মসির ধারায় অসির ধার (22)
সঞ্জীব মুখার্জী
“Tough times don’t last longer, but, tough men do. You become an adult at 18, serve in Indian Army for 10 years and become a man. When you go home, tell everybody about us that we gave our toughest today for their nicest tomorrow.”
- General PK Batra
শঙ্খ নিনাদের সঙ্গে এবং এক টান টান পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে গিয়েছিলো আমাদের ‘ওয়ার এক্সারসাইজের’ কর্মসূচীর বাস্তবায়ন। এক্সারসাইজের জায়গাটি ছিল পাঞ্জাবের ফাজিলকার সন্নিকটে ভারত পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমা রেখায় অবস্থিত একটি “বর্ডার চেক পোস্ট” যার নাম “সাদিকী – সুলেমানকি বর্ডার চেক পোস্ট”। কখনো ‘ওয়ার ব্রীফিং’, আবার কখনো ‘স্যান্ড মডেল ডিসকাশন’, কখনো সীমান্তরেখা ধরে লম্বা ‘পেট্রোলিং’, আবার কখনো বাইনোকুলার দিয়ে নিজের “অবজারভেশন পোস্ট” বা “চেক পোস্ট” থেকে সীমান্তের অপরদিকে পাকিস্তানী সীমান্তরক্ষী বাহিনী বা পাকিস্তানী সৈনিকদের গতিবিধির উপর নজরদারী করা, এসবই ছিল ‘ওয়ার এক্সারসাইজের’ প্রাথমিক স্তরের মুখ্য কর্মসূচী।। পাক সৈনিকদের উপর নজরদারী করে তার প্রতিমুহূর্তের রিপোর্ট যাকে মিলিটারী ভাষায় বলা হয় “Pulse-by-Pulse Report” আমাদের উচ্চতর হেডকোয়ার্টারে পাঠানো ছিল আমাদের ‘ওয়ার এক্সারসাইজের’ কার্যকলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমাদের “অবজারভেশন পোস্ট” থেকে পাক সেনাদের গতিবিধির উপর নজর রাখার জন্য দিনের বেলায় অত্যন্ত ক্ষমতাশীল বাইনোকুলার ব্যবহার করা হতো আর রাত্রিবেলায় ব্যবহার করা হতো অত্যাধুনিক ক্ষমতাসম্পন্ন “প্যাসিভ নাইট ভিশন ডিভাইস” (PNVD) যেটা দিয়ে রাত্রির অন্ধকারে পর্যন্ত অনেক দূরের অবজেক্ট অতি সহজে দেখতে পাওয়া যেত। আমাদের দেশের তিনটি রাজ্য যথা গুজরাট, রাজস্থান এবং পাঞ্জাবের যতটা এলাকা পাকিস্তানের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্তে পড়ে ততটা এলাকায় সাধারণ সময়ে আমাদের “সীমা সুরক্ষা বল”-ই (BSF) নিযুক্ত থাকে। কিন্তু এই সমস্ত সীমান্তে যুদ্ধ শুরু হলে বা আন্তর্জাতিক শান্তিভঙ্গ হলে তখন সেখান থেকে BSF-কে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং সেখানে ‘আর্মি ব্যাটালিয়ন ডিপ্লয়’ করা হয়। এটাই আমাদের দেশের সামরিক নিয়ম। যেমন আমাদের সীমান্তরক্ষীদের BSF বলা হয় তেমনি পাকিস্তানের সীমান্তরক্ষীদের বলা হয় “রেঞ্জার”। পাঞ্জাব প্রদেশের আর পাকিস্তানের মাঝখানে পুরো আন্তর্জাতিক সীমারেখায় মোট তিনটি “জয়েন্ট চেক পোস্ট” পড়ে যেগুলির নাম যথাক্রমে অমৃতসর জেলার Wagah-Attari বর্ডার, ফিরোজপুর জেলার Ganda Singh Wala-Hussainiwala বর্ডার আর তৃতীয়টি হলো ফাজিলকা জেলার Sadqui-Sulemanki বর্ডার। আপনাদের অনেকেই অমৃতসরের নিকট Wagah-Attari বর্ডারে ভারতের BSF এবং পাকিস্তানের Ranger-দের দ্বারা যুগ্মভাবে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ ধরণের প্যারেড “Retreat Ceremony Parade”-এর নাম শুনে থাকবেন অথবা তার দর্শনও করে থাকবেন। অনেকে আবার এই সেরিমনিটি কে “Silly Walk Ceremony” বলেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। ঠিক একইরকম ভাবে “Retreat Ceremony Parade” বাকি দুটি বর্ডারেও ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুগ্ম ভাবে অনুষ্ঠিত হয় তার কথা হয়তো আপনাদের অনেকেই জানেন না। ভারত আর পাকিস্তান এক অপরকে চিরশত্রু ভেবে এসেছে আর আজও তাই আসছে, সে ক্রিকেট খেলার মাঠই হোক অথবা হকি খেলার মাঠই হোক কিংবা রাজনৈতিক পটভূমিই হোক অথবা যুদ্ধের রণভূমিই হোক। কিন্তু এতো সবকিছুর মধ্যেও রয়েছে একটি উল্লেখযোগ্য এবং আনন্দের বিষয় যেটি হলো এই তিনটি আন্তর্জাতিক সীমান্তের যে “জয়েন্ট চেক পোস্ট”-গুলির কথা আপনাদের এতক্ষণ আমি বললাম সেগুলির সবগুলিতেই আমাদের BSF এবং পাকিস্তানের Ranger দের মধ্যে একটি সুমধুর সম্পর্ক রয়েছে। হ্যাঁ, আপনারা শুনে হয়তো অবাক হবেন এই চেক পোস্টগুলিতে তারা নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি তো করেই না বরং তারা নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব রেখে পরস্পর পরস্পরকে প্রতিদিন “সুপ্রভাত”, “শুভ রাত্রি” ইত্যাদির আদান প্রদানের মাধ্যমে এবং বিশেষ উৎসবের দিনগুলিতে যেমন দুর্গাপূজা, দিওয়ালী, হোলি, ঈদ, মহরম, রমজান, সবে-বরাত, প্রজাতন্ত্র দিবস, স্বাধীনতা দিবস প্রভৃতিতে একে অপরকে অভিনন্দনের আদান প্রদানের মাধ্যমে কি সুন্দরভাবে যে সহাবস্থান করেন তা আপনারা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না। যখন তাদের কেউ দীর্ঘ অথবা হ্রস্য ছুটিতে যায়, ছুটি কাটিয়ে আসার পর তার পারিবারিক কুশল, তার ছুটি কেমন কাটলো, ছুটিতে কোন কোন আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হলো, সে কোনো বিয়ে পৈতে অনুষ্ঠান পেয়েছে কিনা, ইত্যাদি জানতে চেয়ে কথোপকথন করাটা যেন তাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এছাড়া এমনকি নিজেদের মধ্যে চা, মিষ্টান্ন এবং অন্যান্য খাদ্যবস্তুর আদান প্রদান পর্যন্ত করাটাও তাদের সেখানকার জীবনের অভিন্ন অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। শুনে আপনাদের কি দারুন অনুভূতি হচ্ছে, তাই না?
এবার আসি আমাদের মাছ ধরার কাহিনীতে, একটি বিশেষ পদ্ধতিতে DCB-র ক্যানালের গভীর জলে মাছ ধরার এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কাহিনীতে। একদিন আমার তাঁবুতে যখন আমাদেরই একজন সৈনিক, আমার থেকে জুনিয়র, যে কিনা একজন উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা, নাম সামশের সিং, এসে আমায় এমন একটি পদ্ধতিতে মাছ ধরার প্রস্তাবটা দিলো যাতে জালও লাগবে না, ছিপ ও লাগবে না আর মাছ ধরার জন্য আমাদের জানা অন্য কোনো উপকরণের প্রয়োজন নেই সেটা শুনে আমি সত্যি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সামশের সিং উত্তর প্রদেশের বাসিন্দা হলেও একজন মৎস্য প্রেমী, মাছ খেতে খুব ভালোবাসত সে। নির্বাক হয়ে সামশের সিংয়ের মুখ পানে চেয়ে থেকে নিজেকেই প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম, যে মাছটা তাহলে সে ধরবে কিভাবে? এর সঙ্গে জড়িত আর একটি প্রশ্ন ও আমার মনের কোণায় উঁকি দিচ্ছিলো, মাছ ধরার কি এমন পদ্ধতি আছে যা আমার মতো একজন বাঙালীর, একজন মৎস্য প্রধান রাজ্যের লোকের জানা নেই, অথচ একজন উত্তর প্রদেশের লোকের জানা আছে? আজ আমি আপনাদের সেই ঘটনার কথাই বলবো। সামশের সিংয়ের মাছ ধরার প্রস্তাবে প্রাথমিক ভাবে আমি একটু সন্দেহাধীন থাকলেও সেদিন সামশের সিং আমায় অভয় দিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে আগামী শনিবার আমরা মাছ ধরার অভিযান চালাবো। অভিযানটি চালানোর জন্য থাকবে চার পাঁচটি যুবসৈনিকের অর্থাৎ জওয়ানের একটি দল আর অভিযান দলটিকে নেতৃত্ব দেবে স্বয়ং সামশের সিং। যা করার সামশের সিং আর তার দলই করবে। তা শুনে আমি সরাসরি সমশের সিং-কে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে আমায় তাহলে কি করতে হবে। উত্তরে সমসের সিং আমায় বলেছিলো, “স্যার, আপনাকে কেবল আমাদের মৎস্য শিকার অভিযানের দলটিকে দুটি সাপোর্ট জোগাতে হবে তার প্রথমটি হলো দলটিকে অভিযান চালানোর জন্য আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের কাছ থেকে অনুমতির ব্যবস্থা আর দ্বিতীয়তঃ মাছ ধরার জন্য যে মুখ্য বস্তুটির প্রয়োজন যার নাম হ্যান্ড গ্রেনেড নাম্বার M৯০ (এম নাইনটি) তার গোটা দশেকের ব্যবস্থা আমাদের আর্মির গোলা বারুদ ভান্ডারের থেকে করিয়ে দেওয়ার”। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “হ্যান্ড গ্রেনেড দিয়ে মাছ ধরবে সামশের? গ্রেনেডের টুকরোর আঘাতে মানুষই কিভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় সেকথা কি তুমি জানো না সামশের? তাহলে ভেবে দেখো তো মাছের কি অবস্থা হবে? যে মাছ খাওয়ার জন্য এতো প্রচেষ্টা, গ্রেনেডের টুকরোর আঘাতে সেই মাছের শরীর চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে, কিছুই তো অবশিষ্ট থাকবে না মাছের। না না তুমি ভুলে যাও সামশের এ অভিযানের কথা”। শুনে সামশের আমায় বলেছিলো, “স্যার, আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, “এম নাইনটি” গ্রেনেডে মাছের শারীরিক কোনো আঘাত লাগবে না, শুধু অজ্ঞান হয়ে যাবে আর জলের উপর ভেসে উঠবে, তখন আমার দলের জওয়ানেরা জলে নেমে সাঁতার কেটে মাছগুলি ধরে নিয়ে আবার ডাঙায় উঠে আসবে”। “এম নাইনটি” গ্রেনেড আমরা অনেক মিলিটারি অপারেশনের সময় আর ট্রেনিং এর সময় ব্যবহার করেছি, কিন্তু এর ব্যবহার যে মাছ ধরার জন্য করা যেতে পারে সেকথা আমার জানা ছিল না, আর আমি এই কথাটুকু অকপটে স্বীকার করতে পারি। এবার আমি আপনাদের বলি আমরা “এম নাইনটি” গ্রেনেড দিয়ে কিভাবে মাছ ধরেছিলাম। তবে তার আগে আপনাদের এটাও বলে রাখি যে এই “এম নাইনটি” গ্রেনেড টি আসলে কি? সাধারণতঃ যুদ্ধক্ষেত্রে বা মিলিটারি অপেরেশনে অথবা শত্রুপক্ষকে মারতে যে গ্রেনেডটি ব্যবহার হয় তার নাম হ্যান্ড গ্রেনেড নাম্বার ৩৬, এটি একটি মারণাস্ত্র এবং fragmentable, ডেটোনেটরের সাহায্যে একে বিস্ফোরিত করানো হয় এবং ফেটে গিয়ে এর উপরিভাগের যে পুরু লোহার আবরণ সেটি টুকরো টুকরো হয়ে শত্রু সেনার উপর আঘাত হানে এবং তাদের নিহত হতে হয় অথবা গুরুতর ভাবে আহত হতে হয়। তার তুলনায় “এম নাইনটি” গ্রেনেড প্রাণঘাতী নয় এবং ফেটে গিয়ে এর থেকে কোনো লোহার টুকরোও নিঃসৃত হয় না। “এম নাইনটি” গ্রেনেড আসলে একধরনের ‘প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ’ দিয়ে তৈরি এবং মিলিটারি অপেরেশনের সময় ধোঁয়ার সৃষ্টি করার জন্য ব্যবহার করা হয় যাতে করে নিজেদের লুকিয়ে রেখে শত্রুসৈনিকদের উপর সহজে আক্রমণ করা যায়। “এম নাইনটি” গ্রেনেড ফাটাতে ডেটোনেটরের প্রয়োজন হয় না, হয় দিয়াশলাইয়ের আগুনের। যাইহোক, কথামতো শনিবার এসে গেলো। আমি ও আমার দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের অনুমতির এবং দশ বারোটি “এম নাইনটি” গ্রেনেডের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলাম। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল সুদানের আমার প্রতি সহৃদয়তার জন্য কোনোটারই অনুমতি পেতে অসুবিধা হয়নি। কেবল আমাকে কর্নেল সুদান বলেছিলেন যে মাছ ধরার কাজটা সম্পন্ন করতে আমাদের যেন আধ ঘন্টার বেশি সময় না লাগে আর সেখানে যেন আমি নিজে উপস্থিত থেকে থাকি। বলাই বাহুল্য, আমার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে এই অভিনব পদ্ধতিতে “মৎস্য শিকার অভিযানের” দৃশ্য উপভোগ করার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্ছিত করি কিভাবে তাই এক অদম্য কৌতূহলের সঙ্গে শনিবার ঠিক দুপুর দুটো কি আড়াইটের সময় গোটা কয়েক “এম নাইনটি” নিয়ে সামশের সিং আর তার দলবলকে নিয়ে ক্যানালের একটি পরিষ্কার জায়গা দেখে সেখানে কাজে নেমে পড়লাম। চরিত্রগত ভাবে “এম নাইনটি” গ্রেনেডটির সাইজ ঠিক টেনিস বলের আকারের, উপরটা দেখতে ঘন বাদামি রঙের, মসৃণ এবং চকচকে একটি আস্তরণ। এর একদিক থেকে দুই থেকে আড়াই ইঞ্চি মতো লম্বা একটা পলিতা বেরিয়ে রয়েছে। পলিতাটির অগ্রভাগ কোনো ধারালো চাকু অথবা ছুরি দিয়ে একটু ছুলে নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে দূরে ছুঁড়ে দিলেই মিনিট খানেকের মধ্যেই সেটা ফেটে যাবে। যখন ফাটবে তখন ভীষণ জোরালো শব্দ হবে আর তার থেকে উদ্গীরণ হবে অত্যন্ত ঘন ধোঁয়া, চারিদিক আচ্ছন্ন হয়ে যাবে সেই ধোঁয়ার উপস্থিতিতে। আমরা প্রথমে একটা “এম নাইনটি” গ্রেনেড নিয়ে জলের উপর রেখে পরীক্ষা করে দেখলাম সেটি খুব হালকা বলে জলের উপর ভেসে থাকছে। তখন দলের ছেলেরা এক একটি “এম নাইনটি” এক একটি মাঝারি সাইজের পাথরের সঙ্গে পাতলা অথচ শক্ত সুতো দিয়ে জড়িয়ে জড়িয়ে টাইট করে বাঁধলো, সবগুলো বাঁধা হয়ে গেলে তাদের একটির পলিতাই আগুন লাগিয়ে সেটি ক্যানালের ঠিক মধ্যিখানে জলের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলা হলো। দেখতে দেখতে পাথরসমেত “এম নাইনটি” গ্রেনেডটি জলের তলায় তলিয়ে গেলো। ক্যানালের জল কাঁচের মতো স্বচ্ছ হওয়াতে পাড় থেকে জলের নীচ পর্যন্ত স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো জলের তলা অব্দি যেতে যেতে পলতের আগুন কিন্তু নিভে গেলো না সেটি অব্যবহত ভাবে জ্বলতে জ্বলতে জলের নীচ পর্যন্ত পৌঁছে গেলো। এবার শুরু হলো আমাদের গ্রেনেড টি ফাটার অপেক্ষা। আমাদের অপেক্ষার এক মিনিট যেতে না যেতেই উপর থেকে দেখতে পেলাম জলের তলায় একটা বেশ বড়সড়ো বিস্ফোরণ হলো, আওয়াজ জলের বাইরে খুব একটা না আসলেও বাইরে থেকে গ্রেনেড ফাটার বিকীর্ণ আলোর ছটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিলো। আর তারপর যা হলো তা শুনে আপনারা আশ্চর্যচকিত হবেন। দেখি ক্যানালের ওই জায়গাটি আর আশপাশের কিছুটা জায়গা জুড়ে জলের উপর প্রচুর মাছ ভেসে উঠলো। প্ল্যান অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য দলের ছেলেরা প্রস্তুতই ছিল তাই বিনা বাক্যব্যয়ে তৎক্ষণাৎ ছেলেরা জলে নেমে পড়লো। প্রত্যেকের হাতে একটি করে থলে। সমস্ত মাছ সংগ্রহ করে তারা উঠে আসলো। প্রত্যেকের থলিতেই পনেরো থেকে কুড়িটা করে মাছ আর প্রতিটি মাছের গড় ওজন হবে ৮০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি পর্যন্ত। মাছগুলি নানান জাতির ছিল, কোনোটা রুই, কোনোটা কাতলা, কোনোটা গ্রাস কার্প, আবার কোনোটা সিলভার কার্প। সেদিন আর একটি গ্রেনেড ছোঁড়া হলো। সেদিনকার মতো অভিযান শেষ হলো। ঠিক হলো বাকি গ্রেনেড গুলি দিয়ে আবার পরে মাছ ধরা হবে। দুটি গ্রেনেডে যে পরিমান মাছ ধরা হলো তাতে আমাদের ব্যাটালিয়নের সমস্ত মৎস্যভোজীরা পেটপুরে খেলো। সামশের সিং আমার জন্য বেশ কয়েকটি বড় দেখে রুই মাছ রেখে দিয়ে ছিল। সেদিনটা ছিল সপ্তাহশেষের বিকালবেলা, অর্থাৎ শনিবার, তাই ব্যাটালিয়নের নিয়মানুযায়ী আমাদের গাড়ি করে আমি সেই সব মাছ নিয়ে আমাদের কলোনীতে আসি। আমার কোয়ার্টারে পৌঁছে জবাকে বলি দুই তিনটে মাছ রেখে দিতে, আর বাকি মাছ গুলো আশপাশের প্রতিবেশী পরিবার যারা মৎস্যভোজী তাদের দিয়ে দিই। খেয়ে বুঝতে পেরেছিলাম দারুন সুস্বাদু সেই মাছ। অন্যান্য সকলেও মাছ খেয়ে খুউব খুশি। তাদের আবার মাছ খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সোমবার সকালবেলায় আমাদের গাড়ি করে আবার ফিরে যাই কেরিয়ান গ্রামের কাছে ‘ওয়ার এক্সারসাইজ এরিয়াতে’।
এইভাবে বেশ কয়েকটি সপ্তাহ শেষে মৎস্য শিকার অভিযান চালিয়েছিলাম। দেখতে দেখতে আমাদের মাস তিনেকের ওয়ার এক্সারসাইজের স্বর্ণালী দিনগুলি শেষ হয়ে গেলো। ১০ই আগস্ট ১৯৯৩ তারিখে লট-বহর নিয়ে ফিরে এলাম আমাদের ব্যাটালিয়নের নিজস্ব ঠিকানায় আর তার সঙ্গে ফিরলাম আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মূল স্রোতে।
নতুন বছরও এসে গেলো। ১৯৯৩ ছেড়ে ১৯৯৪ সালে প্রবেশ করলাম। নববর্ষের দিনটা একটু পুরোনো হতে না হতেই এসে গেলো রঙে ভরা দোলের উৎসব। উত্তর ভারতে দোল কে হোলি বলে। পাঞ্জাবে হোলির উৎসব খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও আমাদের ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের মধ্যে এবং কলোনী তে উপস্থিত সমস্ত সৈনিক পরিবারের মধ্যে খুব ধুমধাম করে পালন করা হতো। আমাদের ব্যাটালিয়নে বেশিরভাগ লোকই রাজস্থানের এবং হরিয়ানার এবং তাদের বেশির ভাগই লোক হয় জাট নাহয় রাজপূত যেমনটি আমি আপনাদের আগে উল্লেখ করেছি। হোলি উৎসব পালন করার প্রথা আমাদের দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ধরণের। কোথাও রঙে রঙে ভূত করে দেয়, কোথাও লোকেদের টেনে নিয়ে এসে রঙের বদলে কাদা জলে বা নোংড়া জলে চোবায়, আবার কোনো কোনো জায়গায় টানা দশ দিন ধরে হোলি উৎসব পালিত হয়। কিন্তু এসব কিছুকে হারিয়ে দিয়ে হরিয়ানার জাটদের হোলি পালন করার পদ্ধতিটা একেবারেই অন্যরকম এবং বৈচিত্রপূর্ণ, এককথায় অনন্য বলা চলে। আজ আমি আপনাদের সেই কথাই বলবো। হরিয়ানার জাট মহিলারা হোলির ঠিক নয় দিন আগে থেকে প্রতিদিন একটা করে মাঝারী সাইজের পাথর জোগাড় করে আর সেই পাথরগুলি হয় তাদের দোপাট্টায় অথবা শাড়ীতে বাঁধে আর তা দিয়ে একটা চাবুকের মতো তৈরি করে। একটি করে দিন যায় আর একটি করে পাথর বাঁধে। এইভাবে বাঁধতে বাঁধতে নয় দিন পর অর্থাৎ ঠিক হোলির দিন সেই পাথর বাঁধা দোপাট্টা বা শাড়ীটি দেখতে একটি লম্বা চাবুকের মতো দেখতে হয়। প্রথা অনুযায়ী এই চাবুক দিয়ে সেখানকার জাট মহিলারা তাদের দেবর কে রং লাগায় আর তাদেরকে ছুটিয়ে ছুটিয়ে সেই চাবুক দিয়ে মারে। কিন্তু প্রথাভঙ্গ করে এইসব মহিলারা তাদের সামনে দেবর ছাড়া অন্য কাউকে পেলে তাদেরকেও পেটায় এমনকি নিজেদের স্বামীকেও পর্যন্ত ছাড়ে না। এতে যারা চাবুকের বাড়ি খায় তাদের অনেকে আহতও হয়। কিন্তু কিস্যু করার নেই, এটাই নিয়ম। ওই অঞ্চলে হোলি খেলার এই ধরণের চল কে “ধূলন্ডী হোলি” বলে আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। হোলির সারা সারাটা দিন এইভাবে চলে। বিকালবেলায় সবকিছু শান্ত হয়ে যায়। তারপর শুরু হয় এ ওকে মিষ্টি খাওয়ানোর পালা। আর তার সঙ্গে থাকে আহত দেবরকে বা স্বামীকে ওষুধপত্র দিয়ে, সেবা শুশ্রূষা করে সুস্থ করে তোলার উদ্যোগ। এদের এইসমস্ত কীর্তিকলাপ দেখে আমার স্ত্রী জবা ভয়ে ডরে কোয়ার্টার থেকে বেরোয় তো নি, এমনকি দ্বাররুদ্ধ করে বন্ধ ঘরেই বসে ছিল। বাইরে থেকে জাট মহিলারা দরজায় ঘা দিয়ে দিয়ে জবাকে তাদের সঙ্গে তাদেরই প্রথায় হোলি খেলতে বাইরে আসার জন্য উৎসাহিত করার শত চেষ্টা করেও তারা জবাকে দিয়ে তাদের সঙ্গে হোলি খেলাতে পারেনি। যাইহোক, এই দিনটা এমন একটা দিন যে এই দিনে কোনো দেবর বা কোনো স্বামী কে রাগ করতে দেখা যেত না, এমনকি তাদের মহিলাদের উপর পাল্টা আক্রমণ করতে ও দেখা যেত না। তবে আমি আপনাদের যে কথাগুলো বললাম সেটা আজ থেকে প্রায় ৩০ বছর আগেকার কথা। আজ সময় পাল্টেছে, উন্নত হয়েছে তাদের শিক্ষার মান আর সমাজ ব্যবস্থা। আধুনিকতার প্রভাব পড়েছে গ্রামাঞ্চল গুলিতেও। গ্রামগুলি পরিণত হয়েছে ছোট বড় শহরে। সময়ের তালে তাল মিলিয়ে পাল্টেছে তাদের লাইফস্টাইলও। তাই আজ তাদের এই হোলির প্রথা অবলুপ্তির পথে। তবে হ্যাঁ, কোনো কোনো অনুন্নত এবং অজ পাড়াগ্রামে গেলে আজও হয়তো এই প্রথার কিছুটা অবশিষ্টাংশের সাক্ষী হওয়া যেতে পারে।
হোলির উৎসবের রেশ কাটতে না কাটতেই আবার বেজে উঠলো রণদুন্দুভি, পড়ে গেলো সাজ সাজ রব। না, তবে এবারের দামামাটা একটু অন্য ধরণের। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল মাস, হঠাৎ একদিন শুনলাম আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের ব্যাটালিয়নের পোস্টিং অর্ডার এসে গেছে। আমাদের ব্যাটালিয়ন “তৃতীয় ব্যাটালিয়ন দ্য রাজপুতানা রাইফেলস” বেশ কয়েক বছর ফাজিলকায় থেকে সমগ্র পাঞ্জাবে গুরুদায়ীত্বের সঙ্গে অনেক উল্লেখযোগ্য কাজ করে, অনেক সুনাম অর্জন করে ফাজিলকা ছেড়ে একটি নতুন জায়গায় প্রস্থান করতে চলেছে। সেই সঙ্গে শুরু করতে চলেছে সেনাজীবনের এবং দেশ রক্ষার কাজে নতুন একটি অধ্যায়ের সূচনা। নতুন জায়গাটির নাম “কুপুপ” এবং যেটি হলো সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের উর্দ্ধে তুষারে আবৃত পর্বতবহুল এলাকায় অবস্থিত “ভারত-চীন” সীমান্তে। সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়নের থাকার মেয়াদ প্রায় ৩ থেকে ৪ বছর। প্রস্থান করার সম্ভাব্য দিন ১৯৯৪ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি। তবে তার গল্প নিয়ে আবার ফিরে আসবো আপনাদের কাছে। ততদিন ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন, আর অবশ্যই দেখতে থাকবেন “জেলার খবর সমীক্ষা”। জয় হিন্দ।
ক্রমশঃ