August 21, 2025

মসির ধারায় অসির ধার (৩১)

সঞ্জীব মুখার্জী 

 “Success is not final; failure is not fatal: It is the courage to continue that counts.”

 Winston S. Churchill

 

বেশ কেটে যাচ্ছিলো নানান প্রাকৃতিক এবং সামরিক অনুকূলতা এবং প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে সিকিমের ভারত-চীন সীমান্তের দিনগুলি। কখনো পেঁজা তুলোর মতো মাটিতে পড়ে থাকা ২০ ফুট পুরু বরফের চাদরের আবরণ আবার কখনো নিরন্তর ঝরে পড়া অতিবৃষ্টির দোর্দন্ড প্রকোপ। সীমান্তে আমাদের বসবাস করার জন্য নির্মিত ঈগলুগুলিকে ব্যবহার করা হতো। কখনো সেই ঈগলুর ছোট ঘুলঘুলির ন্যায় খোলা জানালা দিয়ে ঈগলুর ভিতর অবাধে প্রবেশ করতো একঝাঁক পথ হারা মেঘের দল আবার কখনো আকাশ পরিষ্কার থাকলে ঈগলুর কাঁচের জানালা দিয়ে সক্কাল বেলায় দেখা যেত কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া। ঈগলুতে প্রবিষ্ট মেঘের দল যেন আমাদের প্রবাসী সৈনিকদের সাহস জুগিয়ে বলার চেষ্টা করতো যে – তোরা কেউ ভয় করিসনা আমরা তোদের সঙ্গে আছি, ঠিক তেমনি নির্ভীক মাথা উঁচু করে গগনচুম্বী কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াও তার নিজের উপস্থিতির মাধ্যমে আমাদের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করতো যে – চিন্তা করিসনে, আমার মতো তোদের মাথাও সগর্বে এবং সসম্ভ্রমে উঁচু হয়ে থাকবে। আমাদের বসবাস করার জন্য ইগলু ছাড়া এক্কেবারে চূড়ান্ত সীমান্তে অর্থাৎ সীমারেখার তারকাঁটার বেড়ার লাগোয়া ছিল আমাদের নিজস্ব অবজারভেশন পোস্টগুলি যেখান থেকে থেকে দূরবীন দিয়ে অপর দিকের চীনা সৈনিকদের গতিবিধির উপর নিশ্ছিদ্র প্রহরীর মতো নজরদারী রাখাটাই ছিল আমাদের পরম দায়িত্ব এবং কর্তব্য। আমাদের অবজারভেশন পোস্টগুলির একটির থেকে আরেকটির দূরত্ব প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ মিটার আর পোস্টগুলি একে অপরের সাথে একটি মানুষ সমান গভীরতা বিশিষ্ট খনিত একটি পরিখার দ্বারা এমন ভাবে যুক্ত যাতে করে আমাদের সৈনিকরা যখন অবজারভেশন পোস্ট অদলা বদলী করেন তখন তাঁরা সেই পরিখার মধ্যে দিয়ে হাঁটা চলা করে পোস্ট বদলী করেন এবং চীনা সৈনিকদের নজরদারী এড়িয়েই সেটা করতে পারেন। কয়েক মাস সেখানে থাকার পর অপরদিকের চীনা সৈনিকদের সঙ্গে মুখচেনা হয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে সেটা পরিচিতিতে রূপান্তরিত হয় আর যেটার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে একে অপরের প্রতি এক সৌহার্দ্য সুলভ আচরণ। বিনিময় হয় দৈনিক সকাল, বিকাল এবং রাত্রির রুটিন অভিবাদন বার্তার। কখনো কখনো তারা ইংরেজি ভাষায় আমাদের শরীর স্বাস্থ্যের খোঁজ খবর নিতো। প্রথম প্রথম তাদের ইংরেজীটা বুঝতে একটু কষ্ট হলেও সময়ের প্রগতির সাথে সাথে আমরা সেগুলির সঙ্গে সড়গড় হয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে মধ্যে আমাদের এবং চীনা সৈনিকদের রুটিন অভিবাদন বার্তা বিনিময়ের মধ্যে স্থান পায় “জয় বাবা হরভজন” শব্দাবলীর। চীনা সৈনিকদের জ্বিহা দিয়ে খুব একটা পরিষ্কার ভাবে “জয় বাবা হরভজন” না নিঃসৃত হলেও তাঁরা যথা সম্ভব চেষ্টা করতো বাবা হরভজনের জয়ধ্বনির নির্ভুল উচ্চারণের। যাইহোক, চীনা সৈনিকদের মুখ থেকে ‘বাবা হরভজনের জয়’ বার্তার উচ্চারণ শুনে এবং বাবা হরভজনের অপার্থিব উপস্থিতির প্রতি চীনা সৈনিকদের এক শ্রদ্ধাপূর্ণ ভাবমূর্তি দেখে ভারতবর্ষের সৈনিক হিসাবে আমাদের বুক সত্যিই গর্বে ফুলে দ্বিগুন হয়ে যেত। বাবা হরভজনের প্রতি আমাদের অগাধ আস্থা এবং অটুট বিশ্বাস যেন অহর্নিশি আমাদের সাহস যোগাতো আর বলাই বাহুল্য যে সেই অদম্য সাহস ভারত-চীন সীমান্তে আমাদের দেশের প্রতি কর্তব্যনিষ্ঠা এবং দায়ীত্বপরায়ণতার দিকে সুদৃঢভাবে ঠেলে দিতো।

এইভাবে অতিবাহিত হচ্ছিলো দিন, সপ্তাহ আর মাসগুলি আর তারপর দেখতে দেখতে বছরও ঘুরে গেলো, ১৯৯৫ সাল ছেড়ে প্রবেশ করলাম ১৯৯৬ সালে। এরই মাঝে হঠাৎ একদিন আমার স্ত্রী জবার লেখা একটি চিঠির মারফৎ জানতে পারলাম যে আমার স্ত্রী জবা সন্তানসম্ভবা  আর ঠিক তারই সমান্তরালে বাড়ি থেকে আসা বাবা এবং মায়ের লেখা অপর একটি চিঠি তেও একই সংবাদ পেলাম। বাবা এবং মা জবাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে নিয়ে এসে সমস্ত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর সুনিশ্চিত হয়ে তারপর খবরটা আমায় দেন। ডাক্তারের মতামত অনুযায়ী যদিও সেটা জবা এবং আসন্ন সন্তান উভয়ের কাছেই একদিকে যেমন একটা প্রাথমিক পর্যায় ছিল তেমনি অন্যদিকে ব্যাপারটা অত্যন্ত সংবেদনশীলতার মধ্যে ছিল। যাইহোক, খবরটা শুনেই আমার মনটা যেন আপনা থেকেই এক অজানা খুশীর তরঙ্গে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো, সারা শরীরকে যেন আন্দোলিত করে দিয়ে গেলো এক পরম আনন্দের ঢেউ। পোস্টের সহকর্মী সৈনিকদের সাথে খবরটা ভাগ করতেই তারাও খুব খুশি হলো। কেটে গেলো আরো কয়েকটি মাস আর এই মাসগুলিতে ঘনীভূত হলো বাড়ির আর আমার মধ্যে পত্রের আদান প্রদানের তীব্রতা। কিছুদিন পর বাবার লেখা একটি চিঠিতে জানতে পারলাম এবং জানতে পাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তাগ্রস্তও হলাম যে জবার পেটের ক্রমবর্ধমান শিশুটি একটু জটিলতার মধ্যে রয়েছে যার কারণে জবা এবং শিশু দুজনেই বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারে যদি না সত্বর কোনো বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা যায়। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সেই সমস্ত সাবধানতা অবলম্বন করেই এবং একরকম তাঁর ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানেই জবা সহ শিশুটি তিল তিল করে বেড়ে উঠল। যথা সময়ে বাবার একটি চিঠিতে জানতে পারলাম যে জবা এবং শিশুটি বিপদ কাটিয়ে উঠলেও এক্ষেত্রে সাধারণ প্রসব পদ্ধতির দ্বারা শিশুটিকে ভূমিষ্ঠ করানো যাবে না।  তাহলে কি সার্জারী করে বের করতে হবে শিশুটিকে? বাবার উত্তরটা ছিল হ্যাঁ। ওই একই চিঠিতে বাবা লিখেছিলেন যে ২৪শে মে ডাক্তার ডেট দিয়েছেন সার্জারীর এবং সেই মতো আমাকে বাড়ি আসার কথাও লিখেছেন বাবা ওই চিঠিতে। কুপুপ থেকে বাড়ি পৌঁছতে কি রকম কি সময় লাগবে সেই সব কথা মাথায় রেখে আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল ধিল্লন কে ইতিবৃত্তান্ত জানালাম। শোনার সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল ধিল্লন আমায় দিন ২০ ছুটি অনুমোদন করে দিলেন।

২৪শে মে তারিখটার কথা মাথায় রেখে ঠিক ২০ মে তারিখের ভোরবেলাতেই রওনা দিলাম কুপুপ থেকে।  আর্মির কনভয়ের গাড়িতে করে সারাটা দিনমান চলে সেই দিনই বিকাল বেলায় শিলিগুড়ি ট্রানজিট ক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম।  সেখান থেকে হয় তেনজিঙ নোরগে বাস টার্মিনাস থেকে সিউড়ীগামী কোনো স্টেট বাস ধরে সিউড়ি পৌঁছানো অথবা শিলিগুড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন গিয়ে সেখান থেকে রাত্রি বেলায় কলকাতাগামী কোনো ট্রেন ধরে সিউড়ি পৌঁছনো। সারাটা দিন কনভয়ের গাড়িতে ভ্রমণ করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত শরীরটা যেন আর চাইছিলোনা আবার বাসে করে শিলিগুড়ি থেকে সিউড়ী যেতে। ট্রানজিট ক্যাম্পেই লাগানো রেলওয়ে টাইম টেবিল দেখে জানতে পারলাম যে নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রাত্রি সাড়ে আটটায় কলকাতাগামী দার্জিলিং মেল ছাড়ে। বর্তমানে সেই ট্রেনটির নাম বদলে গিয়ে “পদাতিক এক্সপ্রেস” হয়ে গিয়ে থাকলেও সেই সময় “দার্জিলিং মেল” এর নামেই চলাচল করতো।  টাইম টেবিলের টাইমটা দেখে সঙ্গে সঙ্গে ঠিক করলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ট্রেন ধরবো, অন্ততঃ পক্ষে রাত্রিটাতো আরামে ঘুমানো যাবে আর ঠিক সক্কাল বেলায় সিউড়ী পৌঁছে যাবো। এইসব ভেবে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছলাম। স্টেশনে পৌঁছে এনকোয়ারিতে খোঁজ করে সৌভাগ্য বশতঃ একটা রিজারভেশনও পেয়ে গেলাম।  ট্রেন ছাড়ার পূর্বে প্লাটফর্ম থেকে কিছু রুটি তরকারী প্যাক করিয়ে নিলাম যে ট্রেন ছাড়ার পর নিজের বার্থে বসে আরামসে ডিনারটা সেরে নেওয়া যাবে। ট্রেনে উঠে পড়ার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেনটি নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ছেড়ে দিলো। একঘন্টা টানা চলার পর ট্রেনটি থামলো একটি স্টেশনে যার নাম আলুয়াবাড়ী। আর সেখান থেকে পুনরায় ট্রেনটি ছাড়ার পর আমি আমার খাবারের প্যাকেটটা খুলে রাত্রির খাবারটা খেতে শুরু করেছি কি করবো তখন আমার সামনের বার্থের সহযাত্রীটি আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “দাদা আপনি কতদূর যাবেন?” প্রশ্নটিতে একটু সংকোচের ভাব মিশ্রিত থাকলেও স্পষ্টতা যথেষ্ট ছিল।  আমি আর্মিতে চাকরি করতাম তাই হঠাৎ করে যেকোনো পরিচিত অথবা অপরিচিতের সাথে অযথা আলাপ করে ফেলার বদোভ্যেসটা আমার ছিল না আর কারোর এইধরণের হ্যাংলাপনাও আমার পছন্দ ছিল না।  আমার স্বভাবসিদ্ধ কারণেই অযাচিত ভাবে লোকটার এই প্রশ্ন করার কারণটা খুঁজে পেলাম না আর সেটা না পেয়েই আমি গম্ভীর গলায় লোকটিকে একটি পাল্টা প্রশ্ন করে বসলাম, “কেন, তা জেনে আপনার কি প্রয়োজন?”  লোকটি থতমত খেয়ে গিয়ে আমতা আমতা করে আমায় বললো যে সেও আর্মিতে চাকরি করে এবং আমার মতোই সেও ছুটি নিয়ে বাড়ি যাচ্ছে।  তা শুনে আমি তার প্রতি একটু সদয় হয়ে তাকে একটু গুরুত্ব দিলাম তবু তার প্রথম প্রশ্নের সদুত্তরটা না দিয়েই তাকে পরের প্রশ্নটা করলাম, “আপনার পোস্টিং কোথায়? আর আপনি কতদূরই বা যাচ্ছেন?”  সেই ভদ্রলোক উত্তরে বললেন যে তার পোস্টিং গ্যাংটকে এবং তার বাড়ি বর্ধমান আর দুর্গাপুরের মাঝে কোনো এক জায়গায়।  তিনি বর্ধমানে নেমে সেখান থেকে অন্য কোনো বাস ধরে তাঁর বাড়ী যাবেন আর আমি সাঁইথিয়াতে নেমে বাস ধরে সিউড়ি। তার পর মুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে গেলো আমাদের নানান গল্প, কখনো সিকিমের আবহাওয়া নিয়ে আবার কখনো আমাদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে। একসাথে ডিনার টাও সারলাম আমরা। রাত একটু করে বাড়তে লাগলো।  অন্ধকারের বুক চিরে দুর্দান্ত গতিতে ছুটে চলেছে দার্জিলিং মেল’টি। আরো কিছুক্ষণ গল্প করার পর আমরা ঠিক করলাম যে অন্যান্য সহযাত্রীদের ডিসটার্ব না করে এবার আমরা ঘুমিয়ে পড়বো। সারাদিনের অবসাদ কাটিয়ে উঠতেই ঠিক করেছিলাম ট্রেনের জার্নিটা আরামদায়ক হবে। যদিও ঘুমিয়ে পড়লাম বটে কিন্তু বিধি বাম। দার্জিলিং মেলের জার্নিটা আরামদায়ক হওয়া তো দূরের কথা বরং আমাদের জন্য ঐরকম একটি ভয়ানক পরিস্থিতি অপেক্ষা করে বসে আছে তার বিন্দুবিসর্গও টের পাইনি। কিন্তু কি ই বা ছিল সেই ভয়ানক পরিস্থিতি আর কিভাবেই বা সেই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে তার সামাল দিলাম সে ঘটনার কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে আবার ফিরে আসবো আপনাদের কাছে। ততদিন ভালো থাকবেন, সুরক্ষিত থাকবেন, আর অবশ্যই পড়তে থাকবেন “জেলার খবর সমীক্ষা”। জয় হিন্দ।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *