মসির ধারায় অসির ধার (5)
সঞ্জীব মুখার্জী
“Life is a mountain and your goal is on the other side. So, don’t celebrate on reaching the peak. Remember, you have to descend first if you want to reach your goal.” – Maxim Gorky
ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর, দুপুর দুটো কি আড়াইটে বাজে তখন আমি মালদা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে অপেক্ষা করছি সিউড়ির বাসের জন্য। কিছুক্ষণ পরই একটা স্টেট বাস এসে ঢুকলো যার সামনেটাতে লেখা ছিল “দুর্গাপুর”। বাসটা এসে দাঁড়াতেই কন্ডাকটরকে জিজ্ঞেস করলাম যে বাসটা সিউড়ি যাবে কিনা, কন্ডাকটর মাথা নাড়িয়ে সায় দিতেই এক লাফে বাসটিতে উঠে পড়লাম। একটা খালি সিটও পেয়ে গেলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসটা ছেড়ে দিলো। বাসটা ছেড়ে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই ব্যাগের ভিতর থেকে কাগজপত্রের ফাইলটা বের করলাম আর বের করে তার মধ্যে থেকে খুব সন্তর্পনে কলকাতায় যাওয়ার ফাইনাল ইন্টারভিউর কল লেটারটা বের করে মনোযোগ দিয়ে পড়তে লাগলাম। আসলে কি হয়েছিল, সেই দিনই সকালে কল লেটারটা আমি হাতে পাই আর লেটারটা পাওয়ার পর মাসির বাড়ি ফিরে খেয়ে নিয়েই মাসির বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি তাই লেটারটা ভালো করে পড়া হয়নি।
“নেক্সট স্টেপ অফ সিলেকশন” এর জন্য ১০ নভেম্বর-এ কলকাতায় ঠিক কি কি ধরণের টেস্ট হবে তার বিশদ বর্ণনা ‘কল লেটার’টিতে লেখা ছিল এবং সংক্ষেপে তার কিছুটা আপনাদের বলে দিই। কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম-এর পাশে রেড রোড ক্যাম্পে ঠিক সকাল আটটাতেই পৌঁছতে হবে আমায় আর সেখানে প্রথমেই হবে ‘ফিজিক্যাল এফিসিয়েন্সি টেস্ট’। তার মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ হলো চার কিলোমিটার দৌড়ানো। আর তার সঙ্গে থাকছে – বডি ব্যালান্স টেস্ট, বিম টেস্ট, লং জাম্প ইত্যাদি। এই পরীক্ষাগুলি ঠিক কিভাবে হয় বা হয়েছে আর এই পরীক্ষাগুলির সময় কিধরণের অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে সে কথায় আমি পরে আসবো। এখন শুধু এইটুকুই বলে রাখি আপনাদের। যাই হোক, যে কথাটা বলছিলাম, ফিজিক্যাল এফিসিয়েন্সি টেস্টের দিনই বিকালবেলায় সেই টেস্টের রেজাল্ট ঘোষণা করা হবে এবং যে সমস্ত ক্যান্ডিডেটরা এই টেস্ট ক্লিয়ার করবে তাদেরই কেবল পরদিন অর্থাৎ ১১ নভেম্বর লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ডাকা হবে। লিখিত পরীক্ষায় থাকবে ম্যাথেমেটিক্স, ইংলিশ আর জেনারেল নলেজ এন্ড কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বেসড এপ্টিচুডের উপর প্রশ্ন। প্রশ্নপত্রে অবজেক্টিভ এবং সাবজেক্টিভ দুই ধরণের প্রশ্নই থাকবে। একশো করে মার্ক্স্ থাকবে তিনটি বিষয়ের প্রতিটিতে।
লেটারটা পড়তে পড়তে ঘন্টা দেড়েক পর প্রায় সাড়ে চারটেতে বাস টা উমরপুর মোড় পৌঁছালো। সেখানে চা খাওয়ার জন্য বাসটা কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। সবাইকে চা খাওয়ার জন্য নামতে দেখে আমিও চিঠিটা ব্যাগের মধ্যে আবার পুরে রেখে চা খেতে নেমে পড়লাম। চা খেয়ে আবার বাসে উঠলাম আর বাসটাও ছাড়লো। বাসে ওঠার পর ভাবতে শুরু করলাম যে এই সমস্ত পরীক্ষাগুলোর জন্য আমার ‘অনগোয়িং প্রিপারেশন’টাকে ‘মডিফাই’ করে কিভাবে আরো ‘ইম্প্রুভ’ করা যায় সেই চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়লাম। তারপর ভাবলাম আগে বাড়ি তো পৌঁছাই তারপর নাহয় দেখা যাবে। অবশ্য সেই সময় প্রস্তুতির ব্যাপারে আমার মনে কার্তিকদার কথাটাই বেশি করে আসছিলো, মনে হচ্ছিলো ১০ নভেম্বরের মধ্যে কিছুদিন যদি কার্তিকদাকে পাশে পেতাম তাহলে কি ভালোটাই না হতো। কার্তিকদা আমার ফাইনাল রাউন্ডের পরীক্ষার প্রস্তুতিতে হয়তো ‘চার চাঁদ’ লাগিয়ে দিতো। কার্তিকদাকে মনে আছে তো আপনাদের? আরে সেই কার্তিকদা, যার কথা আগে বলেছিলাম আপনাদের, আমার পাশের পাড়ার, আর্মি তে চাকরি করে। যাক মনে পড়েছে তাহলে।
ও হ্যাঁ, আর একটা জরুরি কথা, যেটা হলো, কলকাতায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সবথেকে বড়ো আকর্ষণীয় ব্যাপার যেটা আমার কাছে ছিল সেটা হলো কলকাতা মানেই আমার নিজের বড়মাসীর বাড়ি। আর আমার বড়মাসীর বাড়িতে যাওয়া, বড়মাসীর বাড়িতে থাকা আর বড়মাসীর বাড়িতে থেকে আমার পরীক্ষাটা দেওয়া, পুরোটাই আমার কাছে একটা ভীষণ আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল আর সেটা আমার কাছে কেন এত আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল সেকথায় আমি পরে আসবো। যাই হোক, এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বাসটা যখন সিউড়ি পৌঁছালো তখন রাত ন’টা কি সাড়ে ন’টা বাজে। সেই সময় রাস্তা ঘাটের হাল খুব একটা ভালো ছিল না, তাই মালদা থেকে সিউড়ি আসতে সময় একটু বেশিই লেগে গেলো। সিউড়িতে বাস স্ট্যান্ডে নেমে একটা রিকশা করে বাড়ি পৌঁছালাম। বাড়ি পৌঁছেই বাবা আর মা কে একটা প্রণাম করে শর্টকাটে শুধু এইটুকুই বললাম, মালদায় যার জন্যে আমায় ডাকা হয়েছিল সেটা আমার ‘ক্লিয়ার’ হয়ে গিয়েছে। আর এইটুকু বলে বাবার হাতে ১০ নভেম্বর-এ কলকাতায় ফাইনাল ইন্টারভিউর কল লেটার টা তুলে দিলাম; আর সেটা তুলে দিতে দিতেই মাকে বললাম, মা খেতে দাও, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে আর ঘুম পাচ্ছে। মা বললো, “ঘুম পাবারই কথা, যা ধকল গেলো কয়েক দিন। তুই হাত পা ধুয়ে নে, আমি খেতে দিচ্ছি,” বলে মা রান্না ঘরে ঢুকে গেলো। মা খাবার দিতেই আমি খেতে বসে গেলাম আর খেয়ে নিয়ে আমি বাবাকে বললাম, বাবা আমি এখন আমি ঘুমোতে যাচ্ছি, কালকে তোমাকে সবকিছু ডিটেইলে বলবো আর এই বলে আমি নিজের রুমে ঘুমোতে চলে গেলাম।
পরদিন সকালে ঘুমটা একটু দেরি করেই ভাঙলো। ঘুম থেকে উঠে মুখ টুখ ধুয়ে একটু চা বিস্কুট খেয়ে বাবার রুমে গেলাম। গিয়ে দেখি বাবা আমার কলকাতার কল লেটারটাই পড়ছেন বা হয়তো ততক্ষণে পড়ে ফেলেছেন। আমাকে দেখেই বাবা চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন। বসলাম। বাবা সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “কি করবি তাহলে, যাবি কলকাতা ?” বুঝতে পারলাম, বাবা হয়তো তখনও অতটা সিরিয়াস হতে পারেননি আমার ব্যাপারটা নিয়ে। আসলে বাবা চাইছিলেন আমি অন্ততঃ পক্ষে মাস্টার্স ডিগ্রীটা কমপ্লিট করি আর তারপর চাকরির কথা নিয়ে ভাবি আর চাকরিটাও যেন হয় সিভিলস অথবা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ লাইনে। আমি আপনাদের আগেই বলেছি যে আমার বাবা সরকারি চাকুরে ছিলেন তাই আমার চাকরির ব্যাপারে বাবার ধ্যান ধারণাটা যে ঐরকম থাকবে সেটা অস্বাভাবিক কিছু ছিলনা। বাবাকে আমি পরিষ্কার ভাবেই বললাম যে মালদার টা যখন ক্লিয়ার করে এসেছি তখন আমাকে কলকাতার টাও “ক্র্যাক” করতে হবে। বাবা একটু আমতা আমতা করেই বললেন, “বেশ ঠিক আছে, যা তাহলে।“
বাবার সাথে এইটুকু কথা বলেই বেরিয়ে গেলাম সোজা কার্তিকদার খোঁজে। কার্তিকদার বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম যে সামনেই পুজো আর পুজোতে নাকি কার্তিকদা কুড়ি দিনের ছুটিতে বাড়ি আসবে। কিন্তু ঐসময়ে পুজো আসতে সপ্তাহ দুয়েক দেরি ছিল। ভাবলাম, অন্ততঃ ততদিন তো প্রস্তুতিটা যথারীতি চালিয়ে যাই, যখন কার্তিকদা আসবে তখন নাহয় কার্তিকদার সঙ্গে আলোচনা করে সবকিছু জেনে নেওয়া যাবে। ইতিমধ্যে আমাদের পুরো মুখার্জী পরিবারে, পাড়ার সকলে এবং বন্ধুদের যাদের সাথে দেখা হলো এবং যারা যারা আমার মালদার ব্যাপারটা নিয়ে আগ্রহী ছিল তাদের সবাই কে বেশিকিছু না জানিয়ে শুধু এইটুকু বললাম যে মালদার ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গিয়েছে এবং তারা আমায় ১০ নভেম্বরে কলকাতায় ফাইনাল ইন্টারভিউর জন্য ডেকেছে। শুনে তারা প্রত্যেকেই খুব খুশি। আমার দাদুদের পাঁচ ভাইয়ের পাঁচটি বড় বড় পরিবার নিয়ে ছিল আমাদের মুখার্জী পরিবার আর যেগুলিকে মিলিয়ে হতো একটি অনেক বড় পরিবার। কথায় কথায় বাবার কাছে জানতে পারলাম যে আমাদের পরিবারে আমার এক পিসি অর্থাৎ আমার বাবার এক খুড়তুতো বোন, তার বিয়ে আর বিয়ের দিনটা ঠিক হয়েছে আগামী ১২ই নভেম্বর। তাই বাবা আগে থেকেই বলে রাখলেন যে পিসির বিয়ের ব্যাপারটা মাথায় রেখে কলকাতায় পরীক্ষার পর্বটা চুকে গেলেই আমি যেন বাড়ি ফিরি। বাবাকে বললাম, বাড়িতে যখন বিয়ে তখন পরীক্ষা দিয়েই বাড়ি চলে আসবো। যাই হোক, আমি আমার প্রস্তুতি নিয়ে পুরোদমে লেগে গেলাম। কল লেটারে শারীরিক বিভাগে যা যা পরীক্ষার কথা লেখা ছিল সেগুলোতে আমি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে শুরু করলাম আর লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি হিসাবে নানান রকমের কম্পিটিটিভ এক্সামিনেশনের বইগুলো পড়তে লাগলাম।
এবার আমি আসি কলকাতায় বড়মাসীর বাড়িতে থেকে পরীক্ষা দেওয়াটা আমার কাছে কেন একটা বিশেষ আকর্ষণের ব্যাপার ছিল সেই কথাই। আমার বড়মাসীর বাড়িটা হলো হাওড়ার একটা প্রমিনেন্ট লোকেশনে যেটা রামরাজাতলার খুবই কাছে ডুমুরজলাতে। আমি প্রায়ই বড়মাসীর বাড়ি বেড়াতে যেতাম, বিশেষ করে যখনই স্কুল বা কলেজে লম্বা ছুটি থাকতো তখনই আমি বড়মাসীর বাড়িতে গিয়ে বেশ কয়েকদিন থেকে আসতাম। এককথায় বড়মাসীর বাড়ি যেতে আমার ভীষণ ভালো লাগতো আর তার প্রধানতঃ দুটো কারণ ছিল যার প্রথমটা হলো আমার বড়মাসীর বড় ছেলে যার নাম জহর, বয়সে আমার থেকে ৩ কি ৪ বছর ছোট এবং সে হলো আমার খুবই প্রিয় ভাই। ছোটবেলা থেকে আমরা একসাথে ঝগড়া মারপিট ভালোবাসা সবকিছুর মধ্যে দিয়েই মানুষ হয়েছি। সুখে দুঃখে একে অপরের পাশাপাশিও থেকেছি আমরা। তাই আমাদের বন্ডিংটাও সময়ের সাথে সাথে দৃঢ থেকে দৃঢতর হয়েছে। জহর ছোটবেলা থেকেই শান্ত প্রকৃতির এবং একটু ক্রিয়েটিভ নেচারের ছেলে ছিল। সে ক্রিয়েটিভিটি নিয়েই বেশিরভাগ সময় থাকতো আর কোয়ালিটেটিভ কাজ করতে বা কোয়ালিটেটিভ কথা বলতে ভালোবাসতো। কারোর সাতে অথবা পাঁচে সে থাকতো না। অন দি কন্ট্রারী, আমি একটু ডেস্ট্রাক্টিভ নেচারের ছেলে ছিলাম। অবশ্য আমার ডেস্ট্রাক্টিভনেসটা আমার ডানপিটে স্বভাবেরই একটা ডেরিভেটিভ ছিল, যেটা আপনাদের আমি আগেই বলেছি। এখানে আমার শৈশব জীবনের একটি ছোট্ট অথচ গুরুত্বপূর্ণ দিক যেটি আপনাদের সামনে তুলে না ধরলে আমার এই স্মৃতিচারণার গল্পটাই অসুম্পর্ণ থেকে যায় তাই সংক্ষেপেই আপনাদের বলি। বড়মাসী ছাড়া আমার আরো চারটে মাসী ছিল আর ছিল একমাত্র মামা তাই আমরা সব ভাই ও বোনেরা একত্রিত হলে আমাদের ভাই বোনেদের সংখ্যাটাও হতো বেশ ভারী। ছোটবেলায় যখন মামার বাড়িতে, আমাদের বাড়িতে, অন্য কোনো মাসীদের বাড়িতে অথবা কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে আমার মা, বড়মাসী এবং আরো মাসীরা সব একজায়গায় হতো তখন আমরা ভাই বোনেরাও সব একজায়গায় হতাম আর আমরা একত্রিত হয়ে কি তান্ডবটাই না করতাম। আমাদের সকলকে সামলানোই দায় হয়ে উঠতো সব মাসী এবং মামাদের পক্ষে, বিশেষ করে আমাকে নিয়ে তো তারা সর্বদাই উদ্বিগ্ন থাকতো। কেননা আমার ডেস্ট্রাক্টিভ নেচারের জন্য আমি এমন সব উদ্ভট কাজকর্ম করে বসতাম যার না থাকত কোনো মাথা আর না থাকত কোনো মুন্ডু। আমি কিন্তু ঐসব কাজ করে নিজে খুব আনন্দ পেতাম। ছেলেবেলায় আমার ঐসব কুবুদ্ধিজনিত কর্মকান্ডের মধ্যে জহরসহ আরো অন্যান্য ভাই বোনেদেরও তাদের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাদের কে ইনভল্ভ করতাম এবং আসন্ন বিপদের আশংকা করতে পেরে যথাসময়ে সেখান থেকে আমি কেটে পড়তাম আর আমার কৃতকর্মের ফল ভোগ করতে হতো আমি ছাড়া আর সব ভাই বোনেদের। যদিও ছেলেবেলায় আমার এই ধরণের কর্মকান্ডের ফিরিস্তিটা দীর্ঘ, তবুও তার কিছুটা আপনাদের বলি, আপনারা পড়ে হয়তো একটু মজা পাবেন। ছোট ছোট হাঁসের ছানাদের তাড়া করে ধরা, কুয়োর জলের মধ্যে বেড়াল ছানা ফেলে দেওয়া, কাঠের আগুনে কুকুরের ছানা পোড়ানোর চেষ্টা করা, কয়েকটি ব্যাঙ কে মেরে তাদের মালা বানিয়ে কোনো এক দরজার পাশে টানিয়ে রাখা, ছাগলের ছানাকে ধরে পুকুরের জলে ফেলে দেওয়া, পুকুরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা কাউকে হটাৎ করে ধাক্কা দিয়ে জলে ফেলে দেওয়া, ইত্যাদি ছিল আমার সেই সমস্ত অপকর্মের তালিকার কিছুটা অংশ।
সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে আমরা সবাই বড় হলাম, বয়সের সাথে সাথে আমাদের সকলের মধ্যে আসলো পরিপক্কতা আর সেই সঙ্গে আসলো নৈতিক, চারিত্রিক এবং গুণগত পরিবর্তন। সেই দুষ্টুটি না থেকে আমি ধীরে ধীরে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে তৎপর হলাম, জহরও বড় হতে লাগলো তার পড়াশোনা আর ক্রিয়েটিভিটি দুটো নিয়েই এবং অন্যান্য ভাইবোনেরাও বড় হতে লাগলো তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিভা এবং দক্ষতা নিয়ে। যাই হোক, বড়মাসীর বাড়ি গেলেই জহরের সাথে নানান বিষয়ে গল্প করে আর আড্ডা মারা থেকে আরম্ভ করে একসাথে কলকাতায় বিভিন্ন জায়গায় ট্রামে বাসে ঘুরে বেড়ানো, সিনেমাহলে সিনেমা দেখা, থিয়েটারে নাটক দেখা, বাড়িতে বসে স্টিরিও তে গান শোনা, বাইরে দোকানে গিয়ে নানান ধরণের স্ট্রিট ফুড খাওয়া, পার্কে ঘোরা, তাস খেলা, কোনো কিছু দোষ করে একসাথে বকুনি খাওয়া, এগুলো ছিল আমাদের অন্যতম ক্রিয়াকলাপ। এককথায় জহরের সঙ্গটা আমি ভীষণ ভাবে উপভোগ করতাম আর এর জন্যই সময় পেলেই বড়মাসীর বাড়ি দৌড়োতাম। বড়মাসীর বাড়িতে খুব একটা রেস্ট্রিকশন না থাকার জন্য যদিও আমরা এই সমস্ত করতাম সম্পূর্ণ অবাধে এবং সাচ্ছন্দেই তবে আমরা যেটাই করতাম সেটা করতাম বড়মাসীর প্রতি ভীতি এবং সম্মানকে অক্ষুন্ন রেখেই। আমার বড়মেসোমশাই রেলে চাকরি করতেন আর একটু গুরুগম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন। কথা একটু কমই বলতেন তিনি তাই মেসোমশাইকে আমি বা আমরা একটু বেশিই সম্ভ্রম করে চলতাম। আচ্ছা, এবার আসা যাক বড়মাসীর বাড়ির দ্বিতীয় মুখ্য আকর্ষণের কথায়। বড়মাসী সব কাজে খুব পারদর্শী ছিলেন এবং নানান ধরণের খাবার রান্না করতে জানতেন আর সেই সঙ্গে আমাদের সকলকে খুব ভালোও বাসতেন তিনি। যখনই আমরা কেউ বড়মাসীর বাড়ি যেতাম মাসী আমাদের বিভিন্ন ধরনের খাবারের ডিশ বানিয়ে খাওয়াতেন। যখনই যেটা বলতাম তখনই সেটা। আমাদের আর কি চাই ? আর সেই জন্যই বড়মাসী আমাদের সকলের হৃদয়ে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে নিয়েছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি, শুধু সেদিনই কেন বড়মাসীর সেই স্থান আমাদের সকলের হৃদয়ে আজও সমানভাবেই বিদ্যমান। একটা কথার যথার্থতা সেদিন আমি খুব ভালো করে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে, “The best way to reach someone’s heart is only through stomach”. এবার আপনারাই বলুন, এ হেন বড়মাসীর বাড়ি যেতে কার না ভালো লাগে ? ইন ফ্যাক্ট, আমার আর্মিতে জয়েন করার ব্যাপারে বড়মাসীর বা বড়মাসীর বাড়ির বিশেষ ভূমিকা ছিল তাই প্রসঙ্গের একটু বহির্ভূত হলেও এইকথাগুলো আপনাদের না বলে আমি পারলাম না।
এদিকে কলকাতার পরীক্ষার প্রস্তুতির কাজ আমার সমান গতিতেই চলছে। একেই হাতে বেশি সময় নেই তার মধ্যে আবার রয়েছে দুর্গাপুজোর আনন্দ মুখরিত দিনগুলি আর সেই সঙ্গে হয়তো থাকছে আমার প্রস্তুতি পর্বের মধ্যে কার্তিকদার কিছুদিনের উপস্থিতি। তাহলে কি ১০ নভেম্বর নিয়ে আসবে আমার জীবনে আশার আলো? পূর্ণ হবে তো আমার আর্মিতে জয়েন করার স্বপ্ন? ফিরবো সেই গল্প নিয়ে…
ক্রমশঃ