টিঁকে থাকলে বয়স হত পঁচাত্তর

সুকান্ত মুখোপাধ্যায়
আমরা যারা পঞ্চাশোর্ধ বা ষাটোর্ধ তাদের ছেলেবেলায় না ছিল স্মার্টফোন, না এল.ই.ডি টিভি আর হাজারো রকমের গেমস। তখন ঘরে বসে খেলা মানে ছিল ব্যাগাডুলি, চাইনিজ চেকার, ক্যারাম, দাবা, লুডো এইসব আর মাঠে ছিল হাডুডু, কবাডি, চুন দিয়ে ঘর কেটে শির খেলা, শীতকালে ক্রিকেট আর গরম বা বর্ষাকালে ফুটটেনিস। ফুটবল খেলাটাও তখন প্রায় বিলাসিতার পর্যায়ে পড়ত। আর ছিল হরেক রকম পত্রিকা। শুকতারা, কিশোর ভারতী ছাড়াও দেব সাহিত্য কুটির থেকে ছোটদের জন্য চমৎকার সব পত্রিকা প্রকাশ হত। তবে একটা কথা অনস্বীকার্য যে বাঁটুল, হাঁদা ভোঁদা আর নন্টে ফন্টে এরা বড় ছোট নির্বিশেষে সকলেরই প্রিয় চরিত্র ছিল। বছরের পর বছর এদের কারো বয়স বাড়ে না, এমনকি হেডস্যার পাতিরাম হাতি বা বজ্জাত কেল্টুদারও। আমরা সবসময় চাইতাম বাঁটুল যেন কখনই না হারে আর ঠিক সেটাই হত। কোন না কোন অদ্ভুত উপায়ে বাঁটুল প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করত। মজার ব্যাপার হল আমরা সকলেই বুঝতে পারতাম যে এগুলো সবই আসলে কাল্পনিক চরিত্র কিন্তু কখনই সেটা মনে ঠাঁই পেত না।
আর এক ছিল খবরের কাগজের চরিত্র জাদুকর ম্যানড্রেক। অসম্ভব তার জাদুর ক্ষমতা। এখনকার ছোটদের কাছে যেমন প্রিয় চরিত্র ব্যাটম্যান বা সুপারম্যান আমাদের সময়ে তেমনই প্রিয় চরিত্র ছিল টারজান আর জাদুকর ম্যানড্রেক।
এইসব পত্রপত্রিকার ভিড়ে আরও একটা চমৎকার পত্রিকা প্রকাশিত হত যার নাম ছিল “চাঁদমামা”। এটা শুধু বাংলা ভাষা নয় ভারতের আরও তেরটি ভাষায় মাসিক পত্রিকা হিসাবে প্রকাশিত হত। এই পত্রিকার আকর্ষণ ছিল আবার সম্পূর্ণ আলাদা কারণ এখানে কার্টুন নয় রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ আর নানারকম অজানা কাহিনী খুব সুন্দর করে ছবি দিয়ে লেখা হত। এত চমৎকার সেই লেখার বাঁধুনি যে একবার পড়া শুরু করলে না শেষ করে ওঠার যো ছিল না। সবচেয়ে আকর্ষক ছিল দীর্ঘদিন ধরে চলা “বেতাল কথা”। বেতাল পঞ্চবিংশতির আখ্যান থেকে উপাদান নিয়ে একেকটা গল্প শুরু হত। মহারাজ বিক্রমাদিত্য প্রতিদিন শবরূপী বেতাল যে একটা গাছে ঝুলত তাকে নামিয়ে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেই অমনি বেতাল তাঁকে একটা করে প্রশ্ন করত। বিক্রমাদিত্য তার উত্তর দিতেন। বেশ মজার সেই প্রশ্নোত্তর পর্ব। একটা নির্দিষ্ট সময় পর সেই পর্ব শেষ হলে অমনি বেতাল সড়াৎ করে রাজার কাঁধ থেকে নেমে আবার সেই গাছে গিয়ে উঠত। এই গল্পগুলো আমাদের মোহিত করে রাখত। এছাড়াও অন্য যে সব গল্প থাকত সেগুলোও পড়তে খুবই ভাল লাগত, নতুন কত কিছু জানা হয়ে যেত। তবে সব গল্পের একটা মূল কথা থাকতই — সেটা হল দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন।
এখন শুকতারা বা কিশোর ভারতী পাওয়া গেলেও তার আকর্ষণ গেছে কমে। আর চাঁদমামা বন্ধ হয়ে গেছে সেই ২০১৩ সালে। অথচ টিঁকে থাকলে তার বয়স হত পঁচাত্তর।
চাঁদামামা পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৪৭ সালে আমাদের স্বাধীনতা পাওয়ার আগেই জুলাই মাসে। প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় লেখক চক্রপাণি। দক্ষিণ ভারতের প্রখ্যাত চিত্র প্রযোজক বি. নাগি রেড্ডি এই পত্রিকার মুদ্রক ও প্রকাশক ছিলেন। মূলত এই দু’জনের প্রচেষ্টায় ছোটদের এই পত্রিকাটি সারা ভারতে অচিরেই বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একসময় এই ছোটদের পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় দু’লক্ষে। তেলুগু ও তামিল এই দুই ভাষাতে দক্ষিণ ভারত থেকে “অম্বুলিমামা” নামে চাঁদমামার আত্মপ্রকাশ কারণ চাঁদের দক্ষিণ ভারতীয় নাম “অম্বুলি”।
অভিনব জয়যাত্রা চাঁদমামা’র। ১৯৪৯ এর জুলাই মাসে কন্নড় ভাষায়, আগস্ট মাসে হিন্দী ভাষায় প্রকাশের পর ১৯৫২ সালে মালয়ালাম, ১৯৫৪ য় গুজরাতি, ১৯৫৫ য় ইংরেজি, ১৯৫৬ সালে ওড়িয়া ও সিন্ধী, আগস্ট ১৯৭২ এ বাংলায়, ১৯৭৫ এ পাঞ্জাবী ভাষায়, পরের বছর অর্থাৎ ১৯৭৬ এ অহমিয়া, ১৯৭৮ এ সিংহলী, ১৯৮৪ র এপ্রিল মাসে সংস্কৃতে, এবং ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয় সাঁওতালী ভাষায়। সহজেই বোঝা যায় সারা ভারতে এই পত্রিকার জনপ্রিয়তা কেমন ছিল। সম্ভবত গোটা ভারতবর্ষে স্থান অনুযায়ী চাঁদের নামে স্থানীয় ভাষায় আর কোন পত্রিকা এত জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি।
চাঁদমামা প্রথম যখন তেলেগু ভাষায় প্রকাশ পায় সেই আমাদের স্বাধীনতার সময়ে তখন থেকেই এর মূল আকর্ষণ ছিল গল্প লেখার রীতি আর অসাধারণ অলঙ্করণ। ঠিক ছোটরা যেমন ঠাকুমা বা ঠাকুরদার কাছে বসে পুরনো দিনের গল্প শোনে সেই আঙ্গিকেই গল্প লিখতেন কুটুম্বরাও যিনি প্রায় একক প্রচেষ্টায় এক ঝাঁক তেলেগু লেখককে ক্রমাগত উৎসাহ দিয়ে সহজ সরল গদ্যে নানা পৌরাণিক ও গল্পকথা লিখিয়ে নিতেন। অন্যদিকে হাল ধরেছিলেন দশেরি সুব্রমণিয়ম যিনি ফিচার লেখার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ‘পাতাল দুর্গা’ কে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। শুধুমাত্র আনন্দ নয় লেখার মাধ্যমে জীবনে নীতিবোধের প্রভাব যাতে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল “চাঁদমামা”।
চাঁদমামা অনেকটাই বন্ধুবান্ধবদের দ্বারা তৈরি হয়েছিল বলে দীর্ঘদিন এর পরিচালনভার ছিল পারিবারিক স্তরে। সম্পাদকের গুরুদায়িত্ব দীর্ঘদিন সামলেছেন চক্রপাণির বিশেষ বন্ধু ও তেলেগু সাহিত্যের বিশিষ্ট লেখক কুটুম্বরাও। পত্রিকা পরিচালনা করা মোটেও সহজ কাজ ছিল না কারণ দেশের নানা ভাষায় ভাল অনুবাদক যোগাড় করা ছাড়াও পত্রিকার বিপণনেরও এক বড় দায়িত্ব ছিল। পাশাপাশি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্যকে সহজ সরল ভাষায় নীতিবোধ বজায় রেখে ছোটদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার গুরুদায়িত্বও কুটুম্বরাও পালন করেছেন ১৯৮০ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত।
এই ধরনের পত্রিকায় রঙীন ছবির প্রয়োজন সর্বাধিক তাই গোড়া থেকেই বেশ কিছু শিল্পী এই গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। তাঁরা পাঠকদের কাছে সংক্ষিপ্ত নামেই পরিচিত ছিলেন। যেমন এম.টি.ভি.আচার্য যিনি পরিচিত ছিলেন আচার্য নামে, তেমনই ‘চিথ্র’ র আসল নাম ছিল ভীরা রাঘবন, ‘ভাপা’র আসল নাম হল ভাদাদি পাপায়য়া, কেশব নামে ছবি আঁকতেন কেশব রাও আর শঙ্কর নামে দীর্ঘদিন — সেই ১৯৫১ থেকে টানা ২০১১ পর্যন্ত যিনি অজস্র ছবি তুলি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর আসল নাম ছিল কে.সি.শিবশঙ্করণ। পরের দিকে অবশ্য নতুন নতুন শিল্পীর যেমন রাজী, বাসা, আয়া, মহেশ এঁদের আঁকা ছবিতে সমৃদ্ধ হয়েছিল “চাঁদমামা”। প্রথম দিকে নিজেরা পরিচালনভার নিলেও পরে ১৯৯৯ নাগাদ মরগ্যান স্ট্যানলি এটিকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর করে পরিচালনায় সহায়তা করেছিল। কুটুম্বরাওয়ের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বি.বিশ্বনাথ রেড্ডি সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। শুধুমাত্র, ” অমর চিত্রকথা” বিভাগটি অক্ষুণ্ণ রেখে পত্রিকাটিকে আধুনিক করার লক্ষ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন করা হয় এবং পুরনোর পাশাপাশি খেলাধূলা, রহস্য রোমাঞ্চ গল্প ও আরও নানা ধরনের নতুন নতুন গল্প জুড়ে বদলে যাওয়া যুগের নব্য পাঠকদের উপযোগী করে তোলার চেষ্টা করা হয়। তবে একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে “বেতাল কথা” চাঁদমামার জনপ্রিয়তাকে তুঙ্গে পৌঁছাতে সাহায্য করেছিল।
২০০০ সালের পর থেকে প্রযুক্তির হাত ধরে এল নতুন যুগ। আস্তে আস্তে মোবাইল, নানা রকমের অনলাইন গেম, কার্টুনের রমরমায় আস্তে আস্তে জনপ্রিয়তা হারাতে লাগল চাঁদমামা। এটা শুধু যে এই অভিনব পত্রিকাটির ক্ষেত্রে হয়েছে তা নয় আধুনিকতার শিকার হয়েছে আরও অনেক ছোটদের পত্রিকা।
২০০৭ সালে “চাঁদমামা” র স্বত্ব কিনে নেয় ‘জিওডেসিক ইনফরমেশন সিস্টেম’ নামের এক কোম্পানি।
মার্চ ২০১৩ সালের পর থেকে চাঁদমামার সবকটি প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।পরিচালকদের পক্ষ থেকে অবশ্য আগেই ঘোষণা করা হয়েছিল যে এই পত্রিকার পুরনো সব সংখ্যাই আধুনিক পদ্ধতিতে ডিজিটাইজ করে সংরক্ষণ করা হবে। যদিও তা বাস্তবে কতটা হয়েছে তা বলা মুস্কিল।
তবে আশার কথা এই যে চাঁদমামা পত্রিকা আকারে প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেলেও চাঁদমামাপ্রেমীদের একটি দল একজোট হয়ে নিজেদের উদ্যোগে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই পত্রিকাকে তুলে ধরার জন্য ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে এক ওয়েবসাইট খুলেছেন এবং দশটিরও বেশী ভাষায় পুরনো সংখ্যাগুলি বর্তমান আগ্রহী পাঠকদের কাছে পৌঁছে দিতে পেরেছেন।
আমাদের দেশের স্বাধীনতার সময়কালে তেলেগুভাষী চক্রপাণি, নাগি রেড্ডি এবং কুটুম্ব রাও – আমাদের দেশীয় ইতিহাস, পুরাণ, সামাজিক ও নৈতিক শিক্ষাকে এদেশের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আদর্শ নাগরিক ও দেশকে ভালবাসার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন ও কাজে করিয়ে দেখিয়েছিলেন আজ পঁচাত্তর বছর পরে সেই ইতিহাস স্মরণ না করলে আমরাই অপরাধী থেকে যাব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে শুধু এই কারণেই যে নিজেদের দেশের শিক্ষা সংস্কৃতির মধ্যে যে নৈতিকতার বীজ নিহিত আছে তাকে বহন করা মানে আসলে ঐতিহ্যকেই বাঁচিয়ে রাখা।