মসির ধারায় অসির ধার (2)

সঞ্জীব মুখার্জী
“I have always adhered to two principles. One is to train hard to get in the best physical contour and the another is to forget everything about your opponent until you face him in the ring and the bell sounds for the fight”.
– Rocky Marciano
তো দুর্গা দুর্গা বলে নেমে পড়লাম রণে, অবশ্য তখন আমার কাছে আমার শারীরিক আর শৈক্ষিক যোগ্যতাকে একটা সঠিক জায়গায় নিয়ে আসাটা কোনো অংশে রণের থেকে কম বলে মনে হয় নি বরং তার থেকে একটু বেশি বলেই মনে হয়েছিল। আরে বাবা লক্ষ্যে পৌঁছাতে হবে তো, ‘আর্মি জয়েন’ করতে হবে তো। পড়াশোনা তো আগে থেকেই চলছিলোই তাহলে রইলো শরীর গঠনের ব্যাপারটা। শুরুতে শরীর গঠনের কাজটা যে কিভাবে আরম্ভ করবো সেটা নিয়ে বেশি না হলেও একটু সংশয় ছিল। কিন্তু সংশয় তো আমার সমস্যার সমাধান ছিল না, জীবনে লক্ষ্যের পথে অবরোধ তো আসবেই আর তাকে জয় করে এগোনো টাই তো ….। এছাড়া সেই সময় সিউড়ি তে Gym-এর কোনো প্রচলন আর অস্তিত্ব দুটোই ছিল না, তবে থাকার মধ্যে দু একটি ব্যায়ামাগার ছিল, তাও আবার ছোট ছোট। সেইসময় বিখ্যাত মার্কিন বক্সার Rocky Marciano-এর উপরে বর্ণিত উক্তিটিকে আমার শারীরিক প্রশিক্ষণের কাজের একটি অনুপ্রেরণাদায়ক যুক্তি বলে খুব মনে হতো। সেই সঙ্গে আমার এক বন্ধু আমায় এমন কাউকে দেখতে বললো যে আমাকে এই ব্যাপারে হেল্প করতে পারবে, বুঝতে পারছিলাম ও কোনো physical trainer-কে mean করে বলছিলো। ইন্টারনেটের কনসেপ্ট তো সেই সময় স্বপ্নাতীত ছিল। তাহলে ইনফরমেশন কোত্থেকে পাবো আর সেটা ছিল গোদের ওপর একটি বিষফোঁড়া। সব মিলিয়ে আমি একটি কিংকর্তব্যবিমূঢ-এর মতো একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে বিচরণ করছিলাম, কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছিলাম না। এইসব কথাগুলো আমি এই কারণে বলছি যাতে করে পাঠকগণ আমার জীবনের সেই সময়ের চ্যালেঞ্জিং পার্ট একটু উপলব্ধি করতে পারেন।
যাই হোক এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার এক জেঠতুতো দাদা যে কিনা আমার থেকে বয়সের পার্থক্য কম থাকায় একপ্রকার আমার বন্ধুর মতোও ছিল সে বললো যে আমাদের পাশের পাড়ায় কার্তিকদা বলে একজন আছে যে সেই সময় আর্মিতে চাকরি করতো এবং সে হয়তো আমাকে এই ব্যাপারে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারবে। সে আমাকে অন্ততঃ আর্মির ‘সিলেকশন’-এর প্রসিজারটা তো বলে দিতে পারবে আর সেই সঙ্গে আমাকে ঠিক কি কি ধরণের শারীরিক যোগ্যতার পরীক্ষা এবং লিখিত পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে সেটাও বলে দিতে পারবে। জেঠতুতো দাদার কথাটা শুনে একটা আশার আলো মনের মধ্যে ঝিলিক মেরে উঠলো। মনে অনেক আশা নিয়ে খুঁজতে খুঁজতে কার্তিকদার বাড়ি চলে গেলাম এবং জানতে পারলাম যে কার্তিক দা নাকি যোধপুরে posted আছে অর্থাৎ সেটি তার কর্মস্থল, তবে তার ছুটি নিয়ে আসার কথা ছিল পরের মাসে। চলো, এমতাবস্থায় আমার কাছে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
কিছুদিন পর কার্তিকদা ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসার খবর পেয়েই তাঁর সাথে দেখা করতে গেলাম। কার্তিকদা আমাকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করার সম্পূর্ণ পদ্ধতিটা আমাকে বলে দিয়েছিলো, আর তার সাথে এটাও বলে দিয়েছিলো যে শরীর চর্চার সাথে সাথে আমাকে ‘কম্পিটিটিভ পরীক্ষা’-এর কিছু বই মন দিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। শুধু তাই নয়, কার্তিকদা তাঁর ছুটির দিনগুলোর বেশ কিছুটা সময় আমার শারীরিক প্রশিক্ষণের জন্য অতিবাহিত করেছিলেন আর তার জন্য আমি কার্তিকদার অবদান আজও ভুলিনি।
শুরু হয়ে গিয়েছিলো আমার শারীরিক প্রশিক্ষণ-এর প্রক্রিয়া, যেগুলোর মধ্যে প্রতিদিন সকালে উঠে দৌড়ানোটা তো সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল। এছাড়া লং জাম্প, একটি সিঙ্গেল পাইপের উপর দিয়ে ব্যালান্স করে হাঁটা, মাথার থেকেও উঁচু হাইট-এ একটি পাইপ-এর বার ধরে ঝুলে তাতে বুক স্পর্শ করা ইত্যাদি শরীরের সহনশীলতার পরীক্ষার প্রস্তুতির অঙ্গ ছিল। আর এইগুলো করার সময় কার্তিকদা আমার সঙ্গে থেকে আমাকে সাহস যোগাতো। কার্তিকদা আমাকে সবসময় একটা কথা বলতো যে আমি আর্মি জয়েন করলে কার্তিকদার একটি সঙ্গী হবে। আসলে সেই সময় আমাদের সিউড়িতে আশেপাশে কেউ আর্মি-তে ছিলনা তো তাই । শরীরের গঠনের দিক থেকে আমি খুব একটা healthy, মানে শক্তিশালী ছিলাম না, তাই কার্তিকদা আমায় বলতো যে আমাকে নাকি তৈরি করতে বেশ সময় লাগবে।
বেশ ঠিকঠাক ভাবেই চলছিল আমার প্রশিক্ষণ নেবার কাজটা। হঠাৎ একদিন অনুভব করলাম যে আমার বাম চোখে দেখতে একটু অসুবিধা হচ্ছে, ব্যস বিধি বাম। এই চ্যালেঞ্জের কথাটাই আমি আমার কাহিনীর প্রথম পর্বের শেষের দিকে উল্লেখ করেছিলাম। যাই হোক, বাবাকে ব্যাপারটা জানাতেই বাবা আমাকে সিউড়ির কাছে বোলপুরে একটি ভালো চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ছিল। ডাক্তার আমার চোখ পরীক্ষা করে আমাকে বেশ কয়েক টি Do’s এবং Don’ts বলে দিলেন। চোখের ঠিক থাকাটা আর্মি তে জয়েন করার জন্য ফিজিক্যাল ফিটনেস এর একটি অপরিহার্য অঙ্গ ছিল তাই ডাক্তারের উপদেশ মতো চলা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না।
চোখ দেখানোর সময় আমি ডাক্তারকে বলেই দিয়েছিলাম যে আমি আর্মি-তে জয়েন করার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তাই কি কি ধরণের ব্যায়াম এবং শরীরের অনুশীলনী নিলে চোখের কোনো ক্ষতি হবেনা সেই ব্যাপারে আমি ডাক্তারের অনুমতি নিয়ে নিয়েছিলাম। তাই, ডাক্তার আমায় যা যা করতে বলেছিলন আমি তাই তাই করছিলাম। চোখের ট্রিটমেন্ট ও সমান্তরালে চলছিল। সময়ের সাথে সাথে আমার চোখটাও সম্পূর্ণ রূপে সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো আর শারীরিক দিক থেকেও আমি অনেকটাই ready হয়ে গিয়ে ছিলাম। এবার শুরু হলো আর্মির চাকরির ভ্যাকেন্সির বিজ্ঞাপনের অপেক্ষার। তাই নিয়মিতভাবে বিভিন্ন রকমের কর্মখালির বিজ্ঞাপন দেওয়া খবরের কাগজ গুলোতেও আমার শ্যেন দৃষ্টি থাকতো। অবশ্য, সেই অপেক্ষাটা আমাকে খুব বেশি দিন করতে হয়নি, কেননা মাস দুয়েকের মধ্যেই একদিন ‘এমপ্লয়মেন্ট নিউজ’ নামে কাগজটিতে দেখতে পেলাম ‘আর্মির ভ্যাকেন্সি’-র খবরটা। শুভস্য শীঘ্রম, তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে apply করে দিলাম। আর এদিকে আমার শরীর চর্চা আর কম্পিটিশন-এর বই-এর পঠন পাঠন ও অব্যাহতভাবেই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। একদিন দেখি, কেউ যেন আমাদের বাড়ির main gate-এর দরজায় কড়া নাড়লো, দরজা খুলে দেখি ‘পোস্টম্যান’ দাঁড়িয়ে আছে। আমায় দেখে ‘পোস্টম্যান’টি বললো যে সঞ্জীব মুখার্জীর নাম রেজিস্ট্রি চিঠি আছে। আমি বললাম আমিই সঞ্জীব মুখার্জী। তখন উনি আমায় একটি কাগজে সই করিয়ে আমার হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন। এবার তাহলে আপনারা আন্দাজ করতে পারছেন খাম টা হাতে পেয়ে আমার মনের কি রকম অবস্থা।
ক্রমশঃ