সা তে পাঁ চে

জহর চট্টোপাধ্যায়
কোভিডের প্রকোপ কাটিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরেই মানুষের মন যখন চাইছে উৎসবে মাততে ঠিক তখনই আমাদের সামনে এল ‘স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসব’। অর্থাৎ স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বর্ষ উদযাপন। পঁচাত্তর সংখ্যাটা এখানে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, প্রতিবছরের স্বাধীনতা পালনের থেকে এ বছরের স্বাধীনতা পরবর্তী দীর্ঘ পঁচাত্তর বছরে কী কী সাফল্য এবং ব্যর্থতা এল তার খতিয়ান পর্যালোচনা। আমাদের এবারের শারদীয়ার বিষয় নির্বাচনে তাই পঁচাত্তর সংখ্যাটাকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়ভাবনা হয়েছে ‘সাতে পাঁচে।’
পঁচাত্তর সংখ্যাটার মধ্যে আছে দুটি অঙ্ক সাত ও পাঁচ। এই দুটি অঙ্ক সংখ্যাই মৌলিক সংখ্যা। ছোটোবেলায় পঁচাত্তর সংখ্যাটিকে চিনেছিলাম ‘সাত দশ পাঁচ’ বা ‘সাতের পিঠে পাঁচ’ বলে। অর্থাৎ, সংখ্যাটি তৈরি হয়েছে ‘সাতে পাঁচে’। সংখ্যা হিসাবে পঁচাত্তরের স্থান পঞ্চসপ্ততিতম, কিন্তু দশক সংখ্যাগুলির মধ্যে পঁচাত্তরের স্থান পঞ্চষষ্টিতম। পঁচাত্তরের পূর্ববর্তী সংখ্যাটি চুয়াত্তর এবং পরবর্তী সংখ্যাটি ছিয়াত্তর। পঁচাত্তরের গুণনীয়কগুলি হল ১, ৩, ৫, ১৫, ২৫, ৭৫ এবং মৌলিক উৎপাদকগুলি হল ৩ এবং ৫।
এবার দেখা যাক নানা ভাষায় ও নানা ব্যবহারিক বিষয়ে পঁচাত্তর লেখা হয় কীভাবে। যেমন –
গ্রীক ভাষায় পঁচাত্তর লেখা হয় OE
রোমান ভাষায় পঁচাত্তর লেখা হয় LXXV
বাইনারি পদ্ধতিতে পঁচাত্তর লেখা হয় 1001011,
টারনারি পদ্ধতিতে পঁচাত্তর লেখা হয় 2210,
সেনারি পদ্ধতিতে পঁচাত্তর লেখা হয় 203,
অক্টাল পদ্ধতিতে পঁচাত্তর লেখা হয় 113.
মায়াইয়ান সংখ্যায় পঁচাত্তর লেখা হয়
‘সাইন ভাষায়’ পঁচাত্তর দেখানো হয়
‘ব্রেইল ভাষায়’ পঁচাত্তর লেখা হয়
পঁচাত্তর বছর পূর্তি হলে বলা হয় ‘হীরক জয়ন্তী’, কিন্তু এখন ষাঠ বছর পূর্তিকে বলা হয় ‘হীরক জয়ন্তী’। তাই পঁচাত্তর বছর পূর্তি হলে বলা হচ্ছে ‘প্লাটিনাম জয়ন্তী’। তবে ব্যক্তিই হোক আর প্রতিষ্ঠান, পঁচাত্তরটি বছর পার করা সত্যিই কৃতিত্বের। ২০২২ সালে নিজেদের পঁচাত্তরতম জন্মদিন পালন করলেন এমন মানুষদের মধ্যে রয়েছেন বিখ্যাত ‘রক’ গায়ক এল্টন জন, চলচ্চিত্র পরিচালক স্টিফেন স্পিলবার্গ, অভিনেতা এবং ‘মিঃ ইউনিভার্স’ খেতাব জয়ী সুঠাম শরীরের আর্নল্ড সোয়ারজানেগার, বিখ্যাত লেখক স্টিফেন কিং প্রমূখ। দুটি পঁচাত্তর বছর পূর্তি হলে বলা হয় ‘স্বার্ধশত বর্ষ’ অর্থাৎ একশত পঞ্চাশ বছর। এ বছর ঋষি অরবিন্দ স্বার্ধশত বর্ষে পদার্পণ করলেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিপ্লবী অরবিন্দ এবং পরবর্তীকালে আধ্যাত্মিক অরবিন্দ – এক ব্যক্তির দুটি স্বত্বাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান ‘নেতাজী রিসার্চ ব্যুরো’ এ বছর পঁচাত্তর বছর পূর্তি পালন করছে। ১৯৪৭ সালের ২৩ জানুয়ারি নেতাজীর বাসভবনটি সুভাসষচন্দ্রের বড় দাদা এবং বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী শ্রী শরৎচন্দ্র বসু জাতির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন এবং তাঁর পুত্র ডঃ শিশির বসু এই বাড়ীতে নেতাজী সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন।
প্রতি শতাব্দীতেই পঁচাত্তর সংখ্যা যুক্ত সাল আসে। কিন্তু বিংশ শতকের পঁচাত্তর সংখ্যা যুক্ত সালটি পৃথিবী তথা ভারতের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য বছর হয়ে আছে নানা কারণে। ১৯৭৪ সালে হাঙ্গেরির স্থপতি এবং স্থাপত্য বিদ্যার অধ্যাপক এর্নো রুবিক ‘ম্যাজিক কিউব’ নামে একটি খেলনা তৈরি করলেন যেটি ১৯৭৫ সালে বাজারে এল এবং ছোটো বড় সবাইকে মাতিয়ে দিল। আজও বড় বিপনি থেকে ফুটপাথের বেলুনওয়ালা, সব খেলনা বিক্রেতার কাছে পাওয়া যায় এই ‘ম্যাজিক কিউব’, যা আজ ‘রুবিকস কিউব’ নামেই বেশী জনপ্রিয়। ১৯৭৫ সাল মানেই DISCO-র যুগ। এই ‘ডিস্কো’ নাচাগানাও গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখনও ‘ডিস্কো’র সুরে পা নেচে ওঠে, গলায় সুর বেজে ওঠে। ১৯৭৫ সালের অন্যতম বড় ঘটনা হল, ভিয়েতনামে আমেরিকার পরাজয়। সে বছর এপ্রিল মাসের ৩০ তারিখ ভিয়েতনাম যুদ্ধ শেষ হয়। দীর্ঘ আট বছর বন্ধ থাকার পর মিশর সরকার সুয়েজ খালে আবার জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়। বিনোদনের জগতে আলোড়ন ফেলে ১৯৭৫ সালেই ব্যাজারে আসে VCR যন্ত্রটি। জাপানের SONY কোম্পানি ‘বেটামেক্স’ নামে যে যন্ত্রটি বানালো তাতে ঘরে বসে সিনেমা দেখার সাধ পূর্ণ হল। জাপানের আর এক কোম্পানি Matshushita বানালো VHS অর্থাৎ VCR যন্ত্রের সাহায্যে দেখার জন্য সাধারনের ভাষার ‘ভিডিও ক্যাসেট’। স্টিফেন স্পিলবার্গের দুনিয়া কাঁপানো ছবি ‘জশ’-এর VHS ছিল একেবারের প্রথম কয়েকটি সিনেমার অন্যতম।
ভারতের ইতিহাসে নানা ঘটনা ঘটেছে ১৯৭৫-এ। যার একটা যদি হয় Emergency অন্যটি হল ভারতের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ আর্যভট্ট। চালু হয়েছিল ফারাক্কা ব্যারেজও। এ বছরেই ভারতের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি এবং প্রথম উপরাষ্ট্রপতি ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের দেহাবসান হয়। এই বছর শেষেই ঘটেছিল চাসনালা খনি দুর্ঘটনার মত মর্মান্তিক ঘটনা, যাতে ৩৭৫ জন খনি শ্রমিকের মৃত্যু হয়। সংখ্যাতেও রয়েছে পঁচাত্তরের উপস্থিতি, ৩৭৫ সংখ্যাটিও পঁচাত্তরের গুণিতক।
বাংলা প্রবচনেও পঁচাত্তরের উপস্থিতি একটু অন্য ভাবে। কোনও ঝামেলা ঝঞ্ঝাট ঘটলে তা থেকে দূরে থাকতে চান বেশীরভাগ মানুষ, তারা ‘সাতে পাঁচে’ থাকেন না। তবে যারা বলে যে ‘আমি সাতে পাঁচে থাকিনা’, দেখা যায় তারাই সব চেয়ে বেশী অন্যের ব্যাপারে নাক গলায়। যাই হোক আর ‘সাত পাঁচ’ ভাবনা ভাবা যাচ্ছে না, এবার অন্যদের লেখাগুলো সময় নিয়ে পড়তে হবে। সকলকে এই লেখার মাধ্যমে শারদীয়ার শুভ কামনা জানালাম।