August 21, 2025

মসির ধারায় অসির ধার (২৯)

 

সঞ্জীব মুখার্জী 

 

“Only the best friends and the worst enemies meet us and visit us”.

 – General AS Vaidya

 

১৯৯৪ সালের ২৮শে আগস্ট সকালবেলা কুপুপের “সানি ভ্যালি” তে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের গ্রাউন্ডে আমাদের প্রাথমিক ব্রীফিং পর্ব সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল।  কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল শেরগিল কে আমাদের নিকটবর্তী ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার গিয়ে ব্রিগেড কমান্ডারের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হয় তাই সেদিন কর্নেল শেরগিলের নির্দেশে আমাদের ব্যাটালিয়নকে এলাকা পরিচিতির জন্য চারপাশের এলাকাগুলি ঘুরে দেখে আসি। কিংবদন্তি অনুযায়ী প্রচলিত আছে সিকিমের এই স্থানটিতে প্রতিদিন সূর্যোদয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাকি সর্বপ্রথম সূর্যের কিরণ পড়ে এবং তার সঙ্গে সুন্দর মনোরম উপত্যকাটি সূর্যালোকে ভরে ওঠে তাই এর স্থানটির নাম “সানি ভ্যালি” বলে আখ্যা দেওয়া হয় আর এই কিংবদন্তির প্রমাণ স্বচক্ষে উপলব্ধি করলাম। এলাকা পরিচিতির জন্য আমাদের ব্যাটালিয়নের সমস্ত সৈনিকরা ছোট ছোট ১০ – ১২ টি দলে বিভক্ত হয়ে দলবদ্ধ হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দলগুলি চতুর্দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।  সেখানকার চারপাশটা ঘুরতে ঘুরতে অনেককিছু অদেখাকে দেখলাম এবং অজানাকে জানলাম, বিশেষ করে সেখানকার স্থানীয় উদ্ভিদজগৎ এবং প্রাণীজগৎ যাকে বলে “ফ্লোরা এন্ড ফৌনা।”  যদিও বেশিরভাগ পাহাড়গুলি ন্যাড়া, বুড়ো তবে কিছু কিছু জায়গাতে সেখানকার অত্যন্ত প্রিয় এবং সিকিমের ‘স্টেট ফ্লাওয়ার’ হিসাবে আখ্যা প্রাপ্ত ফুল “নোবল অর্কিড এবং রডোডেনড্রন”-এর দর্শন হওয়ার সাথে সাথে অন্যান্য স্থানীয় উদ্ভিদ যেমন ম্যাগনোলিয়া, বার্চ, অল্ডার্স, ইত্যাদিও অল্প বিস্তর চোখে পড়লো যেগুলি আমি জীবনে তার আগে কোনো দিন দেখিনি। রেড পান্ডা সিকিমের ‘স্টেট এনিম্যাল’ এবং এদের দেখা পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে চোখে না পড়লেও বেশ কয়েকটি অদ্ভুত প্রাণী দেখতে পেলাম।  তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো চামরী গাই, হিমালয়ান তাহার, হিমালয়ান মারমট, হিমালয়ান গোরাল, হিমালয়ান সেরোও, মঙ্গুস ইত্যাদি। এদের বেশিরভাগই হরিণের প্রজাতি হলেও এদের মধ্যে একটি প্রাণীর বৈশিষ্ট বেশ বিচিত্র যেটি হলো হিমালয়ান সেরোও। আপনারা অনেকেই ‘ইউনিকর্ন’-এর নাম শুনেছেন যেটি এক শিং বিশিষ্ট ঘোড়ার মত দেখতে একটি রূপকথার প্রাণী কিন্তু তাকে আপনারা দেখেননি কেউ।  ‘হিমালয়ান সেরোও’কে দেখলে কিন্তু আপনাদের সেই ভ্রান্তির অবসান ঘটবে।  ‘হিমালয়ান সেরোও’ হরিনের একটি প্রজাতি হলেও তার মাথায় নাকের ঠিক উপরে একটি সিং।  তবে এই প্রজাতি আজকের দিনে বিরল এবং বিলুপ্তির পথে।  ঘুরতে ঘুরতে বেশ কিছু অদেখা পাখিদেরও  দেখতে পেলাম তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘হিমালয়ান মোনাল’, ‘ক্রিমসন হর্নড ফেস্যান্ট’ এবং ‘স্নো পারট্রিজ’।  আরো অনেক অনেক প্রকারের পশু পক্ষী এবং গাছপালা দেখতে পেলাম তাদের নাম এবং বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। তবে এদের সবচাইতে বিপদজনক যে প্রাণীটির সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হলো সেটি হলো “জংলী কুকুর”, এদের চরিত্রগত বৈশিষ্ট হলো এরা দল বেঁধে থাকে, এদের দলটিকে বলে “ঝুন্ড”, এরা ভয়াল ভয়ঙ্কর এবং প্রচন্ড হিংস্র। আকারে চিতা বাঘের থেকে একটু ছোট এবং দলবদ্ধ ভাবে ছোট ছোট ঝোপঝাড়ের আড়ালে ওৎ পেতে বসে থাকে, কোনো শিকার পেলে তার উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে এবং শিকারকে নিমেষে টুকরো টুকরো করে গলাধঃকরণ করে ফেলে, এমনকি দু-একজন মানুষ এসে পড়লে তাদেরকেও একই পরিণতির সম্মুখীন হতে হয়।  আমরা দলে ভারী ছিলাম এবং আমাদের সকলের কাছে ‘পার্সোনাল উইপন’ রয়েছে তাই আমাদের নিয়ে ওরা বেশি আর ঘাঁটায়নি, আর আমরাও ওদের ঘাঁটাইনি, আমরা ওদের দেখলাম এবং ওরা আমাদের দেখলো এই পর্যন্তই, আর তারপর দর্শন শেষে হিংস্র কুকুরের দলটি চোখের পলকে জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এগুলি ছাড়া পাহাড়ে ঘোরার সময় দেখলাম কোনো কোনো জায়গায় বেশ বড় সাইন বোর্ড লাগানো রয়েছে আর তাতে সতর্ক বাণী লেখা রয়েছে “আপনি এখন থেকে চীনের সৈনিকদের দৃশ্যমানতাতে আছেন, তাই সাবধান থাকুন।”  এলাকা পরিচিতি একদিনে সম্পূর্ণ করা সম্ভব না হলেও মোটামুটি বেশ কয়েকটি জায়গা দেখে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের ঠিকানায় ফিরলাম।  পরদিন কর্নেল শেরগিলের ব্রীফিং সেই সঙ্গে আমাদের চারপাশের এলাকা ঘুরে দেখার পর আমাদের ‘জেনারেল অবজারভেশন’-এর ব্যাপারে আমাদের সকলকে আপডেট দিতে হবে কর্নেল শেরগিলকে।

পরদিন সকাল পূর্বনির্ধারিত সময়ে এবং স্থানে আমরা সকলে একত্রিত হলাম।  যথারীতি শুরুও হয়ে গেলো আমাদের ব্রীফিং পর্ব।  ব্রীফিং এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিন্দু হলো আমাদের ব্যাটালিয়নের “এরিয়া অফ রেসপনসিবিলিটি” অর্থাৎ ভারত-চীন সীমান্তে কোন কোন স্থানগুলি আমাদের ব্যাটালিয়নের দায়িত্বের স্থান হবে সে বিষয়টি। আমাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের লোকেশন থেকে একটু দূরে একটি পাহাড়ের গায়ে মেন রোডের ঠিক লাগোয়া একটি বড় মন্দির অবস্থিত। সানি ভ্যালিতে পৌঁছনোর পরেই শুনেছিলাম যে সেই মন্দিরটি নাকি “বাবা হরভজন সিং”-এর মন্দির।  কর্নেল শেরগিলের ব্রীফিং চলাকালীন, কর্নেল সাহেব সেই মন্দিরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে ইশারা করে বললেন যে আমাদের ব্যাটালিয়নের পরম সৌভাগ্য যে আমরা যতদিন এখানে থাকবো ততদিন এই মন্দিরের দেখাশোনা এবং রক্ষনাবেক্ষনের দায়িত্ব আমাদের ব্যাটালিয়নের উপর থাকবে। এই কথা বলে কর্নেল শেরগিল “বাবা হরভজন সিং”-এর মাহাত্যের যে উপাখ্যান শুরু করলেন তা এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। সকলে অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে সেই কাহিনী শুনতে লাগলাম। কর্নেল যতই কাহিনীর গভীরে যাচ্ছিলেন আমরা ততই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম। কাহিনীর আদ্যোপান্ত শোনার পর যে অনুভূতির সৃষ্টি আমাদের হৃদয়ে হলো তা সত্যি ভাষায় প্রকাশ্য নয়। মনে মনে শুধু একটাই কথা ভেবে চলেছি আর ভেবে চলেছি কিন্তু যুক্তি বা তর্ক দিয়ে আজও তার কোনো কিনারা করতে পারিনি।  কিংবদন্তি তো অনেক জায়গায় অনেক শোনা যায় কিন্তু এ এমন এক কিংবদন্তি যে সমগ্র ভারতীয় সেনা এই ঘটনাকে স্বীকৃতি অদ্যাবধি দিয়ে চলেছে।  “বাবা হরভজন সিং”-এর এই মাহাত্যের কথা শুধু ভারতবর্ষেই নয় এমনকি সিকিমের ভারত-চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় চীনা সৈনিকরা পর্যন্ত এই ঘটনাকে সসম্মানে বিশ্বাস করে। আজ আমি আপনাদের সামনে সেই অবিশ্বাস্য এবং বিস্ময়কারী ঘটনার কথা তুলে ধরবো।

১৯৪৬ সালের ৩০ শে আগস্ট পাঞ্জাবের একটি গ্রামে (যেটি বর্তমানে পাকিস্তানে) একটি শিখ পরিবারে “বাবা হরভজন সিং” জন্মগ্রহণ করেছিলেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়-এর পঠন পাঠন সমাপ্ত করে ১৯৬৫ সালের মার্চ মাসে পাঞ্জাবের একটি উচ্চ বিদ্যালয় যার নাম DAV বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং তৎপরবর্তী তিনি সেই বছরেই তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি রেজিমেন্টে যোগ দেন যার নাম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার পর নিয়মানুযায়ী রেজিমেন্টাল সেন্টারে হরভজন সিং-এর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্তি হয় এবং কর্মসূত্রে ১৯৬৮ সালে জওয়ান হরভজন সিং ওই এলাকার নিকটবর্তী ‘নাথু লা’ গিরিপথে কর্মরত ছিলেন। জায়গাটি ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এক দুর্গম ও সংকীর্ণ গিরিপথ। এই জায়গাটি ইন্দোচীন যুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে আজও বিদ্যমান।  মাত্র ২২ বছরের অকুতোভয় জওয়ান হরভজন সিং নির্ভীক ভাবে ভারত-চীন সীমান্তে সাহসিকতার সঙ্গে দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতেন। তখন যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরী না হলেও সেই জায়গাটি ছিল অত্যন্ত স্পর্শকাতর এলাকা, তাই সেখানে সেনা জওয়ানদের সব সময় সজাগ থাকতে হতো। একদিন এই অঞ্চলটিতে যাওয়ার জন্য ভারতীয় সেনা জওয়ান হরভজন সিং মালবাহী পশুর পিঠে চাপিয়ে আউটপোস্ট-এর উদ্দেশ্যে রওনা দেন। পথ ছিল অত্যন্ত দুর্গম এবং সংকীর্ণ যা আমি আপনাদের পূর্বেও বলেছি। রওনা দেওয়ার সময়টি ছিল ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাস। সেই ১৬,০০০ ফুট উচ্চতায় বরফে আচ্ছাদিত পর্বতমালায় অন্যান্য সেনারা তখন প্রয়োজনীয় রসদের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। জওয়ান হরভজন সিংকে দায়ীত্ব দেওয়া হয়েছিল যে সম্ভাব্য যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির প্রক্রিয়ায় রসদের জন্য অপেক্ষারত আমাদের দেশের সৈনিকদের জন্য রসদ ভান্ডার নিয়ে সে জায়গায় পৌঁছাতে হবে। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকায় প্রবল বৃষ্টিপাতের কারণে সীমান্তে প্রচন্ড ধ্বস নেমে এক ভীষণ প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই প্রতিকূল পরিস্থিতিকে একরকম তোয়াক্কা না করেই এর মধ্যে দিয়ে জওয়ান হরভজন সিংকে সেখানে পৌঁছতে হবে। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেই ব্যাটালিয়নের তদানীন্তন কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী তিনি বেশ কয়েকটি মালবাহী পশু আর তাদের পিঠে রসদ চাপিয়ে নিয়ে রওনা হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ তিনি সেই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারেননি।  মাঝ রাস্তা থেকে মালবাহী পশুদের কয়েকটি পশু ফিরে আসে সেই আউট পোস্টে যেখান থেকে হরভজন সিং তার যাত্রা শুরু করেছিলেন। এই পুরো ব্যাপারটি দেখে তার সহকর্মীরা বুঝতে পারে যে হরভজন সিং নিশ্চয়ই কোন বিপদে পড়েছেন এবং পুরো ব্যাটালিয়ন উঠে পড়ে লাগে তাকে খোঁজার জন্য, চিরুনি তল্লাশি করে হরভজন সিং’কে খোঁজা শুরু করা হয়। সারা রাত, সারা দিন ধরে সার্চ অপারেশন চালানোর পরও কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সকলে আশা প্রায় ছেড়েই দেয়। দুই দিন অতিবাহিত হওয়ার পর হঠাৎ, এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে যায়। শোনা যায় নিখোঁজ হরভজন সিং নাকি তার আরেক সহকর্মী সেনা জওয়ান প্রীতম সিংকে স্বপ্নে দেখা দিয়ে বলেন যে, যে রাত্রিতে তিনি নিখোঁজ হন, সেই রাত্রিতেই তার সমাধিলাভ হয় এবং তিনি অপার্থিব হয়ে যান। স্বপ্নে তিনি প্রীতম সিংকে এও বলেন যে তার প্রাণহীন নিথর দেহটি ঠিক কোন জায়গায় রয়েছে এবং সেই স্থানে খোঁজাখুঁজি শুরু করতে বলেন। প্রীতম সিংয়ের মুখ থেকে সব কিছু শোনার পর তার বিবৃতিকে প্রাথমিক ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় নি, উল্টে বরং প্রীতম সিং’কে ভর্ৎসনা করা হয় যে সেনাবাহিনীর মতো সংগঠনে স্বপ্নাদেশকে বিশ্বাস করা হয় না এবং স্বপ্নাদেশের ভিত্তিতে কোনো ক্রিয়া প্রতিক্রিয়াও করা হয় না। হরভজন সিং কেবল প্রীতম সিংই নয়, তদানীন্তন ব্রিগেড কমান্ডার কেও একই স্বপ্নাদেশ দেন। যখন ব্রিগেড কমান্ডার পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের কমান্ডার’কে নির্দেশ দেন তখন সেই নির্দেশ পালন করতে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনাদের তরফ থেকে স্বপ্নাদেশে বর্ণিত জায়গায় তল্লাশি চালানো হয় এবং কিছুক্ষন তল্লাশী চালানোর পর সত্যিই সেই জায়গাটিতে জওয়ান হরভজন সিংয়ের প্রাণহীন নিথর দেহটি পাওয়া যায়।

যে স্থানটিতে তাঁর নিবাস স্থান ছিল আজ সেটি একটি মন্দিরে পরিণত হয়েছে আর গর্বের বিষয় হলো সেই মন্দিরটি আমাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টের অতি সন্নিকটে অবস্থিত এবং ততোধিক গর্বের বিষয় হলো এই মন্দিরের দেখাশোনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের ব্যাটালিয়নের উপর থাকবে যতদিন আমাদের ব্যাটালিয়ন সিকিমে থাকবে। প্রয়াত সেনা জওয়ান হরভজন সিংয়ের পোশাক এই মন্দিরে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে এবং তার ব্যবহৃত বিছানা ও জিনিসপত্রও এই মন্দিরেই সংরক্ষণ করা হয়েছে।  মাঝে মাঝে তার বিছানা অগোছালো হয়ে যায়, সেনারা বিশ্বাস করেন তিনি এখনও কাজের ফাঁকে ওই বিছানায় বিশ্রাম করেন। ভারতীয় সেনা জওয়ানদের কাছে আজ তিনি দেবতার জায়গা পেয়েছেন। তার উপস্থিতিকে অনুভব করার জন্য একটি মন্দির তৈরি করে স্মৃতি রক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ভারতীয় সেনা জওয়ানদের কাছে তিনি ‘বাবা হরভজন সিং’ নামে পরিচিত। বহু পর্যটক বাবা হরভজন সিংয়ের মন্দির প্রত্যক্ষ দর্শন-এর জন্য যান। কথিত আছে মন্দির দর্শনের পর সকলে একটি বোতল করে জল রেখে দিয়ে আসেন। তারপর এই জল পান করলে দর্শনার্থীদের মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। সাধারণ মানুষজন ও সেনা জওয়ানদের কাছে বাবা হরভজন সিং এখনো পূজিত হন। সমগ্র ভারতীয় সেনার বিশ্বাস যে জওয়ান হরভজন সিং নাকি মৃত্যুর পরও এখনো পর্যন্ত দেশরক্ষার কাজ করে চলেছেন এবং এখনো শত্রুপক্ষের থেকে আসা আগাম সতর্কবার্তা তিনি ভারতীয় সেনা প্রধানদের দেন। আপনারা বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা তবে এমনটাও জানা যায় যে, সেই স্থানে কর্তব্যরত সেনাদের পোশাক যদি একটু অগোছালো হয়ে থাকে তাহলে শূন্য থেকে তিনি এসে থাপ্পর মেরে যান।

বাবা হরভজন সিং’কে ১২ বছর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ যে সময়ে আমাদের ব্যাটালিয়ন সেখানে ছিল সেই সময়  জীবিত সেনা জওয়ান দের মতনই সবকিছু করা হতো। প্রতিবছর ২ মাসের বার্ষিক অবকাশ পেতেন, প্রতি বছর ফিক্সড ডেট ১৫ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৪ই নভেম্বর পর্যন্ত। আর এই দুই মাস সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত ভাবে সতর্ক থাকার নির্দেশ থাকতো। তাঁর নামে ট্রেনে রিজার্ভেশন করা হতো, এবং তার জিনিসপত্র নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে পৌঁছানো হত তার গ্রামের বাড়ি পাঞ্জাবের কাপূর্থালা জেলার কোকে গ্রামের উদ্দেশ্যে।  কিন্তু গত ১২ বছর ধরে এই রীতি বন্ধ আছে। বাবা হরভজন সিংয়ের স্মৃতিকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্য একটি শর্টফিল্ম তৈরি করা হয়েছে, নিজ গ্রামে তিনি একজন শহীদের মর্যাদা পেয়েছেন। বর্তমানে ভারত ও চীনের মধ্যে যে সংঘাত তাঁর স্মৃতিকে আরো ফিরিয়ে নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরকম দেশপ্রেমী সেনানায়কের কাহিনী আমাদেরকে সত্যি ভাবুক করে তোলে। বাবা হরভজন সিং’কে শতকোটি প্রণাম।

এই ভাবে শুরু হলো আমাদের সিকিমের ভারত-চীন সীমান্তের জীবনযাত্রা। সময় কেটে যেতে লাগলো নিজের লয়ে এবং ছন্দে। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল শেরগিল বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পর নুতন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল দলজিৎ সিং ধিল্লন সংক্ষেপে কর্নেল ডি এস ধিল্লন এসে ব্যাটালিয়নের কান্ডারী হলেন। প্রচন্ড সৎ, দৃঢচেতা এবং নির্ভীক আধিকারিক হওয়ার সাথে সাথে ভীষণ অনুশাসন প্রিয়ও ছিলেন কর্নেল ধিল্লন। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন ছিল তাঁর প্রধান নীতি, সে চীন হোক আর পাকিস্তান হোক।  তাঁর ছত্রছায়াতে আমাদের ব্যাটালিয়ন সীমান্তের প্রহরী হিসাবে নিখাদ এবং নিরলস ভাবে কর্তব্যপরায়ণতার সঙ্গে দেশ রক্ষার কাজে লিপ্ত। এইভাবে একটি বছর কেটে যাওয়ার পর হঠাৎ কর্নেল ধিল্লন আমাদের ব্যাটালিয়নের সকলকে একত্রিত করে আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে একটি সুখবর সম্মৃদ্ধ সুপ্রস্তাব দিলেন, যেটি সম্প্রতি আমাদের ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার থেকে এসেছে। তবে কি সেই সুখবর আর কি সেই সুপ্রস্তাব তার গল্প নিয়ে আর একদিন হাজির হবো আপনাদের সামনে। ততদিন ভালো থাকবেন, সুরক্ষিত থাকবেন, আর অবশ্যই পড়তে থাকবেন “জেলার খবর সমীক্ষা”। জয় হিন্দ।

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *