August 21, 2025

ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরের ক্রীড়াজগৎ : সাফল্য ও ব্যর্থতা   

সুরজিত দাস

শুরুর কথা : ২০২২ সাল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছরপূর্তি । এই ৭৫ বছরের মধ্যে ভারতের ক্রীড়াপ্রেমীরা দেখেছে নানা চড়াই ও উতরাই । কখনও বিজয়ের আনন্দ কখনও বা পরাজয়ের গ্লানি । এই ৭৫ বছরে নতুন ভাবে উঠে এসেছে নানা খেলা । জন্ম হয়েছে নানা তারকার । পতন হয়েছে নানা খেলোয়াড়ের । এবার সেই সব বর্ণময় কাহিনি ফিরে দেখার পালা।

 

ফুটবল : ভারতীয়রা বর্তমানে এই খেলাতে তেমন দক্ষতা প্রর্দশন করতে না পারলেও ভারতে ফুটবলের সূত্রপাতের কহিনী বেশ রোমাঞ্চকর । ১৮৭৯ সালে যখন বালক নগেন্দ্রপ্রসাদ সর্বাধিকারী প্রথম ভারতীয় হিসেবে ফুটবলে পা ছোঁয়ান তখন থেকেই ব্রিটিশদের তিরস্কার ছাড়া কিছুই জোটেনি কপালে। কিন্তু ১৮৯৩ সালে নগেন্দ্রপ্রসাদের নেতৃত্বে শোভাবাজার ক্লাবের ট্রেডস কাপ জয় জাতীয়তাবাদের বারুদকে উস্কে দিয়েছিল । ১৯১১ সালে শিবদাস ভাদুড়ির নেতৃত্বে মোহনবাগানের আই.এফ.এ শিল্ড জয় ছিল ভারতীয় স্বাধীনতার অগ্রদূত । কিন্তু তার পরবর্তী সময়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটেনি । ১৯৫৪ সালে সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপে ভারত সুযোগ পেলেও ভালো বুটের অভাবে আর খেলা সম্ভবপর হয়নি। সাফ কাপে ভারত সাফল্য বেশ চোখে পড়ার মতো। ৪বার এই কাপ জয় করেছে ভারত । ১৯৮৫ সালে ভারতের দক্ষিন এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপে ভারতের জয় বেশ উল্লেখযোগ্য । এছাড়া ২০১৮ সালে অনুর্ধ্ধ ২০ দলের আন্তর্জাতিক ফিফা প্রদর্শনী ম্যাচে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলে হারানো যথেষ্ট কৃতিত্বের দাবি রাখে । এছাড়া ২০১৭ সালে ভারত প্রথমবারের জন্য অনুর্ধ ১৭ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় । যদিও ফল আশানুরুপ হয়নি । এবছর ২০২৩ AFC এশিয়ান চ্যাম্পিয়ানশিপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে প্রতিটি ম্যাচেই জিতেছে ভারত । আশা করা যায় ২০২৩ এ অনুষ্ঠিত হওয়া এই প্রতিযোগিতায় ভারত ভালো ফল করবে।  ভারতের মহিলারাও ফুটবলে পিছিয়ে নেই । বালাদেবী প্রথম ভারতীয় হিসেবে স্কটল্যান্ডের রেঞ্জার্স ক্লাবের হয়ে মহিলাদের UEFA চ্যাম্পিয়ানস লিগে খেলে ইতিহাস তৈরি করেছেন । স্বাধীন ভারতের কয়েকজন অজেয় ফুটবলার —— গোষ্ঠপাল , চুনী গোস্বামী , শ্যাম থাপা , আই.এম.বিজয়ন , শৈলেন মান্না , পিটার থঙ্গরাজ , বাইচুং ভুটিয়া , সুনীল ছেত্রী (ভারতের সর্বকালীন সর্ব্বোচ্চ গোলদাতা – ৮৪ টি গোল )

 

ক্রিকেট : স্বাধীন ভারতে ক্রিকেট খুবই জনপ্রিয় । এই খেলাতে ভারতের সাফল্য সবথেকে   বেশি । ১৯৩২ সালে লর্ডসের মাঠে সি.কে.নায়াডুর নেতৃ্ত্বে ভারত প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামে ও ইতিহাসের সূত্রপাত করে । ১৯৭৪ সালে অজিত ওয়াদেকারের অধিনায়কত্বে ভারত প্রথম ওয়ানডে খেলে । ২০০৬ সালে জোহেনেসবার্গে দক্ষিন আফ্রিকার বিরুদ্ধে ভারত বীরেন্দ্র সহবাগের নেতৃত্বে প্রথম টি টোয়েন্টি খেলে ।  এই অঙ্গনে ভারতের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো । ১৯৮৩ ও ২০১১ তে দুবার একদিনের বিশ্বকাপ , ২০০৭ এ টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ , ২০১৩ তে চ্যাম্পিয়নস্ ট্রোফি এছাড়াও সাতবার এশিয়া কাপ জয় তো রয়েছে। ভারতীয় মহিলাদের ক্রিকেটও পিছিয়ে নেই । তারাও এই খেলাকে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্বের দরবারে । বিশ্বকাপ না জিতলেও দুবারের রানার্স আপ । এই বছর কমনওয়েলথ গেমসে আমাদের মহিলাবাহিনী রৌপ্য পদক  পেয়েছে । যদিও ভারতীয় পুরুষদের ক্রিকেটের সময়টা বিশেষ ভালো যাচ্ছে না । এক ভাঙাগড়ার মধে্য দিয়ে দল এগোচ্ছে । তারুণ্য ও অভিজ্ঞতার মিশেল থাকলেও দলে ম্যাচ উইনারের অভাব চোখে পড়ছে । এশিয়া কাপে সুপার ফোর থেকে বিদায়ের পর ভারতের চোখ এবারের টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ যা অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হবে । দেখার বিষয় ভারত কতদূর এগোতে পারে । স্বাধীন ভারতের কয়েকজন অজেয় ক্রিকেটার —— শচীন তেন্ডুলকর , সৌরভ গাঙ্গুলি , সুনীল গাভাস্কার , জাগাভাল শ্রীনাথ , জাহির খান , কপিল দেব . মহেন্দ্র সিং ধোনি , যুবরাজ সিং , বিরাট কোহলি , রোহিত শর্মা , মিতালী রাজ , ঝুলন গোস্বামী , হরমনপ্রীত কৌর ( এই তালিকা শুধুমাত্র রের্কডের ভিত্তিতে) ।

 

হকি : হকি ভারতের জাতীয় খেলা হলেও এই খেলার মানও প্রায় পড়তির দিকে । কারন বড় মঞ্চে ভারতীয় দলের মহিলা কিংবা পুরুষ উভয়েই নক আউট ম্যাচে স্নায়ুচাপ ধরে রাখতে পারে না । একসময় স্টিক হাতে কোর্টে জাদু দেখিয়েছেন হকির জাদুকর ধ্যানচাঁদ । স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে হকির বিশ্বকাপ জয় বেশ উল্লেখযোগ্য । অলিম্পিক ১৯২৮, ১৯৩২ , ১৯৩৬ , ১৯৪৮ , ১৯৫২ , ১৯৫৬ , ১৯৬৪ , ১৯৮০ মোট আটবার সোনার পদক আসে ভারতের ঘরে । অলিম্পিকে ১৩৪টি ম্যাচে ৮৩টি জয় ভারতের সাফল্যের শিখরকে চিহ্নিত করে । এছাড়া টোকিয়ো অলিম্পিকে ব্রোজ্ঞ ও বার্মিংহাম কমনওয়েলথ গেমসে ভারতীয় পুরুষ হকি দল রৌপ্য পদক জেতে । অনেকদিনের পদক জয়ের খরা কাটিয়ে আলোর দিশা দেখাচ্ছে বর্তমান হকি দল । মহিলা দলও কমলওয়েলথ গেমসে ব্রোঞ্জ পদক পেয়েছে । তবে কি ধ্যানচাঁদের সময়কালীন সেই স্বর্ণযুগ আবার ফিরতে চলেছে ? সময়ের গর্ভে আছে সেই উত্তর ।  স্বাধীন ভারতের কয়েকজন অজেয় হকি খেলোয়াড় —–ধ্যানচাঁদ , ধনরাজ পিল্লে , বালবীর সিং , সর্দার সিং , মনপ্রীত সিং , মহম্মদ সাহিদ , শ্রীজেশ , রানি রামপাল , গুরুজিৎ কাউর প্রমুখ ।

অন্যান্য খেলা : ভারতীয়রা এই তিন মুখ্য খেলা ছাড়াও অন্যান্য খেলাতেও নিজেদের দক্ষতা প্রদর্শন করে চলেছে । যার প্রমান আমরা অলিম্পিক ও কমনওয়েলথ গেমসে পেয়েছি ।

ব্যাডমিন্টন : পিভি সিন্ধু এই সার্কিটে বেশ পরিচিত নাম । পরপর দুবার অলিম্পিকে রুপো ও ব্রোঞ্জ পদক লাভ করে দেশকে সম্মান্নিত করেছেন । এবছরও কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতে নিজের দক্ষতা প্রদর্শন করেছেন । এছাড়াও শ্রীকান্ত কাদম্বি , লক্ষ্য সেন প্রমুখ তরুনরাও চেষ্টা চালাচ্ছেন । এখানে সাইনা নেওয়ালের অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয়ও উল্লখযোগ্য।

ভারোত্তলন : এই দুনিয়ায় বর্তমানে ভারতের আকাশে ছেয়ে আছেন মনিপুরের সোনার কন্যা মীরাবাঈ চানু। অলিম্পিকে রুপো জিতে নজরে এসেছিলেন কিন্তু কমনওয়েলথ গেমসে সোনা জিতে সার্চলাইটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছেন । এছাড়াও জেরেমি লালরিনুনগা , অচিন্ত্য শিউলি যে যার নিজের বিভাগে সোনা জিতে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করেছেন । কর্নম মালেশ্বরী এক্ষেত্রে উল্লেখ্য নাম ।

বক্সিং : মেরি কম , লভলিনা বরগোঁগাঁই , নিখাত জেরিন , বিজেন্দ্র সিং , ডিঙ্কো সিং প্রমুখরা ভারতীয় বক্সিংকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছেন । অলিম্পিক ও কমনওয়েলথ গেমসে পদকও জিতেছেন ।

কুস্তি : ভারতের প্রাচীন খেলাগুলির মধ্যে কুস্তি অন্যতম । সুশীল কুমার , যোগেশ্বর দত্ত , রবিকুমার দাহিয়া , বজরং পুনিয়া , সাক্ষী মালিক , ভিনেশ পোঘাট প্রমুখরা ভারতীয় কুস্তিকে আলো করে রেখেছেন । অলিম্পিক ও কমনওয়েলথ গেমসে পদকও এসেছে তাদেরই হাত ধরে ।

টেনিস : টেনিসে ভারতের মুখ বলতে সানিয়া মির্জা , লিয়েন্ডার পেজ , রোহন বোপান্না , মহেশ ভূপতি প্রমুখ । তাদের সৌজন্যে এসেছে নানা গ্র্যান্ডস্ল্যাম । ১৯৯৬ অলিম্পিকে লিয়েন্ডার পেজ ব্রোঞ্জ জয় গুরুত্বপূর্ণ ।

কাবাডি : কবাডি ভারতের প্রাচীন খেলা । কিন্তু একসময়ের  জাতীয় খেলা বর্তমানেও দর্শকদের কাছে বেশ আকর্ষনীয় ও জনপ্রিয় । এখনও পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপ হয়েছে কবাডিতে তিনটি বিশ্বকাপই জয় করেছে ভারত । প্রোকাবাডি লিগের দৌলতে নতুন খেলোয়াড়েরা সুযোগ পাচ্ছেন । এখান থেকেই তো প্রদীপ নারওয়াল , মনজিৎ চিল্লার , পবন কুমার সেরাওয়াত , রাহুল চৌধুরি প্রমুখ তারকার জন্ম হয়েছে ।

শেষের কথা : টেবিল টেনিস , জ্যাভলিন থ্রো , তিরন্দাজী , শুটিং , গল্ফ , বিলিয়ার্ডস , স্নুকার , জুডো ইত্যাদি নানা খেলাতেই ভারতের খেলোয়াড়েরা কিন্তু সাফল্যের প্রমান দিয়েছেন । স্বাধীনতার ৭৫ বছরে সকল ভারতীয় ক্রীড়াব্যক্তিত্তকে আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা । স্বাধীনতার একশো বছরে যেন তারা প্রত্যেকেই ভারতীয় ক্রীড়াকে সাফল্যের এভারেসটে পৌঁছে দেবে । একজন ভারতীয় হিসেবে এই হোক আমাদের কামনা ।।।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *