August 21, 2025

মসির ধারায় অসির ধার (২৭)

সঞ্জীব মুখার্জী 

“Our flag does not fly because of the wind moving around it, it flies because of the wind of the last breath of each soldier who sacrificed their lives protecting it.”

 General JJ Singh

আমাদের ব্যাটালিয়নের রংপো স্টেজিং ক্যাম্পের উপচারিক কার্যাবলী সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো ১৭ই আগস্ট ১৯৯৪ তারিখেই। ঠিক হয়েই ছিল যে পরদিন অর্থাৎ ১৮ই আগস্ট ঠিক সকাল ৭টার সময় আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিয়ে কনভয় রংপো স্টেজিং ক্যাম্পের কনভয় গ্রাউন্ড থেকে রওনা দিয়ে দেবে জুলুকের অভিমুখে। যা কথা তাই কাজ। ১৮ই আগস্ট সকালবেলা গরম চা আর হালকা জলখাবার খেয়ে নিয়ে কনভয়ে যে যার গাড়িতে গিয়ে উঠে বসলো।  ঘুরপাক দিতে দিতে পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে আমাদের কনভয় যাত্রা করবে তাই রাস্তায় কারুর কোনো শারীরিক সমস্যা না হয় তাই সকালের জলখাবার খুবই হালকা ছিল। জুলুকের তৃতীয় এবং শেষ ক্যাম্পটি যাকে বলে ‘স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজেসন’ ক্যাম্প সেটি সমুদ্রতল থেকে ১০,০০০-১২,০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এবং সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়নকে বাধ্যতামূলক ভাবে ৭-৮ দিন মতো থাকতে হবে আর সেখানে এক বিশেষ ধরণের পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমাদের কাটাতে হবে তাই এটিকে স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজেসন ক্যাম্প বলে। অবশ্য সেই বিশেষ ধরণের পরিস্থিতিগুলি আমি আপনাদের পরে বলছি। রংপো স্টেজিং ক্যাম্প থেকে জুলুকের স্টেজিং ক্যাম্পটির ভৌগোলিক দূরত্ব প্রায় ৮০ কিলোমিটার। দূরত্বের দিক দিয়ে বিচার করলে ৮০ কিলোমিটার হয়তো কিছুই দূরত্ব নয় কিন্তু যে রাস্তা দিয়ে আমাদের কনভয় যাত্রা করবে সেটি একদম উঁচু উঁচু পাহাড়ের গা কেটে কেটে এঁকেবেঁকে সর্পিল আকারে নির্মিত তাই এ রাস্তা প্রতিকুলতায় ভর্তি আর পদে পদে বিপদ অপেক্ষা করে বসে আছে। সেইজন্য আমাদের কনভয়ের পৌঁছতে প্রায় ৭ থেকে ৮ ঘন্টা লাগবে। পাহাড়ি রাস্তার চড়াই কোথাও খাড়া আবার কোথাও একটু মাধ্যম। কনভয়ের সব গাড়িগুলি হয় ভারী ভারী সামরিক মালপত্রে না হয় আমাদের সৈনিকে মোটামুটি ভাবে বোঝাই তাই খাড়া চড়াই আরোহন করতে সেই গাড়িগুলির যাতে কোনো অসুবিধা না হয় তার জন্য সব গাড়িগুলিতেই বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন “ফোর বাই ফোর” গিয়ার্ অপারেটেড ড্রাইভিং এর ব্যবস্থা আছে।

রংপো কনভয় গ্রাউন্ড থেকে আমাদের কনভয় মার্চ করার ১৫-২০ মিনিটের পথ অতিক্রম করার পরই শুরু হয়ে গেলো পর্বতারোহন। আমাদের কনভয়ের পর্বতারোহী গাড়িগুলিকে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে ত্বরণ লাভ করতে অতিরিক্ত যান্ত্রিক শক্তি প্রয়োগ করতে হচ্ছে আর তার থেকে যে ধরণের বিকট শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে সেটাই আমাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিচ্ছে যে গাড়িগুলি এবার সমতল ভূমি ছেড়ে দিয়ে পাহাড়ের উচ্চতায় অভিচরণ করতে চলেছে। ধীরে ধীরে অত্যন্ত মন্থর গতিতে আমাদের কনভয় দৌড়োচ্ছে এবং এইভাবে ঘন্টা দুয়েক চলার পর গাড়ির ভিতর থেকে জানালা দিয়ে যখন বাইরের দিকে তাকালাম তখন দেখতে পেলাম আমরা সমতল ভূমি থেকে অনেকটা উঁচুতে চলে এসেছি। দূরে এবং পাহাড়ের নিচে তাকালে সেখানকার বাড়ি, ঘর, গাড়ি, ইত্যাদি দেখে ছোটছোট দিয়াশলাই বাক্সের ন্যায় মনে হচ্ছে।  আরো কিছুটা চলার পর সেই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছনোর পর কিছুটা সমতল রাস্তা পাওয়া গেলো যেটিকে বলে “Plateau” কিন্তু সেটা ১০ থেকে ১৫ মিনিটের রাস্তা। সেটি অতিক্রম করার পর আগের পাহাড়ের থেকেও উচ্চতা সম্পন্ন আরেকটি পাহাড়ে আরোহন করা শুরু করলো আমাদের কনভয়টি।  রাস্তায় যেতে যেতে ভ্রমণকারীদের সাবধান করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন ধরণের সতর্ক বার্তা দিয়ে নোটিশ বোর্ড লাগানো। পাহাড়ি রাস্তায় আনাচে কানাচে বিপদ ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে, ওই যে কথায় বলে না, “সাবধানী হটী, দুর্ঘটনা ঘটী” অর্থাৎ সাবধানতার একটু অভাব হলেই ঘটে যেতে পারে অনেক বড় দুর্ঘটনা। রাস্তার কোনো কোনো জায়গায় নোটিশ বোর্ডে এমনটাও লেখা আছে যে “Beware Of Shooting Stones” অর্থাৎ ছুটে আসা পাথরের থেকে সাবধান। রাস্তার সেই সব স্থানে পাহাড়ের অনেক উঁচু থেকে বড় মাঝারি এবং ছোট আকারের গোল পাথর গড়িয়ে যখন নিচের দিকে ছুটে আসে তখন তার গতিপথে গাছপালা, গাড়ী, ঘর বাড়ি যাকে পাই তাকে নিমেষের মধ্যে চূর্ণ বিচূর্ণ করে ফেলে। যেতে যেতে পাহাড়ের নিচে পড়ে থাকা গাড়ীর অথবা গাছের মোটা গুঁড়ির ধ্বংসাবশেষের মাধ্যমে তার কয়েকটি নিদর্শনও পেলাম। অবশ্য এইধরণের বিপদ ঠেকাতে মোটা মোটা গ্যালভানাইজড আয়রনের তার দিয়ে তৈরি শক্তিশালী জাল দিয়ে পাহাড়ের গায়ে আলগা পাথরগুলিকে টাইট করে সুরক্ষিত করা আছে। তবুও বিপদ তো বিপদই, সে তো আর কাউকে বলে কয়ে আসে না। তাই শত সাবধানী হয়ে থাকা সত্ত্বেও জীবনে আমাদেরকে ছোট বড় নানান ধরণের বিপত্তি এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় আর এটাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা। একটা পাহাড়ের চড়াই শেষ হলে সে পাহাড় থেকেও উঁচু আবার একটা অন্য পাহাড়ে চড়াই, এই ভাবে বেশ ছয়-সাতটা পাহাড় যখন অতিক্রম করে নিলাম তখন বুঝতে পারলাম যে আমরা সমুদ্রতল থেকে অনেক অনেক উঁচুতে এসে গেছি এবং এটাও বুঝতে পারছিলাম যে আরো অনেকটা উঁচুতে চড়া বাকি আছে। যাইহোক, এইভাবে আরো কয়েকটি পাহাড় পর্বত পেরিয়ে আরো উঁচুতে ওঠার পর আমাদের কনভয় যখন জুলুকের স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজেসন ক্যাম্পে পৌঁছলো তখন ঘড়িতে বাজে প্রায় সাড়ে তিনটে। লাঞ্চ আমরা যাত্রাপথে একটা “Plateau” অর্থাৎ সমতল জায়গা দেখে সেখানেই সেরে নিয়েছিলাম।  তবে অন্যান্য বারের মতো এবারের লাঞ্চটা অতটা জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না, যাত্রাপথের শারীরিক অস্বস্তিকে অযাচিতে আমন্ত্রণ না জানানোর জন্যই সেবারের লাঞ্চটা আমাদের খুবই হালকা ফুলকা ছিল। সেই সময়টা যদিও আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কিন্তু জুলুক পৌঁছনোর পর গাড়ি থেকে নামার পর আমাদের সবাইকে বেশ শীত শীত করতে লাগলো। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল শেরগিলের নির্দেশ অনুযায়ী স্টেজিং ক্যাম্পে আমাদের জন্য সুনির্দিষ্ট বাসস্থানে যে যার প্রবেশ করলাম।

জুলুক স্টেজিং ক্যাম্পটি বেশ আকারে এবং আকৃতিতে বেশ বড়ো। সৈনিকদের থাকা খাওয়ার জন্য পাহাড়ের গা কেটে কেটে ধাপ করে নির্মিত প্রচুর ব্যারাক তাদের কোনোটা বাসযোগ্য আবার কোনটা কুক হাউস, আবার কোনোটা ডাইনিং হল। এছাড়াও স্টেজিং ক্যাম্পে  ভলি বল গ্রাউন্ড, বাস্কেট বল গ্রাউন্ড, রিক্রিয়েশন রুম ইত্যাদি। সেখানকার টয়লেট বাথরুমগুলিও ভীষণ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আর প্রতিটি জায়গায় লাগানো রয়েছে থার্মোমিটার এবং হাইড্রোমিটার যেগুলি সর্বদা সেখানকার আবহাওয়ার তাপমাত্রা এবং বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।  বসবাস করার ব্যারাক গুলিতে বেছানো রয়েছে কাঠের তৈরি সিঙ্গেল খাট যেটিকে বলা হয় “উডেন কট” আর তাদের প্রত্যেকটিতে বেছানো রয়েছে কোয়ারের পুরু গদী। সকলে নির্ধারিত ব্যারাকে যে যার প্রবেশ করার পর আমরা নিজের নিজের উডেন কটে আমাদের বিছানাপত্র খুলতে লাগলাম। তার কিছুক্ষন পরেই আমাদের সকলকে বিকালের গরম চা এবং সদ্য ভাজা পাকোড়া পরিবেশন করা হলো। সারাদিনের জার্নির ক্লান্তি এবং পরিশ্রান্তির পর আর বিশেষ করে শীতের অনুভূতির মধ্যে চা পাকোড়াটা মন্দ লাগছিলো না। চা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে গল্প করতে করতে হঠাৎ অনুভব করলাম যে বাইরের আবহাওয়া একেবারে মেঘলা হয়ে গেলো আর একটা দমকা হাওয়ায় আমাদের ব্যারাকে জানালা দিয়ে প্রচুর কুয়াশা প্রবেশ করলো। পরে অবশ্য জানলাম যে সেগুলো কুয়াশা ছিল না, সেগুলো ছিল মেঘ।  মেঘ আমরা প্রত্যেকেই দেখেছি কিন্তু তা বলে ঘরের মধ্যে ওই ভাবে মেঘ। যাইহোক অভিজ্ঞতা টা নতুন ছিল তাই একটু আশ্চর্য হচ্ছিলাম, এই আর কি। চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই জানতে পারলাম যে কিছুক্ষনের মধ্যেই আমাদের সকলকে বিশেষ ধরণের শীত বস্ত্র দেওয়া হবে আর সেই শীত বস্ত্র গুলি আমাদের অঙ্গের সঙ্গী হয়ে যতদিন আমরা আমাদের গন্তব্যস্থল অর্থাৎ ভারত-চীন সীমান্তের “কুপুপে” থাকবো ততদিন আমাদের সঙ্গে থাকবে। এইধরণের বিশেষ শীতবস্ত্রগুলিকে বলা হয় “ECC Clothing” অর্থাৎ “Extreme Cold Climate Clothing” এবং কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের “ECC Clothing” দিয়ে দেওয়া হলো।  জীবনে প্রথমবার ঐধরণের উপকরণ ব্যবহারের আস্বাদ পেতে চলেছিলাম। “ECC Clothing” এর মধ্যে ছিল একটি স্লীপিং ব্যাগ, একটি স্নো ম্যাট্রেস, দুটি কোট পারকা, দুটি প্যান্ট পারকা, দুই জোড়া রাবার ইনসুলেটেড বুট, হেভি উলেন মোজা, হ্যান্ড গ্লাভস, ক্যাপ বালাক্লাভা, স্নো ভেস্ট এবং সান গ্লাস, আর এগুলির সবগুলিই সুইৎজারল্যান্ডে তৈরি।

সবাই ক্লান্ত তাই শীঘ্রই নৈশ ভোজন সেরে নিয়ে আমরা যে যার বিছানায় শুয়ে পড়লাম এবং ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম। রাত্রি নামার পর শীতটা বেশ ভালোই লাগতে লাগলো।   কৌতূহল বশতঃ ব্যারাকে আমাদের কেউ কেউ নতুন স্লীপিং ব্যাগ বের করে ট্রাই করার জন্য গায়ে দিয়ে শুলো, কিন্তু মিনিট পাঁচ কি দশেক বাদেই গা থেকে স্লীপিং ব্যাগ সরিয়ে ফেলতে হলো কেননা ওই মিনিট দশেকের মধ্যেই ব্যবহারকর্তার ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। তা দেখে কৌতুকের ছলে আমাদের মধ্যে বেশ একটা হাসির উদ্রেক সৃষ্টি হলো। বুঝতে পারলাম এ স্লীপিং ব্যাগের জন্য জুলুকের শীত যথেষ্ট নয়, এ কেবল কুপুপের তুষারাদ্রিত পাহাড়ের শীত কে জব্দ করার জন্য উপযুক্ত। পরিস্থিতি নর্মাল হতে না হতেই প্রায় রাত্রি নয়টার সময় আমাদের ব্যাটালিয়নের একটি বার্তাবাহক অর্থাৎ “মেসেন্জার” প্রতিটি ব্যারাকে গিয়ে গিয়ে বার্তা দিয়ে গেলো যে পরদিন সকালে মেডিক্যাল ফিটনেস চেক করার জন্য আমাদের সকলের মেডিক্যাল এক্সামিনেশন হবে আর তারপর শুরু হবে আমাদের স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজেসনের প্রক্রিয়া। তারপর আরো কিছুক্ষন যে যার বিছানায় লেপমুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে নিজেদের মধ্যে একটু গল্প স্বল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। সবাই ক্লান্ত তাই মোটামুটি এক ঘুমে সকাল।  সকালে উঠে প্রাতঃকৃত্য সেরে নিয়ে ব্রেকফাস্ট করে একটি গ্রাউন্ডে একত্রিত হলাম এবং সেখান থেকে আমরা সবাই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে স্টেজিং ক্যাম্পের “MI Room” (মেডিকেল ইন্সপেকশন রুম) এ গেলাম। সেখানে তিনজন ডাক্তার এবং জন কয়েক নার্সিং অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছেন এবং তাঁরা সকলের মেডিকেল চেকআপ এর কাজে ব্যস্ত। সেখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আমার পালা আসার পর আমি ভিতরে ঢুকলাম এবং আমার মেডিকেল চেকআপ হলো। ব্লাড প্রেসার, বডি টেম্পারেচার, হার্ট রেট, ইত্যাদি মাপা ছিল সেই মেডিকেল চেকআপের বিশেষ উদ্দেশ্য। এই মেডিক্যাল চেকআপ-এর পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হলাম।   ব্যাটালিয়নের সকলের মেডিকেল চেকআপ সম্পূর্ণ হয়ে যাওয়ার পর দেখা গেলো কয়েকজনের মধ্যে কিছু সমস্যা ধরা পড়েছিল, যেমন কারোর ব্লাড প্রেসার নির্ধারিত মানের থেকে কম অথবা বেশি, আবার কারোর হৃৎস্পন্দন নির্ধারিত মানের থেকে কম অথবা বেশি। যাদের মধ্যে এই ধরণের ত্রুটি পাওয়া গেলো তাদের কে চিকিৎসার জন্য জুলুকেই আটকে দেওয়া হলো। চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের শারীরিক ত্রুটিগুলি শুধরে দেওয়ার পর তাদের কুপুপে পাঠানো হবে। কেননা কুপুপে যেখানে আমাদের ব্যাটালিয়নকে গিয়ে থাকতে হবে সেই জায়গাটা সমুদ্রতল থেকে ২০,০০০ ফুট উঁচুতে আর সেখানটা প্রায় সারা বছর বরফে ঢাকা থাকে এবং তাপমান মাইনাস ১০-১২-র মধ্যে ঘোরাফেরা করে, তাই যদি কোনো সৈনিকের শরীরে এইধরণের ত্রুটি থাকে তাহলে কুপুপের মতো জলবায়ু পরিস্থিতিতে তাদের প্রাণ পর্যন্ত বিপন্ন হতে পারে তাই এই সতর্কতা অবলম্বন করা।  যাইহোক, জুলুক স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজেসন ক্যাম্পে পরদিন থেকে ব্যাটালিয়নের এক্লিমেটাইজেসনের কাজকর্ম শুরু। এবার আমি আসছি সেই কথায়। ‘এক্লিমেটাইজেসন’ বস্তুটি হলো এককথায় ক্লাইমেটের সঙ্গে এডজাস্ট করা।  সমতলভূমির জলবায়ুর তুলনায় হাই অল্টিটুডের জলবায়ু একেবারেই পরিপন্থী এবং সমতল ভূমিতে থাকা কালীন একধরণের ক্লাইমেটে থাকবার পর ঐরকম উচ্চতাসম্পন্ন পাহাড়ের প্রতিকূল ক্লাইমেটে যাওয়ার আগে একটা মধ্যবর্তী জায়গায় ক্লাইমেটের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া কেই বলা হয় “এক্লিমেটাইজেসন।” আচ্ছা, এবার আসি এর প্রক্রিয়ার কথায়।  প্রথম দুই দিন দলবদ্ধ হয়ে জুলুক থেকে কুপুপ অভিমুখে পাহাড়ের চড়াই দিয়ে যে মেন রোড টি গেছে সেই রাস্তায় পায়ে হেঁটে ৩ কিলোমিটার পাহাড়ে উঠে সেখান থেকে আবার ক্যাম্পের লোকেশনে ফিরে আসতে হবে। জুলুক থেকে শুরু হয় বিপদসংকুল পরিস্থিতি তাই হাঁটবার সময় কেউ তাড়াহুড়ো করবে না অথবা অতিরিক্ত শারীরিক বল প্রয়োগ না করে যে যার নিজের গতিতে এবং শারীরিক সামর্থ অনুযায়ী চলবে। নবাগতদের জন্য এইসমস্ত ভৌগোলিক পরিস্থিতিতে এইটুকু ভুল অনেক বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আর তাছাড়া এটি কোনো প্রতিযোগিতামূলক ব্যাপার নয় তাই আগে পৌঁছনোর তাগিদে অযথা কেউ নিজের বিপদকে ডেকে আনবে না। এটা ওখানকার বিশেষ নির্দেশগুলির একটি। তবে হ্যাঁ, এখানে কিছুদিন থাকতে থাকতে অভ্যেস হয়ে গেলে তখন বিপদের সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায়।  যাকগে, যেটা বলছিলাম, প্রথম দুদিন ৩ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠে ফিরে আসার পর তারপরের দুই দিন ওই একই ভাবে একই রাস্তা দিয়ে একই পাহাড়ে উঠে ৫ কিলোমিটার গিয়ে সেখান থেকে ফিরে আসা আর তারপর দুই দিন ৮ কিলোমিটার করে পদযাত্রা করা।   এই ৬ দিন পদযাত্রা কালে মাঝে মাঝে থেমে বুকভরা নিঃস্বাস নেওয়া। যদিও অক্সিজেনের একটু আধটু অভাব জুলুক থেকেই অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। এটাই হলো এক্লিমেটাইজেসন প্রক্রিয়া।

