August 21, 2025

মসির ধারায় অসির ধার (4)

An Indian Army officer gives instructions to Indian youths keen to join the service during a recruitment camp at the India Gate lawns in New Delhi on February 14, 2012. Recruitment into the Indian armed forces is voluntary and does not discriminate between caste, class, religion and community, as long as the candidate meets all required physical, medical and educational criteria. AFP PHOTO / Prakash SINGH (Photo credit should read PRAKASH SINGH/AFP via Getty Images)

সঞ্জীব মুখার্জী

 

“Destination is like Sun, which casts the shadow of our burden behind us with the progress of our journey towards it.” – Samuel Smiles

২৫ সেপ্টেম্বর-এর সূর্যস্নাত সকালটা বেশ ঝলমলেই ছিল। পুলিশ লাইনের মাঠ টা সমস্ত aspirant দের ভিড়ে মুখরিত।  আমি মাঠে ঠিক ৭ টায় পৌঁছে গেছিলাম, যদিও আমাকে ৮ টায় হাজির হতে বলা হয়েছিল, কিন্তু একটু আগে থেকে পৌঁছনোই ভালো তাই … … মনের ভিতর আমার একটা কেমন ভয় আর উৎসাহ একই সঙ্গে কাজ করছিলো।  উৎসাহটা ছিল এই কারণে যে কখন এবং কিভাবে screening-এর কার্যক্রম শুরু হবে সেই সব নিয়ে আর ভয়টা লাগছিলো সম্ভবতঃ মেসোমশাই আমাকে সেখানে ছেড়ে যাওয়ার পর একা একা লাগার কারণে।  একে নতুন জায়গা, তার উপর ওইরকম লোক জনের ভিড়।  ভিড়টাও যেন একটু বিশৃঙ্খল ভাবে আর ছড়িয়ে ছিটিয়েই ছিল, এখানে একটু, ওখানে একটু। মাঠের মধ্যে জায়গা ছেড়ে ছেড়ে নানান আকারের বেশ কয়েকটি তাঁবু খাটানো আর প্রতিটি তাঁবুর সামনে একটা করে সাইন বোর্ড লাগানো।  পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো সেই সব তাঁবুগুলো এক একটা অফিস।

ইতিমধ্যে সকলে একটু আধটু নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করাও শুরু করে দিয়েছে, যেটা হয় আরকি।  কেউ কেউ তাদের স্ক্রীনিং এর ব্যাপারে সন্দেহ দূর করতে ব্যস্ত আবার কেউ কেউ নিজেদের অভিমত দিতে ব্যস্ত।  আরে বাবা, একটু পরেই তো সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে।  যাই হোক, সবাই যখন এইসব নিয়ে মেতে রয়েছে, তখন দেখি হঠাৎ একটা মিলিটারি গাড়ির কনভয় ঢুকলো পুলিশ লাইনের মেন্ গেটটা দিয়ে। সময়টা তখন ৮ টা বাজে।  কনভয়টির মধ্যে কয়েকটি জীপ্ বা মিডিয়াম সাইজের গাড়ি আর কয়েকটা ট্রাকের মতো বড় গাড়ি ছিল।  সব গাড়িগুলিই ছিল জলপাই রঙের অর্থাৎ মিলিটারি রঙের।  ভিড়ের মধ্যে লোকজন বলাবলি করছিলো যে এই টীমটা নাকি কলকাতা থেকে এসেছে। আর কলকাতা বলতেই মনে পরে গেলো যে আমি এপ্লিকেশন তো কলকাতার অফিসেই পাঠিয়েছিলাম আর আমার Call Letter টাও সেখান থেকেই এসেছে। গাড়িগুলি এসে মাঠের এক প্রান্তে গিয়ে সেখানে একটা ডিসিপ্লিনের সাথে দাঁড়িয়ে গেলো আর সেই গাড়িগুলোর ভিতর থেকে সবুজ রঙের ইউনিফর্ম পড়া সব মিলিটারির লোকেরা নামলো আর তারা এক জায়গা তে জমায়েত হয়ে দাঁড়ালো। তাদের কারোর ইউনিফর্ম এর বাহু তে ফিতার মতো কিছু সাঁটানো আবার কারোর কাঁধে স্টার লাগানো।  আর তাছাড়া তাদের বেশির ভাগের কাছে রাইফেল ছিল।  সর্ব শেষে তাদের মধ্যে একজন একটি জীপ্ গাড়ি থেকে নেমে সমস্ত সৈনিকদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে লাগলো।  বুঝতে পারলাম উনি নিশ্চই কোনো সিনিয়র অফিসার হবেন। তাঁর বলা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত সৈনিকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো।

আমরা সবাই এখানে ওখানে ভিড় করে মাঠের যেদিকটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে চার পাঁচ জন সৈনিক এসে আমাদের সকলকে বললো একটা সাইড এ গিয়ে বসতে আর অপেক্ষা করতে।  সবাইকে এক এক করে নাম ধরে ডাকা হবে আর এটাও বললো যে আমরা সবাই যেন আমাদের নিজের নিজের Call Letter হাতে নিয়েই অপেক্ষা করি।  তাঁদের কথামতো আমরা সেই ভাবেই এক জায়গায় বেশ কয়েকটি লাইনে বসে গেলাম।  তারপর তাদের মধ্যে একজন, যার কাঁধে তকমা আঁটা ছিল, সে এসে আমাদের সামনে একটি ফাইল নিয়ে একটি চেয়ারে বসলো।  ফাইলটা থেকে বেশ কয়েক পাতার লিস্ট বের করে বললো যে যাদের যাদের কাছে Call Letter আছে কেবল তাদেরই নাম ধরে ডাকা হবে আর তাদেরই স্ক্রীনিং হবে, যাদের কাছে Call Letter নেই তারা যেন অযথা ভিড় না বাড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে চলে যায়।

তারপর সেই তালিকা থেকে আর্মির অফিসারটি এক এক করে নাম ধরে ডাকে আর candidate-দের মাঠের ভিতর দিকে পাঠায়। যথারীতি এক সময় আমারও নাম ধরে ডাকা হলো।  আমি উঠে দাঁড়াতেই অফিসারটি আমাকে বললো যে আমার সমস্ত আকাডেমিক সার্টিফিকেট গুলো আর কিছু পাসপোর্ট সাইজ-এর ফটোগ্রাফ যেন রেডি করে রাখি আর তারপর ইশারায় মাঠের একটি তাঁবু দেখিয়ে সেখানে যেতে বললো। কাছে গিয়ে বুঝতে পারলাম সেই তাঁবুটা একটা অফিস যেখানে আমাদের সার্টিফিকেটগুলো চেক করা হবে আর সেখানে এও দেখি যে আমার আগে যাদেরকে ডাকা হয়েছিল তারা সবাই অপেক্ষা করছে।  তারপর আমায় বলা হলো আমার সব সার্টিফিকেটগুলো আর ফটোগ্রাফ নিয়ে সেখানে অপেক্ষা করতে আর আমার টার্ন আসার পর সেই তাঁবুতে বসে থাকা একজন অফিসারকে আমার সার্টিফিকেট গুলো জমা করিয়ে দিতে। আমার টার্ন আসতেই আমি সার্টিফিকেটগুলো জমা করিয়ে দিলাম আর সেই অফিসারটি সার্টিফিকেটগুলো এক এক করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন আর সার্টিফিকেটগুলোর পেছন দিকে একটা স্ট্যাম্প মেরে তাতে কি যেন সব লিখলেন।

তারপর আমার “Physical Measurement” এর জন্য আমাকে আর একটি তাঁবুতে যেতে বললো আর সেই তাঁবুতে যাওয়ার পর আমি দেখি আমার আগে যারা সেখানে পৌঁছেছিল তারা সবাই জুতো, জামা, প্যান্ট, ইত্যাদি খুলে শুধু শর্টস এবং গেঞ্জি পড়ে সেই তাঁবুর সামনে অপেক্ষা করছে।  এক এক করে সবাইকে ডাকা হচ্ছে আর একটি হাইট মাপা পোলের কাছে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। হাইট মাপার সময় কারোর হাইট কম হলে immediately তাদেরকে reject করে দেওয়া হচ্ছে আর তাদের আগের তাঁবুতে পাঠিয়ে সার্টিফিকেট গুলো ফেরত দিয়ে তাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।  যাই হোক আমার টার্ন আসার পর আমার হাইট এর মাপ নেওয়া হলো এবং আমি হাইট এর ব্যাপারটায় কোয়ালিফাই করে গেলাম আর তার ঠিক পরবর্তী পদক্ষেপ অনুযায়ী আমার ওজন মাপা হলো ।  ওজন নাকি ওদের দেওয়া একটা রেঞ্জ অর্থাৎ ব্রাকেট এর মধ্যেই থাকতে হবে, তার থেকে একটু বেশি বা কম হলেই তাদের কে reject করে দেওয়া হচ্ছে।

তারপর আমায় নিয়ে যাওয়া হলো সেই তাঁবুতেই আর একটি অফিসার এর কাছে যিনি বুকের ছাতির measurement নিচ্ছিলেন। বুকের ছাতি নাকি ৫ সেন্টিমিটার ফোলাতেই হবে অর্থাৎ না ফুলিয়ে কমপক্ষে ৮৫ সেন্টিমিটার আর ফুলিয়ে কমপক্ষে ৯০ সেন্টিমিটার।  আমি তো এই দিনটার জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম।  যাই হোক, আমি সেই অফিসার টির সামনে দাঁড়াতেই আমাকে একদম স্ট্রেইট হয়ে দাঁড়াতে বললো আর তারপর একটা ইঞ্চি টেপ দিয়ে আমার বুকটা নর্মাল অবস্থায় অর্থাৎ না ফুলিয়ে মাপলো তারপর আমাকে শ্বাস টেনে নিয়ে বুকটা ফোলাতে বললো আর ঠিক সেই সময় আমার সাথে ছোট্ট একটা মজার ঘটনা ঘটে যেটা আমি পাঠকদের না বলে পারছি না।  আমায় বুকটা ফোলাতে বলা মাত্রই আমি সজোরে শ্বাস টেনে নি এবং সঙ্গে সঙ্গেই যখন আমার ছাতিটা মাপার জন্য অফিসারটি ইঞ্চি টেপ দিয়ে মাপতে যান ঠিক তখনি আমি কৌতূহল বশতঃ আমার মাথাটা নুইয়ে ফিতার দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করি যে আমি ঠিক করে ৫ সেন্টিমিটার ফোলাতে পেরেছি কিনা, আর ঠিক তখনি আমার বুকে জোরে এক ঘুশি, আচমকা ঘুশিটা খেয়ে একরকম পড়েই যাচ্ছিলাম।  সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার আগেই অফিসারটি আমার আমার হাতটা ধরে আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দেয় আর আমায় সাবধান করে দেয় যে মাপ নেওয়ার সময় আমি যেন একদম স্ট্রেইট হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর নিচের দিকে একদম না দেখি। মনে মনেই ভাবলাম বাব্বাঃ আর কি ওই ভুল করি। আমার ঐ অবস্থা দেখে অফিসারটি এমন কি সেখানে উপস্থিত ক্যান্ডিডেটগুলোও মুখ চেপে হাসছিলো।  তখন অফিসারটি নিজের হাসি থামিয়ে বাকি ক্যান্ডিডেটদের বললেন তাদেরও একই অবস্থা হবে যদি তারা ঠিক করে মাপ না দিতে পারে।  যাই হোক নিজেকে সামলে নিয়ে দাঁড়ানোর পর আবার আমার বুকের মাপ নেওয়া হলো এবং সেটা ঠিকই ছিল।

তারপর আমায় পাঠানো হলো আর একটা তাঁবু তে যার সামনে লেখা ছিল “Medical Examination” আর সেখানে যাওয়ার পর শরীরের কয়েকটি বিশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হলো আর সেটা যিনি করলেন তিনি একজন ডক্টর লেফটেন্যান্ট কর্নেল র‍্যাঙ্কের। সেই পরীক্ষাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল – সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুই হাঁটু পরস্পরকে touch করছে কিনা, চোখের Power Test, Colour Blindness Test, কানের ভিতর একটা যন্ত্র ঢুকিয়ে তার test, ইত্যাদি। এই টেস্টগুলি চলাকালীন অনেক ক্যান্ডিডেট reject হয়ে যাচ্ছিলো। এই সমস্ত টেস্টের ভিত্তিতে একটা ইন্ডিভিজুয়াল স্কোর শিট তৈরি হচ্ছিলো যেটা ফাইনাল মেরিট লিস্ট এ যোগ হবে।  ঈশ্বরের অসীম কৃপায় আমি সমস্ত টেস্ট-এ উত্তীর্ণ হলাম।  সেদিন সন্ধ্যে হয়ে গেছিলো তাই যারা সিলেক্টেড ক্যান্ডিডেট ছিল তাদের পরদিন সকালে আবার আসতে বলা হলো।

ফিরে গেলাম মাসির বাড়ি আর তার পরদিন সকাল বেলায় আবার হাজির হলাম সেই মাঠে।  তারপর কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর আমার জমা দেওয়া সব সার্টিফিকেট আমায় ফেরত দিয়ে দিলো আর তার সঙ্গে আর একটা ‘লেটার’ আমার হাতে ধরিয়ে দিলো যেটা সেই মুহূর্তে আমার কাছে ছিল সব চেয়ে মূল্যবান।  আমি অধীর আগ্রহে ‘লেটার’টা পড়তে লাগলাম।  সেই ‘লেটার’টায় লেখা ছিল আমি সেখানকার স্ক্রীনিং টেস্টে সম্পূর্ণ ভাবে উত্তীর্ণ হয়েছি আর তাই নেক্সট-স্টেপ-অফ-সিলেকশন-এর জন্য আমি যেন কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম-এর পাশে ‘রেড রোড ক্যাম্প’-এর Headquarters Of Recruitment এ আগামী ১০ নভেম্বর ১৯৮৫ তারিখে সকাল ৮ টায় উপস্থিত থাকি।  চিঠিটা হাতে পাওয়া মাত্রই এক দৌড়ে মাসির বাড়ি।  মাসি তো সবকিছু শোনার পর খুব খুশি।  মাসিকে বললাম আমি দুপুরের খাবার খেয়েই বাড়ি ফিরবো।  মাসি আমাকে তাদের কাছে দু এক দিন থেকে যেতেই বলছিলো, বার বার তো আসা হয় না তাই। মাসিকে বললাম, “এখানকার পর্ব তো মিটলো, কিন্তু আসলটা তো ১০ নভেম্বর-এ কলকাতায় অপেক্ষা করছে আর তাই আশীর্বাদ করো যেন সেখানকার পর্বটাও যেন ঠিকঠাক ভাবে হয়ে যায়, আমি পরে আবার আসবো”।  আমার কি তখন তর সইছে, বাড়ি ফিরে গিয়ে সবাইকে সুখবর টা দেওয়ার তাড়া আছে, তাছাড়া আমার আসল পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার ব্যাপারটা আছে। তাই, কোনোরকমে দুপুরের খাবার খেয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে মাসিকে একটা প্রণাম করে সিউড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম।  বেরোবার সময় মাসিকে বললাম “মাসি আসছি”। মাসি বললো “আবার আসিস কিন্তু”।  বেরোতে বেরোতে শুধু এইটুকু বললাম, “আর্মিতে জয়েন করি, তোমাদের মিষ্টি খাইয়ে যাবো মাসি” ।

 

 

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *