মসির ধারায় অসির ধার (১৫)

সঞ্জীব মুখার্জী
“We live by chance. We love by choice. We kill by profession.” – An Armyman
২রা আগস্ট ১৯৮৭, পাঞ্জাবের ফাজিলকায় রাজপুতানা রাইফেলস-এর তৃতীয় ব্যাটালিয়নে আমি রিপোর্ট করলাম। সেখানে পৌঁছানোর ঠিক পরদিন অর্থাৎ ৩রা আগস্ট, সকাল আটটার সময় ব্যাটালিয়ন কমান্ডার-এর অফিসের সামনে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার। যে সব নবাগত সৈনিক রেজিমেন্টাল সেন্টার থেকে শপথ গ্রহণ করে ব্যাটালিয়নে রিপোর্ট করে, তাদের সঙ্গে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের একটি অফিসিয়াল সাক্ষাৎকার হয়। এটি কোনো সাধারণ সাক্ষাৎকার নয়, এটি একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার নবাগত সৈনিককে বিভিন্ন প্রশ্ন করে সেই সৈনিকের শারীরিক ভাষা এবং তার মধ্যে আত্মবিশ্বাসের স্তর মূল্যায়ন করেন আর এটাই ব্যাটালিয়নের ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি। ব্যাটালিয়নটি ফাজিলকা শহরের সংলগ্ন একটু বাইরের দিকে একটি বিশাল এলাকা জুড়ে অবস্থিত আর তার চারিদিকে কাঁটা তারের বেড়া। ব্যাটালিয়নের মাথার উপর ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার আর তার মাথার উপর ডিভিশন হেডকোয়ার্টার। এছাড়াও তাদের উপর আরো উর্ধ্বতন হেডকোয়ার্টার। ব্যাটালিয়নের মধ্যে আমার বাসস্থান থেকে ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের অফিস খুব একটা দূরে ছিল না। ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের অফিসের ঠিক পাশটিতেই একটি কোয়ার্টার গার্ড আর সেখানে তিনটি পা বিশিষ্ট একটি স্ট্যান্ডের মাঝখানে পিতলের তৈরি একটি সুবিশাল ঝুলন্ত ঘন্টা। কোয়ার্টার গার্ডের একজন কর্মরত সৈনিক প্রতি ঘন্টায় ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজিয়ে পুরো ব্যাটালিয়নের সৈনিকদের সময়ের সূচনা দেয়। যাই হোক, কথামতো সকাল আটটা বাজার আগেই সুনির্দিষ্ট স্থানে অর্থাৎ ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সময়মতো ব্যাটালিয়ন কমান্ডার এসে আমার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়ালেন। সেই সময় আমার ব্যাটালিয়ন কমান্ডার ছিলেন কর্নেল রবীন্দর সিং বসরায়, সংক্ষেপে আর এস বসরায়। কর্নেল বসরায় ছিলেন একজন সর্দারজি। বিশাল লম্বা আর চওড়া তাঁর শরীর, মাথায় একটি বিশাল পাগড়ী। ফাজিলকায় পৌঁছনোর পর সেইদিনই আমার কিছু সহকর্মীর কাছ থেকে কর্নেল বসরায়-এর শারীরিক ক্ষমতার কথা ছাড়া আর যা জানতে পেরেছিলাম তা হলো উনি খুব গম্ভীর ব্যক্তিত্বের সেনা অধিকারী, মিথ্যে কথা এবং অনুশাসনের কোনো গাফিলতিকে তিনি একেবারেই বরদাস্ত করেন না, একই সঙ্গে নিয়মানুবর্তী এবং সৎ সৈনিকের প্রতি উনি খুব স্নেহপরায়ণ। কর্নেল সাহেব আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে নানান ধরণের প্রশ্ন করতে লাগলেন। প্রশ্নগুলির বেশিরভাগই ছিল সামরিক প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত, তবে কিছু প্রশ্ন ছিল পারিবারিক বিষয়ের উপর আর কিছু প্রশ্ন ছিল আমার ব্যক্তিগত। আমি একটু ভয় মিশ্রিত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর প্রতিটি প্রশ্নের যতটা সম্ভব যথাযথ উত্তর দিচ্ছিলাম। প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে আমায় ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারের অফিসে যেতে বলে কর্নেল সাহেব তাঁর একজন অধীনস্থ অধিকারী, যাঁকে বলা হয়ে থাকে এডজুটেন্ট, তাঁর সঙ্গে ব্যাটালিয়নে আমার ‘ইনডাকশন প্রোগ্রাম’ নিয়ে কিছু কথা বলতে লাগলেন। কোনো নবাগত সৈনিককে ব্যাটালিয়নে প্রথম বার রিপোর্ট করার পর সেই সৈনিককে দু সপ্তাহের একটি বিশেষ কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাটালিয়নের ধাঁচে ঢালা হয় আর এটাই ‘ইনডাকশন প্রোগ্রাম’ আর এটাই ব্যাটালিয়নের চিরাচরিত প্রথা। এতক্ষন ধরে টানটান উত্তেজনায় ছিলাম, তাই সেখান থেকে আমায় যেতে বলাতে হাঁফ ছেড়ে যেন বাঁচলাম। তবে কর্নেল সাহেবের হাবভাব এবং শারীরিক ভাষা দেখে অনুমান করতে পেরেছিলাম যে আমার সমস্ত উত্তর তাঁকে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে।
সন্ধ্যাবেলায় মেসের মধ্যে ডাইনিং হলে বসে টিভি দেখছিলাম, তখনই একজন জওয়ান এসে আমাকে মেসেজ দিয়ে গেল যে, পরদিন থেকে আমার এক সপ্তাহের “ইনডাকশন প্রোগ্রাম’ শুরু। স্পেশাল ব্রীফিং, স্থানীয় এলাকা পরিচিতি, সেখানকার স্থানীয় ডেমোগ্রাফি, স্থানীয় লোকেদের সাইকোগ্রাফি, রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে উগ্রবাদের প্রাদুর্ভাব, স্থানীয় এলাকায় স্টেট পুলিশের প্রভাব, ইত্যাদি ছিল ইনডাকশন প্রোগ্রামের অন্যতম অঙ্গ।
সেই সময়ের পাঞ্জাব রাজ্যের সামগ্রিক পরিস্থিতি সংক্ষেপে আপনাদের একটু বলে রাখি। সেই বছরের মাত্র কয়েক মাস আগে অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের জুন মাসে সমগ্র পাঞ্জাব রাজ্যে সবে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হওয়ার ঠিক আগের দিন পর্যন্ত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সুরজিৎ সিং বার্নালা। তার কয়েক বছর আগে, অমৃতসরের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন ‘ব্লু ষ্টার’ নামে যে সামরিক অভিযানটি চালানো হয় তারই জের টেনে পাঞ্জাবে খালিস্তানি সমর্থিত উগ্রবাদীদের হাতে রাজ্যে বেশ কিছু ছোট-বড় রাজনৈতিকদলের নেতা এবং সাধারণ লোকেদের প্রাণ হারাতে হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে তদানীন্তন কেন্দ্র সরকার পাঞ্জাবে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে বাধ্য হয়। ধীরে ধীরে উগ্রবাদীদের উপদ্রবে ছেয়ে যায় পাঞ্জাব রাজ্যটি। সেখানকার আইন শৃঙ্খলা একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এইভাবে রাজ্যটি পরিণত হয় খালিস্তানি সমর্থিত উগ্রবাদীদের স্বর্গ রাজ্যে। স্থানীয় বাসিন্দারা চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। প্রতিনিয়ত নিরীহ নির্দোষ স্থানীয় লোকেরা মরতে থাকে উগ্রবাদীদের হাতে। এমনকি উগ্রবাদীদের দমন করার অভিযান চালাতে গিয়ে অগুনতি পুলিশকেও সেই সমস্ত শিখ উগ্রবাদীদের শিকার হতে হয়। উগ্রবাদীদের সংগঠনগুলি একজায়গাতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তারা রাজ্যজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক সীমান্তে অবস্থিত। তাই শিখ উগ্রবাদীদের সংগঠনগুলি ছিল পাকিস্তানী মদতপুষ্ট। পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারীরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সেই সকল শিখ উগ্রবাদীদের প্রশিক্ষণ দিত। তাছাড়া, এইসমস্ত উগ্রবাদী সংগঠনগুলো গোপনভাবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক উগ্রবাদ সংস্থা থেকে আর্থিক সহায়তা, বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, অটোমেটিক ফায়ার গান, গোলাবারুদ আর তাদের সঠিক ব্যবহার করার উপযুক্ত শিক্ষা পেত। উগ্রবাদীদের আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল খুবই অপ্রত্যাশিত। চলন্ত বাসে অথবা ট্রেনে কালো চাদরমুড়ি দিয়ে নিরীহ যাত্রীদের সামনে গিয়ে আচমকা হামলা চালাতো আর চাদরের তলা থেকে ‘অটোমেটিক গান’ বের করে তা ঘোরাতে ঘোরাতে একনাগাড়ে গুলি চালিয়ে বেশ কিছু যাত্রীকে মেরে নিমেষের মধ্যে সেখান থেকে পালাতো। গ্রামের মধ্যে যে কোনো ধনী লোকের বাড়িতে আচমকা আক্রমণ করে বাড়ির লোকেদের মেরে লুঠতরাজ করে সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে পালিয়ে যেত। রাজ্য পুলিশের তদানীন্তন ‘উইপন প্রোফাইল’ খালিস্তানি উগ্রবাদীদের ‘উইপন প্রোফাইলের’ সম্মুখীন হবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। সেই কারণেই দিনের পর দিন নির্দ্ধিধায় নির্বাধায় উন্মুক্তভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল পাঞ্জাবের নানান উগ্রবাদ সংগঠনগুলি। শেষ পর্যন্ত, বাধ্য হয়ে কেন্দ্রীয় প্রশাসনকে রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ শহর এবং জেলাগুলিতে সেনা নামাতে হয়।সেনার হাতে তুলে দেওয়া হয় উগ্রবাদ এবং উগ্রবাদীদের দমনের গুরু দায়িত্বভার। সেনা বাহিনী পাঞ্জাবের বিভিন্ন জায়গায় একাধিক ব্যাটালিয়ন এবং কোম্পানি নামিয়ে শুরু করে দেয় পুরো পাঞ্জাব জুড়ে উগ্রবাদী দমনকারী অপারেশন যার নাম ছিল “অপারেশন রক্ষক”।
আবহাওয়ার দিক থেকে ফাজিলকা জায়গাটা খুবই চরমভাবাপন্ন অর্থাৎ যত শীত তত গরম। ভৌগোলিকভাবে গ্রামগুলি একে অপরের থেকে একটু দূরে দূরেই অবস্থিত। ফাঁকা জায়গাগুলি হয় চাষ জমি, নয় বাবলা-কাঁটা গাছের জঙ্গল। কাছেই রাজস্থানের মরুভূমি, তাই ধুলোঝড় তো সেখানকার রোজকার গল্প। আর্থিক পরিস্থিতি বা অর্থনৈতিক দিক থেকে পাঞ্জাব খুবই স্বনির্ভর, অভাব অনটনের মুখ কখনোই দেখেনি পাঞ্জাব। তবে উগ্রবাদ পাঞ্জাবের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতাকে অনেকটাই পিছন দিকে ঠেলে দিয়েছিলো, এককথায় বলতে গেলে এক দশক পিছনে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিলো।
এদিকে আমার দুই সপ্তাহের ‘ইনডাকশন প্রোগ্রাম’ সম্পূর্ণ হয়ে গেলো যথা সময়ে। তারপর শুরু হয়ে গেলো ‘পেট্রোলিং টীম’-এর অংশ হয়ে আমার ফাজিলকা সংলগ্ন এলাকার এবং আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়া। পেট্রোলিং টীমের মুখ্য কাজ হলো সেই অঞ্চলকে বিপদমুক্ত করার সাথে সাথে সেই অঞ্চলে উগ্রবাদীদের উপস্থিতির সম্ভাবনা আছে কি না তা সুনিশ্চিত করা। পেট্রোলিং চলা কালীন কোনো জায়গায় উগ্রবাদীদের উপস্থিতি থাকলে রেডিও সেটের মাধ্যমে তার সূচনা তৎক্ষণাৎ ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে পাঠানো। সেই ‘ইনফরমেশনের’ ভিত্তিতে ‘ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার’ সেই অঞ্চলে সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী কয়েক গাড়ি ‘কুইক রিয়াকশন টীম’ (QRT) বা ‘অপারেশন টীম’ পাঠাতো। ‘QRT’ বা ‘অপারেশন টীম’-এর দ্বারা অক্লান্তভাবে ‘অপারেশন’ চালিয়ে সেই অঞ্চলকে ‘ক্লীন’ করে দেওয়াটাই ছিল ‘অপারেশন টীম’-এর মুখ্য উদ্দেশ্য। কখনো সখনো আমি সেই সমস্ত অপেরেশনেও অংশগ্রহণ করেছি। দলবদ্ধ হয়ে অপারেশন চালানোর রোমাঞ্চই আলাদা। ‘আর্মি’তে নানান ধরণের ‘অপারেশন’ হয় তার মধ্যে পাঞ্জাবে উগ্রবাদী দমনে যে ‘অপেরেশন’টি সাধারণতঃ চালানো হতো এবং যে অপেরেশনটি ফলপ্রসূ ছিল সেটি হলো ‘CASO’ অর্থাৎ ‘ক্যাসো’। CASO মানে হলো Cordon And Search Operation (CASO) সংক্ষেপে ‘ক্যাসো’। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে সমস্ত এলাকাতে উগ্রবাদীদের উপস্থিত থাকার বা যে সমস্ত এলাকাতে উগ্রবাদীদের হানা দেওয়ার সম্ভাবনা থাকতো সেই পুরো এলাকাটাকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলা হতো আর তারপর সেই জায়গাটির কেন্দ্রবিন্দুর দিকে অগ্রসর হতে হতে চালানো হতো চিরুনি তল্লাশি। আমাদের অপারেশন টীম সেই সমস্ত অঞ্চলে ক্যাসো (CASO) অপারেশন চালাতো। ‘ক্যাসো’ চলাকালীন বেশির ভাগ সময় সফলতার মুখই দেখতে পেতাম। যদি কোনো উগ্রবাদী আত্মসমর্পন করতো তাহলে তাকে গ্রেফতার করে ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে নিয়ে এসে ‘ইন্টারোগেট’ করা হতো আর যদি তাদের মধ্যে কেউ পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতো তাহলে তাকে গুলিবিদ্ধ করে শেষ করে দেওয়া হতো। সবচেয়ে বড় সমস্যা হতো রাতের অন্ধকারে কে উগ্রবাদী আর কে নিরীহ তা শনাক্ত করতে গিয়ে। ‘ক্যাসো’ অপেরেশনের সময় এতটুকু অন্যমনস্কতা অথবা ভুলত্রুটি যেকোনো সময় আত্মঘাতী হওয়ার কারণ হতে পারতো। আমাদের উপর কঠোর নির্দেশ ছিল যে অপারেশন চলাকালীন কোনোভাবেই বৃদ্ধ, মহিলা, ছোট বাচ্ছা আর গবাদি পশুদের উপর ভুল করেও যেন গুলি না চালিয়ে ফেলি সে ব্যাপারে অত্যন্ত সাবধানী হওয়ার। তাই ঘিরে ফেলা এলাকাতে যদি কোনো বসত বাড়ি থাকতো আর তাতে উগ্রবাদীদের লুকিয়ে থাকার সম্ভাবনা থাকতো তাহলে সেই বাড়ির সকলকে সতর্ক করে তাদের তৎক্ষণাৎ সেই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বলা হতো আর তারপর সেই বাড়িতে তল্লাশি চালানো হতো যাতে করে অপারেশন চলাকালীন কোনো নিরীহ লোকের প্রাণহাণী না হয়। এছাড়া মানবাধিকার কমিশনের প্রচন্ড চাপ তো থাকতোই। এত কথা মাথায় রেখে চালাতে হতো আমাদের ‘ক্যাসো অপারেশন’ আর এতসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়েও ‘উর্দ্ধতন হেডকোয়ার্টার’কে খুশি করতে হতো আমাদের অপেরেশনের সফলতা দিয়ে। যেদিন কোনো সফলতা পেতাম সেদিন কর্নেল বসরায় খুব খুশি হতেন আর অপেরেশনে অংশগ্রহণকারী সমস্ত সৈনিকদের পিঠ চাপড়ে শাবাসী দিতেন আর সেদিন হতো আমাদের মেসে খানা পিনা মৌজ মস্তী। এইভাবে চলতে থাকলো আমাদের ‘পেট্রোলিং’ এবং ‘ক্যাসো’ অপেরেশন। একটা এলাকা ‘ক্লীন’ করে পরের এলাকাটি ‘ক্লীন’ করার দায়িত্ব পেয়ে যেতাম আমরা। দেখতে দেখতে আমাদের ব্যাটালিয়নের দায়িত্বের অধীনস্থ যত গ্রাম শহর ছিল সবগুলোকে এক এক করে উগ্রবাদী মুক্ত করে ফেলেছিলাম আমরা। আমাদের মত অন্যান্য ‘ব্যাটালিয়ন’ও ওই একই কাজ করেছিল।
একদিকে যেমন আর্মি অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছিলো তেমনি অন্যদিকে পাঞ্জাব পুলিশ ও তৎপর হয়ে পড়ে। ঠিক কয়েক মাস পরই ১৯৮৮ সালের মে মাসে তদানীন্তন পাঞ্জাব পুলিশের মহা নির্দেশক অর্থাৎ ‘ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ’ কানোয়ার সিং গিল সংক্ষেপে DGP KPS Gill-এর নির্দেশে পাঞ্জাব পুলিশের তরফ থেকেও পাঞ্জাবের উগ্রবাদ কবলিত অঞ্চলগুলিতে চালানো হয় উগ্রবাদ দমনকারী অপারেশন যার নাম “অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার”। শক্ত হাতে হাল ধরেন DGP KPS Gill আর অপেরেশনের প্রারম্ভেই তিনি শক্তিশালী করেন পুলিশের ‘আর্মামেন্ট সিস্টেম’। তাঁরই দুর্বার নেতৃত্বের অধীনে এবং শক্ত হাতের রণনীতিতে “অপারেশন ব্ল্যাক থান্ডার” অর্জন করে উল্লেখযোগ্য সফলতা। প্রচুর উগ্রবাদী এবং সন্দিগ্ধ উগ্রবাদীকে হয় নিহত হতে হয় নয়তো বন্দিদশা পেতে হয় পাঞ্জাব পুলিশের হাতে। বিভিন্ন খবরের কাগজের আর মিডিয়ার মাধ্যমে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়ে DGP KPS Gill-এর প্রভাবশালী খ্যাতি। কেন্দ্র সরকারও স্বীকৃতি দেন তাঁর দৃঢ প্রত্যয়কে, তাঁর অবিস্মরণীয় কার্যদক্ষতাকে। এই সবের মধ্যে দিয়েই পেরিয়ে যায় আরো বছর দেড়েক। ততদিনে ধীরে ধীরে আর্মি এবং পাঞ্জাব পুলিশের যুগ্মপ্রয়াসে রাজ্যটি উগ্রবাদ মুক্ত হতে শুরু করে। রাজ্যবাসীরা স্বস্তির শ্বাস নিতে শুরু করে, জনসাধারণের মুখে ফুটে উঠতে শুরু করে শান্তির হাসি, দূরীভূত হতে শুরু হয় স্তম্ভিত জীবনযাত্রা আর ফিরে আসতে শুরু করে নিজস্ব লয় আর গতি। আর আমরা? আমরাও মুখ দেখতে শুরু করি এক শান্তিপূর্ণ জীবনযাত্রার। কিন্তু থেমে থাকেনি আমাদের সেনা জীবনের বিশেষ কার্যাবলী, ততদিনে আমরা আলোর কেন্দ্রবিন্দুকে বিদ্রোহী পাঞ্জাবের উপর থেকে ঘুরিয়ে যুদ্ধকালীন প্রস্তুতির প্রতি ঘনীভূত করতে শুরু করি। ওই যে কথায় বলে না, “হোয়েন ইন পিস, প্রিপেয়ার ফর ওয়ার।”
ক্রমশঃ