August 21, 2025

মসির ধারায় অসির ধার (৯)

সঞ্জীব মুখার্জী 

 

“When you undervalue what you do, the world will undervalue what you are.” 

~ Oprah Winfrey

 

অবশেষে এসে গেলো সেই মাহেন্দ্রযোগ।  ১৯৮৫ সালের ৫ই ডিসেম্বর, সকালটাতে শীত বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কিছুক্ষন আগে পিওনের ডেলিভারি করা বাদামি রঙের সীল করা রেজিস্টার্ড পোস্টের আমার সেলফ এড্ড্রেসড খামটার উপর ছোড়দা তখন মনোযোগ দিয়ে চোখ বোলাচ্ছে।  তারপর সীল বন্ধ খামের উপরটা ভালোভাবে দেখার পর ছোড়দা আমায় বললো, “হ্যাঁরে শঙ্কু, এটা তো দেখছি তোর আর্মির রিক্রুটমেন্ট হেডকোয়ার্টার থেকেই এসেছে”।  এটা শোনার পর আমার বুকের পালপিটেশন যেন আরো বেড়ে গিয়েছে।  প্রচন্ড টান টান উত্তেজনায় আমি ছোড়দার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে।  ছোড়দা খামটার এক সাইড এ খুব সাবধানে ছিঁড়ে তার ভিতর থেকে একটা ভাঁজ করা কাগজ বের করে মাথাটাকে see-saw এর ভঙ্গিমায় মনে মনে পড়তে লাগলো।  ছোড়দার তখন একনাগাড়ে চিঠি পড়তে ব্যস্ত আর আমি ছোড়দার অভিব্যক্তি পড়তে ব্যস্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোড়দার চিঠিটা পড়া শেষ হয়েছে।  চিঠি পড়াটা কমপ্লিট হতেই ছোড়দা ‘অচানক’ উচ্ছ্বসিত হয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো, “আরে শঙ্কু তুই তো কেল্লা ফতে করে দিয়েছিস।” ছোড়দার ঐরকম চিৎকার শুনে আমার মা বাড়ির ভিতর থেকে বারান্দার দিকে বেরিয়ে আসলেন যেখানটিতে আমরা বসে ছিলাম আর অপর দিক থেকে ছোড়দার মা অর্থাৎ আমার জেঠুমা বেরিয়ে আসলেন। বেরিয়ে এসে জেঠুমা মাকে হাঁসতে হাঁসতে বলছে, বৌঠান এই ছেলেদুটো যখনই একজায়গাতে হবে তখনই কিছু না কিছু করবে আর আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়বে।  মা প্রত্যুত্তরে জেঠুমা কে বলছে, তা যা বলেছো দিদি। এবার মা আর জেঠুমার মিলিত প্রশ্নটা আমাদের উদ্দেশ্যে, “আবার কি করলি তোরা?” আমি কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই ছোড়দা আমার মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “কাকিমা মিষ্টি খাওয়াও মিষ্টি খাওয়াও”, তারপর হাতের কাগজটা মা আর জেঠুমাদের দেখিয়ে ছোড়দার মুখ থেকে ম্যাজিক্যাল ওয়ার্ড গুলো বেরিয়ে আসলো যার জন্য আমার এতদিনের কাঠ খড় পুড়িয়ে এত প্রচেষ্টা আর এত অপেক্ষা, “এটা শঙ্কুর আর্মির জয়েনিং লেটার।” আনন্দের আতিশয্যে তখন যেন আমার মুখ থেকে কোনো কথা সরছে না শুধু এইটুকু ছাড়া, “ও তাই?”  ছোড়দা আমার হাতে চিঠিটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, “নে, বিশ্বাস হচ্ছে না তো নিজের চোখেই দেখে নে।”  দু পাতার চিঠি।  মন দিয়ে পড়া শুরু করলাম চিঠিটা।  পড়া শেষ হওয়ার পর বুঝতে পারলাম যে চিঠিটার দুপাতা জুড়েই দেওয়া রয়েছে আর্মি’তে জয়েন করার কমপ্লিট ‘জয়েনিং ইন্সট্রাকশন’।

এবার আসি মূল বিষয়বস্তুতে অর্থাৎ জয়েনিং লেটার-এর ব্যাপারে।  জয়েনিং লেটারের শুরুতেই লেখা ছিল, “ডিয়ার মিস্টার সঞ্জীব, কংগ্রাচুলেশন্স, উইথ রেফারেন্স টু ইওর ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন এন্ড রিটেন এক্সামিনেশন হেল্ড ইন দিস হেডকোয়ার্টার্স অন 10th এন্ড 11th ডিসেম্বর 1985, উই আর প্লিজড টু ইনফর্ম ইউ দ্যাট ইউ হ্যাভ পাসড বোথ দি এক্সামিনেশনস এন্ড হ্যাভ বীন প্লেসড ইন আওয়ার মেরিট লিস্ট।  হেন্স ইউ আর হেয়ারবাই এডভাইসড টু রিপোর্ট দিস হেডকোয়ার্টার্স অন 26th অফ ডিসেম্বর, 1985 বাই 10.00 AM পজিটিভলি এজ পার ডিটেইলেড জয়েনিং ইন্সট্রাকশন্স মেনশনড বিলো…”  অর্থাৎ আগামী ২৬শে ডিসেম্বর ১৯৮৫ তারিখে কলকাতায় গোখেল রোডে অবস্থিত রিক্রুটমেন্ট হেডকোয়ার্টারে ঠিক সকাল দশটায় আমাকে রিপোর্ট করতে হবে।  তারপর ডিটেইলেড জয়েনিং ইন্সট্রাকশন এ যেগুলো লেখা ছিল সেগুলো মূলতঃ হলো, সেখানে রিপোর্ট করার পর সেই অফিস আমাকে pre-dispatch ফাইনাল মেডিকেল এক্সামিনেশন করবে তারপর তারা আমাকে কোনো একটি রেজিমেন্টের রেজিমেন্টাল সেন্টারে পাঠাবে যেখানে আমাকে একটি ব্যাচ সিস্টেমে ৬ মাসের বেসিক ট্রেনিং নিতে হবে।  বেসিক ট্রেনিং সফলভাবে কমপ্লিট হওয়ার পর চার সপ্তাহের ছুটি পাবো। ছুটি থেকে ফিরে এসে আমাকে আবার নয় মাসের প্রফেশনাল ট্রেনিং এর জন্য একটি পূর্বনির্ধারিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পাঠানো হবে।  প্রফেশনাল ট্রেনিং কমপ্লিট হলে পরীক্ষা হবে আর সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে তবে আমার শপথ গ্রহণ হবে। এরই মধ্যে একদিকে যেমন ট্রেনিং চলবে তেমনি অন্যদিকে সমান্তরালে আমার পুলিশ ভেরিফিকেশন, এডুকেশনাল সার্টিফিকেটের ভেরিফিকেশন ইত্যাদি ও চলবে।  সরকারি চাকরি তাই ওগুলো অনিবার্য।  তাই শপথ গ্রহণের পূর্বেই আমার ওই সমস্ত ভেরিফিকেশন এর ফর্মালিটিটাও কমপ্লিট হয়ে থাকতে হবে।  শপথ গ্রহণটা হবে সেই ব্যাচের সমস্ত উত্তীর্ণ সৈনিকদের সাথেই একটি “Oath Ceremony” অর্থাৎ শপথ গ্রহণ সমারোহের মাধ্যমে।  জয়েনিং ইন্সট্রাকশনে এগুলো ছাড়া আর যেগুলো লেখা ছিল তা হলো সঙ্গে আমায় যা যা নিতে হবে সেগুলো হলো আমার সমস্ত শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেটের অরিজিনালস, একটি হালকা বেডিং, তিন চারটে জামা প্যান্ট, দুটি শীত বস্ত্র, জুতো চপ্পল, কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আর হাত খরচের জন্য অনধিক ৫০০ টাকা ক্যাশ কেননা জয়েন করার পর ফার্স্ট বেতন পেতে হয়তো একটু সময় লাগতে পারে।  এটাও স্পষ্ট করে লেখা ছিল যে ট্রেনিং পিরিয়ড এ কোনোরকমের মূল্যবান সোনার গহনা, হাতের আংটি, গলার হার, ইত্যাদি সঙ্গে রাখার অনুমতি নেই।  মোটকথা ইত্যাদি ছিল জয়েনিং ইন্সট্রাকশনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

সেখানে উপস্থিত মা এবং জেঠুমাদের ঢিপ করে প্রণামটা করেই বাড়ির ভিতর ঢুকে গেলাম।  ছোড়দা ও ঢুকে গেলো তার বাড়িতে।  তবে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে ছোড়দা শুধু এইটুকু বলে গেলো যে সন্ধ্যা বেলায় ক্লাবে দেখা হচ্ছে।  ক্লাবঘরটা আমাদের বাড়ির খুব কাছেই, এককথায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বেই বলা চলে।  সন্ধ্যা বেলায় ক্লাবে আড্ডা দিতে যাবো এমন সময় দেখি বাবা অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেন।  বাড়ি ফিরে একটু চা জলখাবার খাওয়ার পর বাবাকে প্রণাম করে সুখবরটা দিলাম আর সেই সঙ্গে বাবার হাতে দিলাম আর্মির জয়েনিং লেটারটা।  বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কি কোথাও বেরোচ্ছিস?”  আমি বললাম, “হ্যাঁ বাবা, ক্লাবে যাচ্ছি একটু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে।”  শীত কালের রাত বলে বাবা আমাকে বেশি দেরি না করে একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে বললেন আর তা ছাড়া বাবা আমার সাথে আর্মিতে জয়েন করতে যাওয়ার ব্যাপারে বিশদ আলোচনা করতেও চাইছিলেন।  বেরোতে বেরোতে বাবা কে বললাম – বাবা আমি খুব তাড়াতাড়িই ফিরবো।  ক্লাবঘরে গিয়ে দেখি সেখানে ছোড়দা এবং আমার আরো বন্ধুরা অপেক্ষা করছে।  ছোড়দা আমার জেঠতুতো এবং বরিষ্ঠ দাদা কিন্তু বয়সের পার্থক্যটা কম হওয়াতে আমরা বন্ধুস্থানীয় হয়ে গিয়েছিলাম সেকথা তো আপনাদের আগেই বলেছি।  তবে বন্ধুস্থানীয় হলেও আমি ছোড়দার খুব বাধ্য ছিলাম এবং ছোড়দার সম্মানের জায়গাটা অক্ষুন্ন রেখেই।  ক্লাবে পৌঁছে দেখি তাদেরকে আমার কিছু বলার আগেই ছোড়দা আমার আর্মির এপয়েন্টমেন্ট লেটারের বিষয়ে সব বলে দিয়েছে আর সেই নিয়ে সবাই খুব উৎসাহী।  সবার মুখে একটাই কথা, “শঙ্কু, তোর এতদিনের কষ্ট, সাধনা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে প্রচেষ্টা সফল হলো।”  সকলে মিলে আমায় ধরেছে কবে খাওয়াবি বল।  আমি তাদের ‘যেদিন ইচ্ছে’ আর ‘যেটা ইচ্ছে’ তাই খাওয়াবো বলে আপাততঃ আস্বস্ত করলাম।  তারপর মিলিটারির সম্বন্ধিত নানান ব্যাপারে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা, বাড়ি থেকে সুদূরে যেতে হবে যেখানে সবাই নাকি যেতে পারে না সেই সব জায়গাতে থাকতে হবে,  নানান প্রদেশের খাবার খাওয়ার সুযোগ, সরকারি খরচায় দেশ বিদেশ ঘোরার সুযোগ,  ইত্যাদি ইত্যাদি।  যাই হোক ঐসব গল্প করে আর আড্ডা মেরে যে যার বাড়ি ফিরে গেলাম।   বাড়ি ফিরে খাবার টেবিলে বসে ডিনার করতে করতে বাবার সাথে আলোচনা শুরু হলো।  বাবার একটা প্রশ্ন দিয়েই আলোচনা পর্বের শুরুটা হলো, “তুই কি তাহলে আর্মি জয়েন করবি বলে ঠিক করেছিস?”  মনে মনে ভাবলাম যে বাবার মনে এখনো সন্দেহ আছে বোধ হয়।  বাবাকে খুব বিনীত অথচ দৃঢভাবে জানিয়ে দিলাম যে আমি আর্মিতে জয়েন করবো বলেই মনস্থ করেছি।  বাবা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে কাজের কথা শুরু করলেন।  মা তখন খাবার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের খাবার পরিবেশন করছেন।  খুশির বহিঃপ্রকাশ খুব একটা আড়ম্বর ভাবে না থাকলেও ছেলের সাফল্যে মা এবং বাবা যে আনন্দিত হয়েছিলেন সেটা বোঝাই যাচ্ছিলো।  যখন থেকে চিঠিটা হাতে পেয়েছি তখন থেকেই পুরো ব্যাপারটা আনন্দের হলেও মায়ের মুখে একটা নিরানন্দের আর যন্ত্রণার ছাপ।  আমার সরকারি চাকরি পাওয়ার এতো খুশি আর আনন্দের মধ্যে একটা জিনিস যেটা আমার চোখ এড়াতে পারেনি সেটা হলো মায়ের আংশিক মনের একটা গভীর কষ্ট।  কষ্টটা ছিল আমাকে ছেড়ে থাকার কষ্ট, কষ্টটা ছিল বাড়ির সকলকে ছেড়ে সুদূরে পারি দেওয়ার কষ্ট, কষ্টটা ছিল আমি সেখানে গিয়ে ঠিক করে খেতে পাবো কিনা তার কষ্ট, কষ্টটা ছিল আমি আরামে থাকতে পারবো কিনা তার কষ্ট।  খুব আলোড়িত হচ্ছিলো মায়ের মনটা।   সেটা বুঝতে পেরে মাকে স্তোকবাক্য দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করছিলাম।

যাইহোক এবার তোড়জোড় দিয়ে শুরু করে দিলাম গোছগাছ করা।  যদিও হাতে গোটা কুড়িটা দিন ছিল তবু বাবা এবং মা বললো যে ধীরে ধীরে গোছানো শুরু করতে যাতে করে কোনো কিছু ভুলে না যাই।  ইতিমধ্যে, একটা ইনল্যান্ড খামে কার্তিকদাকে সুখবরের সাথে উত্তরটাও লিখে পোস্ট করে দিলাম।  একই সঙ্গে আরো চিঠি লিখে আরো দুই জায়গায় সুখবরটা দিলাম যার প্রথমটা আমার হাওড়ার বড়মাসীকে আর দ্বিতীয়টা মালদার ওই মাসীকে যার বাড়িতে থেকে মালদার স্ক্রীনিং এর প্রসেসটা ক্লিয়ার করে এসেছিলাম।  এইভাবে কেটে গেলো আরো কয়েকটা দিন।  কার্তিকদার আবার একটা চিঠি এসে গেলো আমার সুখবরটা পাওয়া মাত্র।  ভীষণ খুশি কার্তিকদা আমার সুখবরটা পেয়ে।  মনে হচ্ছিলো আর্মির চাকরিটা আমি নয় কার্তিকদা পেয়েছে যেন।  অবশ্য সেরকমটাই তো হওয়া স্বাভাবিক ছিল, যা মেহনত করেছিল কার্তিকদা আমার সঙ্গে সঙ্গে।  মোটকথা কার্তিকদা আমার জন্য যা করেছিল তা জীবনে ভোলবার নয় আর সত্যি কথা বলতে কি, আমি সারা জীবন কার্তিকদার কাছে ঋণী থাকবো।  চিঠিতে কার্তিকদা আরো অনেক কথার সঙ্গে একটা বহুমূল্য কথা আমায় লিখেছিলো যে জয়েন করার আগে যেকটা দিন আমি বাড়িতে আছি চাকরি পাওয়ার আনন্দে শারীরিক অনুশীলনী থেকে দূরে সরে না যাই এবং শরীর চর্চার অভ্যাসটা যেন আমি আগের মতোই অব্যাহত রাখি কেননা এটা আমার বেসিক ট্রেনিং এর সময় কাজে লাগবে।  অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলাম আমি কার্তিকদার কথার।  কার্তিকদা আমাকে এটাও লিখেছিলো যে আমি যেই রেজিমেন্টাল সেন্টারেই যাই না সেখানে গিয়ে গিয়েই কার্তিকদাকে চিঠি লিখে জানাই যে আমি কোন রেজিমেন্টাল সেন্টারে জয়েন করেছি এবং পরবর্তীকালেও যেন কার্তিকদার সাথে চিঠির মারফত যোগাযোগটা রাখি।

২৬শে ডিসেম্বর জয়েনিং এর ডেট, তাই ঠিক করলাম দিন দুয়েক আগেই অর্থাৎ ২৪শে ডিসেম্বর সকালের ময়ূরাক্ষী ট্রেনটাতে করে যাবো হাওড়াতে বড়মাসীর বাড়ি আর সেখানে আমার ভাই জহরের সঙ্গে দুটো দিন চুটিয়ে আড্ডা মেরে ২৬ তারিখে গোখেল রোডের রিক্রুটমেন্ট হেডকোয়ার্টারে সব জিনিসপত্র নিয়ে সকাল দশটায় রিপোর্ট করবো।  আর দেখতে দেখতে এসে গেলো ২৩সে ডিসেম্বর, পরদিন আমাকে বেরোতে হবে।  বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন সকলের সাথে দেখা করে সকল গুরুজনদের প্রণাম করে তাঁদের আশীর্বাদ নিলাম।  মা আর বাবার মন ভীষণ খারাপ, বিশেষ করে মায়ের।  বাবা আবেগটা ঐভাবে প্রকাশ করতে না পারলেও বাবার মনটা যে ভারাক্রান্ত সেটা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিলো।  ২৪শে ডিসেম্বর সকাল বেলা বেরোবার সময় বাবা মাকে প্রণাম করলাম।  মা ছলছল চোখে বললেন, “খুব সাবধানে যাস আর আমাদের জন্য একদম মন খারাপ করিসনা।” আর বাবা বললেন, “মন দিয়ে ট্রেনিং করবি আর আমাদের জন্য একদম চিন্তা করবি না, কলকাতা থেকে যেখানে পাঠাবে সেখানে গিয়ে গিয়েই যেন চিঠি দিস।”

স্টেশনে পৌঁছে ময়ূরাক্ষী ফাস্ট প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে হাওড়া বড়মাসীর বাড়ি।  সুখবরটা তো আগে পেয়েই গিয়েছিলো মাসীরা।  বড়মাসী, মেসোমশাই এবং ভাইবোনেরা সবাই খুব খুশি।  বড়মাসীর বাড়িতে দুটো দিন জমিয়ে খাওয়া দাওয়া গল্প আড্ডা এই সবের মধ্যে দিয়ে কিভাবে যে কেটে গেলো তার টের ও পেলাম না।  আর তারপর এসে গেলো ২৬ ডিসেম্বর।  যথারীতি, ২৬শে ডিসেম্বর সকাল ৮ টায় সমস্ত ব্যাগ বেডিং নিয়ে আমার ভাই জহরকে সঙ্গে নিয়ে মেসোমশাই আর বড়মাসীকে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়লাম।  ঠিক দশটার আগেই পৌঁছে গেলাম গোখেল রোডের অফিসে। এবার কিন্তু মেন্ গেটের বাইরে আমার ভাই জহরকে আটকায়নি তারা।  তাই জহরকে নিয়ে আমি ভিতর অব্দি চলে গেলাম। ভিতরে একটি পূর্ব চিহ্নিত জায়গাতে যেখানে একটি সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা ছিল “NEW JOINEES REPORT HERE” সেখানে রাখা কয়েকটি চেয়ারের দুটিতে আমি আর জহর বসলাম।  কিছুক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করার পর একজন আর্মির ইউনিফর্ম পরা লোক এসে আমায় অফিসের ভিতর আসতে বললো।  আমি জহরকে সেখানে বসতে বলে অফিসের ভিতর ঢুকে গেলাম।  ভিতরে ঢুকেই আমার আবার ফাইনাল মেডিক্যাল এক্সামিনেশন হলো।  তারপর একজন কর্নেল রাঙ্কের অফিসার আমায় বললেন, “আপনি মেরিট লিস্টের টপার আর আপনি যেহেতু টপার সেহেতু আমাদের নিয়ম অনুযায়ী আপনাকে ইন্ডিয়ার পাঁচটা বিভিন্ন শহরে অবস্থিত পাঁচটা রেজিমেন্টাল সেন্টারের অপশন দেওয়া হবে, যেগুলোর মধ্যে আপনাকে যেকোনো একটি পছন্দ করার সুযোগ দেওয়া হবে।  আর তারপর আপনার পছন্দ মতো রেজিমেন্টাল সেন্টারে আপনাকে পাঠানো হবে।”  যাই হোক আমাকে যে পাঁচটি শহর দেওয়া হয়েছিল সেগুলো ছিল দিল্লি, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, ফৈজাবাদ আর লক্ষ্ণৌ।  কিন্তু দিল্লি দেশের রাজধানী এবং দেশের মধ্যে সবচেয়ে বড় শহর। চাকরীর শুরুতেই দিল্লিতে থাকবো এবং দিল্লিতে থেকে ট্রেনিং নেবো তার সুযোগ কি হাতছাড়া করা যায়। তাই বেশি কিছু না ভেবে কর্নেল সাহেবকে বলেছিলাম যে আমার দিল্লি চাই। কর্নেল সাহেব তা শুনে আমায় সাবধান করার ভঙ্গিমায় বললেন যে দিল্লিতে যে রেজিমেন্টাল সেন্টার আছে তার নাম রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্ট আর সেটা হরিয়ানার আর রাজস্থানের জাট আর রাজপুতে ভরা, তাদের নাকি ইয়া ইয়া বড় গোঁফ আর তারা নাকি বিশাল আকারের, তা আমি কি এহেন জাট আর রাজপুতদের সাথে খাপখাইয়ে সেখানে থাকতে পারবো, না কিছু দিন যেতে না যেতেই পালিয়ে আসবো। সেটা শুনে আমি এবার একটু দৃঢসচেতন ভাবেই কর্নেল সাহেবকে বললাম, “Yes Sir, I will choose Delhi.”  কর্নেল সাহেব সেটা শুনে তৎক্ষণাৎ তাঁর কর্মচারীদের বলেদিলেন যে আমার দিল্লিতে যাওয়ার সমস্ত কাগজপত্র তৈরি করা হয়। তামিল হলো কর্নেল সাহেবের হুকুমের। আমার দিল্লি যাওয়ার যাবতীয় কাগজ পত্র তৈরী করে এক দু ঘন্টার মধ্যেই তাঁরা আমায় ছেড়ে দিলেন।  বেরোবার সময় তাঁরা আমাকে সাবধান করে দিলেন যে সমস্ত কাগজপত্র আমায় দেওয়া হয়েছে সেগুলো আমি যেন খুব সাবধানে এবং যত্ন করে রাখি এবং রাজপুতানা রাইফেলস রেজিমেন্ট সেন্টারে পৌঁছনোর পর সেখানকার নির্ধারিত অফিসেই যেন জমা দিই। এছাড়াও নানারকম ভাবে গাইড করে তারপর সেখান থেকে তাঁরা পাঠালেন।  ততক্ষণে দুপুর হয়ে গিয়েছে।  জহরকে কে সঙ্গে নিয়ে অফিস পরিসরের ভিতরেই একটি ক্যান্টিনে লাঞ্চ করে নিলাম। সন্ধ্যা সাতটায় কালকা মেল, সেইটা ধরতে হবে আমায়।  রিক্রুটমেন্ট হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ অনুযায়ী হাওড়া স্টেশনে একটি MCO অর্থাৎ Movement Control Office থেকে ওই দিনের কালকা মেলের রিজার্ভেশন করিয়ে আমায় দিল্লি রওনা দিতে হবে।  জহরকে সঙ্গে নিয়ে লাগেজগুলো নিয়ে হাওড়া MCO তে খোঁজ করলাম কালকা মেলে কোনো সিট খালি আছে কিনা। ভাগ্যক্রমে একটি সিট খালি পাওয়াতে MCO থেকে একটি রিজার্ভেশন করিয়ে নিলাম।  তখন বাজে চারটে কি সাড়ে চারটে।  সন্ধ্যা সাতটায় কালকা মেল। জহর বললো যে হাতে একটু সময় বেশি থাকলে বাড়ি হয়ে আসা যেত বড়দা। আমি বললাম যে ঠিকই বলেছিস জহর, তবে রিস্ক নিয়ে লাভ নেই, তার চেয়ে বরং এখানেই গল্প করে কাটিয়ে দিই।  এই বলে হাওড়া স্টেশনে ওয়েটিং রুমে কিছুক্ষণ দুজনে গল্প করে কাটিয়ে দিলাম।  প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটি দেওয়ার এনাউন্সমেন্ট হতেই আমি আর জহর লাগেজ গুলো নিয়ে প্ল্যাটফর্মে চলে আসলাম। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে ঢোকার পর জহর আমায় আমার নির্ধারিত কোচে এবং নির্ধারিত বার্থে বসিয়ে দিয়ে “আমি এক্ষুনি আসছি বড়দা” বলে ট্রেন থেকে নেমে গেলো।  ট্রেনটা ছাড়তে তখন একটু দেরি ছিল।  কিছুক্ষন পর দেখি জহর ফিরে এলো।  হাতে তার একটা প্যাকেট।  প্যাকেটটা আমায় ধরিয়ে দিয়ে বললো, “এটা রাত্রে খেয়ে নিও।” তখনও ট্রেন ছাড়ার সময় হয় নি। আমি জহর কে বললাম, “আমার সাথে সাথে তোরও সারাদিন হয়রানি হয়েছে, তুই এবার বাড়ি যা। চিন্তা করিসনা ভাইটি, দিল্লি পৌঁছেই চিঠি দেব তোকে।”  যেতে চাইছিলো না জহর।  আমারও মন চাইছিলো না জহরকে ছাড়তে। একরকম জোর করেই পাঠালাম ওকে। দুজনেরই অশ্রুসিক্ত চোখ। জহর চলে যাবার পর মনটা খুব খারাপ লাগছিলো।  প্রতিবারই মন খারাপ করে জহরকে ছেড়ে যাওয়ার সময় কিন্তু এবারের খারাপ লাগার পরিমাণটা যেন একটু বেশিই অনুভূত হচ্ছিলো। হয়তো অন্যান্য বারের তুলনায় এবার একটু বেশিই দূরে যাচ্ছি বলে।  যথা সময়ে ট্রেনটা ছেড়ে দিলো। দিল্লি পৌঁছতে পরদিন সন্ধ্যা হবে।

                                                                                          ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *