August 21, 2025

রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ১৯৭৫

সৌরভ সিংহ

মানুষ রাজনৈতিক জীব,একথা বলেছেন বিখ্যাত দার্শনিক অ্যারিস্টটল।আর বহুবার মানুষ বিভিন্ন রাষ্ট্রে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে থাকে। তেমনি আমাদের ভারতে জরুরি অবস্থা।২৫ জুন ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো ভারতীয় সরকার জরুরি অবস্থা অর্থাৎ নাগরিকদের নাগরিক অধিকার স্থগিত করে (অনেকটা প্রাক-স্বাধীনতার যুগের মতো), এবং দেশটিকে অগণতান্ত্রিক মোডে ঠেলে দেয়, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সেন্সর করে, ছাত্র, শিক্ষাবিদদের গ্রেপ্তার করে,  লেখক, সাংবাদিকদের পাশাপাশি যারা সরকারের বিরোধিতা করেছেন। ঘটনাটি সত্যিই দুঃখজনক এবং অনেকে এটিকে ভারতীয় রাজনীতির অন্ধকারতম দিন হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

ইন্দিরা গান্ধী ২৫ জুন,১৯৭৫-এ আন্তর্জাতিক গোলযোগের কারণে জরুরী অবস্থা জারি করেছিলেন বলে প্রধানমন্ত্রী অফিস সূত্রে প্রকাশ, সংবিধানের অধীনে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য নিশ্চিত করা মূল মৌলিক অধিকারগুলি স্থগিত করেছিলেন।

এটি ছিল তৃতীয় জাতীয় জরুরি অবস্থা (প্রথমটি ছিল ১৯৬২ সালে যখন চীন ভারত আক্রমণ করেছিল এবং দ্বিতীয়টি ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের সময়), সেটা তেমন কিছু ছিল না এবং “অভ্যন্তরীণ ঝামেলা” উল্লেখ করে একমাত্র ঘোষণা করা হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থা পরিপ্রেক্ষিতে ইন্দিরা গান্ধী সরকার যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি রয়েছে যার জন্য এই ধরনের কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।  সেই সময়ে, পাকিস্তানের সাথে একটি যুদ্ধ সম্প্রতি শেষ হয়েছিল যার কারণে অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রতিবাদ ও ধর্মঘটের দিকে। এটা, সরকার বলেছে যে এটি অনেকাংশে দেশের ক্ষতি করেছে।

জরুরি অবস্থা বলতে ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ২১ মাসের সময়কালকে বোঝায়। বর্তমান ‘অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার’ কারণে সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের অধীনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলী আহমেদ আনুষ্ঠানিকভাবে জারি করেছিলেন। জরুরী অবস্থা ২৫ জুন ১৯৭৫ থেকে ২১ মার্চ ১৯৭৭ পর্যন্ত কার্যকর ছিল।

ভারতীয় সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদ অনুসারে, যুদ্ধ, বহিরাগত আগ্রাসন বা সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে ভারত বা এর যে কোনও অঞ্চলের নিরাপত্তার জন্য “গুরুতর হুমকি” হলে একটি জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রী পরিষদের লিখিত অনুরোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতি এই ধরনের জরুরি অবস্থা জারি করতে পারেন।

১৯৭৫ সালে কি ঘটেছিল?

এই ২১ মাসের সময়কালে, ইন্দিরা নিজেকে ‘অসাধারণ ক্ষমতা’ পাওয়ার জন্য সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করেছিলেন এবং ‘নাগরিক স্বাধীনতা’ এবং রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্র্যাকডাউন শুরু করেছিলেন, বিজয়রাজে সিন্ধিয়া, জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজি দে-এর মতো বিরোধী নেতাদের গ্রেপ্তার করেছিলেন। চৌধুরী চরণ সিং, অটল বিহারী বাজপেয়ী এবং লালকৃষ্ণ আদবানি সহ ৩৯ জন সাংসদ কে গ্রেফতার করা হয়।

মিডিয়ার নিন্দা করা এবং ইন্দিরার ছোট ছেলে সঞ্জয় গান্ধী দ্বারা পরিচালিত ‘জোর করে বন্ধ্যাকরণ অভিযান’ও এই সময়কালে  হয়েছিল। জরুরি অবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হওয়ার পর, নতুন নির্বাচন আহ্বান করা হয়, কংগ্রেস একটি বড় ব্যবধানে হেরে যায়, যার ফলে জনতা পার্টির মোরারজি দেশাই ভারতের প্রথম অ-কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী হন।

ইন্দিরা সরকার মৌলিক অধিকার প্রয়োগের জন্য আদালতে যাওয়ার অধিকার স্থগিত করে। এছাড়াও, অভ্যন্তরীণ জরুরী অবস্থা আরোপ করার আগে থেকেই একটি বাহ্যিক জরুরি অবস্থা জারি ছিল

কেনো হয়েছিল জরুরি অবস্থা শুধু কি প্রশাসনিক ব্যাপার,নাকি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র? বেশ কয়েকটি কারণ আছে তার মধ্যে চারটি পেশ করছি।

১/ কংগ্রেস আই এর মধ্যে ব্যাপক হারে দূর্নীতি স্বজনপোষণ ইত্যাদি তার বিরুদ্ধে গলা তুলেছিলেন লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ।

২/ ১৯৭৩ সালে গুজরাটের নবনির্মাণ কমিটি যা আদি কংগ্রেস নেতা মোরারজি দেশাই দ্বারা পরিচালিত ছিল, এবং বিহারের ছাত্র সংসদ কমিটি যা লালুপ্রসাদ যাদব ও নীতিশ কুমার যারা তখন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ওদের নেতৃত্বে আন্দোলন গড়ে ওঠে।যা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ে।সেই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন চিমনভাই প্যাটেল,তার বিরুদ্ধে দূর্নীতির অভিযোগ আনেন নবনির্মাণ কমিটি, মোরারজি দেশাই সিদ্ধান্ত নেন সরকার উৎখাত না হ‌ওয়া অবধি আমরণ অনশন করবেন।সেই সময় ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন ভি.ভি.গিরি, তিনি তখন ইন্দিরা গান্ধী কে বোঝান যে মোরারজি দেশাই এর কিছু হলে সর্বনাশ হবে,তখন ইন্দিরা গান্ধী বাধ্য হন গুজরাট বিধানসভা ভেঙ্গে দিতে,ফলে নির্বাচন হয়, ভরাডুবি হয় কংগ্রেসের। আদি কংগ্রেস নেতা বাবু ভাই জে. প্যাটেল হন মুখ্যমন্ত্রী।

৩/ ১৯৭১ সালে উত্তরপ্রদেশের রায়বেরালি ইন্দিরা গান্ধী জেতেন, ওনার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন রাজ নারায়ণ, তিনি এলাহাবাদ হাইকোর্টে একটি মামলা ঠোকেন যে অসৎ উপায়ে ইন্দিরা গান্ধী জয়ী হয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী অফিসের অফিসার যশপল কাহার’কে ব্যবহার করে। ১৯৭৫ সালের ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট রায় দেন, ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচন অবৈধ। ফলে জয় হয় রাজ নারায়ণের।

৪/ ২৩ জুন ও ২৪ জুন সংসদে বিরোধীদের ধরণা শুরু হয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পদত্যাগের দাবীতে। সেই সময় কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ গোলোযোগ শুরু হয়,বাবু জগজীবন রাম কে প্রধানমন্ত্রী করার দাবীতে স‌ই সংগ্রহ চলে তৎকালীন তরুণ তুর্কি নেতা চন্দ্রশেখর যিনি পরবর্তী সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, কৃষ্ণকান্ত যিনি পরবর্তীতে ভারতের উপরাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন,অন্ধ্রপ্রদেশের সাংসদ লক্ষ্মীকান্তামা এবং মোহন বালিয়া যিনি মোরারজি দেশাই-এর মন্ত্রীসভায় মন্ত্রী হন, এদের নেতৃত্বে স‌ই সংগ্রহ চলে।

ইন্দিরা গান্ধী চিন্তিত হয়ে পড়েন,তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রহ্মানন্দ রেড্ডি, আইন মন্ত্রী এইচ. আর. গোখলে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়’কে ২৪ জুন বৈঠকে ডাকেন। সেই সময় আইনে ৩৫২ অনুচ্ছেদের কিছু সংশোধনী এনে, গোপনে রাত বারোটার সময় অর্থাৎ ২৫ জুন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদের কাছে স‌ই করিয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়। সেই সময় প্রেসের স্বাধীনতা খর্ব করা হয়, কোনো কিছু না দেখিয়ে ছাপানো যাবেনা, কিন্তু ২৫ জুন অত রাতে কি করে তা সম্ভব হবে,তাই দিল্লীর সব মিডিয়া হাউজের পাওয়ার কাট করা হয়, পরেরদিন যথাক্রমে ওই নিয়ম বলবৎ হয় প্রেসের ক্ষেত্রে।

আজ থেকে বহু বছর আগে সুকুমার রায় লিখে গেছেন,

“শিবঠাকুরের আপন দেশে,

আইন কানুন সর্বনেশে !

কেউ যদি পা পিছলে প’ড়ে,

প্যায়দা এসে পাক্‌‌ড়ে ধরে,

কাজির কাছে হয় বিচার-

একুশ টাকা দণ্ড তার ।।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *