মসির ধারায় অসির ধার (১৩)

সঞ্জীব মুখার্জী
“Either I will come back after hoisting the Tricolor, or I will come back wrapped in it. But I’ll be back for sure.”
~ Captain Vikram Batra
৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৬, নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেস ধরে রওনা দিলাম মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদের উদ্দেশ্যে। ঔরঙ্গাবাদে যেখানে আমাদের প্রফেশনাল ট্রেনিং দেওয়া হবে তার নাম ‘আর্মি স্পেশাল ট্রেনিং একাডেমী’। ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতে অথবা প্রধান শহরে আরো বিভিন্ন যে সমস্ত রেজিমেন্টাল সেন্টার আছে সেখান থেকেও বেসিক ট্রেনিং শেষ করে সেই রেজিমেন্টের ছেলেরাও আসবে আর্মি স্পেশাল ট্রেনিং একাডেমীতে ওই প্রফেশনাল ট্রেনিং নিতে। ভারতবর্ষ ছাড়াও এমনকি আমাদের দেশের কিছু প্রতিবেশী রাষ্ট্রের যেমন শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি থেকেও তাদের ছেলেরা আসবে আমাদের সাথে ট্রেনিং নিতে। এটা আমাদের দেশের সাথে সেই সমস্ত দেশের মধ্যে একটি বিশেষ চুক্তি অনুযায়ী হয়ে থাকে। আর আমাদের প্রফেশনাল ট্রেনিং চলবে প্রায় ৯ মাস ধরে। ট্রেনিং প্রোগ্রাম অনুযায়ী ট্রেনিংয়ের ঠিক পাঁচ মাস পর একটি পরীক্ষা হবে আর সেই পরীক্ষাতে পাশ করলে সেখান থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্য ২০ দিনের মিড-টার্ম ছুটি দেবে। প্রফেশনাল ট্রেনিংটা মুখ্যতঃ থিওরি বেসড অর্থাৎ পড়াশোনা করার ব্যাপারটা একটু বেশি করেই থাকবে। তার সঙ্গে যদিও শারীরিক দিকটা থাকবে, তবে সেটা খুব হালকা ধরণের, বেসিক ট্রেনিংয়ের মতো অতটা কঠিন নয়। আমার সঙ্গে আরো ৩জন ছেলে ছিল। আমরা একসাথেই বেসিক ট্রেনিং কমপ্লিট করেছি আবার ঔরঙ্গাবাদে প্রফেশনাল ট্রেনিংও একসাথেই করবো, সুতরাং তাদেরকে আমার ব্যাচমেটই বলা চলে। বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেসে আমাদের সকলের রিজার্ভেশন করাই ছিল। রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্টাল সেন্টার-এর মাধ্যমেই আমাদের ঔরঙ্গাবাদ যাত্রার যাবতীয় বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। ট্রেনটি নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে রাত্রি সাড়ে নয়টায় ছাড়লো। আমরা আমাদের জন্য সংরক্ষিত যে যার বার্থে বসে পড়লাম। রেজিমেন্টাল সেন্টার থেকে আমাদের জন্য রাতের ডিনার প্যাক করে দেওয়া হয়েছিল। ট্রেনটি ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমরা আমাদের ডিনার সেরে ফেললাম। ভাত, ডাল, তরকারি, ডিমের কারী, স্যালাড, ইত্যাদি ছিল ডিনারের আইটেম। খাবার খেয়ে আমরা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ গল্প করতে করতে চোখে ঘুম নেমে আসলো, তাই আর দেরি না করে যে যার বার্থে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরের দিন পুরো এবং রাত পুরো ট্রাভেল করার পর তার পর দিন অর্থাৎ ৮ই সেপ্টেম্বর সকাল বেলায় পৌঁছবো ‘মনমাড’ নামক একটি স্টেশনে আর সেখান থেকে আবার একটা ট্রেন ধরতে হবে যেটিতে করে প্রায় ৪-৫ ঘন্টা জার্নি করে তারপর ঔরঙ্গাবাদ যেতে হবে। বেঙ্গালুরু এক্সপ্রেসের পুরো জার্নিটা খুব আরামপ্রদ ছিল এবং নতুন নতুন অজানা জায়গা দেখার ব্যাপারটা সত্যিই একটা আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল। যথারীতি ৮ সেপ্টেম্বর তারিখের সকাল ৯টার সময় ‘মনমাড’ স্টেশনে পৌঁছালাম আর সেখানে একঘন্টা মতো অপেক্ষা করে ঔরঙ্গাবাদগামী ‘নান্দের এক্সপ্রেস’ নামে ট্রেনটি পেলাম। যাত্রাপথেই মাঝখানে কিছু হালকা খাবার আর ফল খেয়ে লাঞ্চের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলেছিলাম আমরা চারজনই। ট্রেনটি ধরে আমরা যখন ঔরঙ্গাবাদ পৌছালাম তখন বাজে দুপুর দুটো। আমাদের লাগেজপত্র নিয়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসলাম। দিল্লিতে রেজিমেন্টাল সেন্টারেই আমাদের বলে দেওয়া হয়েছিল যে ঔরঙ্গাবাদ স্টেশন চত্বরে আমাদের জন্য আর্মির বাস থাকবে। আর হ্যাঁ ‘মনমাড’ থেকে ঔরঙ্গাবাদ যাওয়ার জন্য যখন ‘নান্দের এক্সপ্রেস’ ধরলাম তখন ঐ ট্রেনটিতে আরো বেশ কিছু ছেলের সাথে আলাপ হলো যারা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত বিভিন্ন রেজিমেন্টাল সেন্টার থেকে আসছে। তারাও ঔরঙ্গাবাদে ওই প্রফেশনাল ট্রেনিং নেবে আমাদের সাথেই।
ঔরঙ্গাবাদ স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে বিশেষ অসুবিধা হয়নি। আর্মির বাসটি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। বাসটি আমাদের সকলকে নিয়ে আর্মি স্পেশাল ট্রেনিং একাডেমীতে একটি গ্রাউন্ডে ছেড়ে দিলো। সেখানে বিশেষ ধরণের উর্দি পরা এক ডিউটি অফিসার আমাদেরকে রিসিভ করে আমাদের থাকার জন্য সুনির্দিষ্ট ব্যারাক-এ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পাঠিয়ে দিলো। সেখানকার সিস্টেমটাও অনেকটা দিল্লির রেজিমেন্টাল সেন্টারের মতোই। যাই হোক সেখানে চার পাঁচ দিন ধরে বিভিন্ন রেজিমেন্টাল সেন্টার থেকে আসা ছেলেদের নিয়ে একটি সম্পূর্ণ ট্রেনিং-এর ব্যাচ গঠন করা হলো। তারপর আমাদের সকলের একটি ‘এন্ট্রান্স এটিটুড টেস্ট’ হলো। একাডেমী-র নিয়ম অনুযায়ী প্রফেশনাল ট্রেনিং নিতে হলে সেই এন্ট্রান্স টেস্ট পাশ করা অনিবার্য। যদি প্রথমবার সেই টেস্ট কেউ উত্তীর্ণ হতে না পারে তাহলে তাকে আর একবার সুযোগ দেওয়া হবে আর দ্বিতীয় বারেও যদি সে ফেল করে তাহলে তাকে তার নিজস্ব রেজিমেন্টাল সেন্টারে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তারপর সেই সমস্ত ছেলেদের সাথে পরবর্তী কি করা হবে সেটা তার রেজিমেন্টাল সেন্টার-ই ডিসাইড করবে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই সমস্ত ছেলেদের রেজিমেন্টাল সেন্টার “undesirable” বলে আখ্যা দিয়ে তাদেরকে পার্মানেন্টলি বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, এককথায় তাকে চাকরি থেকে বেরই করে দেওয়া হয়। সুতরাং আমার মাথার উপরেও সেই চাপটা ছিল। যাইহোক, ঈশ্বরের কৃপায় আমি ভালো ‘মার্ক্স্’ নিয়েই সেই এন্ট্রান্স টেস্ট পাশ করলাম এবং আমাদের প্রফেশনাল ট্রেনিংও কয়েকদিনের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো। ঔরঙ্গাবাদ শহরটা মাঝারি গোছের কিন্তু শহরটা খুব ইম্প্রেসিভ অর্থাৎ এককথায় দারুন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন শহর ঔরঙ্গাবাদের আবহাওয়া খুব সুন্দর এবং অদ্ভুত, সারা বছর না খুব শীত না খুব গ্রীষ্ম আর না খুব বর্ষা। আমাদের একাডেমীর লোকেশনটা আরো দারুন। চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড়ে ঘেরা, ঘন সবুজ গাছপালাতে আদৃত একাডেমীর পরিবেশটা দুর্দান্ত। আমাদের একাডেমীর লাইফস্টাইল অর্থাৎ জীবনযাত্রা ছিল অনেকটা কলেজ লাইফের মতোই। দারুন লাগতো। খাওয়া দাওয়ায় মাছ, মাংস, ফল, দুধ, ডিম্, তরিতরকারি সবকিছুরই প্রাচুর্য ছিল একাডেমীতে। ট্রেনিংদাতা ইন্সট্রাক্টররা স্ট্রিক্ট হলেও খুব কেয়ারিং। সবকিছু মিলিয়ে পুরো ব্যাপারটা অ্যামেজিং ছিল।
ট্রেনিং চলাকালীন আমাদের পুরো ট্রেনিংয়ের ব্যাচকে ঔরঙ্গাবাদের মুখ্য আকর্ষণীয় জায়গাগুলো একাডেমীর তরফ থেকে দেখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই জায়গাগুলো ছিল অজন্তা, ইলোরা, দৌলতাবাদ ফোর্ট, ইত্যাদি। এই জায়গাগুলো ঔরঙ্গাবাদ শহরের বাইরে। ঔরঙ্গাবাদ শহরের ভিতর যে ঐতিহাসিক জায়গাটি আছে সেটির নাম “বিবি কা মকবরা”, এটি আসলে একটি স্মৃতিসৌধ। আগ্রার তাজমহলের আদলে তৈরী হুবহু ঐরকম দেখতে। আগ্রার তাজমহলের থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ঔরংজেব তার বেগমের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এই সৌধটি নির্মাণ করেন। দেখতে দেখতে আমাদের প্রফেশনাল ট্রেনিং কমপ্লিট হয়ে গেলো। মাঝখানে ২০ দিনের ছুটির জন্য বাড়িও ঘুরে এসেছিলাম। ট্রেনিং শেষে একটি সমারোহর মাধ্যমে একাডেমীর কমান্ড্যান্টরা আমাদের সমস্ত সফল ট্রেইনী-দের কোয়ালিফিকেশন সার্টিফিকেট প্রদান করা হলো। তারপর আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো নিজের নিজের রেজিমেন্টাল সেন্টারে যেখানে আমাদের শপথ গ্রহণ হবে একটি বিশেষ সমারোহের মধ্যে দিয়ে। শপথ গ্রহণ হয়ে গেলে আমাদের পোস্টিং করে দেওয়া হবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সীমান্তে অথবা সংবেদনশীল এলাকায়। ২০ জুন ১৯৮৭, একাডেমীতে সমস্ত ব্যাচমেটদের থেকে বিদায় নিয়ে আবার কবে কার সাথে দেখা হবে সেই আশায় আশাবাদী হয়ে আমরা ফিরে গেলাম নিজের নিজের রেজিমেন্টাল সেন্টারের অভিমুখে। আমিও আমার সঙ্গের ৩জন মিলে দিল্লির ট্রেন ধরবো বলে বেরিয়ে পড়লাম।
ক্রমশঃ