর’ যা মূলত বালির প্যান্ডেল নামে পরিচিত। ২০০১ সাল থেকেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেতে থাকে এই পুজো। ২০০৭ সালে ৬০তম বর্ষে পদার্পণ করে এই পুজো। সেবছর কুচবিহার থেকে বাঁশ এনে, বিভিন্ন মাটির কুটির গুলির মধ্যে বাঁশের সুন্দর কাজ করে মন্ডপ সাজিয়েছিলেন শিল্পী শ্রী সৌরভ দত্ত। প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের চিন্তাভাবনার মাধ্যমে থিমের পুজো করে এই পুজো ক্রমশ হাওড়া শহর থেকে শুরু করে কলকাতা ও সংলগ্ন অঞ্চলগুলিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে আসছে। তাই এদের ঝুলিতে আছে বহু পুরস্কার। তার মধ্যে সেরা মন্ডপের জন্য পার্লে আনন্দবাজার শারদ অর্ঘ্য, বাংলা শারদ সম্মান, হাওড়া কলকাতা মিলিয়ে সিএসসি টেলিগ্রাফ, বিশ্ব বাংলা সেরার সেরা, বিশ্ব বাংলা সেরা প্রতিমা, শ্রীরাম শারদ বরণ, ফিনোলেক্স শারদ সম্মান, ঘড়ি রিটারজেন্টের বহু পুরস্কার ইত্যাদি আরো নানা পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। ২০১৬ সালে ‘গঙ্গা আমার মা’ নামক থিমের মাধ্যমে মন্ডপসজ্জা করে, সর্বোচ্চ আর্থিক মূল্যের (ছয় লাখ পঞ্চাশ হাজার টাকা) পুরস্কার লাভ করেছে। এছাড়া স্টেট চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক লাখ টাকার সম্মান অর্জন করেছে। সে বছর ‘গঙ্গা আমার মা’ টেলিগ্রাফ আয়োজিত ‘ছোটদের চোখে বড়দের পুজো’তেও দ্বিতীয় পুরস্কার অর্জন করে। এছাড়া প্রশাসন থেকেও এই প্রাচীন পুজো বহু পুরস্কার অর্জন করে। শহর থেকে শুরু করে কলকাতাতেও আলোড়ন সৃষ্টি করে আসছে ওলাবিবিতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। প্রতিবছর মন্ডপসজ্জায় নানা অভিনবত্ব সৃষ্টি করে চলেছে এই পূজা কমিটি। প্যান্ডেল নির্মাণে নানা চমকপ্রদ, চিত্তাকর্ষক শিল্পকর্মের নিখুঁত ছোঁয়া থাকলেও এখানে প্রতিবছর মা কিন্তু আসেন তার একই চিরাচরিত রূপ নিয়ে। মন্ডপে মা বিরাজ করেন তার চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে একই চালচিত্রের তলায়। এই বছর এই পুজো ৭৫ বছরে পদার্পণ করল। এবছর এদের পুজোর থিম – “শিশু বিকাশের তরে, শৈশব ফিরুক ঘরে ঘরে”।

গত দুবছর করোনা অতিমারির ফলে এই পুজো হয়েছিল আড়ম্বরহীন। তাই এই বছর আবার নতুন উদ্যমে পুরনো ঐতিহ্য বজায় রেখে পুজোর প্রস্তুতি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে ওলাবিবিতলা সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি। বর্তমানে পুজোর প্রেসিডেন্ট শ্রী দেবীপ্রসাদ দত্ত, সাধারণ সম্পাদক শ্রী আবির অধিকারী এবং যুগ্ম সম্পাদক শ্রী সৌরভ ব্যানার্জি ও শ্রী সৌরভ মুখার্জি। এছাড়াও রয়েছেন এই পুজোর অন্যতম কর্ণধার দেবকি রঞ্জন সাহা, যিনি ৪৩তম বর্ষ থেকে বেশ কিছু বছর এই পুজোর সেক্রেটারি পদে আসীন ছিলেন। এবছর পুজোর উদ্বোধন হবে দ্বিতীয়াতে। উদ্বোধন করবেন গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ, পশ্চিমবঙ্গ সমবায় মন্ত্রী শ্রী অরূপ রায় মহাশয়, হাওড়া কর্পোরেশনের মুখ্য প্রশাসক শ্রী সুজয় চক্রবর্তী মহাশয়। এর পরে থাকবে সংগীতানুষ্ঠান। তৃতীয়া তে ও থাকবে বিভিন্ন সংগীতানুষ্ঠান। তাঁর সাথে সংবর্ধনা দেওয়া হবে সেই সমস্ত মানুষকে যারা এই পুজো সৃষ্টির আদি থেকে রয়েছেন। তার মধ্যে রয়েছে ১৯৫৫ সালের সেক্রেটারি ৯৬ বছর বয়সি শ্রী রাম মজুমদার মহাশয়, ১৯৬১ সালের সেক্রেটারি শ্রী পরিতোষ ব্যানার্জি প্রমুখ।

