মসির ধারায় অসির ধার (২৫)

সঞ্জীব মুখার্জী
“It is God’s duty to forgive the enemies, but it’s our duty to arrange a meeting between the two.”
– General D Oberoi
দিনটা ১৯৯৪ সালের আগস্ট মাসের ৪ কিংবা ৫ তারিখ এবং শিলিগুড়ির নিকটে সেবকের মধ্য জঙ্গলে স্টেজিং ক্যাম্পে আমাদের ব্যাটালিয়নের তৃতীয় দিন। গ্রীষ্মের প্রখর রৌদ্র আর উত্তাপে চারিদিক উত্তপ্ত হলেও আমাদের স্টেজিং ক্যাম্পটি জঙ্গলের ঠিক মাঝখানটিতে হওয়ার জন্য আমরা অন্ততঃপক্ষে গরমের হাত থেকে একটু রেহাই পেয়েছি। উঁচু উঁচু শাল আর সেগুনের গাছ এবং মাঝারি সাইজের বিভিন্ন রকমের জানা অজানা গাছের উপস্থিতিতে ক্যাম্পের চারিদিকের জঙ্গলটা একদম কম্প্যাক্ট। ক্যাম্পের লোকালয় এবং জঙ্গল থেকে একটু বাইরে বেরিয়ে আসলে উত্তরদিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় সুদূরে ছোট বড় নানান আকারের পাহাড়ের প্রাচুর্য। সে কি এক নয়নাভিরাম দৃশ্য তা আমি আপনাদের ভাষায় বোঝাতে পারবো না। আবছা আবছা পাহাড়ের চূড়াগুলি যেন হাতছানি দিয়ে আমাদেরকে তাদের নিজের কাছে আসতে বলছে। স্টেজিং ক্যাম্পের দুটো দিন খুবই সুন্দর ভাবে কেটে গেলো। রাত্রিতে ঝিঁঝিঁ পোকার আর শিকার-সন্ধানী শেয়ালের ডাকে ঘুমিয়ে পড়া আর সকালের নানা ধরণের পাখির কলকাকলীতে ঘুম থেকে উঠে পড়া। কোনো এক গাছের মগডাল থেকে ভেসে আসা কোকিলের কণ্ঠের সুমধুর ডাক আর নানান ধরণের রং বেরঙের প্রজাপতিদের আনাগোনা মনকে বাস্তব জগৎ থেকে কিছুটা হলেও একটা বিচ্ছিন্ন জগতে টেনে আনছিল। ভুলে যাই আমরা সবকিছু, হয়তো এমনকি নিজেকেও। আর তারই মধ্যে সারাক্ষণ ধরে বয়ে চলা মৃদুমন্দ শীতল বাতাসে বুকভরা প্রশ্বাসে সঞ্চারিত হয় এক অভূতপূর্ব অনুভূতি। স্টেজিং ক্যাম্প চলাকালীন কার্যপ্রণালীর অংশ হিসাবে এলাকা পরিচিতির জন্য প্রথম দুটো দিন আমরা সবাই ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে সশস্ত্রভাবে জঙ্গলের চারপাশে এবং জঙ্গলের আরো গহনে যাই। ঘুরতে ঘুরতে কোথাও দেখি কোনো মৃত পশুর হাড়গোড় পড়ে আছে, আবার জঙ্গলের মাঝে কোনো ছোট জলাশয়ের কাদায় দেখি নানান ধরণের পশুর পায়ের ছাপ। এই পদচিহ্নগুলির মধ্যে কোনোটা প্রকট আবার কোনোটা প্রচ্ছন্ন। প্রকট পায়ের ছাপগুলি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জায়গাটি নিরাপদ নয় এবং স্থানটি হাতি, বাঘ, চিতাবাঘ, ভাল্লুক, ইত্যাদি বন্যপ্রাণী সংকুল। তাদের পদচিহ্নগুলি তাদের উপস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে আর একটা কথাও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে এটা তাদের সাম্রাজ্য এবং এখানে কোনো বহিরাগতর আগমন তাদের কাছে অনধিকার প্রবেশ বলেই গণ্য হবে এবং সেই অনধিকার প্রবেশকারীদের কঠোরতম শাস্তি দিতে তারা কোনরকমভাবে পিছপা হবে না।
ক্যাম্পে প্রথম দুটো দিন নির্বিঘ্নে কেটে গেলেও তৃতীয় দিনের অভিজ্ঞতাটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত এবং বিভীষিকাপূর্ণ। কে জানতো তৃতীয় দিনের মধ্য রাত্রিতে ওৎ পেতে রয়েছে আমাদের সকলের জন্য এক ভয়াল ভয়ঙ্কর আর হাড়হিম করা দুর্ঘটনা আর কি ভাবেই বা পেলাম আমরা সকলে সেই আকস্মিক এবং মৃত্যুসম দুর্ঘটনার হাত থেকে পরিত্রান? আজ আমি আপনাদের বলবো সেই অনন্য, অনবদ্য এবং অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতাটির কথা।
রোজকার মতো সেদিনও আমরা রাত্রির খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়ে ক্যাম্পে যে যার ঘরে নিজের বিছানায় শুতে চলে যাই এবং সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়েও পড়ি। ক্যাম্পের বাসস্থান বলতে ঢালাই ছাদ এবং করোগেটেড টিনের ছাদ বিশিষ্ট বেশ কয়েকটি পাকা দেওয়ালের বাড়ি যেগুলি সৈনিকদের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত আর করোগেটেড টিনের দ্বারা নির্মিত অস্থায়ী ঘর যেগুলি ভান্ডার ঘর হিসাবে ব্যবহৃত। এছাড়াও রয়েছে তাঁবু নির্মিত কতকগুলি কক্ষ যেগুলি বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হত। যাইহোক, ঘুমিয়ে পড়ার পর মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গে সকলের সমস্বরে হইচই আর চিৎকারে। সবাই জোরে জোরে চিৎকার করে শুধু একটি কথাই বলছে, “সভী লোগ সাবধান হো যাও, ক্যাম্প মে হাথিওঁ নে হামলা কর দিয়া, কোই আপনে জাগাহ সে বাহার নাহি আয়েগা” অর্থাৎ “সবাই সাবধান থাকুন, আমাদের ক্যাম্পে জংলী হাতীর দল হামলা করে দিয়েছে, আর কেউ যেন নিজের ঘর থেকে বাইরে না বেরোয়”। সবাই তারস্বরে চিৎকার করছে আর এদিক থেকে ওদিকে ছোটাছুটি করছে। স্বাভাবিকভাবেই মধ্যরাত্রিতে ঐরকম চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমরাও জেগে যাই আর পুরো ব্যাপারটা কিছুটা আঁচ করতে পারি। কাঁচা ঘুমে জড়ানো চোখদুটি কচলাতে কচলাতে আমাদের ঘরটির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে আমরা তাকাই। একে মধ্যরাত্রি তার উপর আবার জঙ্গলের মাঝে তাই বাইরেটা একটু আলোআঁধারী হয়ে রয়েছে। যদিও বনবিভাগের এবং আমাদের ক্যাম্পের ল্যাম্প পোস্ট মিলিয়ে কয়েকটি হ্যালোজেন লাইট জ্বলছে। সেই আলোআঁধারীতে যে দৃশ্য আমরা অবলোকন করলাম এককথায় তাকে হাড়হিম করা দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না, আর সে দৃশ্য আপনারা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না বলে আমার মনে হয়। বাইরে তাকিয়ে দেখি কালান্তক যমের মতো কয়েকটি ভয়াল ভয়ঙ্কর, বিশালাকার এবং দাঁতাল হাতী শুঁড় দোলাতে দোলাতে এদিক থেকে ওদিকে গজেন্দ্রগমনে এলোপাথাড়ি দৌড়াদৌড়ি করছে। আমার পাশের একটি সৈনিক জানালা দিয়ে টর্চের আলো ফেলতেই হাতীদের মধ্যে একটা দৌড়ে তেড়ে আসে আমাদের জানালার দিকে। মনে মনে আমরা প্রমাদ গণলাম। আমরা তৎক্ষণাৎ টর্চের আলো নিভিয়ে দিয়ে জানালা বন্ধ করে দিই, আর দরজা খুলে আমরা বেরিয়ে আসি ক্যাম্পের সম্মুখে। বাইরে বেরিয়ে দেখি সামনেও বেশ কয়েকটি দাঁতালর উপস্থিতি। ভয় মিশ্রিত আক্রোশে মদমত্ত এবং বেপরোয়া হাতীদের উচ্চৈস্বর যুক্ত বৃংহতি সহযোগে রাতটি হয়ে ওঠে আরো ভয়ানক। এমত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার আগে কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে পড়ি আমরা সবাই। কিন্তু তা হলে তো চলবে না, এই বিষম পরিস্থিতিতে আমাদের সামান্য একটি ভুল পদক্ষেপও আমাদের যে কারুরই জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে তাই বেশি হুড়োহুড়ি না করে আমরা পরিস্থিতির শান্তি কিভাবে বজায় রাখা যায় তারই চেষ্টা করছিলাম। অন্যদিকে, আমাদের ক্যাম্পের পাশে থাকা বনবিভাগের প্রহরীরাও জোরে জোরে ড্রাম বাজাতে শুরু করেছে। সেখানে হাতির উপদ্রব প্রতিনিয়ত ঘটার ফলে বনবিভাগের লোকেরা রাত্রিতে ড্রাম জাতীয় বাদ্য নিয়ে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। সকলের সম্মিলিত চিৎকারে কলরব মুখরিত সেই রাত্রিতে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, এক কথায় তা নজিরবিহীন। ইতিমধ্যে হঠাৎ শুনতে পাই লাগাতার ফায়ার করে চলা রাইফেলের কয়েকটি গুলির আওয়াজ আর তার সঙ্গে স্মোক বোমের ফাটার আওয়াজ। সেই জোরালো শব্দে হাতীর দলটি ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করে। তীব্র ধোঁয়ার গন্ধে তারা ক্যাম্প ছেড়ে জঙ্গলের দিকে পালাতে শুরু করে। আর্মির ব্যাটালিয়নের কাছে একটি জংলী হাতীর দলকে কাবু করতে হয়তো বেশি মেহনত করতে হতো না, কেননা রাইফেলের কয়েকটি রাউন্ডই বুনো হাতীগুলির উপদ্রব থেকে চিরতরে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু সরকারি আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র হাতী কেন, তার সঙ্গে বন, বনজ সম্পদ অথবা যেকোনো বন্য প্রাণীকে হত্যা করা আইনত একেবারেই নিষিদ্ধ, তাই সেই কানুন উলঙ্ঘন করা আমাদের ধর্মও ছিল না আর কর্তব্য ও ছিল না, তাই আমরা তাদের মারিনি। তাহলে বন্দুকের যে গুলি গুলোকে ফায়ার করা হলো সেগুলি তাহলে কি? আর স্মোক বম্ব-ই বা কেন ফাটানো হলো? কিছুক্ষণ পরে এই প্রশ্ন দুটির উত্তর পেয়ে গিয়েছিলাম। জানা গেলো নিরুপায় হয়ে আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল শেরগিলের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের ব্যাটালিয়নের নৈশ প্রহরীরা রাইফেল দিয়ে ব্ল্যাঙ্ক কার্তুজের কয়েকটি রাউন্ড ফায়ার করে আর তার সঙ্গে ফাটানো হয় কয়েকটি স্মোক বম্ব। নইলে সেদিন রাত্রিতে আমাদের ব্যাটালিয়নের ক্ষয়ক্ষতির পরিমানটা অনেক বেশি হতে পারতো, ঈশ্বর না করুন আমাদের কোনো সৈনিক আঘাতপ্রাপ্তও হতে পারতো এমনকি প্রাণ পর্যন্ত যেতে পারতো। ব্ল্যাঙ্ক কার্তুজ ফায়ার করলে রাইফেলের নল থেকে কোনো বুলেট ছুটে বেরও হয়না আর কারও কোনো ক্ষয়ক্ষতিও হয় না, কিন্তু আওয়াজ হয় অরিজিনাল রাউন্ডের মতোই। যাইহোক, ব্ল্যাঙ্ক কার্তুজের আওয়াজে ভয় পেয়ে হাতীর দল ক্যাম্প থেকে হেলতে দুলতে ছত্রভঙ্গ হয়ে দৌড়াদৌড়ি করে পালাতে শুরু করে আর ধীরে ধীরে জঙ্গলের মধ্যে অন্ধকারে মিশে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায় ভয়ানক সেই হাতীর পালটি, যাকে বলে “The herd of Gentle Giants”। আমাদের ক্যাম্পে এই “Gentle Giants”-এর দলটির আগমন কালে তাদের অতিথি আপ্যায়ন করতে না পারলেও ফেরার পথে আমাদের থেকে এককথায় জোর করে ছিনিয়ে নেয় তাদের এক বিদায় সম্ভাষণ। কথাটা আপনাদের একটু হাস্যকর শোনালেও কিন্তু কথাটা সত্যি। কেননা যেতে যেতে তারা কেউ খালি হাতে ফেরৎ যায়নি, যাবার সময় আমাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর উপঢৌকন এবং প্রীতি উপহার লুন্ঠন করে নিয়ে তবে তারা ক্যাম্প পরিত্যাগ করে। যাবার সময় হাতীর পালটি আমাদের রেশন স্টোর থেকে কয়েকটি আলুর বস্তা, চিনির বস্তা, শাকসবজির বস্তা, আটার বস্তা, ইত্যাদি যে যা সামনে পায় শুঁড়ে করে তা তুলে নিয়ে পালায় আর তার সঙ্গে তুলে নেয় তাদের প্রিয় ফলটি অর্থাৎ গোটা দুয়েক কলার কাঁদ। পরে অবশ্য জানতে পারি যে জংলী হাতীর পালটি ক্যাম্পের এক কোণ দিয়ে প্রবেশ করে আর হৈহট্টগোলের মধ্যে ক্যাম্পের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আমাদের রসদ ভাণ্ডারে রাখা সমস্ত খাদ্যবস্তুর এবং পাকা ফলমূলের সুগন্ধে আকৃষ্ট হয় বুনো হাতীর পালটি, আর তারই আকর্ষণে উন্মত্ত হয়ে খাবারের সন্ধানে হাতির দলটির প্রধান টার্গেট হয়ে ওঠে আমাদের রেশন স্টোরটি। তাদের পরিকল্পনা কে বাস্তবায়িত করতে তারা আমাদের রেশন স্টোরের উপর চড়াও হয়ে টিনের দেওয়াল উপরে ফেলে আর রসদ ভান্ডারে রাখা চাল, ডাল, আটা, তেলের টিন, শাকসব্জি, ফলমূল, ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছুটা খায় আর বেশ কিছুটা তছনছ করে নষ্ট করে দেয়। সেখানে আমাদের ডিউটিরত নৈশ সান্ত্রী হাতীর পালটিকে প্রথম যখন দেখতে পায় তার সঙ্গে সঙ্গেই জোরে জোরে চিৎকার করে পুরো স্টেজিং ক্যাম্পটিকে অ্যালার্ট করে দেয়। যাই হোক, হাতীর পালটির আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পর আমরা সবাই স্বস্তির নিঃস্বাস ফেলি, সকলের ছন্দহারা হৃৎপিণ্ড যেন ফিরে আসে স্ব-স্পন্দনে আর সকলের ওষ্ঠাগত প্রাণ যেন ফিরে পায় স্ব-গতি। এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড়কথা হলো আমাদের কোনো সৈনিকেরও কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি আর দাঁতালোগুলিও অক্ষত অবস্থায় ক্যাম্প ছেড়ে পালাতে সক্ষম হয়। রেশনের জিনিস যা গেছে যাক, তাতে কোনো দুঃখ নেই বরং এটা ভেবে আমরা আনন্দিতই হচ্ছিলাম যে কিছুটা খাদ্যের যোগান দিয়ে আমরা হাতীর দলটির উদরপূর্তির কিছুটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি তাই হয়তো “লর্ড গণেশ” প্রসন্ন হয়ে আমাদেরকে আশীর্বাদই করবেন। যাইহোক, হাতীর দলটি যখন আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে চলে যায় তখন রাত্রি প্রায় তিনটে। সকলের ঘুম ভেঙ্গে যাওয়াতে মধ্যরাত্রিতে চা বানিয়ে চা সহযোগে নিজেদের মধ্যে হাতীর পালের গল্প গুজবের মাধ্যমে উপভোগ করতে করতে বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দিই। হাতীদের সেখান থেকে চলে যাওয়ার পর আমাদের ক্যাম্পে বনবিভাগের লোকেরাও এসে পড়ে, তাদেরকেও চা পরিবেশন করে তাদেরকেও অতিথি সৎকার করি। আমাদের সাথে গল্প গুজবে অংশগ্রহণ করার কিছুক্ষণ পর তারাও খুশি হয়ে সেখান থেকে চলে যায়। থেকে যায় শুধু আমাদের সকলের মনে সেই রাতের অবশ্যম্ভাবী এবং প্রাণঘাতী বিপর্যয়ের ঘটনার স্মৃতিটুকু। সে ঘটনার দাগ এতই গভীর যে তা আজো তা মুছে যেতে পারেনি আমাদের কারোর মনের পটভূমি থেকে। আজও ভুলতে পারিনি আমরা কেউ সে রাতের কথা। আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কোনো না কোনো ভাবে অহরহ কিছু না কিছু ঘটে চলেছে, হয়তো তাদের কোনোটা আমাদের মনে থাকে আবার কোনোটা আমরা সহজেই ভুলে যাই, কিন্তু এই বিভীষিকাময় ঘটনার কথা সত্যি ভোলাবার নয়।
প্রসঙ্গ বহির্ভূত হলেও একটি কথা আজকে আমার মনকে ভীষণভাবে নাড়া দিচ্ছে ফলতঃ মন প্রচন্ডভাবে আন্দোলিত হচ্ছে আর আন্দোলিত মনের সেই অনুভূতির কথা আজ আপনাদের সামনে প্রকাশ করতে আমার খুব ইচ্ছে করছে। প্রকৃতি যেমন একদিকে উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছে, মুক্তহস্তে দান করে চলেছে সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়ে সসাগরা পৃথিবীকে তার নৈসর্গ আরো বেশি সুসজ্জিত করার জন্য, নদী নালা, পাহাড় পর্বত, পশু পক্ষী, গাছ পালা, ফুল ফল, ইত্যাদি কোনো কিছুরই কার্পণ্য রাখেনি, আর অন্য দিকে আমরা অবাধে করে চলেছি তার অপব্যবহার, অহর্নিশি নিজের কার্য চরিতার্থ করার জন্য অবলীলায় ধ্বংস করে চলেছি সেই সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদের আর নির্দ্বিধায় লিপ্ত হয়েছি সেই প্রাকৃতিক সম্পদকে অবক্ষয়ের মুখে ঠেলে দিতে। একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে অবিলম্বে আমাদের সকলের এই সমস্ত কার্য্য থেকে নিরস্ত হওয়ার প্রয়োজন, তবেই বাঁচবো আমরা আর তবেই বাঁচবে আমাদের পৃথিবী। আর এই কথাটা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করতে পারবো আমরা ততই আমাদের মঙ্গল।
যাইহোক, সেবকের স্টেজিং ক্যাম্পে পূর্ব নির্ধারিত বাকি আরো কয়েকটি দিন কাটিয়ে দিয়ে আমরা সেখান থেকে রওনা দিই পরবর্তী স্টেজিং ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে যার নাম “রংপো স্টেজিং ক্যাম্প”। রংপোতে চার পাঁচ দিন স্টেজিং করার পর সেখান থেকে শুরু হয় আমাদের কনভয়ের পর্বতারোহন। উদ্দেশ্য “জুলুকে” অবস্থিত পরবর্তী এবং গন্তব্যে অর্থাৎ “কুপুপে” পৌঁছনোর আগে শেষ স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজশন ক্যাম্প। জুলুক সমুদ্রতল থেকে প্রায় ৮,০০০ থেকে ১০,০০০ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়নকে থাকতে হবে বাধ্যতামূলকভাবে ৭ দিন আর করতে হবে ‘স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজশন’, তবে তারপর সেখান থেকে রওনা দেওয়া হবে “কুপুপ” এর অভিমুখে। আর্মির জন্য যেকোনো ‘স্নো-বেসড স্টেশন’-এ অর্থাৎ তুষারে আবৃত হাই অল্টিটুডে পৌঁছনোর পূর্বে ‘স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজশন একটি বাধ্যতামূলক এবং বিশেষ ড্রিল। কিভাবে আমরা জুলুকে ৭ দিন স্টেজিং-কাম-এক্লিমেটাইজশন’ সম্পন্ন করেছিলাম আর তারপর কিভাবে আমরা পৌঁছেছিলাম সেখান থেকে আরো ১০,০০০ ফুট উচ্চতায় “ভারত – চীন” সীমান্তে অবস্থিত আমাদের গন্তব্য স্থলটিতে যার নাম “কুপুপ” তার গল্প নিয়ে হাজির হবো আপনাদের সমক্ষে আর এক দিন। ততদিন ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, আর অবশ্যই চোখ রাখবেন “জেলার খবর সমীক্ষায়”। জয় হিন্দ।
ক্রমশঃ