মসির ধারায় অসির ধার (১৭)

সঞ্জীব মুখার্জী
“The safety and security of the nation comes first, the safety and security of the people working under your command comes second and the safety and security of yourself comes thereafter.”
~ Field Marshal KM Cariappa, OBE
দেখতে দেখতে দুমাসের ছুটি শেষ। ছুটিটা ও আমার বিয়ে আর অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে বেশ আনন্দ ও মজাতেই কেটে গেলো। ২৬শে জুন ১৯৯২, বাবা মায়ের কাছে নতুন বৌকে রেখে ভারী হৃদয় নিয়ে আবার কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। বেশ ভালোই গরম পড়ে গেছে তখন। দিনেরবেলায় প্রখর সূর্যের তাপ। গরমের দিন বলে সাথে লাগেজ বেশি নেই, একটা ব্যাগ তাতে রাস্তার জন্য কিছু খাবার আর জামা কাপড়, আর একটা স্যুটকেস তাতে শুধুই কাপড় জামা আর কিছু দরকারি জিনিসপত্র। সিউড়ি স্টেশন থেকে ট্রেন ধরে সিউড়ির কাছে অন্ডাল বলে একটি জায়গা আছে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। এবার অন্ডাল থেকেই আমার হাওড়া – জম্মু-তাবী হিমগিরি এক্সপ্রেসে রিজার্ভেশন করানো ছিল, তাই অন্ডাল থেকেই ট্রেন ধরলাম। পরদিন রাত্রিতে লুধিয়ানা পৌঁছবো আর লুধিয়ানা থেকে আবার অন্য একটি ট্রেন ধরে সোজা ফাজিলকা। ফাজিলকা পৌঁছতে পৌঁছতে আমার হয়ে গেলো ২৮শে জুন ভোরবেলা। আমার মনের ভিতরের অবস্থা তখন ভীষণভাবে ভারাক্রান্ত। কোনো কিছুই যেন ভালো লাগছে না। নিজের বিয়ের আনন্দের রেশটা যেন কাটতেই চাচ্ছিলো না। বেরিয়েই আসতে পারছিলাম না আমার বিয়ের পর্বের পুরো ব্যাপারটা থেকে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফাজিলকা পৌঁছনো পর্যন্ত সারাটা রাস্তা ছুটির দিনে ঘটে যাওয়া ছোট বড় সব ঘটনাগুলোর স্মৃতিচারণা করছিলাম। টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো একটার পর একটা যেন ভেসে উঠছিলো আমার মনের প্রেক্ষাপটে। এখানে এই হয়েছিল, ওখানে ওই হয়েছিল, ইত্যাদি। চাকরির এতগুলো বছরে তো অ্যানুয়াল লিভ, ক্যাজুয়াল লিভ মিলিয়ে অনেক বারই ছুটি কাটিয়ে গেছি, কিন্তু কোনোবারই তো এইরকম অনুভূতি হয়নি। তাহলে এবারেরটা এইরকম কেন? এই ‘ডিফারেন্ট ফ্যাক্টর’টা কি যার জন্য আমার এইরকম মানসিক পরিস্থিতি? এইসব সাত পাঁচ ভাবছি আর এই প্রশ্নগুলোর সদুত্তর খোঁজার চেষ্টা করছি। যাই হোক, একটা জিনিস আমি অনুভব করছিলাম যে এই ব্যাপারটাকে এতটা আমল দেওয়া চলবে না, কেননা মনের এই অবস্থাকে গুরুত্ব দিলে সেটা আমার কর্ম জীবনে একটি বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে আর আমি কর্মক্ষেত্রে একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসাবে দেশের প্রতি আমার দায়িত্ব এবং কর্তব্য পালন করতে পারবো না। মনকে শুধু এটাই বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম যে আমার মনের অবস্থা যেমনটাই হোক না কেন এটা একেবারেই অস্থায়ী, যে করেই হোক আমাকে এই পরিস্থিতিকে জয় করে মনের দুর্বলতাটা কাটিয়ে উঠতে হবে আর এটা আমি যত তাড়াতাড়ি করতে সক্ষম হবো ততই মঙ্গল। সেই সময় মনে হচ্ছিলো আমার নববিবাহিতা স্ত্রী অর্থাৎ জবা’র সাথে যদি একটু কথা বলতে পারতাম তাহলে হয়তো মনটা একটু হালকা হতো কিন্তু সেটা তো সেইসময় সম্ভব ছিল না। আজকে হলে সেটা সম্ভব ছিল। শুধু কথাই নয়, কথা বলার সাথে সাথে ভিডিও কল করে তাকে চাক্ষুষ দেখে তার উপস্থিতিটুকুও অনুভব করা যেত। কাটিয়ে ওঠানো যেত রাস্তার একাকীত্বটা।
ছুটি থেকে ফিরে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে রিপোর্ট করলাম। ততদিনে আমাদের আগের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার কর্নেল বসরায় আমাদের ব্যাটালিয়ন থেকে বদলী হয়ে গিয়েছিলেন আর তাঁর জায়গায় এসেছিলেন নতুন ব্যাটালিয়ন কমান্ডার যাঁর নাম কর্নেল জ্ঞান সিং সুদান সংক্ষেপে কর্নেল জি. এস. সুদান.। আগের কমান্ডারের মতো উনিও সর্দারজী ছিলেন। ঐরকম লম্বাচওড়া শরীরের গঠন আর খুব গম্ভীর ব্যক্তিত্ব, ভারী গলার আওয়াজ, সৎ, কর্মঠ এবং কর্তব্যপরায়ণ। দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন ছিল তার নীতি। তবে আগের কমান্ডার-এর থেকে বর্তমান কমান্ডার এক জায়গায় পৃথক ছিলেন, আর সেইটা হলো তাঁর রসিক আর রোম্যান্টিক মেজাজ। কর্নেল সুদানের সাথে কথোপকথনের সময় উনি আমায় আমার বিবাহ সংক্রান্ত কিছু প্রশ্ন করলেন। কি ভাবে বিয়ে হলো, কি কি ধরণের রিচুয়ালস ছিল, কতজন লোক এসেছিলো, খাওয়া দাওয়া কি রকম ছিল, ইত্যাদি ইত্যাদি। উনিও প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আমিও যথাযথ উত্তর দিয়ে যাচ্ছি। এইভাবে বেশ কিছুক্ষন তাঁর কথাবার্তা হওয়ার পর আমার কথা বলার ধরণ এবং শারীরিক ভাষাতে আঁচ করতে পেরেছিলেন আমার মনের অবস্থার কথা। হয়তো রোমান্টিসিজ্ম তাঁর চরিত্রের একটি দিক হওয়াতে উনি সেটা ধরতে পেরেছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে উনি হটাৎ একটা তীক্ষ্ণ বাণের মতো আমার দিকে একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, “ঘর কা ইয়াদ আ রাহা হ্যায়? বিবি কা ইয়াদ আ রাহা হ্যায়?” অর্থাৎ “বাড়ির কথা মনে পড়ছে? বৌয়ের কথা মনে পড়ছে?” আমি প্রশ্নটা শুনে একটু লজ্জায় সংকুচিত হয়ে গেলাম। কর্নেল সুদান আবার শুরু করলেন, “কোই বাত নেহী মুখার্জী, এইসা হোতা হ্যায়, হামারী যব নই নই শাদী হুই থী তব হামারে সাথ ভী এইসা হুয়া থা, সময় কে সাথ ধীরে ধীরে সব কুছ ঠিক হো জায়েগা।” অর্থাৎ “কোনো ব্যাপার না মুখার্জী, এইরকম হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক, আমারও যখন নুতন নুতন বিয়ে হয়েছিল তখন আমার সঙ্গে ও ঠিক এইরকমটাই হয়েছিল।” এরপর উনি যেটা আমাকে বললেন সেটা আমার একেবারে হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। উনি বললেন, “কোশিশ করো কাম মে মন লাগানে কা, আগর মন নেহী লাগতা হ্যায় তো সিধা মুঝে বাতানা, কুছ আউর দিনো কে লিয়ে ছুট্টি চলে জানা, আপ সব কি খুশী হি মেরী খুশী হ্যায়।” অর্থাৎ “চেষ্টা করুন মন দিয়ে কাজ করতে, যদি কোনোরকম অসুবিধা হয় তাহলে আমায় বলবেন আমি আরো কয়েক দিনের জন্য আবার ছুটি পাঠিয়ে দেব, আপনারা সবাই খুশী থাকলেই আমি খুশী।” তারপর কর্নেল সুদানের আরেকটি সংযোজন ছিল সেটি আমি আপনাদের বাংলাতেই বলছি, উনি আমায় বললেন, “আপনি নাহলে আর এক কাজ করতে পারেন মুখার্জী, আমি আপনার নামে ‘family accommodation allot’ করিয়ে দিচ্ছি, আপনি কয়েক দিন পর বাড়ি যান আর আপনার wife-কে এখানেই নিয়ে আসুন, তাহলে আপনার মনও ভালো থাকবে আর মন দিয়ে কাজও করতে পারবেন আপনি।” তারপর কর্নেল সুদান একটু মজা করার মেজাজে হাসতে হাসতে আমায় বলেন, “আপ বাঙালী, তো আপকি বিবি ইহাঁ জাট অর রাজপূত লোগোঁ কি বিবি কে বীচ রহে পায়েঙ্গী? উনকো দিক্কত তো নেহি হোগী?” অর্থাৎ “আপনি তো একজন বাঙালী, তা আপনার স্ত্রী কি ওই কলোনীতে থাকতে পারবেন যে কলোনী জাট আর রাজপূতদের পরিবারে ভরা? আপনার স্ত্রী কি ওদের স্ত্রীদের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারবেন? ওনার অসুবিধা হবেনা তো?” আমি প্রতি উত্তরে বলেছিলাম – স্যার, আমার ওয়াইফ অলরেডি একটি আর্মির পরিবার থেকে এসেছে, ওর বাবা আর্মিতে চাকরি করেন আর সেই সুবাদে তার বাবার সঙ্গে বাবার অনেক কর্মক্ষেত্রেই থেকেছে, তাই ওর এখানে ‘এডজাস্ট’ করে নিতে কোনো অসুবিধা হবেনা। সত্যি, কেই বা ভাবে ঐরকম করে। কর্নেল সুদানের বদান্যতায়, ভ্রাতৃসুলভ আচরণে আর আমার প্রতি ওই রকম সহানুভূতিশীল কথা শুনে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে গিয়েছিলো আমার হৃদয় আর চোখদুটি। মন থেকে কর্নেল সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি স্যালুট মেরে ফিরে গিয়েছিলাম নিজের বাসস্থানে। পরদিন থেকে কাজে লেগে গিয়েছিলাম উঠেপড়ে। সময় বেশ কিছুটা কেটে গেলো আর তার সঙ্গে ধীরে ধীরে মনও তখন অনেকটাই