August 21, 2025

কলাবতী

অনিরুদ্ধ বাগচী

অনিমেষের প্রতিদিনকার অভ্যেস মতন স্কুল থেকে ফিরে এসেই বাড়ী থেকে বেড়িয়ে পড়ল, ওর প্রিয় জায়গা ঐ আম বাগানটার উদ্দেশ্যে। ঐখানে একটা দোলনা টাঙ্গানো আছে, ও তাতে দোল খায় আর দেখতে থাকে প্রকৃতির রূপ। এর থেকে প্রিয় জিনিস আর ওর কাছে কিছুই নেই। আজকেও অনিমেষ এগিয়ে যেতে থাকে বাগানের দিকে। হঠাৎ নজরে পড়ল একটা ছোট্ট হলুদ রং-এর প্রজাপতি কেমন ঘাসের উপর খেলা করছে। অনিমেষ বসে পড়ল আর দেখতে লাগলো প্রজাপতিটা কেমন এখান থেকে ওখানে এগিয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ গুটি গুটি পা বাড়ায়, আরে! একটা টুনটুনি পাখি ও তো এসে পরেছে। ওটাও কেমন এধার ওধার করে প্রজাপতিটাকে দেখছে আর খেলা করছে। অনিমেষ বসে পরে অবাক বিষয়ে তাকিয়ে থাকে।

আস্তে আস্তে ওরা বাগানের ভেতরে দোলনার কাছে চলে আসে। হঠাৎ অনিমেষ দেখল প্রজাপতি আর টুনটুনি পাখিটা বাগানের ধারে যে কলাবতী গাছগুলো আছে তার ওপর গিয়ে বসল আর এই গাছ থেকে ঐ গাছ করছে। কলাবতী গাছ। বেশ কিছুদিন ধরে ঐ গাছগুলো এখানে আছে। বেশ কিছুদিন কেন? অনেকদিনই হল ওগুলো আছে। গাছ গলো সহদেব কাকুর মেয়ে কলাবতী লাগিয়েছিল। কলাবতী। সহদেব কাকুর ছোট মেয়ে। অনিমেষের থেকে বেশ কিছুটা বড় ছিল কিন্তু তাও বন্ধুর মতন। আর  কলাবতী গাছগুলো কলাবতীর খুব প্রিয়। প্রতিদিন এসে পরিস্কার করে আর গাছগুলোতে জল দেওয়া অভ্যাসে দাঁড়িয়েছিল। আর একটা দোলনা থেকে গাছের দিকে তাকিয়ে থাকত। অদ্ভূত সুন্দর জায়গা। অনিমেষ তখন অনেক ছোট। ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ে। সময়টা তখন ছয়ের দশকের প্রথম ভাগ পূর্ববঙ্গের একটা শহর আর সহদেব কাকু ওদের  বাড়ীতে অনিমেষের বাবার কাছে কাজ করত।

অনিমেষ কেমন যেন আবেগ প্রবণ হয়ে পরে। একটা স্বপ্নের মতন ও দেখতে থাকে। হলুদ রঙ্গের প্রজাপতি আর টুনটুনি পাখিটা তখন খেলে চলেছে। অনিমেষ তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ দেখল একটা মাছরাঙ্গা পাখি এসে কলাবতী গাছের মধ্যে ঢুকে গেল। অনিমেষ দেখল সমস্ত কিছুই কেমন ঢেউএর মতন দুলছে। অনিমেষ অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ অনিমেষ বুঝতে পারে হলুদ প্রজাপতি টুনটুনি পাখি আর মাছরাঙ্গা পাখিটা কেমন যেন দূরে চলে যাচ্ছে আর কলাবতী গাছগুলোর পাশ দিয়ে দেখল হাসতে হাসতে সহদেব কাকুর মেয়ে কলাবতী বেরিয়ে আসছে। অনিমেষকে দেখে বলল কিরে তোর স্কুল ছুটি হয়ে গেছে? চল, তাহলে কিছুক্ষণ আমরা দোলনাতে দোল খাই। বলে কলাবতী আর একটা দোলনায় দোল খেতে লাগলো। এখনো চারটে বাজেনি বল? তাহলে তো ডাকহরকরার আওয়াজ পেতাম। ও ঠিক চারটের সময় ঐ রাস্তা দিয়ে যায়। যদি কোনো চিঠি আসে? বাবাতো খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বলে কলাবতী হাসতে থাকে জোরে জোরে আর দোল খেতে থাকে।

অনিমেষ জানে কলাবতীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ওদের দেশের বাড়ীতে। ওরা বিহার থেকে এসেছে কয়েক দশক আগে। তবুও যা কিছু পারিবারিক কাজ সব নিজের দেশে গিয়েই করতে হয়। কিন্তু আচার আচারণে ব্যবহারে ওরা এদেশীয় হয়ে গেছে। না বললে বোঝা যায়না। ওরা দোল খেতে থাকে আর তাকিয়ে থাকে ঐ কলাবতী গাছের জায়গাটার দিকে। ওগুলো কেমন সুন্দর বাতাসে নড়ছে আর অনিমেষ দেখলো খালি হলুদ রঙ্গের প্রজাপতিটা এধার থেকে ওধারে, এ গাছ থেকে ও গাছে ভেসে যাচ্ছে আর বসছে আর ডানা নাড়ছে। আর অনিমেষের কানে আসছে কলাবতীর খিলখিল হাসির আওয়াজ। অনিমেষ মন্ত্রমুগ্ধের মতন চেয়ে থাকে। অনিমেষ কেমন যেন একটা স্বপ্নের মধ্যে চলে যায়।

কলাবতী কথা বলে চলেছে অনর্গল আর দোল খায় । অনিমেষ তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। কলাবতী যেন সেই প্রজাপতির মতন হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসল একটা ঝুমুরের আওয়াজ, ডাকহরকরা আসছে। কত চিঠি নিয়ে আসবে। হয়ত কলাবতীর কোনো চিঠিও এসে যেতে পারে। কলাবতী গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে তারপরে ছুটে চলে যায় রাস্তার দিকে। কলাবতী চলে গেল মনে হল একটা পাখি যেন উড়ে গেল অনেকটা সেই মাছরাঙ্গা পাখিটার মতন । অনিমেষ তাকিয়ে থাকে অবাক বিষ্ময়ে আর কানে আসতে থাকে সেই ঝুমুরের আওয়াজ। অনিমেষ দেখতে পায় তখনো হলুদ রঙের প্রজাপতিটা এ ডাল থেকে ও ডাল এ গাছ থেকে ও গাছ উড়ে চলেছে। অনিমেষ একটা স্বপ্নের মধ্যে চলে যায়।

স্বপ্নটা ভাঙল অনিমেষের যখন দেখল সহদেব কাকু আর তার স্ত্রী বসে আছে ঐ কলাবতী গাছ গুলোর সামনে। হাঁটুর উপর মাথা রেখে ঐ কলাবতী গাছগুলোর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। সঙ্গে জল আর জল দেওয়ার জায়গা। অনিমেষ হঠাৎ নিজের মধ্যে ফিরে আসে আর এগিয়ে যায় ওদের দিকে। কলাবতী গাছ আর সহদেব কাকু আর তার স্ত্রীর দিকে। এইবার অনিমেষ সমস্ত মনে করতে পারে।

বেশ কিছুদিন আগেই কলাবতীর বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। ওদের দেশের বাড়ী থেকে, সহদেব কাকু আর সকলে চলে গিয়েছিল। বেশ কিছুদিন পরেই এসে বলেছিল কলাবতীর খুব ভালো বিয়ে হয়েছে। খুব সুখে আর আনন্দে আছে। শুনে সকলেই খুব খুশী হয়েছিল। কারণ কলাবতীকে সকলে খুব ভালো বাসত। তবে সহদেব কাকু বলেছিল কিছুদিন পরে গিয়ে আরো কিছু টাকা পয়সা দিয়ে আসতে হবে যৌতুক হিসাবে। কিন্তু সহদেব কাকু আর যেতে পারেনি বা হয়তো সমস্ত কিছু যোগাড় করে উঠতে পারেনি। একদিন এই বিকাল বেলা যখন ডাকহরকরার তালে তাল মিলিয়ে যাচ্ছিল ওদের বাড়ীর সামনে দিয়ে অনিমেষ শুনেছিল একটা কলরব আর স্বজন হারানোর এক হৃদয় নিংরানো কান্নার আওয়াজ। যেটা আসছিল সহদেবের মাটি আর খড় দিয়ে বানানো এক সুন্দর বাড়ী থেকে। কিন্তু সুন্দরটা কেমন অসুন্দর হয়ে গেছে। একটা চিঠি এসেছে ওদের দেশের বাড়ী থেকে। আর তাতে কলাবতীর মৃত্যু সংবাদ। কলাবতী নাকি আগুনে পুড়ে মারা গেছে।

অনিমেষ আস্তে আস্তে ওদের ওখানে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখেছিল সহদেব আর সকলের আকুল বিলাপ আর ক্রন্দনরত সহদেবের একটাই কথা- “আমি পারলাম না আমার মেয়েকে বাঁচাতে। আমি পারিনি ওদের সব পাওনা মিটিয়ে দিতে। তাই আমার মেয়েকে পুড়িয়ে মেরে দিল” | অনিমেষ দাড়িয়ে থাকতে পারেনি ওখানে। চলে এসেছিল ওদের বাড়ীতে। নিশব্দে একটা জলের ধারা নেমে আসতে থাকে অনিমেষের চোখ দিয়ে। ডাকহরকরার ঝুমুরের আওয়াজ মিলিয়ে গিয়েছিল ওর মন থেকে।

হঠাৎ সহদেব কাকুর গলার আওয়াজে ওর খেয়াল হয় ও এখন কলাবতী গাছগুলোর সামনে সহদেব কাকু আর স্ত্রীর কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেই বসে বসে চোখের জল ফেলছে আর কলাবতী গাছ গুলোর ওপর হাত বুলাচ্ছে।

হঠাৎ সেই ঝুমুরের আওয়াজ কানে ছেসে আসে। ডাকহরকরা ফিরে যাচ্ছে ওর এখানকার কাজ শেষ করে। সহদেব কাকু বলে দাদাবাবু ঘরে চলে যাও। ডাকহরকরা ফিরে যাচ্ছে তার মানে বিকাল শেষ হয়ে গেলো এখনি অন্ধকার নেবে আসবে।

অনিমেষ আস্তে আস্তে বড়রাস্তার দিকে এগিয়ে যায় দেখে ডাকহরকরা এগিয়ে যাচ্ছে তালে তালে ঝুমুরের আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে আর সাথে তার সেই চিঠি ভৰ্ত্তি ঝোলা। অনিমেষ পা বাড়ায় আর ভাবে ঐ ঝোলাটা নিয়ে ওর থেকে সমস্ত খারাপ সংবাদের চিঠিগুলো বের করে নেবে আর ঐগুলো দুহাত দিয়ে ছিঁড়ে উড়িয়ে দেবে বাতাসে। ঐগুলো সব সুন্দর ফুলের মতন ছড়িয়ে যাবে চারিদিকে আর বাতাসে ভাসবে খালি সেই হলুদ প্রজাপতির মতন আরো প্রজাপতি। যেগুলো খালি সুন্দরই হবে। সুন্দর থেকে সুন্দর তর। অনিমেষ তাকায় ঐ বাগানের দিকে। যেখানে সহদেবও আর তার স্ত্রী জল দিচ্ছে কলাবতী গাছগুলোকে আর গাছগুলোকে পরম যত্নে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বিকেলের পরন্ত বেলায় অনিমেষ তাকিয়ে থাকে উদাস ভাবে। অদ্ভূত এক পৃথিবীর দিকে ।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *