মসির ধারায় অসির ধার (20)
সঞ্জীব মুখার্জী
“We fight in a war to win, only to win and to win with an elimination of the enemy, because there is no Runner’s Up in war. It’s not a matter of ‘Victory and Loss, rather, it’s a matter of ‘Construction and Destruction’.”
- Sanjib Mukherjee
১৯৯২ সালের ২২শে আগস্ট থেকে ২০শে সেপ্টেম্বর অব্দি মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে টানা এক মাস ধরে এবং শতাধিক ব্যাটালিয়নের মধ্যে কাঁটায় কাঁটায় চলা ফিল্ড ফায়ারিং কম্পিটিশনটির সাফল্যের সঙ্গে সমাপ্ত হওয়ার পর এবার প্রতিযোগীতার ফলাফল ঘোষণার শুভ মুহূর্তটি এসে গেলো। ২১শে সেপ্টেম্বর ১৯৯২ তারিখের ঠিক সকালেই কম্পিটিশনের ফল ঘোষণা হবে আর তারপর সমস্ত সাজ-সরঞ্জাম, উপকরণ, ‘উইপন’, তাঁবু ইত্যাদি গুটিয়ে পাটিয়ে যে যার নিজের ব্যাটালিয়নের আস্তানায় ফিরে যাওয়ার পালা। প্রতিযোগিতার খাটাখাটনিতে আর দৌড়ঝাঁপ করতে করতে শারীরিকভাবে সবাই খুব ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আর অবসাদগ্রস্ত কিন্তু মানসিকভাবে সবাই আশা, প্রত্যাশা আর ইচ্ছাশক্তিতে ভরপুর। তাই ২০শে সেপ্টেম্বর-এর রাতটা একরকম ভীষণ উত্তেজনার মধ্য দিয়েই কাটলো। সকাল বেলার ফলাফল আমাদের ব্যাটালিয়নের, না না শুধু আমাদের ব্যাটালিয়নের কেন, অন্যান্য আরো একশোটির উপর ব্যাটালিয়নের ভাগ্য বিধাতা হিসাবে প্রমাণিত হতে চলেছে। সকাল হতে না হতেই, দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই ফায়ারিং রেঞ্জের একটি পূর্ব নির্ধারিত স্থানে সবাই একত্রিত হতে শুরু করেছে। সেই স্থানটির ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে একটি ডায়াস লাগানো রয়েছে আর সেই ডায়াসের উপর রাখা রয়েছে মাইক সমেত একটি স্ট্যান্ড এবং একটি পাবলিক এড্রেস সিস্টেম। বুঝতে পারলাম এতো লোকজনের ভিড়ের কোলাহলের মধ্যে সবাই যেন ফল ঘোষণাটা শুনতে পায় তার ব্যবস্থা। কিছুক্ষনের মধ্যেই মধ্য মরুভূমির সেই স্থানটি সমস্ত ব্যাটালিয়নের লোকজনের উপস্থিতিতে একটি জনঅরণ্যে পরিণত হলো। ফলাফল জানার জন্য সকলের মনে এক সুগভীর উদগ্রীবতা, অদম্য কৌতূহল আর অধীর আগ্রহ, আর সেগুলির ছাপ সকলের মুখমণ্ডলে প্রকটভাবে বিদ্যমান। যাইহোক, আরো কিছুটা সময় কেটে যাওয়ার পর সকলের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমাদের সকলের ভিড়ের সামনে একটি ‘আর্মি জীপ্’ এসে দাঁড়ালো, গাড়িটির সামনে দুইটি বড় আকারের ‘ষ্টার’ আর বনেটের উপর ঠিক মাঝখানটিতে হাওয়ায় উড্ডীন আর্মির ফ্ল্যাগ। যেটি সাধারণত মিলিটারির ভি.আই.পি. আধিকারিকদের গাড়িতেই থাকে। প্রথম জীপের পিছন পিছন আরো দু তিনটি জীপ্ এসে দাঁড়ালো। প্রথম জীপ্ থেকে নেমে এলেন একজন ‘মেজর জেনারেল’ আর অন্যান্য জীপগুলি থেকে ক্রমানুসারে দুজন ব্রিগেডিয়ার আর চার পাঁচ জন কর্নেল র্যাঙ্কের আধিকারিকরা নেমে এলেন। তাদের গাড়ি থেকে নেমে এসে তাঁরা সকলে সোজা ডায়াসটির উপর গিয়ে বিরাজমান হলেন। জানতে পারলাম যে এই আধিকারিকদের দলটি হলো ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জের ফায়ারিং কম্পিটিশনের আম্পায়ারিং টীম আর এই টীমের মধ্যমণি হলেন মেজর জেনারেল সাহেব। এই টীমই স্কোরিং-এর মাধ্যমে ফায়ারিং কম্পিটিশনের রেজাল্ট তৈরি করেন আর তার ফলাফল ঘোষণা করেন। উপস্থিত সকলের কোলাহল থামিয়ে দিয়ে মেজর জেনারেল সাহেব এগিয়ে এলেন মাইক লাগানো স্ট্যান্ডটির সামনে। মাইক ধরে তিনি উপস্থিত সমস্ত প্রতিযোগী ব্যাটালিয়নকে স্বাগত আর অভিবাদন জানিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে ছোট্ট একটি বক্তৃতা দিলেন। আর সেই বক্তৃতার মধ্যেই সকলকে ইঙ্গিত করলেন যে যে কোনো প্রতিযোগীতায় হার জিৎ থাকে, পরিশ্রম সকলেই অল্প বিস্তর সমান সমানই করে কিন্তু তা সত্ত্বেও কেউ হরে আর কেউ জেতে, তাই আমাদের হার জিৎ-কে সমান ভাবে নিয়ে ভবিষ্যতে প্রস্তুতির খামতি গুলি শুধরে নিয়ে পরবর্তী প্রতিযোগীতায় যেন উত্তম স্থান অধিকার করতে পারে সে বিষয়ে সজাগ হওয়া উচিত। তিনি আরো বললেন যে মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ থেকে প্রস্থান করার সময় যে সমস্ত ব্যাটালিয়ন উত্তম স্থান অধিকার করেছে তারা যেন প্রবল উচ্ছ্বাস প্রকাশ না করে আর যে সমস্ত ব্যাটালিয়ন আশানুরূপ ফল অর্জন করতে সক্ষম হয়নি তারাও যেন বিমর্ষ হয়ে না ফেরে। মোটকথা সকলের মনোবল আর পরিস্থিতির ভারসাম্য যেন পুরোপুরি বজায় থাকে সেদিকে সমস্ত ব্যাটালিয়নকে সতর্ক থাকে হবে। জেনারেল সাহেবের বক্তৃতা সম্পন্ন হওয়ার পর আম্পায়ারিং টীমের একজন ব্রিগেডিয়ার সামনে এগিয়ে এসে মাইকের স্ট্যান্ডের সামনে এসে দাঁড়ালেন। হাতে তাঁর ভেলভেটে আচ্ছাদিত, সোনালী বর্ডারে সুসজ্জিত একটি ফাইল। জেনারেল সাহেবের মতই ব্রিগেডিয়ার সাহেবও শুরুতে একটা ছোট্ট অভিবাদনমূলক বক্তৃতা দিয়ে তারপর সেই ফাইলটি ধীরে ধীরে খুললেন। সকলের মনে হচ্ছিলো যে তিনি যেন কোনো ফাইল খুলছিলেন না বরং জাদুকরের ঝুলি খুলছিলেন। জাদুকরের ঝুলি থেকে প্রতিটি জিনিস যেমন অপ্রত্যাশিত ঠিক তেমনই অপ্রত্যাশিত ছিল ফাইলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আমাদের প্রতিযোগিতার ফলাফল।
ব্রিগেডিয়ার সাহেবের সুসজ্জিত ফাইলটি খোলার সাথে সাথে আমাদের সকলের হৃৎপিণ্ডের কম্পন প্রবল হতে প্রবলতর হচ্ছিলো। ফাইলটি খোলার পর ব্রিগেডিয়ার সাহেব সকলকে কোনো রকমের আওয়াজ করতে নিষেধ করে সকলের মনঃসংযোগ আকৃষ্ট করলেন আর তারপর ফল ঘোষণা আরম্ভ করলেন। শুরুতে তিনি বললেন যে এই প্রতিযোগীতায় মোট ১০৫টি ব্যাটালিয়ন অংশগ্রহণ করেছিল এবং প্রত্যেকেই প্রাণপণ চেষ্টা করেছিল সেই প্রতিযোগীতায় উচ্চস্থান লাভ করার, কোনো ব্যাটালিয়নের প্রচেষ্টার মধ্যে কোনো ত্রুটি ছিল না, কিন্তু প্রতিযোগিতার নিয়ম, তাই কেউ প্রথম আবার কেউ বা শেষ। ব্রিগেডিয়ার সাহেব একটু থেমে আবার শুরু করলেন, এই ১০৫টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে স্কোরিং-এর ভিত্তিতে স্কোরিং-এর তালিকায় সর্বোচ্চে যে ১৮ টি ব্যাটালিয়ন স্থান পেয়েছে তাদের নিয়ে একটি প্যানেল তৈরি করা হয়েছে আর তাদেরই নাম ঘোষণা করা হবে। ব্রিগেডিয়ার সাহেব সেই সঙ্গে স্কোরিং সিস্টেম-এর ব্যাপারেও সবাইকে বর্ণনা করেন। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনকারী প্রতিটি ব্যাটালিয়নকে অংশ নিতে হয় বিভিন্ন ‘ইন্ডিভিজুয়াল উইপন ফায়ারিং’-এ, তাদের মধ্যে প্রতিটি ব্যাটালিয়ন কোনোটায় প্রথম স্থান পায়, কোনোটায় দ্বিতীয় স্থান পায়, আবার কোনোটায় অসফল হয়, তাদের প্রতিটি ‘ইন্ডিভিজুয়াল উইপন ফায়ারিং’-এর স্কোরিং-এর ভিত্তিতে একটি ‘ওভারঅল পারফরমেন্স স্কোরিং শীট’ তৈরি হয় আর তার ভিত্তিতেই প্রথম সারির ১৮টি ব্যাটালিয়নকে বেছে নেওয়া হয়। এটাই স্কোরিং সিস্টেম। যাইহোক, ১৮টি ব্যাটালিয়নের নাম ঘোষণা করা হবে নিচের থেকে অর্থাৎ ১৮তম ব্যাটালিয়নের নাম ধরে প্রথমে ডাকা হবে তারপর ১৭তম তারপর ১৬তম… যাকে বলে “রিভার্স অর্ডার”, এই বলে তিনি শুরু করলেন এক এক করে ব্যাটালিয়নের নাম ঘোষণা করতে। যে ব্যাটালিয়নগুলির নাম উনি উচ্চারণ করছিলেন সেই ব্যাটালিয়নগুলি এইটা ভেবে খুশি হচ্ছিলো যে অন্ততঃ পক্ষে প্রথম ১৮টি ব্যাটালিয়নের মধ্যে তো স্থান পেয়েছে। এইভাবে যথাক্রমে ব্রিগেডিয়ার সাহেব এক এক করে ব্যাটালিয়নের নাম ডেকে চলেছেন আর তার সঙ্গে সেই ব্যাটালিয়নের স্থান ও ঘোষণা করে চলেছেন। করতে করতে যখন ১৬টি ব্যাটালিয়নের নাম ডাকা হয়ে গেলো আর মাত্র দুটি ব্যাটালিয়নের নাম ধরে ডাকা বাকি তখন আমরা অর্থাৎ “থার্ড ব্যাটালিয়ন দ্য রাজপুতানা রাইফেলস”-এর উপস্থিত সৈনিকরা একটু একটু করে নিরাশ হতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সমস্ত নিরাশা আর হতাশা ভঙ্গ করে ব্রিগেডিয়ার সাহেব খুব উৎসাহের সঙ্গে যখন বললেন “থার্ড ব্যাটালিয়ন দ্য রাজপুতানা রাইফেলস – দ্বিতীয় স্থান” তখন খুশিতে আমাদের মনের যে কি অবস্থা তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। অবশেষে সফল হলো আমাদের এতদিনের দিনান্তকর পরিশ্রম, শেষ পর্যন্ত সমগ্র আর্মি সমাজে আমাদের ব্যাটালিয়নের মুখ উজ্জ্বল করতে পেরেছি আমরা। আল্হাদে আমরা সবাই তখন সপ্তম আকাশে। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে একে অপরকে অভিনন্দন জানাতে ব্যস্ত। প্রতিযোগিতায় একটুর জন্য প্রথম স্থান অধিকার না করতে পারার দুঃখ যদিও আমাদের সবার মধ্যে ছিল তবুও দ্বিতীয় স্থান দখল করার আনন্দের পরিমান এতটাই প্রবল ছিল যে সেই দুঃখকে আমরা সবাই ভুলে গিয়েছিলাম। কর্নেল সুদানও আনন্দে আমাদের সকলকে অভিনন্দন জানালেন আর অভিনন্দন জানাতে জানাতে বললেন যে একটুর জন্য আমরা প্রথম স্থান থেকে বঞ্চিত হলাম, তারপর তিনি আরো যোগ করলেন, “নেভার মাইন্ড, উই হ্যাভ ডান এ গ্রেট জব এন্ড আই এম প্রাউড অফ এভরি ওয়ান অফ মাই ব্যাটালিয়ন হু হ্যাজ ওয়ার্কড ডে ইন এন্ড ডে আউট টু মেক দিস কম্পিটিশন এ সাকসেসফুল ওয়ান”। হ্যাঁ, সেই প্রতিযোগিতায় আমাদের ব্যাটালিয়নই দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। আজও মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জের হেডকোয়ার্টারে রাখা ফিল্ড ফায়ারিং কম্পিটিশনের রেকর্ডের ইতিহাসে “থার্ড ব্যাটালিয়ন দ্য রাজপুতানা রাইফেলস” এর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
ফল ঘোষণা সমাপ্ত হয়ে গেলে কিছুক্ষণ পর আমরা সবাই সেই স্থানটি ত্যাগ করি আর ফাজিলকায় আমাদের ব্যাটালিয়নের স্থায়ী লোকেশনে ফিরে যাবার তৈরিতে লেগে যাই। ততক্ষণে আমাদের ছেলেরা সবকিছু গুটিয়ে পাটিয়ে গাড়িতে ‘লোড’ করে ফেলেছে। আমাদের কনভয়ও মার্চ করার জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের চড়ার অপেক্ষায় রয়েছে। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা যে যার পূর্ব নির্ধারিত গাড়িতে উঠে পড়ি, আর ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের আদেশ পেতেই আমাদের ব্যাটালিয়নের কনভয় মার্চ করা শুরু করে। উচ্চৈস্বরে আমরা গাড়ির ভিতর থেকে আমাদের ব্যাটালিয়নের নামে জয় জয়কার করতে করতে ধীরে ধীরে মরুভূমির মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে শুরু করি। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ আমরা ফাজিলকায় আমাদের নিজস্ব ডেরায় পৌঁছোই। সেখানে পৌঁছনোর পর কর্নেল সুদান সকলকে একত্রিত করে ঘোষণা করেন যে পরদিন ফুটবল গ্রাউন্ডে পুরো ব্যাটালিয়ন এই জয়ের উৎসব পালন করবে যাতে প্রচুর খানাপিনা আনন্দ হাসিগান সব থাকবে। তার সঙ্গে আর একটা কথা কর্নেল সুদান সকলের উদ্দেশ্যে বললেন যে এই প্রতিযোগীতার জন্য যারা ছুটি যেতে পারেননি তারা কাল থেকে নিজের নিজের লিভ প্ল্যান অনুযায়ী ছুটির জন্য আবেদন করতে পারবেন আর ছুটি ও যেতে পারবেন।
আমি সেই রাত্রেই আমার বাসস্থানে পৌঁছে বাড়ি থেকে আমার স্ত্রী জবাকে আমার সঙ্গে ফাজিলকায় নিয়ে আসার জন্য বাড়িতে বাবা মায়ের অনুমতি চেয়ে একটি চিঠি লিখলাম আর সেই সঙ্গে সমান্তরালে জবাকেও একটি চিঠি লিখে মানসিকভাবে আমার সঙ্গে আসার জন্য মোটামুটিভাবে প্রস্তুত থাকতে বললাম। বাকিটা নির্ভর করছিলো বাবা মায়ের সম্মতির উপর। দিন দশ বারোর ভিতরই সম্মতির সঙ্গেই উত্তর এসে গেলো বাবার। একদিকে বাবা যেমন আমায় সম্মতি জানিয়ে চিঠি লিখলেন অন্যদিকে জবাকেও আমার সঙ্গে আসার জন্য গোছগাছ করতে শুরু করতে বলে দিলেন। বাবার সম্মতি পাওয়ার পর ছুটির জন্য আবেদন করলাম। কর্নেল সুদান তো আমাকে অনেক আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন ছুটির জন্য কিন্তু ফিল্ড ফায়ারিং কম্পিটিশনের জন্যই আমি জবাকে নিয়ে আসার ব্যাপারটা স্থগিত করে দিয়েছিলাম। তাই এককথায় আবেদন করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কর্নেল সুদান আমার ছুটির আবেদন মঞ্জুর করে দিলেন।
দিন পনেরোর ছুটিতে বাড়ি গিয়ে লট-বহরের সঙ্গে জবাকে নিয়ে ফাজিলকায় ফিরলাম। ছুটিতে যাওয়ার আগে থেকেই আমার সরকারি কোয়ার্টারটিকে হোয়াইটওয়াশ করিয়ে এবং ভালোভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে একদম ‘রেডি’ করিয়ে নিয়েছিলাম যাতে জবাকে নিয়ে আসার পর কোনো অসুবিধা না হয় আর সুষ্ঠুভাবে সংসারের জিনিসপত্র ‘আনপ্যাক’ করে ‘ফ্যামিলি লাইফ’ শুরু করতে পারি। জবাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসবার পর প্রতিদিন আমাদের ব্যাটালিয়নের কোনো না কোনো পরিবার আমাদের হয় লাঞ্চ না হয় ডিনারের জন্য নিমন্ত্রণ করে। কোনো নতুন পরিবার আমাদের ব্যাটালিয়নের কলোনীতে আসলে সেই নবাগত পরিবারকে অন্যান্য পরিবার, যারা সেখানে আগে থেকেই রয়েছে তারা, স্বাগত জানানোর জন্য এটা করে থাকেন। এটাকে ‘ওয়েলকাম লাঞ্চ’ অথবা ‘ওয়েলকাম ডিনার’ বলা হয়ে থাকে, আর এটাই আমাদের ব্যাটালিয়নের চিরাচরিত প্রথা। এইভাবে বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেলো আর ততদিনে আমরা মোটামুটিভাবে সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে সংসার জীবন শুরু করার সুযোগ পেলাম, জবাও প্রায় নিজেকে সড়গড় করে নিয়েছিল। ব্যাটালিয়নের দৈনন্দিন জীবনও একটা নির্দিষ্ট ছন্দে ফিরে এসেছিলো। দেখতে দেখতে বেশ কয়েকটা মাস কেটে গেলো। ১৯৯২ ছেড়ে ১৯৯৩ সালে প্রবেশ করলাম। ততদিনে ফাজিলকা সংলগ্ন দর্শনযোগ্য স্থানগুলি জবাকে ঘুরিয়ে দেখলাম। ‘ব্যাটালিয়ন কমান্ডার’ আমাদের সেই স্থানগুলি দর্শনের জন্য ব্যাটালিয়নের তরফ থেকে একটি গাড়িরও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এইভাবে আরো দু-একটি মাস কেটে যাওয়ার পর ১৯৯৩ সালের মে মাসের কোনো এক দিন পুনরায় এক যুদ্ধ নিনাদ তারস্বরে বেজে উঠলো, পুনরায় ব্যাটালিয়ন লোকেশনের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত সেই সূচনাকক্ষে টাঙানো নোটিশ বোর্ডে বড় বড় করে লেখা একটি নোটিশ দেখা গেলো যাতে স্পষ্ট করে লেখা আছে যে উচ্চতর হেডকোয়ার্টারের নির্দেশে আগামী তিন মাসের জন্য অর্থাৎ জুন, জুলাই এবং আগস্ট আমাদের ফাজিলকা সংলগ্ন ভারত পাকিস্তানের ইন্টারন্যাশনাল বর্ডার যার নাম “সাদিকী-সুলেমানকি বর্ডার” সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়নকে অনুশীলনীর জন্য যেতে হবে এবং তিন মাসের জন্য সেখানেই থাকতে হবে। সেখানে যাওয়ার জন্য আমাদের কনভয়ের মার্চ করার দিন ২রা জুন ১৯৯৩ নির্দিষ্ট হলো। যদিও সেই বর্ডার এলাকা আমাদের ব্যাটালিয়নের স্থায়ী লোকেশনের থেকে ২৫ – ৩০ কিলোমিটার দূরে কিন্তু যেহেতু আমাদের সেখানে তিন মাসের জন্য পার্মানেন্টলি থাকতে হবে তাই জবার একা থাকার ব্যাপারটা আমাকে একটু বিচলিত করছিলো। কোয়ার্টারে ফিরে জবাকে আমাদের ব্যাটালিয়নের অনুশীলনীতে যাওয়ার কথা বলার পর জবা আমাকে অভয় দিয়ে বললো – তুমি কোনো চিন্তা করোনা, আমি মোটামুটি সেটেল হয়ে গেছি, কোনো অসুবিধা হবে না। পরে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের ব্রীফিং-এর সময় এটা জানতে পেরে একটু দুশ্চিন্তা মুক্ত হলাম যে অনুশীলনী চলাকালীন তিন মাসে যে সমস্ত সৈনিকদের পরিবার ব্যাটালিয়নের কলোনীতে রয়েছেন সেই সমস্ত সৈনিকদের প্রতি সপ্তাহে দুই দিনের জন্য অর্থাৎ শনি রবিবার ব্যাটালিয়নের লোকেশনে আসার অনুমতিও থাকবে আর ব্যাটালিয়নের তরফ থেকে আসা যাওয়ার জন্য গাড়ির বন্দোবস্তও করে দেওয়া হবে। ধীরে ধীরে অনুশীলনীর প্রস্তুতির মধ্যে দিয়ে আমাদের “সাদিকী-সুলেমানকি বর্ডার”-এ প্রস্থান করার দিন এগিয়ে এল। পূর্ব নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ২রা জুন আমাদের ব্যাটালিয়নের কনভয় মার্চ করলো এবং ঘন্টা খানেকের মধ্যেই বর্ডার এলাকায় পৌঁছে শিবির তৈর করা হ’ল।”সাদিকী – সুলেমানকি বর্ডার”-এ থাকাকালীন অনেক অভিজ্ঞতা হলো আর তার সঙ্গে হলো আমাদের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সঙ্গে এঁটে ওঠার এক রোমাঞ্চকর উপলব্ধি। তবে তার গল্প নিয়ে আবার ফিরবো আপনাদের সমক্ষে। ততদিন ভালো থাকবেন…সুস্থ থাকবেন…আর অবশ্যই চোখ রাখবেন “জেলার খবর সমীক্ষায়”…
ক্রমশঃ