জুলুকে স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজশন ক্যাম্পে ৭ দিন অতিবাহিত করার পর সকলের এক্লিমেটাইজশনের কাজ সফল ভাবে সম্পূর্ণ হয়ে গেলে ২৬ আগস্ট ১৯৯৪ তারিখে পুনরায় আমাদের সকলের মেডিকেল চেকআপ হলো। মোটামুটি আমরা সবাই মেডিক্যাল ফিটনেস চেকআপ এ ফিট ছিলাম তাই আমাদের সকলকে MI Room থেকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে ২৭ই আগস্ট ১৯৯৪ তারিখে আমরা আমাদের ব্যাটালিয়নের কনভয়ে করে রওনা দিলাম আমাদের গন্তব্য স্থলের দিকে যেখানে আমাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে সেখান থেকে আরো ১০,০০০ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট হিমালয়ের এক পর্বত শৃঙ্খলা এবং ভারতবর্ষের একেবারে শেষপ্রান্ত যার নাম কুপুপ। জুলুক থেকে কুপুপের রাস্তায় যাত্রাকালীন অভিজ্ঞতা এবং কুপুপের “ভারত – চীন” সীমান্তে আমাদের ব্যাটালিয়নের স্থায়ী লোকেশনে পৌঁছনোর পর সেখানকার এক অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতার গল্প নিয়ে আর এক দিন আসবো আপনাদের সামনে। তার সঙ্গে থাকবে কুপুপের নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট এবং আবহাওয়ার বৈচিত্রের এক সুমধুর কাহিনী। ততদিন ভালো থাকবেন, সুরক্ষিত থাকবেন, আর অবশ্যই পড়তে থাকবেন “জেলার খবর সমীক্ষা”। জয় হিন্দ।

 

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *