মসির ধারায় অসির ধার (১৬)

সঞ্জীব মুখার্জী
“A soldier doesn’t fight because he hates and intends to kill what is there in front of him. He rather fights because he loves and intends to save what he has left behind him.”
~ Sanjib Mukherjee
ততদিনে পাঞ্জাবে উগ্রবাদীদের এবং দেশবিরোধীমূলক তত্ত্বের সম্পূর্ণ অবসান না হলেও আর্মির “অপারেশন রক্ষক” এবং পাঞ্জাবের সশস্ত্র রাজ্য পুলিশের “অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার”-এর প্রভাবে রাজ্যে উগ্রবাদীদের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আতঙ্ক কমে গিয়েছিলো। সেখানকার জনসাধারণের মুখে আতঙ্কের ছায়া ধীরে ধীরে অপসারিত হয়ে প্রস্ফুটিত হতে শুরু করেছিল স্বস্তির স্মিতহাসি। কিন্তু সরকারের নির্দেশ ছিল পাঞ্জাব থেকে শেষ উগ্রবাদিটিকেও সমূলে উৎপাটিত করতে হবে, যেন একটিও উগ্রবাদী বেঁচে না থাকে। সেই নির্দেশ পালন করতেই আমাদের মিলিটারি অপারেশন চালিয়ে যেতে হচ্ছিলো রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে। যদিও পরবর্তী অপেরেশনগুলো একটু শিথীল ভাবেই চলছিল কেননা উগ্রবাদীর প্রকোপ অনেকাংশেই কমে গিয়েছিলো তাই আগের মতো তীব্র এবং ঘনীভূত অপেরেশনের প্রয়োজন সেইসময় অতটা হতো না। যদিও এটাকে একধরণের যুদ্ধনীতিরই অংশ বলা চলে। এই ধরণের যুদ্ধ পদ্ধতিকে মিলিটারি ভাষায় বলা হয় “ব্যাটেল ইনোকুলেশন”। বিষয়টি হলো প্রথমে যেমন কোনো মহামারীকে প্রশমিত করতে তাৎক্ষণিক দমনমূলক টীকাকরণ বা প্রতিষেধক দেওয়া হয় আর তারপর সেই মহামারীকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর বুস্টার ডোজ দেওয়া হয় ঠিক তেমনটাই হচ্ছে “ব্যাটেল ইনোকুলেশন”। সময়ও গড়িয়ে যাচ্ছিলো। এইভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরো দুটি বছর। এই দুটি বছরের কর্মজীবনে এবং কর্মসূত্রে আমারও ঘোরা হয়ে গেলো ফাজিলকা ছাড়া পাঞ্জাবের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ শহর আর সেই শহর সংলগ্ন গ্রামাঞ্চলগুলো। চন্ডীগড়, অমৃতসর, লুধিয়ানা, জলন্ধর, পাটিয়ালা, তরণ-তারণ, ফরিদকোট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য জায়গাগুলো ঘোরা হল। এই সমস্ত জায়গাগুলো ঘোরার সাথে সাথে সুযোগ হলো পাঞ্জাবের বিভিন্ন ধরণের জনপ্রিয় খাদ্য আস্বাদন করার। যেমন সর্ষের সাগ দিয়ে মকাইয়ের রুটি, তন্দুরি চিকেন, চিকেন সাগওয়ালা, শামি কাবাব, শিক কাবাব, সালামী, দাল মখানি, রাজমা চাউল, অমৃতসরি কুলচা, পরাঠা, ছোলে ভাটুরে, পিন্নী, কড়াই পনীর, ইত্যাদি ছিল খাবারগুলির মধ্যে অন্যতম। একটা কথা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলাম যে শুধু বাঙালিই নয় পাঞ্জাবীরাও ভীষণ খাদ্যরসিক আর বাঙালিদের মতো পাঞ্জাবিরাও খুব মুখরোচক খাবার খেতে পছন্দ করে। সবকিছু মিলিয়ে এককথায় পুরো পাঞ্জাবের সম্মন্ধে ওয়াকিবহাল হয়ে গিয়েছিলাম।
১৯৯০ সালের জুন মাস, আমার চাকরি জীবনের তখন পঞ্চম বর্ষ। সংঘর্ষপূর্ণ পর্যায় অর্থাৎ “স্ট্রাগলিং ফেজ” বললে ভুল বলা হবে না। সেই সময়টা মোবাইল অথবা ইন্টারনেটের যুগ তো ছিলই না, এমনকি মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট বলে কোনোকিছু কোনোদিন হতে পারে সেটাও আমাদের সেইসময় কল্পনাতীত ছিল। তাই বলাই বাহুল্য আজকের দিনের হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক এবং অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্বের কথাও সেদিন আমরা ভাবতে পারতাম না। সেই সময়টা আজকের বর্তমান প্রজন্মের কাছে হয়তো কিছুটা প্রাচীন প্রস্তরযুগের মতোই শোনাবে। পরিবার পরিজন এবং বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার মাত্র একটিই মাধ্যম ছিল আর সেটি ছিল হস্তলিখিত পত্রের আদানপ্রদান দিয়েই। যেদিনই বাবা মা, কোনো আত্মীয় স্বজন বা বন্ধু বান্ধবের কাছ থেকে আমার চিঠির উত্তর আসতো সেদিনটা সত্যিই ভীষণ আনন্দের হতো, যেন খুশির জোয়ারে ভরে উঠতো মন প্রাণ, প্রাণবন্ত হওয়ার সাথে সাথে খুবই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তাম সেদিন। এমনকি চিঠি পড়তে পড়তে ইচ্ছে করতো ইচ্ছেডানায় ভর করে এক উড়ান দিয়ে চলে যাই বাড়িতে আর সকলের সঙ্গে দেখা করে আসি। অন্যান্য দিনের মত সেদিন বাবার একটি চিঠি পেলাম তাতে লেখা ছিল আমার ঠাকুরমার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছেনা আর ঠাকুরমা চাইছেন আমার বিবাহটা যেন একটু তাড়াতাড়ি করে হয়, যাতে করে উনি দেখতে পান। সেই সঙ্গে বাবা এটাও লিখেছেন যে ঠাকুরমার পীড়াপীড়িতে তাঁরা বিভিন্ন জায়গায় আমার বিবাহের জন্য বিবাহযোগ্যা কন্যার খোঁজখবর করতেও শুরু করে দিয়েছেন। কয়েক জায়গায় দেখাশোনা করার পর মায়ের কোনো এক আত্মীয়ের যোগসূত্রেই একটি মেয়ের খোঁজ পান আর সেই মেয়েটির ব্যাপারে প্রাথমিক ভাবে জেনে আর ফটোতে দেখে মায়ের সেই মেয়েটিকে পছন্দ হয়। অবশ্য সেই সময় মেয়ে পছন্দ করার এটাই প্রচলিত পদ্ধতি ছিল। যাইহোক, তারপর মা সেই আত্মীয়ের মারফৎ সেই মেয়ের বাবামায়ের কাছে আমার বিবাহের ব্যাপারে ইচ্ছে প্রকাশ করেন। উত্তরে সেই মেয়ের মাতাপিতার সম্মতি পাওয়ার পর বাবা এবং মা মেয়েটিকে চাক্ষুষ দেখতে যেতে মনস্থ করেন। এরপর বাবা আবার লিখেছেন যে মেয়েটিকে দেখে তাঁদের পছন্দ হলে তখন তাঁরা আমায় ছুটি নিয়ে আসতে বলবেন যাতে করে আমি স্বচক্ষে মেয়েকে দেখার পর্বটা সেরে ফেলি। সেই চিঠির প্রতি-উত্তরে আমি বাবাকে আমার বিবাহের ব্যাপারে অমত জানাই। কেননা তখন আমার চাকরির জীবনের দৈর্ঘ্য সবে মাত্র পাঁচ বছর, তাই আমি চাইছিলাম চাকরিজীবনের আরো কয়েকটি বছর পর দু একটা প্রমোশন নিয়ে নিজেকে চাকরি জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে তারপর নাহয় বিয়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবা যাবে। কিছুদিন পর বাবা আবার আমায় চিঠিতে জানান যে আমার বিয়ে নিয়ে তাঁদেরও অতটা তড়িঘড়ি ছিলোনা যদি না ঠাকুরমার শারীরিক অবনতি হতো। যাইহোক, ঠাকুরমা আমার খুব প্রিয় ছিলেন, তাই তাঁর কথাটা উড়িয়ে দিতে পারলাম না। ইচ্ছে না থাকলেও হ্যাঁ করতে হলো আমাকে। তারপর বাবা এবং মা আনুষ্ঠানিকভাবে সেই মেয়েটিকে দেখতে যান। মেয়েটিকে দেখে আসার পর সত্বর আমাকে একটা খামে করে চিঠি লিখে তাঁদের মতামত জানান। চিঠির সারাংশ ছিল মেয়েটিকে আমার বাবা মায়ের খুব পছন্দ, শুধু মেয়েটিকেই নয় মেয়েটির ঘর পরিবার, তার বাবা মায়ের ব্যবহার, ইত্যাদিও আমার বাবা মায়ের ভীষণ পছন্দ হয়ে যায়। চিঠির ভাষাতে মনে হচ্ছিলো যে আমার বাবা মা পারলে আমার সেদিনই বিয়ে দিয়ে দেয় আরকি। বাবার পাঠানো খামের মধ্যে চিঠি ছাড়া আর একটি জিনিস ছিল আর সেটি ছিল মেয়েটির একটি পোস্টকার্ড সাইজের ফটো। ছবি দেখে আমিও যে মেয়েটিকে পছন্দ না করে থাকতে পারিনি সেটা অস্বীকার করে উপায় নেই। এবার বাবার নির্দেশ অনুযায়ী আমাকে ছুটি নিয়ে বাড়ি যেতে হবে। চিঠিতে লেখা বাবার কথা অনুযায়ী আমি যতদিন ছুটি নিয়ে বাড়ি আসছি ততদিনে আরো কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ আত্মীয়দের দিয়ে মেয়েটিকে দেখানো হবে। এটাও সেই সময়কার প্রচলিত প্রথার একটি অঙ্গ ছিল।
আমার ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসারকে ছুটির দরখাস্ত করে ২০ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি গেলাম। বাড়ি গিয়ে দেখলাম ঠাকুরমার শরীর খুব একটা ভালো না থাকলেও খুব একটা খারাপও ছিল না, মাঝামাঝি স্বাস্থ্যের অবস্থা বলা চলে। বাড়ি পৌঁছনোর পর ঠাকুরমার পাশে গিয়ে বসলাম আর ঠাকুরমার সাথে গল্প করতে শুরু করলাম। গল্পের মধ্যে মধ্যে ঠাকুরমা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন আর বারংবার বিয়ের কথা টেনে আনছিলেন। অনুমান করলাম একথা সেকথা বলে আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে প্ররোচিত করাটাই ঠাকুরমার যেন মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। আর হবেনাটাই বা কেন? আমার ঠাকুরমার আমি খুব প্রিয় আর আদরের নাতি ছিলাম, আর তাই ঠাকুরমার জীবদ্দশায় আমার বিয়ে দেখাটা তাঁর প্রধান লক্ষ্যও ছিল আর মৌলিক অধিকারও ছিল। যদিও ঠাকুরমার শারীরিক পরিস্থিতি দেখে বুঝতে পারছিলাম যে তাঁর স্বাস্থ্যের এতটা অবনতি হয়নি যে আমাকে তড়িঘড়ি করে বিয়ে করতে হবে তা সত্ত্বেও ঠাকুরমাকে অভয় দিয়ে বললাম যে তোমাদের সকলের কথা মাথায় রেখেই আমি ছুটি নিয়ে এসেছি মেয়েটিকে দেখতে যাবো বলে। বাড়িতে দু একদিন কাটানোর পর মেয়েটিকে দেখতে যাবো বলে ঠিক করলাম। খুবই কাছের দুই বন্ধু আর আমার নিজের এক খুড়তুতো বোনকে নিয়ে মেয়ে দেখতে গেলাম আর দেখেও এলাম। যদিও আমি মেয়েটির সামনে খুবই সলজ্জ হয়ে বসেছিলাম তাই দু একটি প্রশ্ন করা ছাড়া আমি বেশি কথা বলতে পারিনি, তবে প্রথম দেখাতেই যে মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ বা সংশয় ছিল না। আরো কিছু সাধারণ প্রশ্ন যেগুলো সাধারণতঃ মেয়ে দেখার সময় করা হয়ে থাকে সেগুলোই করা হলো মেয়েটিকে তবে সেগুলো করলো আমার বন্ধুদ্বয় আর আমার বোন। আমার করা প্রথম প্রশ্নে আমি মেয়েটিকে তার নাম জিজ্ঞেস করেছিলাম। যদিও মেয়েটির নামটা আমার আগে থেকে জানা ছিল আর প্রশ্নটাও একটু বোকা বোকা ছিল, তা সত্ত্বেও কিছু একটা তো জিজ্ঞেস করতে হবে তাই সংলাপ শুরু করতে ওই প্রশ্নটি ছাড়া আর কিছুই আমার মাথায় আসেনি। মেয়েটি অত্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে জানিয়েছিল যে তার নাম জবা, জবা ব্যানার্জী। পরের প্রশ্নে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এ বিয়েতে তার সম্মতি আছে কিনা। তার উত্তরে মেয়েটি সলজ্জ ভাবে একটু মাথা নেড়ে ছিল। মাথা নাড়ার ভঙ্গিমায় বুঝতে পেরেছিলাম যে মেয়েটির সম্মতি আছে। প্রশ্নোত্তর পর্বে কথায় কথায় জবা জানিয়েছিল যে পরের বছর ওর গ্রাজুয়েশনের ফাইনাল পরীক্ষা তাই বিয়েটা যেন পরীক্ষা কমপ্লিট হওয়ার পরই হয়। ব্যস, মনে মনে একপ্রকার ঠিক করেই ফেলেছিলাম যে এই মেয়েটিকেই বিয়ে করবো। বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে সেকথা জানাতেই বাবা-মা বলেন যে ততদিনে সবকিছু ফাইনাল হয়েই থাকবে কেবল বিয়ের দিনটা হবে পরীক্ষা কমপ্লিট হওয়ার পর। বাবা মা একটি ভালো দিন দেখে আমার বিয়ের দিন ঠিক করে ফেললেন আর দিনটি পড়েছিল ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে। সব কিছুই ঠিকঠাক ছিল, বিবাহের পূর্বপ্রস্তুতিও চলছিল পুরোদস্তুর ভাবে, কিন্তু বিধি বাম, হলোনা সেই দিন বিয়ে। কোনো অনিবার্য কারণবশতঃ সেই দিন বাতিল হয়ে গেলো এবং পিছিয়ে গিয়ে সেটি দাঁড়ালো পরের বছর। ১৯৯২ সালের মে মাসের ৪ তারিখে পুনঃনির্ধারিত হলো আমাদের বিয়ের দিন।
বাবা আমায় চিঠি লিখে আমার বিয়ের দিনটা জানিয়ে বললেন যে আমি যেন বিয়ের ঠিক ৬ – ৭ দিন আগেই আসি আর একটু লম্বা ছুটি নিয়ে আসি, বিয়ের ব্যাপার তো তাই একটু বেশি ছুটিরই প্রয়োজন। আর তার সঙ্গে বাবা এটাও লিখে জানালেন আসার সময় যে আমি যদি কলকাতা হয়ে আসতে পারি তাহলে খুব ভালো হয় কেননা বিয়ের কিছু কিছু বিশেষ জিনিস আমি কলকাতা থেকে কিনে নিয়ে আসি। বাবাকে উত্তরে জানালাম যে ঠিক আছে তাই হবে আর যে সমস্ত জিনিস কলকাতায় শপিং করতে হবে তার লিস্টটা আমাকে লিখে জানাতে। আর সেই সঙ্গে আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসে গেলো। প্রথমে বড়মাসীর বাড়ি তারপর বড়মাসী আর আমার ভাই জহরকে নিয়ে কলকাতায় শপিংটা সেরে নেওয়া যাবে। আর এটাও মনে মনে ঠিক করলাম যে হাওড়া থেকে জহরকে সঙ্গে নিয়েই সিউড়ি অর্থাৎ বাড়ি যাবো তাহলে জহরকে বেশ কিছুদিন আমার সঙ্গে পাওয়াও যাবে আর ওর সাথে কয়দিন জমিয়ে আড্ডাও মারা হবে। ব্যাপারটা দারুন হবে। আমার ভাই জহরের কথা তো আমি আমার এই আত্মকাহিনীর আগের কয়েকটি পর্বেই লিখেছি। জহর শুরু থেকেই ভীষণ ক্রিয়েটিভ ছেলে আর পড়াশোনার সাথে সাথে সে শিল্পকলা নিয়েই থাকতো বরাবর। ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনের ব্যাপারে জহর একেবারে সিদ্ধহস্ত, ওই ব্যাপারে প্রচুর ‘ইনোভেটিভ আইডিয়া’ ওর। তাই তার নিজস্ব ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে আমার বিয়েতে অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জার দায়িত্বটা জহর নিজের হাতেই নেবে এটাই ওর ইচ্ছে। আর আমি তো একেবারেই সুনিশ্চিত যে জহর এই কাজে ‘চার চাঁদ’ লাগিয়ে দেবে। যাইহোক, এইসব ভাবতে ভাবতে বেশ কিছু দিন কেটে গেলো। দেখতে দেখতে কাছে এসে গেল আমার ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়ার দিন। বাবার কথা অনুযায়ী একসঙ্গে দু-মাসের ছুটির জন্য দরখাস্ত করে দিয়েছিলাম। নিজের বিয়ে বলে ছুটি পেতে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। জার্নি প্ল্যান করে ২৭ এপ্রিল ১৯৯২ তারিখের পাঞ্জাব মেলে রিজার্ভেশন আগে থেকেই করিয়ে নিয়েছিলাম।
নির্ধারিত দিনে অর্থাৎ ২৭ এপ্রিল পাঞ্জাব মেল ধরলাম আর পরদিন সোজা হাওড়া আর হাওড়াতে নেমে সোজা বড়মাসীর বাড়ি। সেখানে খুব খাওয়া দাওয়া গল্প আর আড্ডা। মাসীকে বললাম যে কলকাতায় কিছু বিশেষ জিনিস কেনার আছে সেগুলো সঙ্গে গিয়ে কিনে দিতে। মাসী বললো বিকালে কিনতে যাওয়া হবে। মাসীকে আর জহরকে সঙ্গে করে বিকাল বেলায় কলকাতায় শপিংটা সেরে ফেললাম। পরদিন বাড়ির জন্য বেরোতে হবে। আমি মাসীকে আর জহরকে আমার সঙ্গেই সিউড়ি যাওয়ার জন্য অনেক জোর করলাম। বড়মাসী বললো, “তুই জহরকে সাথে করে নিয়ে যা, আমরা দোসরা মে ঠিক এসে যাবো।” জহরকে সঙ্গে নিয়ে পরদিন সিউড়ি।
এক এক করে আমাদের বাড়িতে সব আত্মীয় স্বজনদের সমাগম হতে শুরু করলো। ধীরে ধীরে বাড়িটা পুরোপুরি জাঁকজমকপূর্ণ বিয়েবাড়ির রূপ নিয়ে নিলো। সমস্ত আত্মীয় স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবদের উপস্থিতিতে খুবই হৈহুল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে আমার আর জবার শুভবিবাহ সম্পন্ন হলো। আবদ্ধ হলাম আমরা একে অপরের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে। জীবনতরীর পালে লাগলো সকলের আশীর্বাদ আর ভালোবাসার হাওয়া আর সেই হাওয়া দিয়েই পারি দিলাম আমরা এক নতুন জীবনযাত্রার উদ্দেশ্যে। গায়ে হলুদ, ছাঁদনাতলা, বিয়ের তত্ত্ব, বরযাত্রী, শুভ বিবাহ, বিয়ে করে কনেবৌ নিয়ে বাড়ি আসার পর কাল রাত্রি, বৌ ভাত, ভাত কাপড়, অষ্টমঙ্গলা, ইত্যাদি বিয়ের সব লোক-আচারের মধ্যে কিভাবে যে বিয়ের দিন গুলো কেটে গেলো এতটুকুও টের পেলাম না।
ইতিমধ্যে আত্মীয়রা সব এক এক করে চলে যেতে শুরু করলো, সবাই যে যার বাড়ি ফিরে গেলো। দেখতে দেখতে বাড়িটা যেভাবে ভরে উঠেছিল ঠিক সেইভাবে খালি হয়ে গেলো। কেবল আটকে দিলাম জহরকে, আরো কয়েকটা দিনের জন্য। কিন্তু কিছুদিন আমাদের বাড়িতে থাকার পর জহরও একদিন হাওড়া ফিরে গেলো। মনটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগতে লাগলো। এরই মধ্যে বাবা মা একদিন আমাকে বললেন, “তুই নতুন বৌকে নিয়ে কিছু নিকট আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরে আয় তাহলে তোদের মনটাও ভালো লাগবে আর এটা আমাদের পরিবারের একটা নিয়মও বটে।” বাবা মায়ের কথা রাখতে আর পরিবারের নিয়মরক্ষার্থে জবাকে নিয়ে কয়েকজন আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরেও এলাম। দেখতে দেখতে ছুটির দিনগুলো শেষ হয়ে গেলো এইভাবে। এসে গেলো আমার কর্মস্থলে অর্থাৎ ফাজিলকাতে ফিরে যাওয়ার দিন। জবা বাড়িতে বাবা মায়ের কাছে থাকবে। যাওয়ার দুদিন আগে থেকেই আমার ব্যাগপত্র গোছাতে লাগলাম। জবাও আমাকে গোছগাছ করতে সাহায্য করছিলো। মনটা খুব খারাপ ছিল জবার। সজল চোখে এটা ভরে নাও, ওটা ভরে নাও বলে জামাকাপড়গুলো এগিয়ে দিচ্ছিলো। খুব তাড়াতাড়ি আবার ছুটি নিয়ে আসবো, কাজের জায়গায় পৌঁছে পৌঁছেই চিঠি লিখবো, ইত্যাদি সব নানান স্তোকবাক্যে স্বান্ত্বনা দিচ্ছিলাম জবাকে। মনটা আমারও খুব ভারাক্রান্ত ছিল সেদিন, তাই জবাকে স্বান্ত্বনা দেওয়ার ছলে একরকম ভাবে আমি নিজেকেও স্বান্তনা দিচ্ছিলাম। এছাড়া কিই বা আর করতাম। উপায় নেই, কর্মস্থলে আর কর্মজীবনে তো ফিরতেই হবে। এটাই তো পৃথিবীর নিয়ম। নির্ধারিত দিনে বেরিয়ে পড়লাম কর্মস্থলের উদ্দেশ্যে যেখানে কর্মজীবন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। রেখে গেলাম পুরো পরিবার পরিজনদের যাদের স্নেহ মমতা আর ভালোবাসাই আমার জীবনে চলার পাথেয়। একদিকে পরিবারের টান আর আরেকদিকে কর্ত্তব্যের ডাক, এইদুটো জিনিসের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলাটার নামই হয়তো জীবন, অন্ততঃ জীবন আমাদের এটাই শেখায়। আজ চলি, আবার দেখা হবে।
ক্রমশঃ