মসির ধারায় অসির ধার (39)
সঞ্জীব মুখার্জী
“All take offs are optional but every landing is mandatory. If the birds are walking, it means it is probably a bad day for flying for them but a great pilot is who always believe in turning all the challenges into opportunity.”
- Air Marshal Subroto Mukherjee
সময়টা ১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিক। আমাদের ব্যাটালিয়ন তখন কাশ্মীরের শ্রীনগরের নিকটে অবস্থিত গুলমার্গ থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত অনেক উচ্চতা বিশিষ্ট ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ এবং স্বল্প জনবসতি পূর্ণ একটি স্থান যার নাম “চোরখুড” সেখানে ওয়ার এক্সারসাইজের বিভিন্ন কার্যাবলীতে লিপ্ত। এই এক্সারসাইজের কাজ সম্পূর্ণ করতে সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়নকে থাকতে হবে ৬ সপ্তাহ মতো। “চোরখুডে” পৌঁছনোর অব্যবহিত পরই আমার সঙ্গে একের পর এক কয়েকটি আশাতীত ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো এবং যেগুলির কথা আমি আপনাদের আমার এই গল্পের আগের পর্বেই বলেছি, কিন্তু সময়ের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এবং সেখানে সপ্তাহ দুয়েক থাকার পর জায়গাটিকে আমাদের সকলের একটু একটু করে ভালো লাগতে লেগেছিলো। সেখানে থাকাকালীন চারপাশের এলাকাগুলি ঘুরে দেখতে দেখতে সেই স্থানটির সম্মন্ধে খুব ভালো পরিচিতি ও হয়ে গিয়েছিলো। আশেপাশে যে সমস্ত লোকালয় গুলি বিদ্যমান সেগুলির দূরত্ব আমাদের ক্যাম্প সাইট থেকে কিছু না হলেও ৪ থেকে ৫ কিমি মতো। লোকালয়গুলি বেশ ফাঁকা ফাঁকা এবং পাহাড়ের গায়ে অবস্থিত আর একটি লোকালয় থেকে আরেকটি লোকালয়ের দূরত্ব ৪ – ৫ কিমি মতো। সেখানে জনবসতি ঘন না হওয়ার প্রধান কারণ হলো সেখানকার ভৌগোলিক পরিস্থিতি, জলবায়ু, অর্থোপার্জনের সুযোগের অভাব, অতি ক্ষীণ পরিবহন ব্যবস্থা এবং জীবিকা নির্বাহের অসংগতি। যারা সেই গ্রামগুলিতে বসবাস করে তাদের বেশিরভাগই হলো পশুপালক সম্প্রদায়ের আর বাকিরা তাদের স্বল্প চাষজমির উপর নির্ভরশীল। এমতাবস্থায় এই সমস্ত গ্রামবাসীদের জীবিকা নির্বাহ যে কতখানি কষ্টসাধ্য তা বলাই বাহুল্য। লোকালয়গুলি ঘুরে বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিটি লোকালয়ে বড়োজোর দুটি কিংবা একটি ছোট্ট দোকান আর তাতেই চাল ডাল তেল নুন থেকে আরম্ভ করে তরিতরকারী যাবতীয় জিনিস উপলব্ধ। সেখানকার পরিস্থিতির বিশদ রিপোর্ট পাঠানোর পর আমাদের উচ্চতর হেডকোয়ার্টার অর্থাৎ ৫৬ মাউন্টেন ব্রিগেডের নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের ব্যাটালিয়ন আর্মির “সিভিক অ্যাকশন স্কিম” এর অন্তর্গত কিছু বিশেষ সুবিধা যেমন খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র, পোশাক পরিচ্ছদ, ইত্যাদি অর্থনৈতিকভাবে দুঃস্থ এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত গ্রামবাসীদের বন্টন করে। এই স্কিম এর প্রধানতঃ দুটি সুফল, এক অভাবী গ্রামবাসীদের কে সরকারী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদের কে উপকৃত করা আর দুই এই গ্রামবাসীদের মানসিকতায় একটি মূলভূত পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টা করা যে সরকার তাদের নিয়ে সমানভাবে চিন্তিত এবং এই গ্রামবাসীরা কোনোভাবেই যেন উগ্রবাদীদের জন্ম না দেয় অথবা তাদের আস্কারা না দেয় আর তাই তাতে সামূহিক ভাবে সমগ্র রাজ্যেরই উন্নতি। আর্মি শুধু এখানে বলেই নয়, ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে যেখানেই এই শ্রেণীর লোকজন থাকে তাদের মধ্যে “সিভিক অ্যাকশন স্কিম” এর মাধ্যমে সরকারী সুযোগ সুবিধা পৌঁছে দেয়। বর্তমান কালে আর্মি এই স্কিম কে আরো উন্নত করে এর মাধ্যমে শুধু খাদ্যদ্রব্য, ওষুধপত্র এবং পোশাক পরিচ্ছদই নয় তার সঙ্গে যোগ করেছে আরো একটি বিরাট সুবিধা – শিক্ষার সুবিধা। তাই বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে যেখানে আর্মির ক্যাম্প রয়েছে সেই অঞ্চলের আশেপাশের গ্রামগুলির অভাবী গ্রামবাসীদের জন্য বই খাতা পেন পেন্সিল এমনকি কম্পিউটার সহযোগে শিক্ষার ব্যবস্থা পৌঁছে দিয়ে আজকের সেনাবাহিনী শুধু দেশেকে সামরিক ভাবে সুরক্ষিত করতেই নয় তার সাথে সাথে দেশের বিশেষ অঞ্চলগুলিতে যেখানে সাধারণ মানুষের পৌঁছনো খুব মুশকিল সেখানে একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করে সেখানকার অসামরিক ব্যবস্থা তন্ত্রকেও একটি নতুন দিগন্ত দিতে তৎপর হয়ে উঠেছে।
এবার আমি আপনাদের বলবো “চোরখুডে” ওয়ার এক্সারসাইজ চলাকালীন কিভাবে একটি নির্ঘাত মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল আর কিভাবেই অবশ্যম্ভাবী সেই বিপদের হাত থেকে রেহাই পেয়েছিলাম। তখন ওয়ার এক্সারসাইজের চতুর্থ সপ্তাহের শুরুর দিক। দিনের দিকে সূর্য্যের প্রখর রৌদ্রতাপে চারিদিকের পাহাড়গুলি উত্তপ্ত ছিল। জঙ্গলঘন পরিবেশ থাকায় গাছপালার মৃদুমন্দ হাওয়াতে গরমের হাত থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পেয়েছিলাম। সেদিন এক্সসারসাইজের সময়সূচি অনুযায়ী ঠিক ছিল যে ব্যাটালিয়নের সকলে যুদ্ধ সাজে সুসজ্জিত হয়ে ক্যাম্প সাইট থেকে বেশ কিছুটা দূরে একটি পাহাড়ের চূড়ায় আরোহন করে সেখানে কয়েকটি নানা আকৃতির মোর্চা খনন করে সেখান থেকে যুদ্ধের মহড়া অর্থাৎ “মক প্রাকটিস” করে আবার ক্যাম্প সাইটে ফিরে আসতে হবে। সম্পূর্ণ কাজটি একটি সময় বন্ধনে আবদ্ধ এবং ঘড়ির কাঁটা ধরে করতে হবে। পরিকল্পনা মাফিক সেদিনের কাজ সম্পূর্ণ করে ক্যাম্প সাইটে ফিরতে ফিরতে আমাদের সকলের প্রায় চারটা কি সাড়ে চারটা মতন হয়ে যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে যে যার তাঁবুতে একটু বিশ্রাম নিতে চলে যায়। আমি ভাবলাম এই ফাঁকে আমি বাথরুমে গিয়ে স্নানটা সেরে ফেলি। সারাদিনের পরিশ্রমে ঘর্মাক্ত কলেবর আর ধুলোবালি লেগে খুবই নিজেই নিজেকে অস্বস্তি করছিলো। যেই ভাবা সেই কাজ। প্লাস্টিকের একটি বড়ো বালতি আর একটা মগ নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোই। এক্সারসাইজের দিনগুলির জন্য মিলিটারীর প্রথা অনুযায়ী “করোগেটেড গ্যালভানাইজড আইরন” শীট (CGI Sheet) দিয়ে আইরনের অ্যাঙ্গেল দিয়ে অস্থায়ী রূপে ব্যবহৃত সারি দিয়ে ক্যাম্প সাইটের এক কোণে কয়েকটি অস্থায়ী স্নানঘরের ব্লক বানানো হয় যাদের প্রতিটি ব্লকে ১০ টি করে স্নান ঘর থাকে এবং যাদের দরজাগুলিও CGI Sheet এর হয়। একটি কেন্দ্রীভূত স্থান থেকে একটি মোটা পিভিসি পাইপ দ্বারা সমস্ত বাথরুমগুলিতে স্নানের এবং কাপড়কাচার জন্য জল সরবরাহ করা হয়। আপনাদের এতটা বিস্তারিতভাবে এই কারণে বলছি যাতে করে আপনাদের পরবর্তী ঘটনাটা বুঝতে সুবিধে হয়। আমি মনের আনন্দে বালতি নিয়ে একটি বাথরুমে প্রবেশ করি আর তৎপশ্চাৎ টিনের দরজাটি ভিতর থেকে একটি ছিটকিনি দিয়ে বন্ধ করে দিই। তোয়ালে টি বাথরুমে টাঙানো একটি দড়িতে ঝুলিয়ে জলের ট্যাপ টির নিচে বালতিটি রেখে ট্যাপের মুখটা যেই না খুলেছি, পিছন থেকে একটি জোরালো “হিস্সস্স” শব্দ শুনতে পাই। শব্দটিকে খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে নিজের স্নানের প্রস্তুতিতেই মনোযোগী হই। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমার সেই মনোযোগ ভঙ্গ হয়ে যায়। আবার পিছন থেকে সেই শব্দ এব তা আরো জোরালো। বালতি ছেড়ে পিছন দিকে ঘুরে তাকাই আর তাকিয়ে যা দেখি তাতে আমার মেরুদন্ড দিয়ে বয়ে যায় এক শীতল শিহরণ। দেখি বাথরুমে ঢুকেই যে দরজাটি ভিতর থেকে আমি বন্ধ করে দিয়েছিলাম সেই বাথরুমের ভিতরে আর বন্ধ দরজাটির ঠিক নীচেই বসে আছে একটি কেউটে সাপ যার রং কালো কুচকুচে আর দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় মিটারের মতো, আর এই দৈর্ঘ্যের আর্ধেকটা ফণা নিয়ে একেবারে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে বুকের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে এবং সেই অবস্থাতেই পুরো উঁচিয়ে ধরা ফণাটা শূন্যে দোলাচ্ছে। সাপটি যখন ফণাটি এদিকে ওদিকে রোল করছিলো, তখন ভালোভাবে দেখতে পেলাম ফণাতে আঁকা রয়েছে একজোড়া চরণের ছাপ, বুঝতে পারলাম এ আর অন্য কিছুই নয়, স্বয়ং “স্পেক্টাকেল্ড কোবরা”, এক্কেবারে জংলী এবং গরলে পরিপূর্ণ। সাপটি হয়তো আমার বাথরুমে ঢোকার আগে থেকেই দরজার নীচটিতে ঠান্ডা জায়গা পেয়ে কুন্ডলী মেরে বসে ছিল, আমি তো তাহলে সাপটিকে ডিঙ্গিয়ে বাথরুমে ঢুকে সাপটির উপর দিয়েই বাথরুমের দরজাটি বন্ধ করি আর সেই সময় কোনোরকমে যদি সে জেগে যেত তাহলে কি যে হতো কে জানে। আমার ঢোকার পর হয়তো একটু পর সাপটি সজাগ হয়ে যায়, বিশেষ করে বাথরুমের মেঝেতে বালতিটি রাখার আওয়াজে। বাথরুমের দরজা খুলে যে বেরিয়ে পালাবার চেষ্টা করবো তার ও উপায় নেই আমার, দরজার মুখটিতেই প্রহরী হয়ে বসে আছে স্বয়ং কালরূপী কোবরা টি। দেখে আমি একদম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, যাকে বলে “টোটালী ব্ল্যাঙ্ক”, কি করি কি না করি কিছুই মাথায় আসছিলো না। অন্যদিকে নিজের উপর ভীষণ রাগ ও হচ্ছে যে এতগুলো বাথরুম থাকতে কেন যে এই বাথরুমটাকে বেছে নিলাম, আবার এটাও ভেবে মনকে স্বান্তনা দিচ্ছি যে ভাগ্যে থাকলে যে বাথরুমটা বেছে নিতাম না কেন তাতেই এনার দর্শন হতো। চিৎকার করে কাউকে সাহায্যের জন্যেও ডাকতে পারছিনা, ভয় হচ্ছে যদি আমার চিৎকারে সাপটি সজাগ হয়ে আমায় আক্রমণ করে বসে। আমি বাথরুমের ট্যাপটির কাছে দাঁড়িয়ে আছি, যদি একটু এগিয়ে যাই সাপটির দিকে তাহলে তার ছোবলের আওতায় চলে আসতে হয় আর ছোবল মারার জন্য উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাপটি যদি আমাকে তার ছোবলের আওতায় পেয়ে ছোবলটি মারে তাহলে তো কথাই নেই “এক ছোবলেই ছবি”।
আজ আমি আপনাদের এতক্ষন ধরে এত সহজে ঘটনাটার কথা বলছি, কার্যতঃ তখন কি এতটা সময় ছিল? সত্যিই তখন কিন্তু পুরো ব্যাপারটা একটা মুহূর্তের হিসাবে চলছিল, এক মুহূর্ত এদিক ওদিক হয়েছে কি একেবারে খেল খতম। যাইহোক, মনে মনে ভাবলাম এবাবে ভয় পেলে চলবে না, কিছু একটা করতেই হবে। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধিও খেলে গেলো। সাপটির উপর থেকে আমার নজর না সরিয়ে পা টিপে টিপে একটু একটু করে পিছিয়ে প্লাস্টিকের খালি বালতিটি তুলে ধরলাম আর বালতির খোলা মুখটা আমার কোমরের কাছে এমন ভাবে ধরে সাপটির সামনে দাঁড়ালাম যে সাপটি আমায় আক্রমণ করতে এলেই বালতিটা তার উপর উপুড় করে সাপটিকে ঢেকে দেব। এছাড়া আমার কাছে আর কোনো বিকল্প ছিল না কারণ আমি যদি সাপটিকে মারতে চেষ্টা করি তাহলে হয়তো বন্ধ বাথরুমে আমি আমার নিজেরই বিপদ ডেকে আনবো। এইসব ভেবে ইষ্টমন্ত্র জপ করতে করতে শরীরের সমস্ত সাহস এবং শক্তি একত্রিত করে বালতির খোলা মুখটা ধীরে ধীরে সাপটির কাছে নিয়ে গেলাম। সাপটি আমায় আক্রমণ করতে গিয়ে বালতির খোলা মুখটিকেই লক্ষ্য করে শূন্যে দু একবার ছোবলও মারে কিন্তু ব্যর্থ হয়। সাপটি তার ফণাটি এদিক ওদিক ঘোরাচ্ছে আর হিস্ হিস্ শব্দে তার পুরো শরীরটা ফোলাচ্ছে। সাপটির ঐরকম রণমূর্তি দেখে আমার যদিও খুব একটা সাহস হচ্ছিলো না, কেননা একটু অসাবধানতা অনেক বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তখন এছাড়া আর অন্য কোনো পথ ছিল না তাই নিরুপায় হয়ে আমি অত্যন্ত ধীরে সন্তর্পনে এবং সাবধানতা পূর্বক বালতিটিকে একটু একটু করে সাপটির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাই। লক্ষ্য একটাই, কোনো না কোনো ভাবে বালতিটি দিয়ে সাপটিকে ঢেকে বন্দী করে দেওয়া। ভয়ও হচ্ছিলো, এটা করতে গিয়ে যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট হই এবং সাপটি এদিক ওদিক দিয়ে বেরিয়ে এসে আমার পায়ে বা অন্য কোথাও ছোবল মারে। কিন্তু ঝুঁকি তো আমায় নিতেই হলো, বালতিটি আস্তে আস্তে সাপটির নিকট নিয়ে যেতে যেতে আর তার সঙ্গে আমার মুখ দিয়ে হালকা করে সিঁটি মারতে থাকলাম যাতে করে সাপটি সেই দিকে আকৃষ্ট হয়ে কম নড়াচড়া করে এবং একভাবে একটু স্থির হয়ে যায়। এই কৌশলটি কোনো সময় কারোর মুখ থেকে শুনেছিলাম তাই সেদিন তার ব্যবহারিক পরীক্ষা করেও দেখলাম। আর সত্যি কথা বলতে কি আমি সেদিন সেই পরীক্ষায় সম্পূর্ণরূপে সফল হয়েছিলাম, মোক্ষম ভাবে কাজ করেছিল সেই কৌশলটি। ঐযে কথায় বলে না, কারোর কাছে শেখা বিদ্যে বা জ্ঞান কখনো বিফলে যায় না, কোনো না কোনোদিন তা কাজে আসবেই। আমার সিঁটির শব্দে মুগ্ধ হয়ে সাপটি নড়াচড়া কম করে ফণাটা তুলে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো এবং আমার দিকে তাকাতে থাকলো আমিও আর বিলম্ব না করে বিদ্যুৎগতিতে সাপটির উপর বালতিটি কে উপুড় করে রাখতে সফল হলাম, এককথায় যাকে বলে সাপটিকে ঝাঁপি বন্ধ করে দিলাম। সাপসমেত বালতিটি যখন বাথরুমের মেঝের উপর রেখে দিই তখন সাপটির আর পালাবার কোন পথ থাকে না। ক্রূদ্ধ রুষ্ট কোবরা ভাইসাহেব তখন বালতিটির ভিতরে ছটফট করতে থাকে আর মারতে থাকে একের পর এক ছোবল। হয়তো নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্যই তাকে বন্দীদশা পেতে হলো তাই রাগে, ক্ষোভে আর অনুতাপে ফেটে পড়ছিলো সে আর সেটা তার হাবভাবে স্পষ্টই ছিল। সাপটিকে ঢাকা অবস্থায় মেঝেতে ঘষে ঘষেই একটু একটু করে উপুড় করা বালতি টিকে দরজার পাশ থেকে সরিয়ে একপাশে নিয়ে এলাম। দরজাটা খুলতে হবে তো। তারপর উপুড় করা বালতিটির উপর একটা পা আলতো করে রেখে বাথরুমের দরজা কোনোরকমে খুলে বাইরের দিকে আওয়াজ দিলাম। বাটালিয়নেরই দু তিনজন লোক সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো। তাদের কে উপুড় করা বালতির ভিতরে একটি আস্ত কোবরা সাপের বন্দী থাকার কথাটা জানালাম। তা শুনে তারা আমায় জিজ্ঞেস করলো যে আমি আগে চিৎকার করে কাউকে কেন ডাকিনি, যাইহোক, তারপর তারা আমায় বললো, “স্যার, আপ যাইয়ে আউর ইয়ে সাপ আউর বালটি হামারে উপর ছোড় দিজিয়ে”। আমি যত তাড়াতাড়ি পারলাম তাদের হাতে সাপ সমেত বালতিটি তুলে দিলাম আর সেখান থেকে সরে গেলাম। যেতে যেতে তাদের বলে গেলাম যে সাপটিকে যেন তারা না মারে এবং পারলে দূরে কোথাও ছেড়ে দিয়ে আসে। প্রকৃতি এই প্রাণীটিকে যতই বিষ দিয়ে থাকুক না কেন তার সঙ্গে একটা সৌন্দর্য ও তো ঢেলে দিয়েছে তাই আমি একে মারার পক্ষপাতী ছিলাম না। অবশ্যম্ভাবী একটি প্রাণঘাতী বিপদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আমার সারা শরীর তখন এক অদ্ভুত অনুভূতির মধ্যে দিয়ে বিচরণ করছে। সেদিন আর স্নান করা হলো না, অস্নাত অবস্থাতেই ফিরে গেলাম আমার তাঁবুতে। একজন জুনিয়র কে দিয়ে পরে একবালতি জল আনিয়ে ভিজা তোয়ালে দিয়ে গা হাত পা মুছে মুখ ভালো করে ধুয়ে নিজের চারপাই তে শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ করে পাওয়া একটা মানসিক আঘাতে সারা শরীর জুড়ে যেন কিরকম একটা ভাব। শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক অবসাদে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানিনা। ঘুম ভাঙলো আমার তাঁবুর সহকর্মী সৈনিক সামশের সিংয়ের ডাকে। ডিনার রেডি হয়ে গিয়েছে তাই তারই ডাক। দুজনে ডিনার করতে করতে সেদিনের কথাটা সামশের সিংকে বলতে লাগলাম, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন অভিজ্ঞতার সেই গল্প। গল্প শোনার ফাঁকে মাঝে মধ্যে আমার সাহস এবং উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসাও একটু আধটু করছিলেন সামশের সিং। তাঁর সঙ্গে গল্প করতে করতে আমিও নিজেকে একটু মানসিকভাবে ভারমুক্ত অনুভব করছিলাম। বন্ধ একটি বাথরুম যার কোনোদিক দিয়ে পালাবার পথ নেই আর সেই বাথরুমে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যের কোবরা সাপ, না হাতে একটা লাঠি না কাছেপিঠে কোথাও একটা পাথর, এক্কেবারে নিরস্ত্র অবস্থায় সেই কোবরার সঙ্গে জীবন মরণের লড়াইয়ের মুহূর্তগুলোতে আমার মানসিক পরিস্থিতির কথাটা একবার ভাবুন তো। কি হয়নি সেটা বড় কথা নয়, কি হতে পারতো সেদিন সেটা বড় বিষয়। এক্সারসাইজের বাকি দুটো সপ্তাহ নির্বিঘ্নেই এবং নিরাপদেই কেটে গেল।
“চোরখুড” থেকে ওয়ার এক্সারসাইজ সফলতাপূর্বক সম্পূর্ণ হওয়ার পর আমরা ফিরে গেলাম আমাদের ব্যাটালিয়নের পুরাতন লোকেশনে অর্থাৎ বারামুল্লায়। কিছুদিন সেখানে কার্যরত থাকার পর সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে উচ্চতর হেডকোয়ার্টার থেকে আদেশ এসে গেলো যে আমাদের সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়নকে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি করে বারামুল্লা থেকে প্রস্থান করতে হবে আর যে নতুন স্থানটি তে আমাদের যেতে হবে তার নাম “সিয়াচেন গ্লেসিয়ার”। আসলে “সিয়াচেন গ্লেসিয়ার” স্থান বললে খুবই ছোটো করে বলা হবে, পৃথিবীর সর্বোচ্চতম, শীতলতম, ভয়ঙ্করতম এবং ব্যয়বহুল যুদ্ধক্ষেত্র অথবা রণভূমি হলো এর আসল পরিচিতি। নির্ধারিত দিনে যেটি ছিল ১৯৯৯ সালের অক্টোবর মাসের ৫ কি ৬ তারিখ, আমাদের ব্যাটালিয়নের সবাই সম্পূর্ণ তল্পিতল্পা সহিত একটি বিশাল কনভয়ে করে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। আমাদের কনভয় প্রথমে শ্রীনগর থেকে NH-১ ধরে প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার যাত্রা করার পর যে জায়গাটিতে পৌঁছলো সেটি হলো লাদাখ নামক কেন্দ্রশাসিত রাজ্যের একটি স্থানে তার নাম “লেহ”। বর্তমানে লাদাখ কেন্দ্রশাসিত প্রদেশ হলেও সেই সময় এটি জম্মু এবং কাশ্মীর রাজ্যেরই একটি অংশবিশেষ ছিল। শ্রীনগর থেকে লাদাখের এই ৪৫০ কিলোমিটারের যাত্রাপথে মাঝরাস্তায় একটি জায়গায় একরাত্রি হল্ট করেছিলাম আমরা। তার কিছুদিন পূর্বেই সদ্য ভারতীয় সেনা NH-১ এর বিশেষ বিশেষ স্থানগুলিকে পাকিস্তান সেনাদের কবল থেকে মুক্ত করেছিল তাই সেই সময় NH-১ দিয়ে আসার সময় আমাদের কোনো অসুবিধে হয়নি, নিরাপদেই পৌঁছে গিয়েছিলাম আমরা লাদাখ। সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়নকে দিন তিন চারেক থাকতে হয়েছিল। সুন্দর শহর লেহ এবং লাদাখ, পর্যটকদের ভিড়ে ঠাসা থাকে এই শহর দুটি, কিন্তু তার মাত্র কয়েকমাস পূর্বেই কারগিল যুদ্ধে পাক কবলিত ভারতীয় পোস্টগুলি পুনরুদ্ধার করার পর লেহ এবং লাদাখ শহরগুলিতে খুব একটা পর্যটকদের ভিড় ছিল না। সেখানে তিন চার দিন থাকার সুবাদে আমরা শহরদুটিকে খুব ভালো করে ঘুরে ফিরে দেখলাম। সত্যিই কি সুন্দর শহর লেহ এবং লাদাখ বিশেষ করে লাদাখ। নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না এর সৌন্দর্য্যের ঘটা আর আমার পক্ষেও ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব হবে না। শহরদুটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপস্থিতিতে ভর্তি তাই এখানকার স্থানীয় সংস্কৃতি জীবন যাত্রা তিব্বতীদের মতো। সেইজন্য কেউ কেউ এই শহর দুটিকে ভারতীয় তিব্বত নামেও আখ্যা দিয়ে থাকেন। ছোট বড় নানান আকারের লেক অর্থাৎ হ্রদে ভর্তি এই শহর দুটি। এদের মধ্যে প্রধান হ্রদগুলির নাম “প্যাংগং সো”, “সো মোরিরি”, “সো কর” ইত্যাদি। এদের মধ্যে সর্ববৃহৎ হ্রদটির নাম “প্যাংগং সো” যেটি ঘন নীল জলে পরিপূর্ণ এবং প্রায় ৬৫০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে। এই হ্রদগুলির সবগুলির জল শীতকালে হিমায়িত হয়ে শক্ত বরফের মাঠে পরিণত হয় আর তখন চলে এগুলির উপর নানান ধরণের উইন্টার স্পোর্টস এর খেলা যার মধ্যে আইস স্কেটিং সব চাইতে জনপ্রিয়। দেশ বিদেশ থেকে পর্যটকরা আসেন এই ভূমিতে এই খেলার আনন্দ উপভোগ করতে।
তিন চার দিন এখানে থাকার পর অন্য আরেকটি কনভয়ে করে আমাদের ব্যাটালিয়ন রওনা দিলো “সিয়াচেন বেস ক্যাম্প” অভিমুখে যার দূরত্ব লাদাখ থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার। এই ২০০ কিলোমিটারের যাত্রাপথে তিন জায়গায় করে হল্ট ছিল যাদের কোনোটা দু দিনের কোনোটা তিন দিনের। পথ অত্যন্ত দুর্গম এবং গাছপালা বিহীন ন্যাড়া পাহাড়। কনভয়ের রাস্তায় একদিকে উঁচু পাহাড় তো আরেকদিকে সুগভীর পাহাড়ের খাল যার নিচ পর্যন্ত দৃষ্টির বাইরে। লাদাখ থেকে সিয়াচেন বেস ক্যাম্প পর্যন্ত যাওয়ার ব্যাপারটা একদম সিক্কিমের কুপুপ যাবার একই পদ্ধতিতে, ওই একই হল্ট, একই ড্রিল, একই স্টেজিং ক্যাম্প। ১০ – ১২ দিন পর আমাদের কনভয় পৌঁছোয় সিয়াচেন বেস ক্যাম্পে। বেস ক্যাম্পে ৭ থেকে ৮ দিনের এক্লিমেটাইজেশন ড্রিল অর্থাৎ সেখানকার জলবায়ুর সঙ্গে ধীরে ধীরে খাপ খাইয়ে নেওয়ার পদ্ধতি। এখানকার পদ্ধতি সিক্কিমের কুপুপে পৌঁছনোর পদ্ধতির মতো হলেও এখনকার ঠান্ডা কুপুপের ঠান্ডার থেকে প্রায় দ্বিগুন। সারা বছরে এখানে ঠান্ডা থাকে মাইনাস ৩০ ডিগ্রীর কাছাকাছি। সিয়াচেনের কেন্দ্রবিন্দুতে তাপমান মিনু ৬০ ডিগ্রী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বেস ক্যাম্প থেকে শুরু হয়ে যায় প্রায় ৮০ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত কারাকোরাম পর্বতশৃঙ্খলাতে অবস্থিত পৃথিবীর দুর্গমতম এবং শীতলতম স্থান “সিয়াচেন গ্লেসিয়ার”। গ্লেসিয়ার শব্দটা শুনে আপনারা সকলে এর মানেটা অবশ্যই বুঝতে পারছেন – “সমতল ভূমির দিকে বয়ে চলা তুষারের নদ”। সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে আমাদের ব্যাটালিয়নকে পুরো দেড় বছর থাকতে হবে কেননা ভারত সরকার এবং ভারতীয় সেনার নিয়ম অনুযায়ী এই অঞ্চলে এর থেকে বেশি সময় থাকার অনুমতি কোনো ব্যাটালিয়নের নেই। তার চাইতেও গুরুত্ত্বপূর্ণ কথা হলো বেস ক্যাম্প থেকে আরো উচ্চতায় যেটা পাকিস্তানের সংলগ্ন সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের একদম ফোর ফ্রন্ট অর্থাৎ ভারত-পাক নিয়ন্ত্রণ রেখার সংলগ্ন এলাকায় কোনো সৈনিকের ৬ মাসের বেশী থাকার কোনো অনুমতি নেই তাই ব্যাটালিয়ন তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে ব্যাচ সিস্টেমে এক একটি ভাগ ৬ মাসের জন্য ফোর ফ্রন্টে মোতায়েন থাকবে, এটাই এখানকার নিয়ম। তাদের ৬ মাস পুরো হওয়ার এক সপ্তাহ পূর্বেই বেস ক্যাম্প থেকে পরের ব্যাচটি ফোর ফ্রন্টে যাবে এবং তাদের কাছ থেকে এলাকা টেক ওভার করবে তবেই আগের ব্যাচটি সেখান থেকে বেস ক্যাম্পে নেমে আসবে।
সেখানকার জীবন যাত্রা যে কোনো সৈনিকের জন্য অত্যন্ত কষ্টের। সারা বছর কম করে ৮০ থেকে ১০০ ফুটের পুরু বরফের চাদরে আচ্ছাদিত থাকে সিয়াচেন গ্লেসিয়ার। বাঁচার জন্য সেখানকার বিশেষ পোশাক পরিচ্ছদ ECC (এক্সট্রিম কোল্ড ক্লাইমেট ক্লোথিং) অর্থাৎ স্লীপিং ব্যাগ, ম্যাট্রেস, কোট, প্যান্ট, জুতা, মোজা, দস্তানা, সান গ্লাস, মাথার টুপি, ইত্যাদি অত্যন্ত বিশেষ ধরণের কাপড়ের উপাদানে তৈরি, সবগুলোই রাশিয়া থেকে আমদানী করা। সিক্কিমের কুপুপে থাকাকালীন এইধরণের পোশাক পরিচ্ছদ আমরা ব্যবহার করেছিলাম কিন্তু সিয়াচেন গ্লেসিয়ার এর আবহাওয়া কুপুপের থেকেও শীতলতর তাই এখানকার পোশাক পরিচ্ছদও কুপুপের থেকে আরো দামী এবং আরো উত্তম। মাটির দেখা কক্ষনোই পাওয়া যায় না সেখানে। বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা খুবই স্বল্প তাই একটু চললেই হাঁফ ধরতে শুরু করে। সুতরাং সেখানে বেশী হাঁটাহাঁটি করে চলার অনুমতি নেই। সেখানকার ভৌগোলিক কারণে এবং আবহাওয়ার প্রতিকূলতার ফলে সৈনিকদের অনেককেই যে রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় সে রোগটির নাম “HAPE” অর্থাৎ হাই আল্টিটিউড পালমোনারী এডেমা, এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট হলো পুরো ফুসফুসটি জলীয় বা তরল পদার্থে ভরে যায় এবং ফলে শ্বাস কষ্ট হতে শুরু হয়, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে চিকিৎসা শুরু না হলে নির্ঘাত মৃত্যু। এই ধরণের রোগীকে নিকটতম সেনা হাসপাতালে পৌঁছনোর জন্য ২৪X৭ সেখানে চিতা হেলিকপ্টার অপেক্ষমান। ক্ষিদে এবং পিপাশা খুবই কম অনুভূত হয় তাই এখানে থাকাকালীন আমাদেরকে সর্বদা দেওয়া হয় বিশেষ খাদ্যদ্রব্য যেগুলি কম পরিমানে খেলে অথবা পান করলেও শরীরে পুষ্টির কোনো অভাব থাকবে না। এই বিশেষ খাদ্যদ্রব্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কাঠবাদাম, আখরোট, কাজু বাদাম, কিশমিশ, চিরনজী, ইত্যাদি আর পানীয় বলতে ফ্রুটি, কমপ্লান, হরলিকস, ইত্যাদি হেলথ ড্রিংক। পিপাসা পেলে জল খেয়ে পেট না ভরিয়ে আমরা খেতাম এইসব পানীয়। কোটের পকেট সর্বদাই ভর্তি থাকতো কাঠবাদাম, আখরোট, কাজুবাদাম ইত্যাদিতে যাতে করে একটু ক্ষিদে পেলেই আমরা এগুলি খেয়ে শরীরের শক্তিকে যথাযথ রাখতে পারি। সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে ফোর ফ্রন্টে থাকালীন ৬ মাসের জন্য সবুজ কাঁচা শাকসব্জী একেবারেই ভুলে যেতে হয়। সব কিছু টিনড এবং প্রসেসড, সে শাকসব্জীই হোক, আর ফলমূলই হোক আর মাছ মাংসই হোক। ডিম সেখানে সাপ্লাই করা হয় পাউডারের আকারে যাকে জল দিয়ে গুলে ওমলেট করে খাওয়া ছাড়া আর কোনো ভাবে খাওয়ার বিকল্প নেই। MRE রেশন অর্থাৎ “মীল রেডি টু ইট” এর ব্যবহার বেশী করে হয় এখানে এদের মধ্যে থাকে প্রি-কুকড পরোটা, বিরিয়ানী, পোলাও, মাংসের কাটলেট, ইত্যাদি। এছাড়া খুবই কালেভদ্রে মুখ দেখা যায় তাজা শাকসব্জী এবং ফলমূলের। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে চন্ডীগড় থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে ড্রপ করে এই সমস্ত খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দেওয়া হতো আমাদের। এখানে কোনো জিনিস পৌঁছাতে পরিবহনের খরচ এতই বেশি যে এগুলির মধ্যে যদি কোনো জিনিসের দাম সমতলে অথবা যে কোনো শহরাঞ্চলে উদাহরণ স্বরূপ ১০ টাকা হলে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে ওই জিনিসটির দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, তার মানে জিনিসের মূল্য ১০ টাকাই থাকছে কিন্তু বাকিটা পরিবহন মূল্য। তাই সিয়াচেন গ্লেসিয়ার কে পৃথিবীর সর্বোচ্চতম ব্যয়বহুল যুদ্ধভূমি ও বলা হয়ে থাকে।জল পিপাসা পেলে পাশে পড়ে থাকা বরফকে গলিয়ে তারপর তাকে ব্যবহার করা। কোনোদিন পরিষ্কার আবহাওয়াতে সূর্য্য উঠলে সান গ্লাস ছাড়া বাইরে বেরোনোর কোনো অনুমতি নেই। সান গ্লাস ছাড়া খালি চোখে শ্বেতশুভ্র বরফের উপর তাকালে সূর্যালোকের প্রতিফলনের চমকে চোখ ধাঁধিয়ে অন্ধ ও হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। এতসব বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েও ভারতীয় সেনাকে দেশ রক্ষার্থে মোতায়েন থাকতে হয় সেখানে যেখানে বাঁচার জন্য লড়াই নিজে নিজেই যে কোনো যুদ্ধের থেকেও খতরনাক।
এগুলো ছাড়া সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের সব চেয়ে ভয়াল ভয়ঙ্কর ঘটনা হলো দুটি। তার প্রথমটি হলো “ক্রেভিস” (Crevice) অর্থাৎ একটি পাহাড়ের মধ্যে ফাটল যার প্রস্থ ৩০ ফুট ও হতে পারে ৪০ ফুট ও হতে পারে আবার ৫০ ফুট ও হতে পারে আর গভীরতা? তা প্রায় ৪০০০ থেকে ৬০০০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সমস্যাটা হলো এই ফাটলটি উপর থেকে ঠাহর করা প্রায় অসম্ভব কেননা ফাটলটির সম্পূর্ণটি ঢাকা থাকে আলগা বরফের স্তরে, উপর থেকে জায়গাটি একটি তুষারে আচ্ছাদিত আশেপাশের সাধারণ স্থানের মতো লাগলেও তার ভিতর কোথায় যে লুকিয়ে আছে এই ক্রেভিস কেউ তা জানেনা। চলতে চলতে ভুল করে তার উপর পা পড়লেই ব্যাস কয়েক হাজার ফুট গর্তে তলিয়ে যেতে হবে। লুকিয়ে থাকা এই ক্রেভিসে বহু সৈনিকের প্রাণহানি হওয়ার পর আজকে এই ক্রেভিস গুলিকে চিহ্নিত করে সতর্ক বাণীর সাথে বড় বড় করে সাইন বোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবু অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে এই সব অঞ্চলে সেনাবাহিনীর কোনো পেট্রোলিং পার্টি গেলে একে অপরের সঙ্গে কোমরে দড়ি দিয়ে বেঁধে সুরক্ষিত করে তবেই এইসব অঞ্চলে ঘোরাফেরা করে। আর এখানের দ্বিতীয় ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্ঘটনাটি হলো “অভ্লঞ্চ” (Avalanche) অর্থাৎ দূরের বরফে ঢাকা পাহাড়ের অনেক উচ্চতা থেকে বিশাল বড় একটি অংশের হিমস্খলন হয় এবং তা দুর্বার দুরন্ত গতিতে নিম্নাভিমুখে অবতরণ করে। নিচের দিকে ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়তে থাকে বরফের এবং পাথরের বড় বড় চাঁইগুলি আর সেই সঙ্গে করতে থাকে বিকট গর্জন, তার আওয়াজ দূর দূরান্ত থেকে শোনা যায়। বুকের রক্তকে হিম করে দেওয়া সেই আওয়াজ, আকাশবাতাস কে কম্পমান করে দেওয়া সেই আওয়াজ। বরফ, মাটি, পাথর, ইত্যাদির নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষণে বরফের কণা গুলি উড়তে থাকে অনেক উঁচুতে দেখলে মনে হবে যেন তুষারকণিকায় মন্ডিত বিশালকায় ধূলিঝড় অথবা টর্নেডো। নীচের দিকে নামার সময় তার সামনে বরফ, পাথর, গাছপালা, ঘরবাড়ী, গ্রাম যে কোনো প্রতিরোধকই আসুক না কেন তাকে ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন করে দেয় আর নিজের মধ্যে বিলীন করে দিতে দিতে অপ্রতিরোধ্য ভাবে ধেয়ে ধেয়ে নামতে থাকে নীচের দিকে আর ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে তার আকার আর সেই সঙ্গে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে তার ভরবেগও। “অভ্লঞ্চ” আসার পূর্বানুমান পাওয়া মাত্রই আশেপাশের সমস্ত এলাকাকে করে দেওয়া হয় হাই এলার্ট। সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে থাকাকালীন আমার চোখের সামনে দুই বার ঘটে যায় এই “অভ্লঞ্চ” নামক ন্যাচারাল ডিজাস্টারটি। দূর থেকে ক্রমশ কাছের দিকে আসতে থাকে আর নিকটস্থ হতে হতে পথ পরিবর্তন করে আমাদের ক্যাম্প এরিয়া থেকে দু তিন কিলোমিটারের দূরত্বে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যায় সে “অভ্লঞ্চ”। যদিও “অভ্লঞ্চ” এলার্ট মেনে আমরা নিরাপদ স্থানে যাবার জন্য একপা ছিলাম কিন্তু তার আর দরকার পড়েনি। দু দুবার এইভাবে আমরা “অভ্লঞ্চ” নামক প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেয়ে যাই। এর অভিজ্ঞতা যে কতখানি ঘাতক তা আপনারা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবেন না।
সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে ভারতীয় সেনা বাহিনীর জাতীয় পতাকা উত্তোলন
দেখতে দেখতে এইভাবে সিয়াচেন গ্লেসিয়ারে আমাদের ব্যাটালিয়নের নিয়মমাফিক দেড় বছর সম্পূর্ণ হয়ে যাবার পর ২০০১ সালের মার্চ মাসে আমাদের ব্যাটালিয়নের পোস্টিং অর্ডার এসে যায় রাজস্থানের “কোটা” নামক শহরের, অর্ডারের শর্ত অনুযায়ী আমাদের ব্যাটালিয়নকে পরের মাসে অর্থাৎ এপ্রিল মাসে প্রস্থান করতে হবে এবং কোটায় তিন বছর থাকতে হবে। তারই সঙ্গে কাকতালীয় ভাবে আমারও ব্যক্তিগত পোস্টিং অর্ডার এসে যায় হরিয়ানায় চন্ডীগড়ের নিকট “আম্বালা” নামক একটি শহরে, আমাকেও এপ্রিল মাসে আম্বালাতে রিপোর্ট করতে হবে এবং সেখানে আমাকে তিন বছর থাকতে হবে। আমাদের ব্যাটালিয়নের কনভয়ের সঙ্গে ২০০১ সালের ১০ই এপ্রিল সিয়াচেন গ্লেসিয়ারের বেস ক্যাম্প থেকে শ্রীনগরের দিকে নামতে শুরু করি এবং তারপর বাটালিয়নেরই সঙ্গে জম্মু তাওয়ী স্টেশন পর্যন্ত আসি। জম্মু তাওয়ী স্টেশন পৌঁছনোর পর আমি ব্যাটালিয়ন থেকে বিদায় নিয়ে আম্বালা চলে আসি এবং সেখানে স্থায়ী ভাবে তিন বছর কাটিয়ে দিই। আম্বালা পৌঁছনোর কিছুদিন পর ছুটি গিয়ে আমার স্ত্রী জবা এবং কন্যা তৃষাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসি এবং আম্বালায় একদিকে পারিবারিক জীবন আরেক দিকে সৈনিক জীবন, এই দুই মিলিয়ে দেখতে দেখতে একটা গতানুগতিক জীবনধারার মধ্যে দিয়ে কেটে যায় সেখানকার তিনটি বছর। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে একদিকে যেমন আমার আম্বালায় পোস্টিংয়ের মেয়াদ ফুরিয়ে যায় অন্যদিকে ঠিক একইভাবে একই সময়ে কোটায় আমার ব্যাটালিয়নের পোস্টিংয়ের মেয়াদ শেষ হয়। নতুন পোস্টিং অর্ডার অনুযায়ী ব্যাটালিয়নকে প্রস্থান করতে হয় মনিপুর রাজ্যের রাজধানী শহর ইম্ফলের কাছে “চূড়াচাঁদপুর” নামক একটি স্থানে ভারত-মায়ানমার আন্তর্জাতিক সীমান্তবর্তী এলাকায়। ২০০৪ সালের মে মাস নাগাদ আমি যখন আম্বালা থেকে প্রস্থান করি তার কিছুদিন পূর্বেই আমাদের ব্যাটালিয়ন “চূড়াচাঁদপুর” পৌঁছে গিয়েছিলো। আমি সরাসরি সেখানে আমার ব্যাটালিয়নে রিপোর্ট করি। ভাগ্যের কেমন সমাপতন দেখুন “চূড়াচাঁদপুরে” যে এলাকার সুরক্ষার দ্বায়ীত্বে কর্তব্যরত থাকবে আমাদের ঠিক পূর্বে সেই এলাকায় কর্তব্যরত ছিল কারগিল যুদ্ধে আমাদের ব্যাটালিয়নের সহযোদ্ধা ব্যাটালিয়ন “১৩ জম্মু এবং কাশ্মীর রাইফেলস” সংক্ষেপে “১৩ জ্যাক রাইফেলস”, কারগিল যুদ্ধে ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রার বলিদান দেওয়া সুবিখ্যাত সেই ব্যাটালিয়ন, যে ব্যাটালিয়নের সঙ্গে থেকে একই সাথে আমরা কারগিলের যুদ্ধে লড়াই করেছিলাম এবং বিজয়ীও হয়েছিলাম। “চূড়াচাঁদপুরে” আমাদের ব্যাটালিয়ন চার্জ টেক ওভার করেছিল সেই “১৩ জ্যাক রাইফেলস” এর কাছে থেকে। কারগিলের যুদ্ধের সময় যিনি “১৩ জ্যাক রাইফেলস” ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড ছিলেন সেই মেজর সুব্রত মুখার্জী তখন সেই ব্যাটালিয়নের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার অর্থাৎ কমান্ডিং অফিসার (CO) কর্নেল সুব্রত মুখার্জী। আমাদের ব্যাটালিয়ন এবং “১৩ জ্যাক রাইফেলস” ব্যাটালিয়নের মধ্যে এলাকার দায়ীত্বের চার্জ আদান প্রদান কালে আবার কর্নেল মুখার্জীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, অনেকক্ষন কথোপকথন হয় আমাদের দুজনের মধ্যে। কথায় কথায় ক্যাপ্টেন বিক্রম বাত্রা যিনি ভারত সরকার দ্বারা পরমবীর চক্র (মরণোপরান্ত) উপাধিতে ভূষিত হন তাঁর কথাতেও চলে আসি আমরা এবং তাঁর কথা আলোচনা করতে করতে আমাদের দুজনের চোখই জলে ভরে আসে। আমাদের ব্যাটালিয়নের হাতে সেখানকার সুরক্ষার দায়ীত্ব তুলে দিয়ে “১৩ জ্যাক রাইফেলস” বাটালিয়নটি দেশের অন্য প্রান্তে নুতন জায়গায় এবং দেশরক্ষার নুতন কর্তব্য পালনার্থে প্রস্থান করে। আমাদের ব্যাটালিয়ন “চূড়াচাঁদপুরের” দেশরক্ষার দায়ীত্ব স্বহস্তে তুলে নিয়ে সেখানকার কর্তব্য পালনে তৎপর হয়ে যায়। উত্তরপূর্বীয় রাজ্যগুলির মধ্যে মিজোরাম এবং নাগাল্যান্ড সহ মনিপুর রাজ্যগুলি তখন ভীষণ ভাবে নাগা উগ্রবাদীদের অত্যাচারে নির্যাতিত বিশেষ করে মনিপুর রাজ্যটি। প্রতিবেশী রাষ্ট্র যেমন বাংলাদেশ, মায়ানমার প্রভৃতি থেকে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত উগ্রবাদীরা গোপনে আন্তর্জাতিক সীমারেখা পার হয়ে আমাদের দেশে অনুপ্রবেশ করে আর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গিয়ে শুরু করে দেয় তান্ডব। এদের নিষ্ক্রিয় করতে শুরু হয়ে যায় আমাদের ব্যাটালিয়নের দ্বারা মনিপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে উগ্রবাদী দমনের অপারেশন। এর পূর্বে উগ্রবাদী দমনের অপারেশনে আমরা পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরে সফলতাপূর্বক কাজ করেছি কিন্তু এখানকার উগ্রবাদীরা পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরের উগ্রবাদীদের থেকে একেবারেই আলাদা। এরা পাঞ্জাব এবং কাশ্মীরের উগ্রবাদীদের মতো মৌলবাদী এবং মগজ ধোলাই করা উগ্রবাদীদের মতো একেবারেই নয় বরং এরা সাহসী, বুদ্ধিমান আর উচ্চ শিক্ষিত এবং এরা বিশেষ একটি মিশনে টাস্ক প্রাপ্ত মিলিট্যান্ট। “এম্বুশ” (জঙ্গলের কোনো এক স্থানে দলবদ্ধ ভাবে লুকিয়ে থেকে অতর্কিতে সেনাবাহিনীর উপর হামলা চালানো), “বুবি ট্র্যাপ” (বিভিন্ন জিনিসের মাধ্যমে হঠাৎ করে সৈন্যদের ঠকিয়ে দিয়ে তাদের ক্ষতি করে দেওয়া), “IED প্রয়োগ” (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস অর্থাৎ মোবাইল ফোন, ট্রানজিস্টর রেডিও, খেলনা। ইত্যাদি দৈনন্দিন উপকরণের মধ্যে বারুদ ঢুকিয়ে তাকে ইলেক্ট্রনিক্যালি ফাটিয়ে দেওয়া) ইত্যাদিতে এরা এতই বেশী কর্মকুশলী যে এদের জুড়ি পাওয়া ভার। তাই আমাদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে এদের দমন করার অপারেশনে নামতে হয়। এইভাবে বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের মধ্যে দিয়ে কেটে যায় মনিপুরের “চূড়াচাঁদপুরে” প্রায় আড়াইটা বছর।
চূড়াচাঁদপুর, মণিপুর
তবে এতদিন ধরে আমি আমার সৈনিক জীবনের যে জীবনবৃত্তান্তের কথা আপনাদের বলে আসছিলাম, সামরিক অথবা অসামরিক, সাধারণ অথবা বৈচিত্রময় ঘটনায় পরিপূর্ণ আমার সৈনিক জীবনের যে উপলব্ধিগুলির বর্ণনা আপনাদের সামনে তুলে ধরছিলাম তা এবার আমায় থামাতে হবে। কেননা বছর আড়াই মতো “চূড়াচাঁদপুরে” থাকার পর ২০০৬ সালের নভেম্বর মাসে আমি অত্যন্ত অনিবার্য এবং ব্যক্তিগত কারণ বশতঃ স্বেচ্ছায় সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিলাম এবং আমার সেনাবাহিনীর দ্বারা প্রদত্ত উর্দি যে বিগত এবং সুদীর্ঘ ২০টি বছর ধরে নানান ভাবে আমার ব্যক্তিত্বকে সম্মান জুগিয়ে এসেছে সেই উর্দিকে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে সযত্নে আমার ঘরের মন্দিরে একটি হ্যাঙ্গারে করে টাঙ্গিয়ে রাখলাম। সেই সঙ্গে সুখে দুঃখে জড়িত দীর্ঘ ২০ বছরের সেনা জীবনের অভিজ্ঞতাটিকেও সোনায় মুড়ে যত্ন করে তুলে রাখলাম মনের মনিকোঠায়। সেনাবাহিনী থেকে সেবানিবৃতি নেওয়ার পর আমি শারীরিকভাবে আমার পরিবারের সঙ্গে থেকে পরিবারের প্রতিপালনের দায়ীত্ব তুলে নিয়ে এক্কেবারে খাঁটি এবং নির্ভেজাল একটি পারিবারিক জীবনযাত্রায় লিপ্ত হলাম।
এবার আমাকে সৈনিক জীবনের গল্পের উপসংহারে আসতে হয়। উপসংহারমূলক বিবৃতিতে বিশেষ কিছু বলার নেই আমার, আমি শুধু এইটুকুই বলবো যে আমি আপনাদের এ গল্পের শুরুতেও বলেছি আবারও বলছি যে আমি কোনো পেশাদার লেখক নই অথবা গল্প লেখার কোনো পেশাগত কৌশল আমার জানা নেই তাই আমি কোনো রচনাভিত্তিক পদ্ধতিকে না মেনে একেবারেই আমার নিজের ভাষায় এবং নিজের শৈলীতে আমার সৈনিক জীবনের জীবনী কে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে একটা নিছক প্রচেষ্টা করেছি। এ গল্প লিখতে গিয়ে গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমি হয়তো অনেক ভুল বা ভ্রান্তি করে ফেলেছি তা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত। তার জন্য আমার একান্ত অনুরোধ আপনারা পাঠকবৃন্দ নিজগুনে ক্ষমাসুলভ দৃষ্টিতে সেই সমস্ত ভুল ভ্রান্তি ক্ষমা করে দেবেন। আমি সবিনয়ে এই গল্পের প্রতিটি পাঠককে আমার সহৃদয় কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করি যাঁরা তাঁদের বহুমূল্য সময়ের কিছুটা বের করে ধৈর্য্য ধরে নিয়মিতভাবে পাঠ করেছেন এই গল্পটি। তার সঙ্গে আমি একই ভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি “জেলার খবর সমীক্ষা” সাপ্তাহিক ওয়েব পত্রিকাটির প্রতি এবং পত্রিকার সঞ্চালকের প্রতি যাঁদের দ্বারা এবং মাধ্যমে আমি আমার সৈনিক জীবনের জীবনকাহিনী কে আপনাদের সম্মুখে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছি। সর্বশেষে, আমি আমার ভাই জহর চ্যাটার্জির প্রতি বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি যিনি আমাকে সদা সর্বদা নানান ভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়ে আমায় এই গল্পটি লিখতে অনুপ্রাণিত করেছেন আর তারই সঙ্গে তিনি নিজের মূল্যবান সময়ের একাংশ প্রদান করে মধ্যরাত্রির তেল পুড়িয়ে এই গল্পের নানান ভুল ত্রুটি গুলো সংশোধন করে আমার গল্পটিকে আপনাদের কাছে পাঠনযোগ্য এবং উপস্থাপনযোগ্য করে তুলেছেন। আমি আশা করবো যে আমার এই ছোট্ট প্রচেষ্টা আপনাদেরকে আনন্দ দিতে পেরেছে এবং ভবিষ্যতে আরো উপহার আপনাদের সামনে তুলে আনার আশায় আমি রইলাম। খুব ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন আর সুরক্ষিত থাকবেন।
নমস্কার – জয় হিন্দ – বন্দে মাতরম
ধন্যবাদান্তে আপনাদের স্নেহধন্য – সঞ্জীব মুখার্জী