মসির ধারায় অসির ধার (21)

সঞ্জীব মুখার্জী
“Our soldiers are truly nationalist. They don’t want to die for the country, actually, they want to live for the country. They want to live because they want to fight for the country to save the country from internal or external aggression.”
~ Danny Denzongpa, Actor
পাঞ্জাবের ফাজিলকা থেকে প্রায় ২৫-৩০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভারত পাকিস্তানের মধ্যবর্তী একটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত যার নাম “সাদিকী-সুলেমানকি বর্ডার” সেখানে আমাদের যুদ্ধ অনুশীলনীর বা যুদ্ধাভ্যাসের জন্য প্রস্থান করার পালা। এই ধরণের যুদ্ধকালীন অনুশীলনকে মিলিটারী ভাষায় “এক্সারসাইজ” বলা হয়ে থাকে। বাস্তবিক যুদ্ধের সাথে তুলনা করলে ‘মিলিটারী এক্সারসাইজ’ যুদ্ধের থেকে কোনো অংশে কম নয়, যুদ্ধে যে সমস্ত প্রক্রিয়া, ড্রিল, ইত্যাদি হয়ে থাকে সেগুলির সবকিছুই নিজেদের মধ্যে অন্তর্নিহিত পদ্ধতিতে করা হয়, কিন্তু সত্যিকারের যুদ্ধ আর এক্সারসাইজের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো এক্সারসাইজ চলাকালীন আমরা প্রতিপক্ষের উপর গোলা গুলিটাই কেবল চালাই না। মোদ্দাকথা হলো, শত্রুপক্ষদের অথবা যে সমস্ত প্রতিবেশী দেশের সাথে আমাদের রাজনৈতিক, সামরিক এবং ভৌগোলিক সম্পর্ক প্রীতিকর নয় তাদের সীমান্তবর্তী এলাকায় আমরা কয়েক মাসের জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসে যুদ্ধ অনুশীলনীর মাধ্যমে তাদের আমরা এটা বুঝিয়ে দিতে চাই যে আমরা সর্বদাই, সর্বাঙ্গীনভাবে এবং সমস্তরকমের সামরিক পরিস্থিতির জন্য সতর্ক, সজাগ এবং প্রস্তুত। কিন্তু যুধ্যাভ্যাসে যাবারও একটা প্রস্তুতি থাকে আর তার প্রস্তুতি যে সত্যিকারের যুদ্ধের প্রস্তুতির থেকে কোনো দিক থেকে কম নয় সেটা আপনারা এতক্ষণে বুঝতেই পেরেছেন।
ভারত পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধাভ্যাসে যাবার নির্ধারিত দিন অর্থাৎ ২রা জুন ১৯৯৩ আসতে তখনও কিছুটা সময় বাকি। তাই তারই প্রস্তুতির নানান ক্রিয়াকলাপে তখন আমাদের পুরো ব্যাটালিয়ন মেতে উঠেছে। প্রস্তুতির নানান ব্যস্ততায় কখনো দিন ধীরে ধীরে আবার কখনো তীব্র গতিতে এগোচ্ছে। বাড়ি থেকে সদ্য নিয়ে আসা আমার স্ত্রী জবাকে কথায় কথায় জিজ্ঞেস করলাম যে তিন মাসের জন্য আমার অনুপস্থিতিতে জবার কোয়ার্টারে একা একা কাটাতে অসুবিধা হবে কি না, যদিও জবাকে আমি এটা বলে অনেকটা আস্বস্ত করেছি যে এই তিনটে মাস প্রতি সপ্তাহশেষে দুদিনের জন্য ফিরবো কিন্তু বাকি দিনগুলোতে কোনো অসুবিধা হয় কি না। জবাও আমাকে সাহসিকতার সঙ্গে ভরসা দিয়েছিলো যে তার আর্মি কোয়ার্টারে থাকতে কোনো কষ্ট এবং অসুবিধা এই কারণে হবে না যেহেতু ওর বাবাও আর্মিতে চাকরি করতেন তাই বাবার সঙ্গে বহু জায়গায় আর্মি কোয়ার্টারে থেকেছে আর তাছাড়া আর্মি কলোনিতে আরো লোকজনের পরিবার তো রয়েছেই। তাই আমাকে ওর জন্য অযথা দুশ্চিন্তা না করে আমার কাজে মনোযোগী হওয়ার প্রেরণা জুগিয়েছিল। অবশেষে দেখতে দেখতে ২রা জুন শিয়রে এসে গেলো। তার দুই তিন দিন আগেই আমি মোটামুটি এক সপ্তাহের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বন্দোবস্ত করে দিলাম।
২রা জুন ১৯৯৩ সকাল বেলা যথা সময়ে আমাদের এক্সারসাইজের জন্য কনভয় মার্চ করে গেলো। ফাজিলকা শহরে আমাদের ব্যাটালিয়ন লোকেশন থেকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত যেখানে আমাদের শিবির ফেলতে হবে তার দূরত্ব খুব একটা বেশি না, তবু ঘন্টা দেড়েক লেগে গেলো। যদিও ৩০ কিলোমিটারের দূরত্ব অতিক্রম করতে দেড় ঘন্টা লাগার কথা নয়, কিন্তু একে তো আর্মি কনভয় তাই নিয়মানুবর্তিতার একটা ব্যাপার তো আছেই তার উপর আছে কিছুটা রাস্তার অবস্থা। ফাজিলকা শহর ছেড়ে কিছুটা যাওয়ার পর আর পাকা রাস্তা নেই, একেবারে কাঁচা রাস্তা, দুধারে শুধুই চাষজমি আর মধ্যিখান দিয়ে আমাদের কনভয় ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। কনভয় মার্চের সময় উড়ন্ত ধুলোর মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট ভাবে দেখা যাচ্ছে দূরের গ্রামগুলি। সিঙ্গেল রোড তাই একটার পিছনে আর একটা গাড়ি, ওভারস্পীড বা ওভারটেকিং-এর প্রশ্নই নেই। শেষপর্যন্ত গন্তব্য স্থলে পৌঁছানোর পরে পরেই সকলে যে যার কাজে জুটে গেলো। জওয়ানদের কেউ কেউ তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত আবার কেউ কেউ কুক হাউস সেট করতে ব্যস্ত ঠিক যেমনটি হয়েছিল মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে। কিন্তু এখানে তাঁবু খাটানোর পদ্ধতিটা একটু বিশেষ এবং মহাজনের তাঁবু খাটানোর পদ্ধতির থেকে বেশ জটিলতর। মহাজনে মরুভূমিতে বা অন্যান্য সাধারণ জায়গাতে ভূমির উপরের স্তরেই তাঁবু খাটানো হয় কিন্তু এক্সারসাইজের এলাকায় সামনে পাকিস্তান সীমান্ত থাকার জন্য মাটিতে তাঁবুর আয়তনে আবক্ষ গর্ত খুঁড়ে তার উপর প্রতিটি তাঁবু খাটানো হয় আর সেই সঙ্গে প্রতিটি তাঁবুর চারিদিক ঘিরে তিন ফুট চওড়া একটি ট্রেঞ্চ কাটা হয় আর তাকে জল দিয়ে ভরে দেওয়া হয় যাকে সাধারণ ভাষায় পরিখা বলা হয়ে থাকে। আবক্ষ গর্ত করা হয় এই কারণে যাতে আমাদের সৈনিকরা সীমান্তের অপর প্রান্তের আচমকা আক্রমণের সম্ভাবনা থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতে পারে। আর এক কারণে পরিখা কাটা হয় যাতে করে কোনো সাপখোপ এবং অন্যান্য বিষধর প্রাণীর তাঁবুতে প্রবেশ করে বিশ্রামরত সৈনিকদের কোনো ক্ষতি না করতে পারে সেই জন্যে। পান্ডব বর্জিত স্থান, চারিদিকে গাছপালা আর চাষ জমি, তাতে ফসল ফলে আছে আর বেশ কিছু দূরে গ্রামগুলি দেখা যাচ্ছে, তাই সেখানে সাপখোপের সম্ভাবনা প্রবল। সৈনিকদের সুরক্ষার জন্যই এই সব ব্যবস্থা।
যে জায়গাটিতে আমরা শিবির ফেলেছিলাম সেখান থেকে চারিদিকের গ্রামগুলি অনেক দূরে দূরে। আমাদের কাছের যে গ্রামটি তার নাম “কেরিয়ান”। গ্রাম থেকে একটু দূরেই আমরা শিবির ফেলেছিলাম। যেদিন আমরা সেখানে পৌঁছাই সেদিনের পুরোটাই লেগে গেলো আমাদের সবকিছু ঠিক করতে। তারপরদিন থেকেই শুরু হলো আমাদের চারপাশের এলাকা পরিক্রমা যাকে বলে “এরিয়া ফ্যামিলারইজেসন” অর্থাৎ স্থান পরিচিতি। মিলিটারীর যেকোনো কাজের আগে এলাকা পরিক্রমা একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ড্রিল। চারপাশটা ঘুরে দেখতে দেখতে গ্রামের ভিতরটাও ঘুরলাম। গ্রামের মানুষেরা খুব সহজ সরল আর বিভিন্ন চাষের ফসল ফলিয়ে তাদের জীবিকা চলে। গ্রামের ভিতরটা ভালোভাবে ঘুরে বুঝতে পারলাম যে গ্রামটি বেশ বড় আর গ্রামের প্রতিটি লোকের কাছে রয়েছে প্রচুর স্থাবর সম্পত্তি, গবাদি পশু এবং তার সঙ্গে আছে আর্থিক সচ্ছলতা, কিন্তু সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার যেটা লক্ষ্য করলাম সেটা হলো গ্রামে একটিও পাকা বাড়ি নেই, সব মাটির বাড়ি আর টিনের চালা। কারণ হিসাবে জানতে পারলাম গ্রামটি সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ার দরুন প্রতিবেশী দেশ অর্থাৎ পাকিস্তান থেকে যেকোনো সময় ভারী ‘আর্টিলারি বম্বার্ডমেন্ট’ হতে পারে তাই তাদের পালাতে যাতে বিশেষ কোনো অসুবিধা না হয় তার জন্য তারা অস্থায়ী বাসস্থানে বসবাস করে। চাষজমি, স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি ছেড়ে তাদের পক্ষে স্থায়ী ভাবে গ্রাম ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তাই বাধ্যতামূলক ভাবে তারা সেখানে থাকে। আর এটা শুধু ‘কেরিয়ান’ গ্রামেরই নয় আশেপাশে যত গ্রাম আছে সবারই এই একই অবস্থা।
এবার আপনাদের বলি সেখানকার আন্তর্জাতিক সীমারেখা কেমন হয়। আমাদের শিবির যেখানে ফেলা হয়েছিল তার ঠিক পিছনদিকটা চাষজমি আর গ্রামে ভরা আমাদের দেশ ভারতবর্ষের মাটি। আর শিবিরের সামনের দিকটা পাকিস্তান অর্থাৎ আমাদের শিবিরের এলাকাটা একেবারে ভারতবর্ষের শেষ সীমান্তে। আমাদের শিবিরের থেকে সামনের দিকে মাত্র একশো গজ দূরে প্রথমে একটি DCB নির্মাণ করা আছে। DCB হলো “Ditch Cum Bandh”, সেটা কেমন দেখতে হয় সেটা বলছি। সীমারেখা বরাবর প্রায় ৩০ ফুট চওড়া একটি ক্যানালের মতো লম্বা খাল কাটা আর তাকে জলে ভরে দেওয়া আছে। ক্যানালের দুইপার উঁচু করে মাটি দিয়ে বাঁধ দেওয়া। DCB এরই নাম। DCB-র ঠিক অপরদিকেই রয়েছে অন্ততপক্ষে কুড়ি ফুট উঁচু কাঁটাতারের বেড়া। যুদ্ধের সময় এই DCB-র জলে আর কাঁটাতারের বেড়ায় ‘হাই ভোল্টেজ কারেন্ট’ ছেড়ে দেওয়া হয়। আর তারপর মাইন ফিল্ড, যেখানে মাটির নিচে কোথায় কোথায় যে মাইন পোঁতা রয়েছে তা কেউ জানেনা। যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষের কেউ সেই জায়গা পেরোতে চেষ্টা করলে মাটিতে পুঁতে রাখা মাইনের উপর পা যদি ভুল করে পরে যায় আর তার উপর থেকে পা উঠলেই সঙ্গে সঙ্গে মাইন ফেটে যায় আর লোকটির তিলমাত্র চিহ্ন থাকে না। মাইনফিল্ড শেষ হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে বেশ চওড়া একটি খালি জায়গা, যেটি না ভারতের আর না পাকিস্তানের, একে বলে “নো ম্যান্স ল্যান্ড” (“No Man’s Land”)। নো ম্যানস ল্যান্ডের পরই শুরু হয় পাকিস্তানের ভূমি। তারপর তাদের ও মাইনফিল্ড, কাঁটাতারের বেড়া, ইত্যাদি ইত্যাদি। রাত্রিতে DCB-র উপর উঠে পাকিস্তানের দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায় সেই আন্তর্জাতিক সীমানা আলোয় ঝলমল করছে। ভারত আর পাকিস্তান দুই দেশেরই কাঁটাতারের বেড়া বরাবর উঁচু উঁচু টাওয়ার আর তাতে রয়েছে চোখ ধাঁধানো ভীষণ শক্তিশালী ফ্লাশলাইট, ঠিক যেমনটি আমরা দেখতে পাই বড় বড় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে।
ওয়ার এক্সারসাইজের তিনটে মাস যে আমাদের খুব রোমাঞ্চকর জীবনযাত্রার মধ্যে দিয়ে কাটবে সেটা আমরা প্রথম থেকে ঠাহর করতে পারিনি। প্রথমদিকটা একটু একঘেয়েমী লাগলেও পরবর্তী দিনগুলোতে বেশ একটা নূতনত্বের আস্বাদ খুঁজে পাচ্ছিলাম। সেখানে পৌঁছনোর পর কেরিয়ান গ্রামের লোকেদের সঙ্গে আমাদের খুব সুন্দর ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেলো। সমগ্র পাঞ্জাবকে উগ্রবাদী মুক্ত করতে আর্মির যে ভূমিতে ছিল তা পুরো রাজ্যে সর্বজনবিদিত ছিল আর সে সুনামের ভিত্তিতেই কেরিয়ান গ্রামের সবাই আমাদের সম্মান করতো। গ্রাম থেকে কেউ না কেউ প্রতিদিন দুধ, দই, ঘী, জমির ফল, কাঁচা শাকসবজি, ইত্যাদি নিয়ে আমাদের উপহার দিতে আসতো। প্রথম প্রথম আমরা তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করে দিতাম কেননা গ্রামের কারোর কাছ থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করার পারমিশন আমাদের ছিল না। কিন্তু ফিরিয়ে দিলে তারা ভীষণ দুঃখ পেতো আর ম্লান মুখে ফিরে যেত। আপনারা বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, এইভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন আমাদের শিবির অঞ্চলে কেরিয়ান গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের আগমন হয়। তিনি বিশাল আকৃতির এক সর্দারজি আর এসে অনুরোধ করেন আমাদের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল সুদানের সঙ্গে দেখা করার। তাঁরই অনুরোধ রক্ষা করে তাঁকে কর্নেল সুদানের টেন্ট অফিসে পৌঁছে দেওয়া হয় সেখানে তাঁদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথোপকথন চলে। পঞ্চায়েত প্রধান কর্নেল সুদানের সঙ্গে মোলাকাত করে চলে যাওয়ার পর কর্নেল সুদান আমাদের সকলকে ব্যাপারটা জানান যে প্রধানজী পুরো গ্রামবাসীদের প্রতিনিধি হয়ে কর্নেল সুদানকে অনুরোধ করতে এসেছিলেন যদি আমাদের ব্যাটালিয়নের সৈনিকরা গ্রামবাসীদের কাছ থেকে তাদের উপহার হিসাবে দেওয়া গৃহৎপন্ন খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করে তাহলে গ্রামবাসী ভীষণ খুশি হবেন আর তার সঙ্গে প্রধানজী এও অনুরোধ করেন যে সমগ্র কেরিয়ান গ্রামের কোনো ব্যক্তি যদি আমাদের ব্যাটালিয়নের কোনো উপকারে আসতে পারেন তাহলে তাঁদের থেকে বেশী খুশি আর কেউ হবে না। গ্রামবাসীরা এও বলেছেন যে সৈনিকরা নিজেদের ঘর পরিবার ছেড়ে দেশবাসী এবং দেশ রক্ষার্থে নিজেদের প্রাণ পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পিছপা হন না, তার তুলনায় গ্রামবাসীদের এই উপহারটুকু নগন্য। মোটকথা তারা আমাদের যেকোনো ভাবে সেবা করতে চান, আমাদের পাশে দাঁড়াতে চান। কর্নেল সুদানের মুখ থেকে সব কিছু শুনে আমাদের প্রত্যেকেই আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়টা হলো আমরা কেউ প্রধানজীর সেই অনুরোধ রাখতে পারিনি কেননা আমাদের আর্মিতে এটা নীতি বিরুদ্ধ, বাইরের কারোর কাছ থেকে কোনো কিছু গ্রহণ করাটা আমাদের অনুশাসনের খেলাপ। এবার ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন তাহলে গ্রামবাসীর মনে কত উদারতা, কত ভালোবাসা, কত সম্মান আর্মির প্রতি। পরে অবশ্য কর্নেল সুদান প্রধানজীকে বুঝিয়ে বলেন যে আর্মি দেশবাসী এবং দেশে রক্ষার্থে প্রাণপাত করে থাকে বটে তবে তার জন্য সরকার তাদের খেয়াল রাখেন এবং সাময়িকভাবে নিরস্ত করার জন্য বা স্বান্তনা দেওয়ার জন্য কর্নেল সুদান প্রধানজীকে বলেন যে “ঠিক আছে, যেদিন আমাদের ওয়ার এক্সারসাইজের ক্লোজিং সেরিমনি হবে সেদিন আমাদের ব্যাটালিয়নের শিবিরে মহাভোজের আয়োজন করা হবে আর সেই মহাভোজে গ্রামবাসীদের ও আমন্ত্রিত করা হবে। সেইদিন আমাদের নিজেদের রেশন আর গ্রামবাসীদের উপহার দেওয়ার খাদ্যদ্রব্য, শাকসবজি, দুধ, দই, ছানা, ইত্যাদি মিলিয়ে মিশিয়ে একসাথে সবাইমিলে খাওয়াদাওয়া করা যাবে”। আমাদেরকে খাদ্যদ্রব্য উপহার দিতে চেষ্টা করা ছাড়া আর একটা উপহার গ্রামবাসীরা আমাদের দিতেন আর সেটা হলো আমাদের স্নানের জল। কি হয়েছিল জানেন? আমরা যেখানে ছিলাম সেখানটি খুব শুষ্ক এবং স্নানের জলের বেশ অভাব ছিল। যদিও পানীয় জল আমাদের নিজস্ব ওয়াটার টেলারে করে শহর থেকে নিয়ে এসে আমাদের সকলকে বিতরণ করতো, কিন্তু তাতে স্নানের জন্য সংকুলান হতো না। গরমে স্নান করাটা খুব আবশ্যক ছিল, কেউ কেউ আবার একাধিকবারও স্নান করতো তাই স্নানের জলের একটু অভাব ছিল। যদিও DCB-র ক্যানাল জলে টইটম্বুর থাকতো কিন্তু তাকে স্নানযোগ্য বলা চলেনা। এদিকে প্রকাশ্য জলাভাবে আশেপাশের চাষজমির মধ্যে গ্রামবাসীরা মাটির সুগভীরে “ডিপ স্যালো পাম্প” বসিয়ে তারা তাদের জমির সেচ করতো আর সেইসব পাম্প রুমের কাছে বানানো থাকতো একটি করে বড়ো চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চাটি এতো বড় সাইজের ছিলো যে জলপূর্ণ থাকলে তাতে একসঙ্গে আট নয় জন স্নান করতে পারতো ঠিক যেমন একটা ছোটোখাটো সুইমিং পুল, তাই যখন আমাদের ইচ্ছে হতো আমরা তখন সেই পাম্প রুমের মালিককে অনুরোধ করতাম আর পাম্প রুমের মালিক সঙ্গে সঙ্গে ৫-১০ মিনিটের জন্য পাম্প চালিয়ে সেই চৌবাচ্চাটিকে তাজা শীতল জলে পূর্ণ করে দিতো। বলাই বাহুল্য, আমরা সেই চৌবাচ্চাতে স্নান করে যে কি আনন্দ পেতাম তার কোনো সীমা ছিল না।
কয়েকদিন এইভাবে কেটে যাওয়ার পর, একদিন গ্রামবাসীদের একজন কথায় কথায় আমাদের বললো যে DCB-র ক্যানালে যে জল আছে তাতে নাকি প্রচুর বড় আর মাঝারি সাইজের মাছ আছে। তা শুনে আমরা তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তারা সেখানে মাছ ধরে না কেন। উত্তরে গ্রামবাসীটি বললো যে সেই গ্রামের বেশিরভাগ লোকই নিরামিষাশী এবং মাছ মাংস তারা খান না, আর তাছাড়া সেই ক্যানাল থেকে গ্রামবাসীদের মাছ ধরার অনুমতি নেই কেননা ক্যানালটি হলো আর্মির সম্পত্তি। গ্রামবাসীটিকে আবার প্রশ্ন করলাম যে সে মাছ খায় কিনা, তাতে সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। তা শুনে আমরা গ্রামবাসীটিকে বললাম যে আমরা যেদিন মাছ ধরবো সেদিন তাকে বেশ কিছু মাছ উপহার দেব। লোকটি আমাদের বললো যে আমরা মাছ ধরবো কিভাবে, ক্যানালটি বেশ গভীর আর তলায় পাঁকে পূর্ণ। সত্যি তো মাছ ধরবো তো বললাম কিন্তু ধরবো কিভাবে, এটা তো একটা বড় প্রশ্ন। গ্রামের কারোর কাছে মাছ ধরা জাল, ছিপ অথবা অন্য কোনো সরঞ্জাম নেই যে মাছ ধরবো। তখন আমাদের সৈনিকদেরই একজন আমার তাঁবুতে এসে আমাকে বললো, “সাব, আপ বিলকুল ফিকর মত্ করো, মছলি হাম পাকরেঙ্গে আউর জরুর পাকরেঙ্গে, লেকিন হাম আগলা শনিবার কো পাকরেঙ্গে, আপ উসদিন আপকে পরিবার সে মিলনে জায়েঙ্গে, তো মছলি সাথ লে জায়েঙ্গে, তাকি আপ কি মেমসাব ভি মছলি খায়েঙ্গে।” আমি তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, “পাকরেঙ্গে তো বটে, লেকিন পাকরেঙ্গে ক্যাইসে?” শুনে সে কিছুক্ষন চুপ থাকার পর সে বলে উঠলো যে তার কাছে নাকি মাছ ধরার অদ্ভুত একটা পদ্ধতি বা জোগাড় আছে, তাতে জালও লাগবে না আর ছিপ ও লাগবে না। অবাক হয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলাম, জালও নেই, ছিপ ও নেই, এমনকি মাছ ধরার অন্য কোনো রকম সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম পর্যন্ত নেই, তাহলে ও মাছটা ধরবে কিভাবে। ভাবতে ভাবতে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে – জোগাড়টা কি সেটা তো শুনি, তাতে সে আমায় যা বললো তা শুনে আমি নির্বাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করা ছিল না। সে ই নীরবতা ভঙ্গ করে আমায় বললো, যে শনিবারটা আসতে দিন তারপর নিজে দেখলেই বুঝতে পারবেন যে কি করে আমরা মাছ ধরি। লোকটির দিকে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি যে এই ভাবে যে মাছ ধরা যায় তা আমি জীবনে কখনো ভাবিনি। সত্যিই পরের শনিবার ওই সৈনিকটির নেতৃত্বে আমরা “মৎস শিকার অভিযান” চালিয়েছিলাম আর তাতে প্রচুর মাছও ধরে ছিলাম। আপনারাও হয়তো ভাবছেন, কিই বা সেই পদ্ধতি আর কিই বা সেই জোগাড়। পুরো ব্যাপারটা শুনলে আপনারাও অবাক হয়ে যাবেন। তবে আজ নয়, আরেকদিন শোনাবো আপনাদের সেই ঘটনার কথা। ততদিন আপনারা ভালো থাকবেন…সুস্থ থাকবেন…আর অবশ্যই পড়তে থাকবেন “জেলার খবর সমীক্ষা”।
ক্রমশঃ