মসির ধারায় অসির ধার (১২)

সঞ্জীব মুখার্জী
“My aim is not to die for the country, but to live each day for its integrity, and defend it with every cent of my will.”
~ Field Marshal Sam Manekshaw
২২শে জুলাই ১৯৮৬, ছয় মাসের বেসিক ট্রেনিং সবেমাত্র সফলভাবে সম্পূর্ণ করতে পেরেছি। আমাদের ব্যাচের সমস্ত সফল ট্রেনিদের ২৮ দিনের মিডটার্ম ব্রেক-এ বাড়ি যাবার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তাই হৈ হৈ করে আমাদের ব্যাচের সকলে যে যার বাড়ি যাচ্ছি। তবে দুঃখ হচ্ছে ব্যাচের কয়েকজন ছেলের জন্য যারা ট্রেনিং-এ সফল ভাবে উত্তীর্ণ হতে পারেনি তাদের কথা ভেবে। তারা ছুটি তো যেতে পারছেই না উপরন্তু তাদের নেক্সট ব্যাচে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের আবার শুরু থেকে ট্রেনিং নিতে হবে। সত্যিই, বিষয়টি ছিল খুবই দুঃখের। যাই হোক সেই সমস্ত ট্রেনিদের পরবর্তী ট্রেনিং-এর সফলতার জন্য শুভকামনা জানালাম। তারপর, দুপুরের লাঞ্চ সেরে নিয়ে আমাদের জন্য রেজিমেন্টাল সেন্টারের বন্দোবস্ত করা সুনির্দিষ্ট একটি মিলিটারি বাসে উঠে একটি সিটে বসে পড়লাম। বাসটি যখন আমাদের নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশনে ছেড়ে দিয়ে আসলো তখন দুপুর তিনটে। আমি ধরবো হাওড়া নিউ দিল্লি AC ডিলাক্স এক্সপ্রেস ট্রেনটি। কেউ আমাকে বলে দিয়েছিলো যে ওই ট্রেনটি নাকি দুর্দান্ত স্পীডে চলে এবং অন টাইম পৌঁছে দেয়। ট্রেনটি নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে ছাড়ে ঠিক সাড়ে চারটায়। নিউ দিল্লি স্টেশনে নেমে নেমেই আবার MCO অফিসের দিকে ছুটলাম ওই ট্রেনে একটি রিজার্ভেশন পাওয়ার জন্য। MCO অফিসের কথা তো আমি আগেই আপনাদের বলেছি আবার বলে দিচ্ছি। MCO অফিস হলো মুভমেন্ট কন্ট্রোল অফিস অর্থাৎ এটি হলো মিলিটারির একটি অফিস যেটা সমগ্র ভারতবর্ষের বড়বড় রেল স্টেশনে অবস্থিত। এই অফিসের কাছে রেল বিভাগ দ্বারা প্রদত্ত বিভিন্ন ট্রেনের রিজার্ভেশনের কোটা উপলব্ধ। MCO অফিসের কাছে গিয়ে তাদের অনুরোধ জানালাম AC ডিলাক্স এ যদি একটা বার্থ পাওয়া যায়।
সৌভাগ্য ক্রমে MCO অফিসের কাউন্টারের লোকটি একটি রেজিস্টার বের করে সেটা খুলে চেক করে আমাকে জানালো যে একটি বার্থ খালি আছে তাদের কোটায় হাওড়া পর্যন্ত। তারপর লোকটি আমায় জিজ্ঞেস করলো যে হাওড়া থেকে ফেরার রিজার্ভেশন লাগবে কিনা। সেটা শুনে আনন্দে আমি লাফিয়ে উঠলাম আর তারপর তাকে বললাম যে আমার ফেরার রিজার্ভেশনটা করিয়ে দিতে। সে আমাকে ফেরার তারিখটা জিজ্ঞেস করলো। আমি বললাম ১৮ই আগস্ট। লোকটি তার বের করা রেজিস্টারটি চেক করে আমায় কন্ফার্ম করলো যে বার্থ পাওয়া যাবে। সঙ্গে সঙ্গে আমি বলে উঠলাম যে করিয়ে দিতে। লোকটি আমাকে একটি ফর্ম দিয়ে সেটি ভরে জমা করতে বলল। ওটা একটা ফর্মালিটি। যাইহোক এইসব করে আমার AC ডিলাক্স ধরবো বলে যখন প্লাটফর্মে পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে বাজে ঠিক চারটে। কিছুক্ষন পরেই প্লাটফর্মে আমার ট্রেনটিকে দেওয়া হলো। দুর্গা দুর্গা করে উঠে পড়লাম আমার নির্দিষ্ট কোচে আর গিয়ে বসে পড়লাম আমার সিটে। আগে থেকেই চিঠির মাধ্যমে আমার ভাই জহরের সাথে কথা বলে ঠিক করে রেখেছিলাম যে সোজা হাওড়া যাবো আর সেখান থেকে বড়মাসির বাড়ি তারপর বড়মাসির বাড়িতে দু এক দিন থেকে জহরকে সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে সোজা সিউড়ি অর্থাৎ আমার বাড়ি। কয়েকদিন আমি জহরকে সঙ্গে নিয়েই সিউড়ি থেকে এখন ওখান করে বেড়াবো অর্থাৎ আমার আত্মীয় স্বজনদের বাড়ি গিয়ে ঘুরে আসবো। এই সব ঘোরাঘুরির ব্যাপারে জহর এককথায় রাজি হয়ে গিয়েছিল। ট্রেনে উঠে বসে কবে কোথায় যাবো তার একটা রাফ প্ল্যান চক আউট করছিলাম। কতদিন পর আবার বাবা মা, আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে দেখা হবে। সবাই আমার দিল্লির ট্রেনিং জীবনের অভিজ্ঞতার কথা শোনার জন্য উৎসুক হয়ে বসে আছে। এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ভীষণ আনন্দ হচ্ছিলো, তর সইতে চাইছিলো না, কখন বাড়ি যাবো। ট্রেনটি যথা সময়ে অর্থাৎ ঠিক বিকাল সাড়ে চারটেয় ছেড়ে দিলো। পরদিন বিকাল চারটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম হাওড়া। হাওড়া স্টেশনে জহর চলে এসেছিলো আমাকে রিসিভ করতে। হাওড়াতে নেমে জহরকে নিয়ে সোজা বড় মাসির বাড়ি। বড়মাসির বাড়িতে সেই দিনটা আর তার পরের দিনটা থেকে সেখান থেকে ভাই জহরকে নিয়ে সিউড়ির ট্রেন ধরে বাড়ি। বাড়িতে বাবা মা ছাড়া আরো অন্যান্য আত্মীয়রা সকলে উদগ্রীব হয়ে বসেছিল। জহরকে নিয়ে খুব ঘোরা ঘুরি করতে করতে, বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা মারতে মারতে ছুটির দিনগুলো দেখতে দেখতে কেটে গেলো। চলে এলো দিল্লি ফিরে যাওয়ার পালা। তবে এবার অতটা মন খারাপ করছিলোনা, আসলে অনেকটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিলো তো তাই। তার উপর আবার বেসিক ট্রেনিংটাও কমপ্লিট করে ফেলেছি। দিল্লি ফিরে ফিরেই প্রফেশনাল ট্রেনিং-এর জন্য আবার মহারাষ্ট্রের ঔরঙ্গাবাদ যাওয়া। তাই এইসব নিয়ে মনটা ওই দিকেই একটু ব্যস্ত ছিল। ছুটি কাটিয়ে ১৮ই আগস্ট ১৯৮৬ তারিখে দিল্লি ফিরে এসে জানতে পারলাম যে আমাকে কিছুদিন পরেই সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে ঔরঙ্গাবাদ যেতে হবে। যথারীতি এসে গেলো ৬ সেপ্টেম্বর। নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে কর্ণাটক এক্সপ্রেস ধরে ঔরঙ্গাবাদ এর উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
ক্রমশঃ