মসির ধারায় অসির ধার (১0)

সঞ্জীব মুখার্জী
“Heroism doesn’t always happen in a burst of glory, sometimes small triumphs and large hearts change the course of history.”
~ Mary Roach
২৬শে ডিসেম্বর, ১৯৮৫ সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত্রি নেমে এসেছে। সন্ধ্যা ৭ টায় হাওড়া স্টেশন থেকে ছেড়ে আসা দিল্লিগামী ট্রেনটিতে আমায় বার্থে বসিয়ে আমার ভাই জহর বাড়ি চলে গিয়েছিলো। জহরের চলে যাওয়ার পর তখন মনটা ভীষণ খারাপ করছিলো। খুব চেষ্টা করছিলাম মনটাকে নানানভাবে স্বান্ত্বনা দিয়ে শান্ত করতে। জীবনে প্রথমবার বাড়ি ছেড়ে এতদূর পথে পাড়ি দিয়েছি তাও আবার দিল্লি। একেবারেই অচেনা লোক আর অজানা শহর। দূরপাল্লার সুপারফাস্ট ট্রেনে চাপার অভিজ্ঞতাটাও জীবনে প্রথম। ট্রেনে বসে কাজ ও তেমন কিছু ছিল না আমার কাছে। ব্যাগের ভিতর থেকে একটা ম্যাগাজিনে বের করে পাতাগুলোতে চোখ বোলাবার চেষ্টা করছি আর আলতো করে পাতাগুলো ওল্টাচ্ছি। মন বসাতে পারছি না। মাঝেমাঝে ট্রেনের ভিতর বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছি। বাইরেটা বড্ড অন্ধকার আর রাতের অন্ধকার চিরে সুপারফাস্ট কালকা মেল্ তখন ছুটে চলেছে দুর্বার গতিতে। কোনো বাধাই যেন মানছেনা। নামেও সুপারফাস্ট কাজেও সুপারফাস্ট। বড় ছোট কোনো স্টেশনেই থামছেনা। সাঁই সাঁই করে স্টেশনগুলো যেন পিছনদিকে ছুটে পালাচ্ছে। আর বিপরীত অভিমুখে যাওয়া ট্রেনগুলো তো দ্বিগুন দ্রুতগতিতে পিছনদিকে ছুটে যাচ্ছে। ট্রেনটা যখন কোনো স্টেশনের উপর দিয়ে পার হচ্ছে তখন স্টেশনের আলোর একটা ক্ষীণ রেখা একটু দেখা দিয়েই মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। যতই দিল্লির দিকে এগোচ্ছে ট্রেনটা ততই যেন আমার মনখারাপের তীব্রতা বাড়ছে। বাবা, মা, ভাই, বোন, আমার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের জন্য তখন মনটা খুব ভারাক্রান্ত। রাত্রি তখন দশটা বাজে। আমার পাশের সহযাত্রীরা সকলে নিজেদের খাবার শুয়ে পড়তে পারলে যেন বাঁচে। খিদে আমার বিশেষ একটা পায়নি। তবুও তাদের দেখাদেখি আমিও জহরের দিয়ে যাওয়া প্যাকেটটা বের করে কোনোরকমে খেয়ে নিলাম। সারাদিনের শারীরিক ধকল আর মানসিক ক্লান্তির হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য ভাবলাম এবার ঘুমিয়ে পড়ি। বার্থটা খুলে একটা বেডশীট বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম। ঘুম যেন আসতেই চায় না। কিছুক্ষণ পর TTE এসে টিকিট দেখতে চাইলেন। টিকিটটা বের করে দেখিয়ে আবার শুয়ে পড়লাম। এপাশ ওপাশ করতে করতে আর ট্রেনের দুলুনিতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তার টের পাইনি। যাইহোক, সকাল বেলায় বাথরুমে গিয়ে চোখমুখ ভালো করে ধুয়ে নিজের সিটে এসে বসলাম। ততক্ষনে মনটা অনেকটাই শান্ত হয়ে গিয়েছে। ভাবলাম প্রথমটা হয়তো সবার সাথে ঐরকমটাই হয়। সিটে এসে বসার পর পাশের দু-একজন সহযাত্রী আমায় চা অফার করলেন। কিন্তু রিক্রুটমেন্ট হেডকোয়ার্টার এর নির্দেশ অনুযায়ী ট্রেনে ভ্রমণকালীন কারোর সাথে বেশি আলাপ করা বিশেষ করে মিলিটারি ম্যাটার নিয়ে আলোচনা করা এবং কারোর দেওয়া কোনো কিছু খাদ্য গ্রহণ করার বিধিনিষেধ ছিল তাই তাদের থেকে কোনো কিছু গ্রহণ না করে বিনম্র ভাবে তাঁদের ম্যানেজ করলাম।
সকালবেলার আলো আঁধারি ভাবটা কেটে গিয়ে তখন একটু একটু করে আলো ফুটতে শুরু করেছে। তবে বাইরের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছিলাম যে বাইরেটা বেশ কুয়াশাচ্ছন্ন। একটু আবছা আবছা দেখতে পাচ্ছিলাম বাইরেটা। পাশের সহযাত্রীরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলো যে ট্রেনটা তখন উত্তর প্রদেশের উপর দিয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর ট্রেনের প্যান্ট্রির একজন খাবার বিক্রেতার কাছে সকালের জলখাবার আর চা কিনে খেলাম। তারপর একটা নিউজ পেপার কিনে পড়তে পড়তে দুপুর হয়ে গেলো। ট্রেনের প্যান্ট্রি থেকে একজন দুপুরের খাবারের অর্ডার নিয়ে গেলো। এবার পাশের একজন একটু বয়স্ক করে সহযাত্রী আমায় সরাসরি কয়েটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসলেন, “কোথায় যাবে তুমি? দিল্লি বেড়াতে যাচ্ছো না কি কোনো কাজে যাচ্ছো না কোনো আত্মীয়র বাড়ি যাচ্ছো? তোমায় দেখে মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্রথমবার এতদূর যাচ্ছো।” এতক্ষণে আমি নীরবতা ভঙ্গ করে খুবই সংক্ষেপে তাঁর সবকটি প্রশ্নের উত্তর দিলাম। শুধু এইটুকু তাঁকে বললাম যে আমি আর্মি জয়েন করতে যাচ্ছি এবং দিল্লিতে আমার ট্রেনিং হবে। আর সেইটুকু শুনে ভদ্রলোক খুব উৎফুল্ল হয়ে আমায় অভিনন্দন জানালেন। বললেন, “বাঃ খুব ভালো, তোমরাই দেশের আসল সম্পদ আর দেশের ভবিষ্যৎ।” শুনে আমিও মনে মনে খুব গর্ব বোধ করছিলাম। এমনকি তাঁর দেখাদেখি পার্শ্ববর্তী দু-এক জন সহযাত্রী যাঁরা শুনছিলেন আমাদের কথোপকথন তাঁরাও স্মিত হাসির সঙ্গে আমায় অভিনন্দন জানালেন। ব্যস, আমার চাকরির বিষয়ে এর বেশি তাঁদের কিছু বলিনি আর বলতেও পারতাম না কেননা আমার উপর সেই রকম বিধিনিষেধ ছিল।
ততক্ষণে দুপুরের খাবার দিয়ে চলে গেলো প্যান্ট্রির লোকটি। খাবার খেতে খেতে তাঁদের সাথে একটু আধটু কথা বলছিলাম। একেবারে মৌনভাবে অতদূর জার্নি করতে করতে আর একঘেয়েমি কাটাতে মুখ খুলতেই হলো। তবে আমার চাকরির বিষয়ে কোনো কথা না বলে কোথায় বাড়ি আমার, বাড়িতে আর কে কে আছে, কোথায় পড়াশোনা করেছি, ইত্যাদি নিয়েই কথা হচ্ছিলো। আমার সহযাত্রীরা বললেন যে তাঁরা শিমলা যাচ্ছেন, তাই ওই ট্রেনটিতে তাঁরা কালকা অব্দি যাবেন আর তারপর কালকা থেকে আবার একটা মিটারগেজের ট্রেন ধরে শিমলা যাবেন। লোকগুলোর সাথে গল্প করতে করতে আরো কিছুটা সময় কেটে গেলো। ইতিমধ্যে ট্রেনটি একটি স্টেশনে থামলো। স্টেশনটি অনেক বড়। প্লাটফর্মের সাইন বোর্ডে লেখাটা পরে বুঝতে পারলাম স্টেশনটা কানপুর। কানপুর পৌঁছানোর পর লোকগুলো নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিলো ট্রেনটা নাকি দুই তিন ঘন্টা দেরিতে চলছে। দেরি হওয়ার সম্ভাব্য কারণটা হয়তো চারিদিকের কুয়াশাঘন বায়ুমণ্ডল এবং দুর্বল দৃশ্যমানতা, যার ফলে ট্রেনটির গতিবেগ শিথিল হয়ে গিয়েছিল।
যাই হোক, এইভাবে দুপুর গড়িয়ে বিকাল আর বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। নির্ধারিত সময়সূচি অনুযায়ী ট্রেনটির দিল্লি পৌঁছনোর কথা ছিল সন্ধ্যা সাতটায়। কিন্তু মাঝরাস্তায় বিলম্বে চলার ফলে ট্রেনটি যখন দিল্লি পৌঁছলো তখন রাত্রি সাড়ে দশটা। স্টেশনটি ছিল পুরোনো দিল্লিতে আর সেখানে ট্রেনটি এক ঘন্টার জন্য দাঁড়ায়। তাড়াহুড়ো না করে ধীরে সুস্থে প্লাটফর্মে নামলাম। ট্রেন থেকে নামবার সময় সহযাত্রীরা আমার লাগেজগুলো নামাতে সাহায্য করে দিলো। এবার আমার আসল সমস্যাটা শুরু হলো। হিন্দি জানতামনা, অবশ্য একদম জানতামনা বললে ভুল হবে, হিন্দি সিনেমা দেখে আর টিভিতে ক্রিকেটের ধারাভাষ্য শোনার জন্য হিন্দি বুঝতে একটু একটু পারতাম কিন্তু বলতে একদম জানতাম না। প্লাটফর্মে নেমে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিলো। কিভাবে স্টেশন থেকে বাইরে বেরোবো, বাইরে বেরিয়ে কিভাবে রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্টাল সেন্টার পৌঁছবো, অত রাত্রে বাস ট্যাক্সি অটো কি পাবো এইসব সাতপাঁচ ভাবছি তখন হটাৎ মনে পরে গেলো যে দিল্লি স্টেশনে নেমে আমার কোনো রকম অসুবিধা হলে MCO অফিসের সাহায্য নিতে হবে সেইরকমটা আমাকে কলকাতার অফিসে বলে দেওয়া হয়েছিল । আর তখনই দেখলাম প্লাটফর্মের উপর উর্দিপরা দুজন পুলিশের লোক টহল দিচ্ছে। আর কোনো কিছু না ভেবে তাদের জিজ্ঞেস করতে চেষ্টা করলাম যে MCO টা কত নম্বর প্লাটফর্মে। কিন্তু হিন্দি বলতে না জানার জন্য শুধু এইটুকু তাদের বলতে পারলাম, “হাম MCO অফিস জায়েগা, হাম মিলিটারি জয়েন করতা হ্যায়।” তা শুনে পুলিশদুটো একটু কৌতুক পাচ্ছিলো। আমার ভাষা ঠিক মতো বুঝতে না পেরে আমায় ঘুরে প্রশ্ন করলো, “কেয়া?” আমি আবার উত্তরটা রিপিট করলাম, “হাম MCO অফিস জায়েগা, হাম মিলিটারি জয়েন করতা হ্যায়।” পুলিশ দুটোর একজন হয়তো আমার মনোভাব বুঝতে পেরেছে তাই আমাকে জিজ্ঞেস করলো উত্তর, “ও আচ্ছা আচ্ছা, MCO অফিস জানা হ্যায়? ফৌজ জয়েন করনা হ্যায়?” যাক অবশেষে বোঝাতে পেরেছি তাহলে। অধীর আগ্রহে আমি জবাব দিলাম, “হাঁ হাঁ।” একটু আত্মবিশ্বাস পেয়ে পুলিশদুটোকে আবার বললাম, “প্লিজ হেল্প, হাম বেশি হিন্দি নেহি জানতা।” সেটা শুনে পুলিশদুটো হাসতে হাসতে আমাকে অভয় দিয়ে বললো, “ফিকর মত্ করো, হাম আপকো MCO অফিস পৌঁছা দেঙ্গে।” সেটা বলে ওরা আমাকে ওভার ব্রিজ দিয়ে এক নম্বর প্লাটফর্মে নিয়ে আসলো আর তারপর MCO অফিসের সামনে নিয়ে এসে ছেড়ে দিলো। কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি নিয়ে করজোড়ে তাঁদের কে বললাম, “থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ স্যার।” তাদের একজন আমার জোড় করা হাতদুটোকে চেপে ধরে প্রতুত্তরে বললো, “কোই বাত নেহি, মন লাগা কে ফৌজ মে নোকরি করনা, ডরনা য়া ঘাবড়ানা নেহি” আর একথা বলে তারা অন্যদিকে টহল দিতে চলে গেলো।
MCO অফিসে বেশ কয়েকজন উর্দিপরা মিলিটারির লোককে বসে কাজ করছে, তাদের একজনকে সব খুলে বললাম, কোত্থেকে আসছি, কোথায় যাবো, ইত্যাদি। সবকিছু শোনার পর সেই লোকটি আমার ডকুমেন্ট ভেরিফাই করার জন্য দেখতে চাইলো যেটা আমাকে রিক্রুটমেন্ট হেডকোয়ার্টার থেকে দিয়েছে। ব্যাগ থেকে কাগজ গুলো দেখানোর পর তাদের মধ্যে একজন আমাকে স্টেশনের একদম বাইরে নিয়ে এসে যেখানে জলপাই সবুজ রঙের একটি মিলিটারি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে এনে ছেড়ে দিলো আর গাড়ির ড্রাইভার কে বলে দিয়ে গেলো যে আমায় যেন দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট এ রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্টাল সেন্টারে পৌঁছে দেয়। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে গাড়িটা ছেড়ে দিলো। গাড়ির ভিতর আমি জবুথবু হয়ে বসে আছি। ভীষণ শীত করছে তখন। গায়ে যদিও একটি মোটা সোয়েটার আর ব্যাগ থেকে একটি মোটা চাদর বের করে মুড়ি দিয়েই ছিলাম, তবুও যেন শীত বাগ মানতেই চায়না। স্টেশন চত্বর থেকে বাইরে বেরিয়ে দিল্লি শহরের বিভিন্ন অঞ্চল-এর মধ্যে দিয়ে গাড়িটা খুব স্পীডে যাচ্ছে। সারা শহর আলোয় ঝলমল করছে। চওড়া, মসৃন, পরিষ্কার আর সপাট সব রাস্তাঘাট। কোনো স্পিড-ব্রেকার বা কোনো খাল খন্দ না থাকার জন্য এতটুকু ঝাঁকানি নেই গাড়িতে বসে। বিরাট বড় শহর দিল্লি। এর আগে কলকাতা ছাড়া আর কোনো বড় শহর আমি দেখিনি।
গাড়িটা শহরের মধ্যে দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর যখন আমাকে রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্টাল সেন্টারের মেন্ গেটের সামনে নামিয়ে দিলো তখন প্রায় মধ্যরাত্রি বলা চলে। মেন্ গেটটা সুবিশাল, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, ঝকঝক তকতক করছে। হ্যালোজেনের আলোতে চারিদিক আলোময়। দিন না রাত সেটা ঠাহর করাই মুশকিল। গেটের সামনে বড়বড় করে ক্যাপিটাল লেটারে লেখা “RAJPUTANA RIFLES REGIMENTAL CENTRE” আর গেটের একপাশে একটি বড় কাঁচের ঘর যেটির ভিতর রয়েছে কয়েকজন উর্দিপরা সৈনিক, তাদের কাছে রাইফেলও রয়েছে । কয়েকজন নৈশ প্রহরী গেটের সামনে ঘোরাফেরা করছে। আমাকে গেটের সামনে গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে নামতে দেখে তাদের একজন আমার দিকে এগিয়ে এলো আর এসে আমায় হিন্দিতে জিজ্ঞেস করলো, “আপ কৌন হ্যায়? কাঁহা জানা হ্যায় আপকো?” মনে মনে ভাবলাম “যা বাবাঃ আবার সেই সমস্যা।” কিন্তু তাদের সাথে বেশি কথা না বলে ব্যাগ থেকে আমার কাগজপত্র গুলো বের করে দেখালাম। দেখার পর সেই লোকটি আমাকে গেটের পার্শবর্তী কাঁচের ঘরটিতে নিয়ে গেলো। সেখানে একজন সৈনিক একটা মস্ত বড় রেজিস্টার বের করে আমার কাগজ গুলো পড়ে পড়ে সেই রেজিস্টারটিতে কি যেন সব লিখতে লাগলো। তার লেখা জোখা কমপ্লিট হলে আমায় কাগজগুলো ফেরত দিলো আর সাবধানে রাখতে বললো। পরে যখন বলা হবে তখন ওই কাগজগুলো আমায় রেজিমেন্টাল সেন্টারের হেড অফিসে জমা করতে হবে। তারপর সে একজন লোককে বললো আমাকে রেজিমেন্টাল সেন্টারের এক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে আসতে। সঙ্গের লোকটি আমাকে সাহায্য করার জন্য আমার বেডিংটা তুলে নিলো। মেন্ গেট পেরিয়ে ভিতর দিয়ে বেশ কিছুটা গিয়ে একটি বড় মতো বিল্ডিং-এর মধ্যে যে জায়গাটিতে আমায় ছেড়ে দিলো সেটি ছিল মস্ত বড় একটি হলঘর আর তাতে সারি দিয়ে লোহার পাইপের তৈরি খাট বেছানো। মেন্ গেট থেকে সঙ্গে করে নিয়ে আসা লোকটি আমাকে ওই বিল্ডিং-এর একজন দায়িত্ববান লোকের দায়িত্বে আমায় ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলো। ঐধরণের বিল্ডিংগুলোকে মিলিটারিতে বলা হয় “ব্যারাক”। খাটগুলোর বেশিরভাগ ছিল খালি আর কয়েকটিতে লেপ মুড়ি দিয়ে লোক শুয়ে ছিল। ব্যারাকের ওই ভারপ্রাপ্ত লোকটি আমায় যেকোনো একটি খালি খাটে শুয়ে পড়তে বললো। আমার কাছে হালকা বেডিং ছিল তাতে হয়তো ঐরকম শীত কাটতো না। তা দেখে ব্যারাকের লোকটি আমাকে দুটি নতুন ব্ল্যাঙ্কেটও বের করে দিলো আর সেই সঙ্গে আমায় বলল যে আমার যদি কোনোরকমের অসুবিধা হয় তাহলে যেন আমি তাকে তা জানাই। আমার সঙ্গের বেডিং আর ওই ব্ল্যাঙ্কেটগুলো মিলিয়ে খুব আরামেই রাত্রিটা কাটলো।
সকাল বেলায় ঘুম ভাঙলো একজনের ডাকে। “চায় পি লিজিয়ে” বলে এক গ্লাস ভর্তি চা দিয়ে গেলো। সকালে ভীষণ শীত। চা খেতে খেতে, চা দিতে আসা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলাম বাথরুমটা কোন দিকে। চা খাওয়া হয়ে গেলে লোকটি আমায় ওই ব্যারাকের সামনে একটি বড় বারান্দা দিয়ে বারান্দার একপ্রান্তে নিয়ে গিয়ে বাথরুমটা দেখিয়ে দিলো। ব্যারাকের সামনে সবুজ ঘাসে ভর্তি একটি বিশাল বড় লন। খুব লোভ হলো লনটিতে নামতে। কাছে গিয়ে দেখি ঘাসের উপর পড়া শিশির বিন্দুগুলি চকচক করছে। এতই শীত যে শিশিরবিন্দুগুলি জমে বরফে পরিণত হয়ে গিয়েছে। প্রাতঃকৃত্য সেরে আসার পর দেখি ব্রেকফাস্ট এসে গেলো। ইয়া বড়বড় পুরি, এতটা করে তরকারি আর গ্লাস ভর্তি চা। ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেলে ভারপ্রাপ্ত লোকটি এসে বললো যে সে দশটার সময় এসে আমায় রেজিমেন্টাল সেন্টারের হেড অফিসে নিয়ে যাবে তাই আমি যেন তার আগে সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে তৈরি থাকি। সময়মতো গিয়ে হেড অফিসে আমার সমস্ত ডকুমেন্ট, এডুকেশনাল সার্টিফিকেটস জমা দিয়ে আসলাম। তারপর আমায় বললো ওই রেজিমেন্টাল সেন্টারেই আমার বেসিক ট্রেনিং হবে, তবে তা হবে দিন দশেক পর কেননা ট্রেনিংটা ব্যাচ সিস্টেমে হবে আর তখন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেসমস্ত ছেলেরা রিক্রুট হয়ে আসছে তাদের নিয়ে ব্যাচ গঠন হচ্ছে। ব্যাচ গঠন সম্পূর্ণ হতে দিন দশেক মতো লাগবে আর তারপর সেই ব্যাচের সাথেই আমার ট্রেনিং হবে। এই আট দশ দিন আমাকে কিছু হালকা শারীরিক অনুশীলনী, পুরো রেজিমেন্টাল সেন্টারের অন্তর্বর্তী এলাকা পরিচিতি, ইত্যাদির মাধ্যমে কাটাতে হবে। শুরু হলো সকালে ফিজিক্যাল ট্রেনিং আর দুপুর দিকে এলাকা পরিচিতির প্রক্রিয়া। রেজিমেন্টাল সেন্টারটি দিল্লি ক্যান্টনমেন্ট এর অনেকটা জায়গা জুড়ে, চারিদিকে কাঁটাতারের বেড়া আর সবকিছু রেজিমেন্টাল সেন্টারের ভিতরেই। পোস্টঅফিস, দোকানপাট, ক্যান্টিন, ষ্টুডিও, টেলারিং শপ, নার্সারি, স্কুল, PT গ্রাউন্ড, প্যারেড গ্রাউন্ড, সবকিছু। সর্ব প্রথম যে কাজটি করলাম সেটি হলো পোস্ট অফিসে গিয়ে সেখান থেকে কয়েকটি ইনল্যান্ড খাম নিয়ে বাড়িতে বাবা-মাকে, জহরকে, ছোড়দাকে আর কার্তিকদা’কে চিঠি লিখে প্রাথমিকভাবে পৌঁছানোর সংবাদটা জানালাম। তারপর শুরু হলো আমার ট্রেনিং আরম্ভ হওয়ার অপেক্ষা।
ক্রমশঃ