চতুর্থীর দিন হবে শিশুদের বস্ত্র এবং মায়েদের শাড়ি বিতরণ অনুষ্ঠান। এই ৭৫ বর্ষে এই পুজোয় নতুন সংযোজন হল নবমীর দিন কুমারী পূজা। নবমীর দিন মায়ের সামনে ত্রিস্তর ভোগ দেওয়া হয়। প্রতিবছর প্রথা মেনে দশমীতে বিসর্জন হলেও এবছর সাধারণ পল্লীবাসীদের অনুরোধে মায়ের ভাসান হবে দ্বাদশীর দিন। তারপর হবে বিজয়া সম্মিলনীর অনুষ্ঠান। এত বড় একটি পুজো।  তার প্রস্তুতিও চলে বহুদিন ধরে । এবছর পুজোর মণ্ডপ সজ্জায র দায়িত্বে আছেন শ্রী তপন মাঝি। তার সাথে মার্চ মাস থেকে এই নিয়ে আলোচনা শুরু হয় এবং জুন মাস থেকে কাজও শুরু হয়ে যায়। তিনি তাঁর ওয়ার্কশপে বিভিন্ন মূর্তি বানানো শুরু করেন। ঝুলন পূর্ণিমার দিন ৭ই আগস্ট এখানে খুঁটি পূজার মাধ্যমে পুজোর সূচনা হয়। বহু মন্দির পরিবেষ্টিত এই জায়গাটিতে তাই খুঁটিপূজো হয় পাঁচটি বিশেষ মন্দিরে পুজো দিয়ে। সেই মন্দির গুলি হল মা ওলাবিবি মন্দির, হাজার-হাত কালি মায়ের মন্দির, শীতলা মায়ের মন্দির এবং দুটি শিবের মন্দির। ওলাবিবিতলার সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি শুধুমাত্র একটি সংগঠন নয়। আশেপাশের বহু সংগঠন একত্রিত হয়ে এই পুজোয় শামিল হয়। পুজোর সময় সমস্ত রকম সাবধানতা অবলম্বন করা হয় – অক্সিজেন সিলিন্ডার, স্ট্রেচার, প্রেশার মাপার যন্ত্র ইত্যাদি। তার সাথে থাকেন একজন ডক্টর, দুজন নার্স ও। থাকে জেন্টস টয়লেট, লেডিস টয়লেট, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, প্রতিবন্ধী বন্ধুদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা, হুইলচেয়ার ইত্যাদি আরও নানা কিছু। সমস্ত দিক দেখাশোনা করেন এই পূজা কমিটির ভলেন্টিয়াররা। এইচ আই টি পার্কের মাঠে এই পুজো হয় বলে বিশেষ অনুমতি নিয়ে তবে পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়।

এইভাবে এক এক পা ফেলে এই পুজো আজ হাওড়া শহরের এক অন্যতম বড় পুজোয় পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসে ভিড় করে এই পূজা মন্ডপে। এই পুজো আরো সুন্দর ও সাফল্যমণ্ডিত হোক, প্রবীনদের আশীর্বাদ নিয়ে নবীন উদ্যমি মানুষজন এগিয়ে আসুক এই পুজোয় এই কামনা করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *