মসির ধারায় অসির ধার

সঞ্জীব মুখার্জী
“The world is a dangerous place, not because of those who do evil, but because of those who look on and do nothing” – Albert Einstein
ছোটবেলা থেকেই স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক আলবার্ট আইনস্টাইন এঁর এই উদ্ধৃতি টি আমার মনকে ভীষণ ভাবে নাড়া দিতো। এক সময় মনের অজান্তেই সেটা কখন যে আমার বড়ো হয়ে ওঠার একমাত্র প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছিল সেটা একদম বুঝতেই পারিনি। অবশ্য ব্যাপারটাকে যদি এক কথায় “অবসেশন অফ মাইন্ড” বলি তো খুব একটা ভুল বলা হবে না এবং কার্যত তারই বশবর্তী হয়ে জীবনে remarkable কিছু একটা করার বদ্ধমূল প্রবণতা দৃঢ থেকে দৃঢতর হয়ে উঠছিলো।
আমার নাম সঞ্জীব, সঞ্জীব মুখার্জী, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার অন্তর্গত সিউড়ি শহরের একজন। প্রিয় পাঠকগণকে আগে থেকেই বলে রাখি যে আমি কোনো কবি, সাহিত্যিক বা প্রোফেশনাল লেখক নই এবং তাই লেখক হবার ধৃষ্টতা দেখানোর দুঃসাহসও আমি আপনাদের দেখাতে চাই না, তবে একই সাথে আমার জীবনের একটি মূল্যবান অংশ আপনাদের সমক্ষে তুলে ধরার লোভটাও সামলাতে পারছিলাম না আর তাই এই প্রচেষ্টা।
তখন আমি বেশ ছোট আর একটি স্কুল পড়ুয়া ছেলে ছিলাম, এই ক্লাস ফোর কিংবা ফাইভ হবে, তাই তখন আমার লাইফের formative stage-এও পা রাখিনি। অবশ্য আমার ডানপিটে স্বভাবটা আমার সেই জীবনের একটা মস্ত বড়ো দিক ছিল। বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে আর স্বভাবে খুব শান্ত প্রকৃতির। আমার ডানপিটে স্বভাবের জন্য বাবাকে পাড়া প্রতিবেশীদের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত নালিশ শুনতে হতো।
আমাদের সিউড়িস্থিত বড়বাগান এর বড়ো মাঠে প্রতি বছর একটি মেলা বসতো আর বলাই বাহুল্য আমরা মেলা দেখতে যেতাম আর খুব আনন্দ করতাম। মাঠটি বেশ বড়ো তাই মেলার আকারটিও বেশ বড়োসড়ো হতো আর মেলাটি অন্ততঃ দিন কুড়ি ধরে থাকতো। তবে হ্যাঁ মেলা দেখতে যেতাম বাবার হাত ধরেই, খুব ছোট ছিলাম তো তাই হারিয়ে যাবার ভয় ছিল। যাই হোক, নাগরদোলা, সার্কাস, ম্যাজিক শো, পুতুলনাচ ইত্যাদি ছাড়া ওই মেলার একটি অন্যতম অঙ্গ থাকতো “মিলিটারি প্রদর্শনী” যেটি বিশেষভাবে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো, এককথায় বলতে গেলে আমি মিলিটারি প্রদর্শনী দেখতেই মেলায় যেতাম। আপনাদের মনে হয়তো একটি প্রশ্ন উঁকি মারছে যে মিলিটারি প্রদর্শনী আবার কি, এখানে একটু বলে রাখা ভালো যে অধুনা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে আমরা প্রতি বছর প্রজাতন্ত্র দিবসের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দিল্লির রাজপথে অনুষ্ঠিত আর্মি, নেভি এবং এয়ার ফোর্সের অত্যাধুনিক টেকনোলজি সম্পন্ন অস্ত্রশস্ত্র, মিসাইল, যুদ্ধ উপকরণ, ইত্যাদি দেখে থাকি ঠিক সেই রকম কিছু যুদ্ধ ট্যাংক, আগ্নেয়াস্ত্র, ইত্যাদি মেলার মধ্যে একটি বিশেষ ভাবে প্রস্তুত এনক্লোজারে রেখে দর্শকদের আকর্ষিত করে তাঁদের আনন্দ দেওয়াটাই ওই মিলিটারি প্রদর্শনীর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল।
আর এনক্লোজারটি পরিব্যাপ্ত থাকতো বেশ কিছু মিলিটারি ম্যান দ্বারা, যাদের বেশভূষা, নিয়মানুবর্তিতা, কর্তব্যপরায়ণতা এবং সর্বোপরি তাঁদের ব্যক্তিত্ব সকল দর্শকদের প্রলুব্ধ করতো আর আমি তাদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলাম যে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁদের ক্রিয়াকলাপ দেখতো। এমনকি এই মিলিটারি প্রদর্শনীর লোকগুলো আমাকে এতটাই আকৃষ্ট করতো যে তাঁদের নিকটে গিয়ে তাঁদের ছুঁয়ে দেখে তাঁদের সাথে কথা বলার জন্য ভীষণ ভাবে ইচ্ছে করতো। বাবাকে আমার ওই ইচ্ছেটা প্রকাশ করলে বাবা বলতো যে ওরা নাকি খুব কড়া লোক এবং আমাকে ওরা ধরে রেখে দেবে আর বাড়ি আসতে দেবে না, এই সব বলে ভয় দেখাতো আর আমার ইচ্ছেটা দমিয়ে দিতো। আমিও নাছোড়বান্দা আর ছাড়ার পাত্র ছিলাম না। অদম্য কৌতূহলের বশবর্তী হয়ে একদিন শরীরের সমস্ত সাহস সঞ্চয় করে প্রদর্শনীর এনক্লোজারের গন্ডি তে দাঁড়িয়ে থাকা মিলিটারি উর্দি পরিহিত এক সৈনিকের হাতটাই ধরে ফেললাম। সারা শরীর ভয় মিশ্রিত এমন এক অদ্ভুত অনুভুতিতে ভরে গেলো যেটা আমার ভাষায় প্রকাশ করার উর্দ্ধে ছিল। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে আমার পুরো ধারণাটাই বদলে গেলো যখন ওই সৈনিক টি আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে আমার গাল দুটো আলতো করে টিপে দিয়ে আমায় ভাঙা বাংলায় জিজ্ঞেস করলো “তোমার নাম কি আছে ?” ব্যস আমায় আর দেখে কে, আমার আনন্দ তখন সপ্তম আকাশে বিচরণ করছে। ঠিক এক কথায় আজকের দিনে একজন নামী সেলেব্রিটির কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিলে যে আনন্দটা হয় সেদিন ঠিক আমার সেই আনন্দটাই হয়েছিল। যাই হোক সৈনিকের প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই আমার সম্বিৎ ফিরে এলো, কেননা বাবা তখন আমার আর একটা হাত ধরে টেনে আমাকে সেই সৈনিকের থেকে সুরক্ষিত দূরত্বে নিয়ে গিয়েছিলো। বাড়ি ফিরে সারা রাত ঘুম যেনো আর এলো না। যাই হোক সেই আনন্দের রেশ কাটতে বেশ কয়েক দিন লেগে গিয়েছিলো। সব সময় শুধু মনে হতো যে যদি আমি ওই সৈনিকটি হতে পারতাম তাহলে কি মজাটাই না হতো, সবাই আমায় দেখতে আসত, সকলের মনে আমায় ছুঁয়ে দেখার প্রবল বাসনা হতো ঠিক যেমনটি আমার মধ্যে হয়েছিল । সময় কেটে গেলো কৈশোর থেকে যৌবনে পা রাখলাম,
স্কুল থেকে হাই স্কুল আর হাই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজ জীবনে পদার্পন করলাম। সময়ের সাথে সাথে অনেক জিনিস বদলে গেলো, কিন্তু যদি কিছু না বদলে থেকেছে সেটি হলো বড়ো হয়ে সৈনিক হওয়ার সেই ইচ্ছেটি। না না বদলায়নি বললে ভুল বলা হবে বরং সেই ইচ্ছেটি একটি ঘনীভূত স্বপ্নে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো যাকে সাকার করার এক নিরলস প্রচেষ্টায় নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিনিয়োগ করে ফেলেছিলাম। ঠিক তারপরই শুরু করে দিয়েছিলাম সমস্ত রকম শৈক্ষিক প্রস্তুতি এবং শারীরিক প্রশিক্ষণ নিতে। কিন্তু কি সেদিন জানতাম যে আমার এই প্রচেষ্টার পথে একটা বড় চ্যালেঞ্জ ঘাপটি মেরে বসে আছে।
ক্রমশঃ