August 21, 2025

চারখোলের চার রাত (প্রথম পর্ব)

অংশুমান সরকার

“অ্যাঁ, আপনারা চার রাত থাকবেন শুধু চারখোলেতে?”

বেশ লজ্জা পেয়ে গেছিলাম প্রশ্নটাতে। হোটেল এর এজেন্ট নিজেই যখন এত অবাক হচ্ছেন, তখন নিশ্চয়ই চার দিন থাকার মত কিছুই নেই ওখানে। কিন্তু আমাদের গ্রুপের বেড়ানোর ধরনটা একটু অন্যরকম, তাই ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম – “আপনি শুধু বলুন যে ওখান থেকে একদম নিরিবিলি তে পাহাড়, কুয়াশা, নৈঃশব্দ আর কাঞ্চনজঙ্ঘা উপভোগ করা যাবে তো?”

বিপ্রনাথবাবু আশ্বাস দিয়েছিলেন – ‘যাবে’। পরে দেখেছিলাম তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। ভাগ্যিস সে দিন ওনাকে ভরসা করে জানুয়ারির ৪ তারিখের টিকিট কেটে ফেলেছিলাম।

কোথায় যেন পড়েছিলাম – ‘নিশির মতন, পাহাড়ও নাকি নিজের দিকে ডাকে’, কথাটা বোধহয় ঠিকই। তাই প্রতি বছর লাগেজ গুছিয়ে আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ি নতুন কোনও পাহাড়ি স্পট এর উদ্দেশে। এবার তো আমার বন্ধু বিপ্লবের স্ত্রী রিম্পা একটু রাগ করে বলেই ফেলল – ‘তোমরা যদি ফের NJP র টিকিট কাটো তাহলে আমি আর যাব না’।  তবে এবার আমাদের দলটা একটু ছোট – মানে আমরা চার বন্ধু আমি, প্রদীপ, বিপ্লব, প্রসেনজিত আর আমাদের পরিবার, সব মিলিয়ে বারো জন। এবার আমাদের দলের নিয়মিত মেম্বার স্বরাজ যায়নি।

দার্জিলিং মেল ছাড়ল ঠিক রাত ৮ টায়। কদিন ধরেই খবর রাখছিলাম যে ট্রেন এক / দু ঘণ্টা করে লেট করছে। তাই শিলিগুড়ি তে Jungle Safari করে তারপর চারখোলের দিকে রওনা দেবার প্ল্যান করা থাকলেও, মনে একটু ভয় ছিল। এর আগে বেশ কয়েকবার আমরা এই সাফারি টা দেখার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ভোররাতের দিকে মোবাইল এ ট্রেনের গতিবিধি check করে, প্রদীপকে নিশ্চিন্ত করলাম যে এখনও no delay দেখাচ্ছে।  পারমিতা, মানে আমার সহধর্মিণী বিজ্ঞের মত জানালেন – ‘ট্রেনটা যা জোরে ছুটছিল, তাতে বোঝাই যাচ্ছিল যে লেট করবে না’। যাই হোক প্রায় ৪০ মিনিট দেরিতে NJP তে পৌঁছলাম। দুটো গাড়ি আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল। ড্রাইভার কাশিম এর কাছে মালপত্র সমেত বউ-বাচ্চা জমা রেখে, প্রতিবারের মত খুচরো কিছু জলখাবার এর সরঞ্জাম, যেমন কর্ণফ্লেক্স, গুড়োদুধ, ম্যাগি, ডিম, মুড়ি, চিঁড়ে, বিস্কুট ইত্যাদি কিনে ফেললাম। এটা প্রতিবার আমাদের Breakfast একটা বড় খরচ বাঁচায়।  এরপর সোজা চলে গেলাম শিলিগুড়ি শহরের এক প্রান্তে (মানে যে দিক দিয়ে বাগরাকোট যেতে হয়) Jungle Safari তে। আমাদের মূল আকর্ষণ ছিল Tiger Safari, কিন্তু জানলাম যে শুধুমাত্র সেটা করা যায় না। তাই Herbivores এর সঙ্গে Tiger Safari র combo ticket কাটলাম – ১০০ টাকা মাথাপিছু। শুনলাম সাফারির গাড়ি নাকি এখন গেছে ভিতরে, তাই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে – আধ ঘণ্টা। ভালই হল, এই ফাঁকে আমাদের ছোট্ট সদস্যরা মানে আমার মেয়ে রাই, আর তার সঙ্গী গুনগুন, আদি আর শালিনী একটু খেলার সুযোগ পেয়ে গেল। একটু পর দেখি – কাঁচের জানালাওলা একটা ছোট মিনিবাসের মত গাড়ি, তাতে গোটা কুড়ি আসন। দেখেই বেশ রোমাঞ্চ হয়। যদিও একটু চিন্তাও ছিল – চারদিক বন্ধ, এতজন লোক, শীতকাল, ট্রেনজার্নি করে আর রাতে অত কিছু খেয়ে উঠেছে, কি জানি কি হয়!!

এবার আসি সাফারির কথায়। যারা এখনও যাননি, তাদের বলব – অবশ্যই যান। সাধারণত শিলিগুড়ি থেকে পাহাড়ে ওঠার দিনটা সকলের একপ্রকার নষ্টই হয়। তাই বলি – না হয় দু’ঘণ্টা পরেই গন্তব্যে পৌছবেন, না হয় গাড়ি কে তিনশ টাকা বেশিই দেবেন waiting charge বাবদ। তবুও যান, না হলে কিন্তু মিস করবেন। ঘেরা জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গাড়ি চলল, কত যে হরিণ আর ময়ূর দেখলাম তার ঠিক নেই। এমন কি, একটা গোঁয়ার টাইপের ময়ূর তো শীতকাল না কি বর্ষাকাল এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে পেখম তুলে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। নেহাত গাড়ির বাইরে শব্দ যায় না, না হলে পারমিতা, লতা, সুমনা আর রিম্পা যা করছিল, তাতে আমি নিশ্চিত যে কোন জানোয়ার আর ত্রিসীমানায় থাকত না। বিপ্লব মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিচ্ছিল – ‘কেউ কথা বলবে না’, আর তারপরই প্রত্যেকে একবার করে সে কথাটাই দ্বিগুণ উৎসাহে অন্যদের বোঝাবার চেষ্টা করছিল। আমার কেবল মনে হচ্ছিল যে, যদি এগুলো দেখতে নাও পেতাম তাহলেও কোনও ক্ষোভ থাকত না, কারন ভিতরের জঙ্গলটা এত সুন্দর আর গভীর, যে মন ভরে যায়। এক কথায় অতুলনীয়। চমক আরও বাকি ছিল। Herbivores শেষ হবার একটু আগে থাকতেই প্রদীপ আন্দাজ করেছিল যে আরও একটা safety gate জাতীয় কিছু থাকবে Tiger safari র আগে। ঠিক তাই, Tiger safari র double locking gate দেখে বুঝলাম যে সতর্কতা যথেষ্টই। ভিতরে ঢোকার পর বেশ কিছুক্ষন চলার পরও কিছু দেখতে না পেয়ে সকলে অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। আমি লক্ষ্য করছিলাম যে, মাঝে মাঝে wireless যন্ত্রে গাড়ির driver এর কাছে কিছু কিছু নির্দেশ আসছে। সেই রকমই একটা আওয়াজ পেয়ে গাড়িটা হঠাৎ থেমে গেল। তারপর দেখলাম একটা বিশাল আকারের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার হাঁটতে হাঁটতে আমাদের গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে। কি অপূর্ব তার চেহারা, কি দৃপ্ত তার হাঁটা তা বলে বোঝানো যাবে না। প্রায় সাত-আট মিনিট ধরে সে চলল আমাদের গাড়ির পাশে পাশে। তারপর হারিয়ে গেল জঙ্গলের গভীরে। তখন আমাদের মাথা ভোঁ ভোঁ করছে। সাফারি শেষ করে, বাগরাকোট এ দুপুরের খাওয়া সেরে যখন ছারখোলের দিকে রওনা দিলাম তখন ঘড়ি তে প্রায় ২.৩০ টে।

(ক্রমশ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *