মসির ধারায় অসির ধার (১৯)

সঞ্জীব মুখার্জী
“Do not lament the death of a warrior in the battlefield as those who sacrifice their lives in the war are honoured in the heaven.”
~ In honour of Field Marshal KM Cariappa
মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে যাওয়ার দিন যতই এগিয়ে আসছে প্রস্তুতি পর্বের তীব্রতা ও তত বাড়ছে। কিন্তু ইতিমধ্যে ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জের কম্পিটিশনে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্বে আর একটি বিস্ময় আমাদের জন্য ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করে যে বসে আছে সেটি ঘুনাক্ষরেও জানতে পারিনি। মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে যাওয়ার ঠিক কয়েকদিন আগে আমাদের ব্যাটালিয়নের ইমিডিয়েট হায়ার হেডকোয়ার্টার যাকে বলে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার তার কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জে. কে. শিবপুরী একদিন আমাদের প্রস্তুতির কাজকর্ম সরেজমিনে দেখতে আসলেন। প্রস্তুতির সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখে নেওয়ার পর উনি আমাদের ব্যাটালিয়নকে নির্দেশ দিলেন যে ঠিক তার পরদিন আমাদের ব্যাটালিয়নের সব্বাইকে ২০ কিলোমিটার ক্রস-কান্ট্রি ম্যারাথন দৌড়োবে। ব্রিগেডিয়ার শিবপুরী এই নির্দেশ দেওয়ার পিছনে কারণ হিসেবে এটাও আমাদের বললেন যে এই ক্রস কান্ট্রি ম্যারাথন দৌড়টি আমাদের শরীরে আরো সহনশীলতা আর ক্ষমতা নিয়ে আসবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়াই করার আর বিশেষ করে সেটি আসন্ন মধ্য মরুভূমির ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে প্রতিযোগিতায় আমাদের অনেকটা সহায়ক হবে। আপনাদের নিশ্চই মনে আছে যে তার ঠিক কিছুদিন পূর্বেই ‘GOC-in-C’ এর নির্দেশে আমরা অনেকগুলি ব্যাটালিয়ন মিলে ৮০ কিলোমিটারের রুট মার্চ করে এসেছি। আবার এই ২০ কিলোমিটারের ম্যারাথন দৌড়। যাইহোক, ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশ পালন করতে আবার আমরা ২০ কিলোমিটারের ম্যারাথন দৌড় করে এলাম। আসার পর আমাদের সকলের পায়ের অবস্থা যে কিরকম হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য।
দেখতে দেখতে ১৯শে আগস্ট এসে গেলো। ১৮ই আগস্ট রাত্রি পর্যন্ত কনভয় গ্রাউন্ডে ফায়ারিং রেঞ্জে যাওয়ার জন্য প্রতিটি উপকরণ প্রয়োজনীয়তা এবং তালিকা অনুযায়ী একটি একটি করে মিলিয়ে ঠিকঠাক করে নেওয়া হয়েছে কিনা তার নিশ্চিৎ করা হয়। পরদিন ভোরবেলায় ৪টার সময় আমাদের কনভয় মার্চ করে। আমাদের ব্যাটালিয়নের কনভয়ে বড়, ছোট, যাত্রীবাহী, অস্ত্রবাহী, রেশন, জল, অ্যাম্বুলেন্স, সব রকম গাড়ির সংখ্যা মিলিয়ে মোট ৯০ থেকে ১০০টি গাড়ি। দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই আমাদের কনভয় প্রবেশ করলো যে এলাকায় সেটি মরুভূমির প্রারম্ভিক এলাকা। রাস্তার ধারে একটি জায়গায় সাইন বোর্ডে লেখা ‘মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জ’ – ৯০ কিলোমিটার অর্থাৎ মরুভূমির প্রবেশদ্বার থেকে আমাদের গন্তব্যস্থল ৯০ কিমি দূর, ওরে ব্বাবা, সে তো অনেকটা পথ। ধীরে ধীরে আমাদের কনভয় এগোচ্ছে। তবে মরুভূমি হলে কি হবে যে রাস্তায় আমাদের কনভয় যাচ্ছে সে রাস্তা পিচ ঢালা, চওড়া আর খুব সুন্দর। জীবনে তার আগে কখনো স্বচক্ষে মরুভূমি দেখার সুযোগ হয়নি তাই মরুভূমি দেখার খিদেয় উন্মত্ত হয়ে চোখ দিয়ে চারিদিকটা যেন গোগ্রাসে গিলছি। মরুভূমির কথা বইতে পড়েছি, ছবিতে দেখেছি বা লোকমুখে শুনেছি, কিন্তু কার্যতঃ সেটা চাক্ষুষ দেখা যে এত উপভোগ্যকর হবে তা আমার স্বপ্নাতীত ছিল। কিন্তু ভুলটা ভাঙলো আরো কিছুটা পথ অতিক্রম করার পর। মরুভূমিতে ঢোকার প্রথম দিকের জায়গাগুলো ঘন বসতিপূর্ণ এবং গাছপালাতে ভর্তি। কিন্তু যতই ভিতর দিকে প্রবেশ করছি ততই জনবসতি কমছে আর গাছপালার ঘনত্ব ও কমছে। আরো কিছুটা দূর চলার পর দেখি আমাদের রাস্তাটা একটা বেছানো রেলওয়ে লাইনের কাছাকাছি এসে গেলো আর সেখান থেকেই শুরু হলো সেই রেলওয়ে লাইনের সমান্তরালে চলা। কনভয়ে যেতে যেতে পাশের রেল লাইনে কু ঝিক ঝিক করতে করতে চলা দু একটা রেলগাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার অভিজ্ঞতাও হয়ে গেলো, উহঃ কি নয়নাভিরাম সে দৃশ্য, আপনাদের ভাষায় বোঝাতে পারবো না সে কথা। সেই দৃশ্য দেখে আমার তখন খুব করে মনে পড়ছিলো সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমায় দেখানো জয়সলমীরের মরুভূমিতে বেছানো রেল লাইনের উপর দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সেই বিখ্যাত দৃশ্যটির কথা। আরো কিছুটা চলার পর একসময় অনুভব করলাম যে না তো সেখানে কোনো জনবসতি আর না কোনো গাছপালা। চারিদিকে কেবল বালির স্তুপ আর আর বালির বড় পাহাড় যাকে বলে “স্যান্ড ডিউন” (Sand Dune)। পরে জানলাম, যে কোনো মরুভূমিতে সব চাইতে মারাত্মক, বিপদজনক আর বিশ্বাসঘাতক বলে যদি কোনো বস্তু থাকে তা হলো এই “স্যান্ড ডিউন”, তবে সে কথায় আমি পরে আসছি। যাইহোক, আরো অনেকটা পথ চলার পর আমাদের কনভয় “মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে” আমাদের ব্যাটালিয়নের জন্য পূর্ব নির্ধারিত জায়গাতে এসে পৌছালো। পূর্বপরিকল্পনা মাফিক সেখানে পৌঁছে পৌঁছেই যে যার কাজে লেগে যায়। কেউ তাঁবু খাটাতে ব্যস্ত আবার কেউ “কুক হাউস” সাজাতে ব্যস্ত। আমাদের ছেলেদের তাঁবু খাটানো হয়ে গেলে গাড়ি থেকে ব্যাগ বিছানা পত্র নামিয়ে নিয়ে যে যার তাঁবুতে ঢুকে গেলো। “কুক হাউসে” আমাদের ছেলেরা চা তৈরি করে ফেললো আর সেই চা আমাদের তাঁবুতে দিয়েও গেলো। চা খেয়ে কিছুক্ষন বিশ্রামের পর তাঁবুর বাইরে এক জায়গায় আমাদের একত্রিত হতে হবে, ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের ব্রীফিং। সেটাকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের ব্রীফিং বললে ভুল হবে, আসলে ব্রীফিংটা হবে “মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে” নিযুক্ত আর্মিরই বিশেষ অধিকারীর দ্বারা যিনি সেখানকার সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল এবং তিনিই আমাদের পুরো ‘ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জের’ ভৌগোলিক ব্যাপারে সম্পূর্ণ গাইডলাইন দেবেন। সেখানে আমাদের কি কি করা উচিত, কি কি করা উচিত নয়, কিভাবে চলা উচিত, ইত্যাদি। শুরু হলো তাঁর ‘ব্রীফিং’ এবং তিনি আমাদের সেই জায়গার ব্যাপারে অনেক কিছুই বললেন। অবশ্য সেগুলোকে মরুভূমির চ্যালেঞ্জ বলাটাই ভালো।
শুরু হলো আমাদের মরুভূমির জীবনযাত্রা। আমি আপনাদের আগেই বলেছি ফিল্ড ফায়ারিং কম্পিটিশনের একমাসের সময়কালের মধ্যে প্রথম ১০ দিন ধার্য থাকবে প্রাকটিস ফায়ারিং বা রিহার্সালের জন্য। এই দশ দিনে আমাদের সমস্ত উইপন-এর ক্যালিব্রেশন করা হবে ‘মিড কোর্স কারেক্শনের’ মাধ্যমে যেটাকে মিলিটারি ভাষায় বলা হয় “জিরোইং” (Zeroing)। শব্দটা আপনাদের হয়তো একটু অদ্ভুত শোনাতে পারে। ‘উইপন ফায়ারিং’-এর সময় গুলি বা গোলা টার্গেটের এদিক ওদিক না গিয়ে সঠিক ভাবে যেন টার্গেটকে হিট করতে পারে সেটা সুনিশ্চিত করা। আর তার জন্য কোনো ‘উইপন’-এ ছোট খাটো কোনো ভুলত্রুটি থাকলে তাকে শুধরে নিয়ে তার সম্ভাবনাকে শূন্য করে দেওয়ার প্রক্রিয়াকেই বলা হয় “জিরোইং”। একটা একটা করে দিন পার হয় আর নতুন নতুন অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয় আমাদের। ফিল্ড ফায়ারিং কম্পিটিশন ও শুরু হয়ে গিয়েছে সেখানেও আমরা প্রোগ্রাম অনুযায়ী বিভিন্ন বড় বড় অস্ত্রশস্ত্রের ফায়ারিং-এ অংশগ্রহণ করছি। সারাদিন ‘ফায়ারিং’ করে ‘রেঞ্জ’ থেকে বিকালবেলায় শিবিরে ফিরছি। কেবল যেদিন নাইট ফায়ারিং থাকতো সেদিনই কেবল রেঞ্জে থাকা। সারাদিনের ঘামঝরানো পরিশ্রমের পর প্রখর সূর্য্যের আলোতে গায়ের চামড়া পুড়িয়ে যখন শিবিরে ফিরতাম তখন ক্লান্তি যেন শিখরে। কিন্তু ক্লান্ত হয়ে পড়লে তো চলবে না, ওই যে – “ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু, পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু”। একদিকে যেমন আমাদের ‘ফায়ারিং কম্পিটিশন’ চলছে তেমনি আরেক দিকে আমাদের শিবিরের দৈনন্দিন জীবন। শিবিরের এলাকা ছেড়ে বেশি দূরে যাওয়া একেবারেই নিষেধ ছিল আমাদের, বিশেষ করে একা একা, তাই শিবির ছেড়ে খুব একটা বেরোতাম না। নির্দেশ অনুযায়ী কোথাও গেলে কমপক্ষে দুই থেকে তিনজন একসাথে যেতাম। কেননা বেশি দূরে গেলে রাস্তা ভুল হবার সম্ভাবনা থাকতো আর সেক্ষেত্রে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কিস্যু করার থাকতো না। রাত্রিতে তো শিবির ছেড়ে কোথাও যাওয়া স্ট্রীক্টলী নিষেধ। আমাদের শিবিরের চারিদিকে বিস্তীর্ণ মরুভূমি আর যেদিকে তাকাই সেদিকেই ছোট বড় আকারের প্রচুর বালির পাহাড় – স্যান্ড ডিউন। আমরা কোনো স্যান্ড ডিউন কে শিবিরের ল্যান্ডমার্ক হিসাবে চিহ্নিত করতাম না অথবা স্যান্ড ডিউন গুলির উপর কোনোরকম ভরসা করতাম না। এবার আমি আসি সেই ভয়াল ভয়ঙ্কর স্যান্ড ডিউনের ব্যাপারে। “স্যান্ড ডিউন” চারিত্রিকভাবে চলমান অর্থাৎ ভ্রাম্যমান অর্থাৎ সেগুলি একজায়গায় একরূপে স্থিতিশীল নয়। মরুভূমিতে সবসময় বালির ঝড় চলছে আর সেই বালির ঝড়ে স্যান্ড ডিউন গুলি একজায়গা থেকে উড়ে আরেক জায়গায় বসে পড়ছে তাই ভুল করেও আমরা যদি কোনো স্যান্ড ডিউন কে কোন ল্যান্ডমার্ক হিসাবে ব্যবহার করি তাহলে সেটা হবে আমাদের মস্ত বড় ভুল কেননা কিছুক্ষন পরই সেই স্যান্ড ডিউন টি সেই স্থানে থাকবে না যেখানে আমরা তাকে ছেড়ে গেছিলাম। আর তাছাড়া মরুভূমিতে ধুলোঝড় হওয়ার প্রধান কারণও হলো স্যান্ড ডিউন কেননা বয়ে চলা তীব্র হাওয়া এবং স্যান্ড ডিউন এর সঙ্গে সংঘর্ষে হাওয়ার গতিবেগ আরো বেড়ে যায় আর তাতে সেই ডিউন এর বালি মিশে গিয়ে ধুলোঝড় কে আরো ভয়ঙ্কর করে দেয়। শিবির ছেড়ে কোথাও গেলে দিকনির্ণয় করে শিবিরে ফেরার জন্য প্রত্যেক দলের কাছে কম্পাস থাকাটা অনিবার্য। মরুভূমিতে প্রচুর পরিমানে বিষাক্ত সাপ, কাঁকড়াবিছে, ডেজার্ট ফক্স, ডেজার্ট ঈগল যত্রতত্র ঘুরছে এবং খাদ্যাভাবে তারা অভুক্ত, যে কোনো সময় তারা আক্রমণ করতে পারে আমাদের উপর তাই প্রত্যেকের কাছে স্নেক বাইট কিট থাকা অত্যাবশ্যক। মহাজনে থাকাকালীন এদের প্রত্যেকের সাথে আমাদের মুখোমুখি সাক্ষাৎও হয়েছে বার কয়েক।
মহাজন ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জে এইসমস্ত ভয়ঙ্কর প্রাণীগুলি ছাড়া আর একটি প্রাণীর প্রাচুর্য রয়েছে যার নাম “Ground Beetles” (গ্রাউন্ড বীটলস) বা “Scarabs” (স্ক্যারাবস)। এদের অনেক রকমের আকার এবং প্রজাতি। এদের কোনোটা রঙিন, কোনোটা কালো, আবার কোনোটা সাদা কালো ছোপ ছোপ। কোনো প্রজাতি উড়তে পারে আবার কোনো প্রজাতি পারে না। তবে এদের মধ্যে কালো রঙের বীটলস এর সংখ্যাই বেশি। যেগুলি দেখতে অনেকটা ঠিক বিখ্যাত হলিউডী মুভি “The Mummy” তে দেখানো বীটলের মতোই, কিলবিল করতে করতে বেরিয়ে এসে অসংখ্য মানুষখেকো বীটল সিনেমার লোকগুলির শরীরের যেকোনো জায়গা দিয়ে ঢুকে সারা শরীরে দাপিয়ে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত সেই লোকটিকে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুমুখে ঠেলে দিচ্ছিলো। মরুভূমিতে এই পোকাগুলি প্রাসঙ্গিক বলেই হয়তো সিনেমায় এই পোকাদের দেখানো হয়েছে। মমীর যুগে মানুষ খেকো স্ক্যারাব্সদের বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল কি ছিল না সে বিতর্কে আমি যেতে চাইনা, তবে একটা কথা আমি হলফ করে বলতে পারি আজকের বর্তমান যুগে ওই ধরণের বীটলসের উপস্থিতি একেবারেই কাল্পনিক। যদিও বাস্তবে চেহারা এবং আকৃতির জন্য এই পোকাদের উপস্থিতি আমাদের কাছে অসহনীয় লাগে তবে সত্যি কথা বলতে কি “গ্রাউন্ড বীটলস” মানুষের পক্ষে কোনো ক্ষতিকর নয় আর সেটা আমাদের বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত। এরা মানুষের ধারেকাছে তো আসেই না বরং মানুষ দেখলে এরা বালির মধ্যে গর্ত করে তার ভিতরে লুকিয়ে পড়ে। মানুষের অথবা অন্য কোনো প্রাণীর মাংস খাওয়া তো দূরের কথা, এরা মানুষের এবং গবাদি পশুর বর্জ পদার্থের উপর নির্ভর করে জীবিকা নির্বাহ করে আর তার জন্য এদেরকে “ডাঙ বীটল”ও (Dung Beetle) বলা হয়ে থাকে।
আমরা যেরকম আমাদের আশেপাশে গরু, ছাগল, কুকুর, বেড়াল, ইত্যাদি প্রাণীদের ঘুরে বেড়াতে দেখি, মহাজন ফায়ারিং রেঞ্জে উটদের ঘুরে বেড়ানোটাও ঠিক সেরকম। মহাজনে থাকাকালীন আমরা উটের পিঠে চড়ে অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি। মরুভূমির আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন অর্থাৎ দিনে যত গরম রাত্রে তত ঠান্ডা। মরুভূমির মাঝে মাঝে প্লেটে খাবার পরিবেশন করার সঙ্গে সঙ্গেই খেয়ে নিতে হবে, খাবার একটু খোলা অবস্থায় থাকলেই তার উপর বালির এমন আস্তরণ পড়ে যাবে যে সে খাবার আর গ্রহণযোগ্য থাকবে না। মরুভূমির গাছপালা বা উদ্ভিদ বলতে কেবল বিভিন্ন রকমের ক্যাকটাসের ঝোপ আর খেজুর গাছ। মরীচিকা মরুভূমির একটি বিশেষ আকর্ষণীয় ঘটনা। যদিও মরীচিকা কোনো ঘটনা নয় কিন্তু ঘটনার প্রারূপে সেটা একটা বিভ্রম যেটি অহরহ ঘটে থাকে। দিনের প্রখর সূর্যালোকে দূর থেকে যাকে জলাশয় বলে মনে হয় কাছে গিয়ে দেখি সেটি জলবিহীন এবং বালুকাময়। তবে হ্যাঁ, মধ্য মরুভূমিতে মাঝে মাঝে মরুদ্যানের উপস্থিতি অবশ্যই আছে। মরুদ্যান কিন্তু মরীচিকার মতো কোনো বিভ্রম নয়। সেটা মধ্য মরুভূমিতে উপলব্ধ সত্যিকারের এবং অস্তিত্বপূর্ণ একটি উদ্যান যাতে একটি ছোট্ট জলাশয় আর তার চারিদিকটা গাছপালা দিয়ে ঘেরা।
দেখতে দেখতে নানান কাজ কর্মের মধ্যে মরুভূমিতে এক মাস কেটে গেলো, হয়ে গেলো ফিল্ড ফায়ারিং রেঞ্জের ফায়ারিং প্রতিযোগিতার সমাপ্তি। পরদিন সকালে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা আর তারপর আমাদের নিজস্ব ঠিকানায় অর্থাৎ ফাজিলকায় ফেরার পালা। যদিও সকলের মন ফলাফলের প্রতীক্ষায় খুবই উত্তেজনাপূর্ণ তবে সেই সঙ্গে খুব খারাপ ও বটে। মহাজনের মরুভূমি ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট। মরুভূমিতে আসার পর যদিও প্রথম প্রথম একটু কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেটা ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। ভাবছিলাম এরকম দিন কি আর আসবে আমাদের জীবনে? এমনটাও কি হয়? শুষ্ক, হৃদয়হীন মরুভূমির সাথে প্রেম! কে জানে, হয়তো হয়। মরুভূমি হৃদয়হীন হলেও আমাদের তো হৃদয় বলে কিছু আছে, আমরা তো ভালোবাসতে জানি পৃথিবীর সবকিছুকে, তা সে মরুভূমির শুস্কতাই হোক…আর পর্বতের কাঠোরতাই হোক…আর সমুদ্রের ভয়াবহতাই হোক…। একদিকে প্রতিযোগীতার ফল ঘোষণার উদ্বেগপূর্ণ প্রতীক্ষা, অন্যদিকে মহাজন ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ, আর সব মিলিয়ে অদ্ভুত এক সংঘাতপূর্ণ মানসিক পরিস্থিতির মধ্যে তাঁবুর ভিতর রাত যেন কারোরই কাটতে চাইছিলো না। যদিও আত্মবিশ্বাসের কোনো অভাব ছিল না আমাদের মনে, তবু মনের কোণে যেন উঁকি মারছিল প্রশ্নগুলি। পরদিন সকালের সূর্য্য ফোটাতে পারবে তো আমাদের সকলের মুখে আনন্দের আলো? আশানুরূপ হবে তো আমাদের এতদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফল? আরোহিত হবে তো আমাদের ব্যাটালিয়নের সুনাম এই প্রতিযোগীতার সোপানে?
ক্রমশঃ