ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য এর জীবন সংগ্রামের ইতিহাস
শঙ্কর জ্যোতি ঘোষ
অবিস্মরণীয় শিল্পী ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের জন্ম হয় ১৯২২ সালে ১০ই সেপ্টেম্বর রবিবারে হাওড়া জেলায় বালি গ্রামের বারেন্দ্র পাড়ায় মামার বাড়ীতে। পিতা সুরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য ও মাতা অন্নপূর্ণা দেবী।
মাত্র ৭ বৎসর বয়সে পিতৃহারা হন। শিল্পীর উপরের দাদা প্রফুল্ল ভট্টাচার্য্য ছিলেন একজন খ্যাতনামা সুরকার এবং শিল্পীর কনিষ্ঠ পান্নালাল ছিলেন শ্যামাসঙ্গীত ও ভক্তিগীতিতে অগ্রগণ্য শিল্পী।
বালির রিভার্স টম্পসন স্কুলে সুধাংশু মাষ্টারমশাই ধনঞ্জয়ের মধ্যে গায়কের প্রতিভার সন্ধান পান এবং স্কুলে মাইনে মকুব, বই কিনে দেওয়া থেকে গান শেখানোর সুযোগ করে দেন।
প্রথমে বিখ্যাত গোকুল চন্দ্র নাগ ও পরে সত্যেন ঘোষালের কাছে সঙ্গীত শিক্ষা।
উত্তরপাড়া রাজবাড়ীতে একটি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় গান শুনে ধনঞ্জয়কে পাঁচ টাকা দিয়ে পুরস্কৃত করেন।
১৯৩৮ সালে আকাশবাণীতে প্রথম সম্প্রচারিত হয় শিল্পীর গান। গান ছিল –“জোছনা রাতে কেন ডাকে “।
১৯৪০ সালে প্রণব রায়ের কথায় ও সুবল দাশগুপ্তের সুরে ‘হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানী ‘ থেকে সুধীর গুহ ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের প্রথম রেকর্ড প্রকাশ করেন, ‘যদি ভুলে যাও মোরে’ ও ‘ ছিল যে আঁখির আগে’।
পরে ‘যদি ভুলে যাও মোরে ‘ ও ‘ঘুমায়ে পড়েছে চাঁদ ‘ পাইয়োনিয়ার কোম্পানী থেকে রেকর্ডিং হয়।
১৯৪২ সালে ‘জীবন সঙ্গিনী ‘ ছায়াছবিতে শচীন দেববর্মণ ও সুপ্রভা সরকারের সহিত টাইটেল সঙ্।
১৯৪৩ সালে ছায়াছবিতে একক ভাবে “আলেয়া” ছবিতে (৫।৩।৪৩) ‘মাটির এ খেলাঘরে’ ও সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের “শহর থেকে দূরে ” ছবিতে (২৪।১২।৪৩) ‘ রাধে ভুল করে তুই চিনলি না তোর প্রেমিক শ্যাম রায় ‘।
১৯৪৫-এর ২৮ শে নভেম্বর ধনঞ্জয় ঘরণী হয়ে এলেন রেখা ভট্টাচার্য্য —ধনঞ্জয়ের সঙ্গীত জীবনের অন্যতম প্রেরণা। তিন পুত্র শ্যামলাল, দীপঙ্কর ও দেবকান্তি।
১৯৪৫-এ “আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন” ও পরে “শিল্পী সংসদে” সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪৯ -এ রাই চাঁদ বড়ালের সুরে “স্বামিজী” ছবিতে পরে ১৯৬৩ -এ অনিল বাগচীর সুরে “বীরেশ্বর বিবেকানন্দ ” ছবিতে প্রধান চরিত্রের নেপথ্যে গান করেন।
১৯৫০-এ “মেজদিদি ” ছবিতে ‘জনম মরণ পা ফেলা আর পা তোলা তোর ওরে পথিক ‘ গান সাড়া ফেলে দিয়েছিল।
ছায়াছবিতে অভিনয় ও নেপথ্যে সঙ্গীত পরিবেশন “পাশেরবাড়ী”(১৯৫২), “শ্বশুরবাড়ি”, “অদৃশ্যমানুষ” (১৯৫৩), “নববিধান ” ও “লেডিস সীট”(১৯৫৪) ।
১৯৫৫-এ “রাণী রাসমণি ” অনিল বাগচীর সুরে অনবদ্য।
১৯৫৬-এ “নবজন্ম” ছবিতে উত্তমকুমারের লিপে কয়েকটি গান করেন।
১৯৫৬ – এ “সাধক রামপ্রসাদ ” ছবিতে একক ভাবে ২৩ টি গান করেন আবার ১৯৮০ সালে “মাতৃভক্ত রামপ্রসাদ ” ছবিতেও প্রধান চরিত্রের নেপথ্যে গান করেন।
শ্রী আনন্দ ও শ্রী পার্থ ছদ্মনামে অনেক গান রচনা ক’রে সুরারোপ করেছেন।
রেডিও ও দূরদর্শনে বিভিন্ন সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুল গীতি, দিজেন্দ্রগীতি, রাগাশ্রয়ী, রোমান্টিক, আধুনিক, ভক্তি গীতি,শ্যামাসঙ্গীত,পুরাতনী,
টপ্পা,আগমনী,বিজয়ার গান ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার গান দাপটের সঙ্গে পরিবেশন করেছেন।
১৯৬১ ও ১৯৮৭ সালে ভারত সরকার কতৃক প্রদত্ত ‘পদ্মশ্রী’ প্রত্যাখ্যান করেন।
ডঃ রমা চৌধুরী ‘রবীন্দ্রভারতী’র উপাচার্য থাকাকালীন “ক্লাসিকাল মডার্ণ সসং এণ্ড আদার বেঙ্গলী”-র ফ্যাকাল্টি ডিন হওয়ার আহ্বান ত্যাগ করেন।
প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা ১৯৭৮ সালে “জয় মা তারা ” ছবিতে।
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সময়ে একটানা ১২ বৎসর শ্রেষ্ঠ নেপথ্য কণ্ঠশিল্পীর সম্মান লাভ করেন।
১৬ ই জানুয়ারি ১৯৮৭ সহধর্মিণী রেখা ভট্টাচার্য্য পরলোক গমন করেন।
১০ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৭ কলকাতা রবীন্দ্রসদনে সঙ্গীত জীবনের ৫০ বর্ষ পূর্তি পালিত হয়।
রেকর্ডে শিল্পীর গান ৮০০, ছায়াছবিতে ১২০০ এবং শ্যামাসঙ্গীত ও অন্যান্য মিলিয়ে ৪০০ – মত।
১৯৯২ সালের ২৭ শে ডিসেম্বর রবিবার সন্ধ্যা ৬-৫৫ মিনিটে ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য্যের জীবন দীপ নির্বাপিত হ’ল।