August 21, 2025

মসির ধারায় অসির ধার (3)

সঞ্জীব মুখার্জী

 

“Dream is not what you see in sleep.  Dream is something that doesn’t let you sleep.” – Dr. APJ Abdul Kalam

১৯৮৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস আর তারিখটা ছিল ৬ কি ৭, আর সময়টা ছিল মোটামুটি সকাল সাড়ে ১০টা কি ১১টা যখন আমি পোস্টম্যানের কাছ থেকে আমার নামের রেজিস্টার্ড OIGS এর খামটি হাতে পাই।  খামটি ধরে দরজার ঠিক পাশটিতেই দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আর খামের উপর একটু চোখ বোলাচ্ছিলাম।  আমার নামের সাথে পুরো ঠিকানা লেখা খামটির উপরেই একটি স্ট্যাম্প মারা ছিল যাতে লেখা ছিল OIGS অর্থাৎ ON INDIA GOVT. SERVICE,  যদিও সেটা দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারছিলাম ব্যাপারটা, কিন্তু তবুও মনের ভিতর টানা পোড়েন তো একটা চলছিলই আর যেটা আমার বুকের ধুকপুকুনিটাও অনেকটা বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। হঠাৎ পিছন থেকে বাবার আওয়াজ, “কে রে শঙ্কু, কে এলো”?  আপনারা হয়তো ভাবছেন শঙ্কুটি আবার কে। ওই যা, এতক্ষন আপনাদের বলাই হয়নি। আমিই হলাম শঙ্কু অর্থাৎ শঙ্কু আমার ডাকনাম।  সেই জন্য ছেলেবেলায় কেউ কেউ আমাকে ভালোবেসে শঙ্কু মহারাজ আবার কেউ কেউ আমাকে ঠাট্টা করে প্রফেসর শঙ্কু বলেও ডাকতো এমন কি কেউ আমাকে জ্যামিতি বলেও রাগাতো।  যাই হোক, কখনো সেটা আমার ভালো লাগতো আবার কখনো আমি একটু বিরক্তই হতাম।  পুরো ব্যাপারটা একটু mood এর উপর dependent ছিল।  তবে একটা কথা স্বীকার না করে পারছি না যে কখন যে অজান্তে আমার ওই ডাক নাম টি আমাকে ছোটবেলা থেকেই একটু একটু করে খ্যাত করে তুলেছিল সেটা বুঝতেই পারিনি আর বাকি খ্যাতিটা বাড়িয়ে দিয়েছিলো আমার ডাকাবুকো স্বভাব যার কথা আমি আগেই আপনাদের বলেছি।  যাই হোক, আমার পাড়ার এবং আশেপাশের পাড়ার সবাই  আমাকে এক নামেই চিনতো। অবশ্য আমার খ্যাতনামা হওয়ার আর একটা দিকও ছিল যেটা হলো আমার ফুটবল খেলা। ভীষণ ফুটবল খেলতে ভালোবাসতাম আমি। আমাকে শঙ্কু নামে ডাকাটা শুধু পাড়াতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়েছিল আমার স্কুলে, এমনকি আমার কলেজেও। উফ্স, দেখলেন তো কথায় কথায় আমি আবার আমার ছেলেবেলার পটভূমিকায় চলে গিয়েছিলাম।  যাই হোক আসল কথায় ফেরা যাক। বাবার ডাকে একটু সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বাবা তখন অফিস যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন কি বের হবেন এই রকম কিছু একটা। বাবাকে উত্তর দিতে দিতেই বাবার দিকে এগোচ্ছিলাম, “বাবা পোস্টম্যান এসেছিলো, আমার নামে রেজিস্ট্রি চিঠি ছিল তাই আমাকে সই করিয়ে আমাকে খামটা দিলো।” বাবা বললেন, “কই দেখি কিসের চিঠি।” বাবার হাতে খামটা ধরিয়ে দিতেই বাবা খামটিকে সন্তর্পনে ছিঁড়ে খাম থেকে একটি ভাঁজ করা কাগজ বের করলেন। কাগজটি unfold করে বাবা চোখ বোলাতে বোলাতে আমাকে বললেন “তোর আর্মির ইন্টারভিউর কল লেটার। এই নে ধর।” শুধু এইটুকু বলে খাম সমেত চিঠিটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েই বাবা অফিস বেরিয়ে গেলেন আর যাবার সময় বলে গেলেন অফিস থেকে ফিরে চিঠিটা ভালো করে পড়ে দেখবেন। কিন্তু আমার যেন তর সইছিল না।

চিঠিটা খুলে মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলাম। চিঠিটার মূল বিষয়বস্তুটা বিনা কোনো ভূমিকায় না গিয়ে আপনাদের বলি। ওটায় লেখা ছিল আমি যে আর্মিতে recruitment-এর জন্য যে আবেদন পত্র পাঠিয়েছিলাম সেটা ওরা কনসিডার করেছে এবং আগামী সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে মালদহে একটি Army Recruitment Rally আছে তাতে আমাকে সমস্ত Education Qualification Certificates এবং কোনো Extra Curriculum Activities এর সার্টিফিকেট নিয়ে সকাল ৮ টাতে  রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে, ওখানে নাকি Recruitment-এর প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে invited candidate-দের Preliminary Screening হবে।

যাই হোক, যেদিন হাতে কল লেটারটা পেয়েছিলাম আর যেদিন আমায় মালদহে যেতে বলা হয়েছিল তার মধ্যে ১৮ কি ২০ দিন ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম যে সেই কয়েকটি দিনে আমার শারীরিক অনুশীলনীর আর লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার পরিমান টা একটু intensify করবো।  সন্ধ্যা বেলায় বাবা বাড়ি ফিরলেন এবং একটু পর আমাকে চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে আসতে বললেন।  গেলাম বাবার কাছে।  বাবা চিঠিটা খুলে ভালো ভাবে পড়ার পর যে কথাটা আমায় বললেন সেটা ঠিক আমার মনোপূতঃ হলো না।  বিশ্বাস করুন।  বাবা কি বললেন জানেন, বাবা বললেন তোর চাকরির কি এতোই দরকার এক্ষুনি চাকরির জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে, এখন লেখাপড়াতে মন দে, মাস্টার ডিগ্রীটা অন্ততঃপক্ষে কমপ্লিট কর তারপর চাকরির কথা ভাবিস, চাকরি করার দিন তো আর পালাচ্ছে না, ইত্যাদি ইত্যাদি।  বলুন তো, ওই সময় ওইসব কথা কার ভালো লাগে ?

যাই হোক, বাবার কাছে এটা শোনার পর মনটা একটু দমে গেলো, তাহলে কি বৃথা হলো আমার সব প্রচেষ্টা।  আর্মি তে join করা টা আমার dream, আর সেটা কিভাবে পূর্ণ হবে এই সব ভাবতে ভাবতে  বাবার সঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে বাবার রুম থেকে বাইরে আসলাম।  ভাবলাম বাবার মুড হয়তো এখন এই কথাগুলো আলোচনা করার জন্য অনুকূল নয়, পরে কথা বলবো। সাহস খুব একটা পাচ্ছিলাম না তাই মাকে indulge করলাম আর মা একটু instrumental-ও হলো।  মায়ের বুঝিয়ে বলাতে বাবা সম্পূর্ণ  রাজি না হলেও নিমরাজি হলেন। হয়তো এইটা ভেবেই বাবা হ্যাঁ করলেন যে দ্যাখাই যাক না শঙ্কুর দৌড় কতটা ।

রাজি হওয়ার পর বাবা আমায় বললেন যে মালদহে যার জন্য ডাকা হয়েছে সেটা কেবল প্রাথমিক রাউন্ড যাতে ফিজিক্যাল এক্সামিনেশন এবং ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশনের প্রসেসটা থাকবে আর সেরকমটাই নাকি কল লেটারে লেখা আছে।  তারপর ওগুলো তে qualify করলে তখন ওরা সেকেন্ড রাউন্ড এর জন্য ডাকবে আর তাতে থাকবে নানা রকমের physical ability-র টেস্ট  এবং সেটাতে কোয়ালিফাই করার পর লিখিত পরীক্ষার জন্য ডাকবে।  তিনটে রাউন্ডে qualify করার পর overall score এর basis-এ একটি মেরিট লিস্ট তৈরি হবে এবং সেই মেরিট লিস্ট এ আমার নাম থাকলে তবেই আমি আর্মি জয়েন করতে পারবো।  আর এসব কথা কল লেটারে Detailed Terms and Conditions এ লেখা ছিল।

আমি কিন্তু আমার প্রস্তুতিতে একরকম আদা জল খেয়ে লেগে পড়লাম।  একটু একটু করে ২৫ সেপ্টেম্বরও এগিয়ে আসলো।  কিন্তু আমার তো সেখানে ২৫ তারিখে গেলে চলবে না কেননা আমাকে সেখানে ঠিক সকাল ৮ টাতেই উপস্থিত হতে বলা হয়েছে। আর্মির ব্যাপার, তাই punctuality আর discipline এ দুটোই তো তাদের কাছে শেষ কথা। তাহলে কি আমার এগুলিকে পালন করার পালা ঠিক এখন থেকেই শুরু হয়ে গেলো?  ভাবছি আর মনে মনে খুব আনন্দ পাচ্ছি।   আমার বাড়ি অর্থাৎ সিউড়ি থেকে মালদা যেতে অন্তত ৪ – ৫ ঘন্টা লাগবে তারপর আমার venue খুঁজে বের করার ব্যাপার টাও আছে, এইসব সাত পাঁচ ভেবে আমি দেখলাম যে আমাকে ২৪ তারিখেই মালদা পৌঁছতে হবে আর সেক্ষেত্রে আমাকে ২৪ তারিখের রাত্রিটা মালদাতেই কাটাতে হবে। কিন্তু সেটা কোথায় হবে তা নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলাম। অবশ্য সে চিন্তা দীর্ঘস্থায়ী হলোনা, কেননা সমাধান দিলো আমার মা।  মা আমায় বললো মায়ের নাকি কোনো এক দূর সম্পর্কের বোন মালদা তে থাকে আর সেখানে আমি থাকতে পারি। ডুবতে কো তিনকে কা হি সাহারা হ্যায় ভাই। যাই হোক, কোনোরকমে মাসির বাড়ির ঠিকানাটা জোগাড় করে ২৪ তারিখে দুর্গা দুর্গা বলে বেরিয়ে পড়লাম।  সিউড়ি থেকে দুপুরের স্টেট বাস ধরে বিকেল নাগাদ মালদা তে।  ঠিকানা খুঁজতে যদিও খুব একটা অসুবিধা হয়নি কেননা মাসির বাড়িটা ছিল Irrigation Colony তে।  যাই হোক, সেখানে পৌঁছে পৌঁছেই ঠিক করলাম Army Recruitment Rally-র venue টা আগে থেকে দেখে রাখলে পরদিন সকালে জায়গা খোঁজার কাজটা একটু এগিয়ে থাকবে।  সন্ধ্যা বেলায় মেসোমশাই অফিস থেকে বাড়ি ফিরলে একটু জলখাবার আর চা খেয়ে নিয়ে মেসোমশাই কে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।  খুঁজতে খুঁজতে venueটাও পেয়ে গেলাম।  জায়গাটা ছিল পুলিশ লাইনের বড়ো একটা মাঠ আর মাঠের চারিদিকে অনেক পোস্টার, ব্যানার ইত্যাদি লাগানো ছিল যেগুলোতে আর্মিতে যোগ দেওয়ার জন্য অনুপ্রেরণামূলক কথা লেখা ছিল।  ব্যানারে দেওয়া ছবি আর ক্যাপশন গুলো দেখছিলাম আর ভীষণ ভাবে উৎসাহিত হচ্ছিলাম।  জায়গাটা যদিও মাসির বাড়ি থেকে খুব একটা কাছে ছিল না তবে খুব একটা দূরেও ছিল না।  সকালে উঠে সেখানে যেতে হবে বলে মাসি তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে বললো।  কিন্তু শুয়ে পড়তে বললেই কি শুয়ে পড়া যায়।  ডিনার সেরে উঠে ভাবলাম সার্টিফিকেট গুলো সব ঠিক ঠাক করে রেখে দি যাতে সকালে সময় নষ্ট না হয়।  সেগুলো সব করে ঘড়িতে অ্যালার্ম সেট করে তারপর শুয়ে পড়লাম, ঘুমোবার চেষ্টা করছিলাম কিন্তু ঘুম কি আর আসছে ?  কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি সে খেয়াল নেই। ঘুম ভাঙলো সকালে আলার্মের আওয়াজে। ঘুম থেকে উঠে মুখটা ধুয়ে নিয়ে এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট খেয়েই তৈরী হয়ে নিলাম।  যদিও মাসি ব্রেকফাস্ট করেই বেরোতে বলছিলো কিন্তু তখন ব্রেকফাস্ট করার মতো মানসিক পরিস্থিতি ছিল না।  মেসোমশাই আমায় স্কুটার-এ করে rally গ্রাউন্ডে ছেড়ে দিয়ে আসবেন বললেন এবং সেই কথামতো আমায় সেখানে ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেলেন কেননা মেসোমশাইয়ের অফিস ছিল। আর যাবার সময় বলে গেলেন যে এখানকার কাজ শেষ হয়ে গেলেই আমি যেন মাসির বাড়ি ফিরে যাই।  আর ঠিক তারপরই শুরু হলো লক্ষ্যের যাত্রাপথের উদ্দেশ্যে পারি দেওয়া……

ক্রমশঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *