August 21, 2025

শংকর চক্রবর্তী

ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি জীবন একটা চক্র। সে চক্র আবর্তিত হয়, চাকা ঘুরতে ঘুরতে জীবনে কখনো সুখ আসে কখনো দুঃখ । কিন্তু নিজের জীবনে কখনো কোন সুখ তো দূরের কথা সুখের দিশাও খুঁজে পায় নি। ভাবতে থাকে বছর ত্রিশের রজত মন্ডল। ছোট বেলায় অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মাকে হারিয়ে মামার গলগ্রহ হয়ে মামার তত্ত্বাবধানে থুড়ি দয়ায় সে আজ গ্র্যাজুয়েট। অন্তত মামি সেটাই মনে করেন। তাই কলেজ জীবন শেষ করেই বেসরকারি কোম্পানিগুলোতে হন্যে হয়ে ঘুরতে থাকে কাজের আশায় । চারটে জুতোর সোল ক্ষইয়ে একটা কারখানাতে ফাইফরমাশ এর কাজও পেয়ে যায়। তারপর পৈত্রিক ভিটা বছর পাঁচেক ধরে সাজাতে থাকে। মাসিক মাত্র ৮০০০ টাকা সম্বল। ঐ টাকার ওপর ভরসা করে নিজের গ্রামেরই মেয়ে নন্দিনীকে বিয়ে করে। কোন রকমে টেনেটুনে সংসার চালায়। অভাব তার নিত্য সাথী । তমাল আসার পর তাদের সামান্য হাত খরচেও  টান পড়ল। ফুটো এসবেস্টের চাল সারাই না হলেও তমালের কোন অভাব তারা হতে দেয় নি। হাতে জমানো বলতে প্রায় কিছুই নেই। তার উপর আরো চিন্তা বেড়ে যায় যখন লকডাউনে কারখানা বন্ধ হয়ে গেল। মাসটাও প্রায় শেষের দিকে, মাসের মাইনেটাও বকেয়া। কি যে করবে ভাবতে ভাবতেই বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে।

নন্দিনী সবটা জানে বলে সান্ত্বনা দেয়। বলে, ‘কটা মাস না হয় বাড়ির চারপাশে সবজি বসিয়ে কোন রকমে তাই সিদ্ধ করে খাব’।

হাসি পায় রজতের। একদিন পৃথিবী শান্ত হবে কিন্তু সবজি বসাবে কবে আর তার ফসলই বা ধরবে কবে। পরদিন সকালেই রজত বেরিয়ে পড়ে বাজারের উদ্দ্যেশে। বীজ,  সার ইত্যাদি কিনতে হবে তো। পরক্ষণেই মনে পড়ে এই লকডাউনে সবই তো বন্ধ। সোজা চলে যায় স্বয়ং দোকানদারের বাড়িতে। সেখান থেকেই সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় সামগ্রী – বীজ, সার ছাড়াও পোকা মারা ওষুধ এইসব। বাড়ি ফেরার পথেই বারংবার ভাবতে থাকে অনেকগুলো টাকা খরচ করে ফেলল সে। বাকি মাসটা কি করে চলবে। ফসল ফলতে তো অনেক দেরি। দেখতে দেখতে দিন দশ-বারো কেটে গেল। হাতের টাকা নিঃশেষ হয়েছে অনেক আগেই নন্দিনীর গয়না বন্ধক রেখে কোনক্রমে চলছে। মুদির দোকান ধার দিতে চায় না। দুধ বন্ধ করে দিয়েছে। কি যে হবে ভগবানই জানেন। আরো দিন পঁচিশ পরে এক মাথা চুল, না কামানো দাড়ি, পরনে ছেঁড়া একখানা শার্ট গায়ে রজত মুদি দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায়।

তাকে দেখেই দোকানদার ভবেশ বলে ওঠে, ‘এবার অন্য রাস্তা দেখো। এই কদিনে তুমি প্রায় তিন হাজার টাকা ধার করে বসে আছো। টাকা দিতে না পারলে আমি একটা নুনের কনাও দেবোনা, এই জেনে রাখ।‘

– কাকা বড্ড বিপদে পড়েছি রেশন থেকে চাল গম পেলেও তা যথেষ্ট না। কারখানা খুলে গেলে সব মিটিয়ে দেব।

– ওসব চলবে না আমি এখানে লঙ্গরখানা খুলিনি বাছা। এখানে ফ্যলো করি মাখো তেল এখন যাও দেখি।

– কাকা না খেতে পেয়ে মরে যাব। মধ্যবিত্তেরা ভিক্ষা করতে পারে না।

– তাই যাওনা। আমার বকেয়া টাকা চাই ভিক্ষা করে হলেও তোমাকেই মিটাতে হবে। দোকানে এতগুলো লোকের সামনে এইরকম অপমান রজতের চোখে জল এনে দিল। আশাহত অপমানিত টলতে টলতে বাড়ি ফিরতে লাগলো। সে জানেনা তার ভবিষ্যৎ কি?

‘তোর এই হাল কেন? দাঁড়ি কাটিস নি কেন ভাই?’

ঘোর কেটে যেতে রজত দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে কৌস্তুভ। কৌস্তুভ ব্যবসায়ী পার্থবাবুর একমাত্র সন্তান। অঢেল টাকা থাকলেও এদের কোন অহংকার নেই। কৌস্তুভ স্থানীয় ক্লাবের সেক্রেটারি। রজতের বন্ধুও বটে। শোনা যায় সে সমাজসেবা করে। তবে লোক দেখানো সেবা করে না আর কাউকে টাকা বা খাদ্য সামগ্রী দিয়ে পঙ্গু করে দেয় না। কর্মসংস্থান করে দেয় নতুবা চলার পথের দিশা দেখাতে সাহায্য করে। জানে যে কৌস্তুভ তাকে টাকা দিয়ে সাহায্য করবে না। সে প্রত্যাশা সে নিজেও করে না। বলতে গেলে টাকা চাইতে তার বড় কুণ্ঠা বোধ হয়।

– তেমন কিছু না রে।

এই বলে রজত এগিয়ে চলে যায় কৌস্তুভকে অবাক করেই। দুপুরে খেতে বসে খেতে পারে না রজত। পাঁচফোড়ন দিয়ে মসুর ডাল আর আলু চোকা দিয়ে গরম ভাত যে নেহাত খেতে খারাপ লাগবে তা নয় কিন্তু সকালের অপমান তাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিছুতেই মেনে নিতে পারে না সে। খেতে বসেও উঠে পড়ে। ব্যস্ত নন্দিনী কিছু বলার আগেই হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনের ওপারে কৌস্তুভ।

– হ্যাঁ … হ্যালো … বল।

– তুই রাধাকান্ত দাদু কে চিনিস ?

– ও পাড়ার রাধা তো।

– বিপত্নীক আর ছেলেও দিল্লিতে একটা ভালো চাকরি করে আর –

– এই জানি জানি। বল কি হয়েছে।

– ভাই দাদুর করোনা রিপোর্ট পজেটিভ। আমরা দাদুকে আপাতত গৃহবন্দি করে রেখেছি। সমস্যা হচ্ছে দাদুর খাওয়া-দাওয়া নিয়ে। একে বাতের ব্যথায় কাবু তার উপর কাজের মেয়েটার দেখা নেই। ভয়ে কেটে পড়েছে। বলছি তুই কি দাদুর খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব নিবি। অন্তত আজকের এই দুপুরে দুটো ভাত ফুটিয়ে দিয়ে আয়না।

– আচ্ছা।

নন্দিনী প্রায় সব কথাই শুনেছে। সে আর দেরী না করে সমস্ত খাবার গুছিয়ে দিতে থাকে। ‘এখনও বেশ গরম খাবার গুলো। নষ্ট হতো তার থেকে এই ভালো হলো, দিয়ে দাও।‘   রজত সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে যায়। কলিং বেল টিপে দরজার সামনে অপেক্ষা করে।  কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে নাকে-মুখে একটা ছেঁড়া কাপড় জড়িয়ে খাবারটা ওখানে বসিয়ে দিয়ে বলে, ‘কোন অসুবিধা হলে আমাদের ফোন করতে পারেন আমার ফোন নাম্বার রাখুন।‘

সন্ধ্যায় রজত আরো একবার ঘোষদার বাড়ি যায় দুধ আনার জন্য। ছেলের জন্য একটু দুধ। ধার পাওয়া গেল না, উল্টে শুনতে হল ‘টাকা কোথায় যে দুধ খাবি ? বিষ খেতে পারিসনা।’ চমকে ওঠে রজত। সে এখন বেশ ভালভাবেই বুঝতে পারছে তার কি করনীয়। রাতের খাবার তৈরি। রুটি আর আলুর তরকারি। রজত খাটের তলা থেকে পোকা মারার ওষুধের শিশি বের করল। রজতের হাতে বিষের শিশিটা দেখে নন্দিনী বুঝে যায় কি ঘটতে চলেছে তাদের জীবনে। জীবনের এমন পরিণতি ভেবে নন্দিনী কাঁদছে, বাচ্চা ছেলেটা কিছু বুঝতে না পেরে মায়ের আঁচলের তলায় লুকিয়ে আছে। রজত বিষের শিশির ঢাকনা খুলল আর ঠিক সেই সময় ফোনটা বেজে উঠল।

– হ্যালো … হ্যাঁ, আমি রাধা দাদু বলছি।

– হ্যাঁ দাদু, বল।

– বৌমার হাতে কিন্তু সত্যিই জাদু আছে। সামান্য আয়োজন, কিন্তু কি অসাধারন হাতের রান্না। কাল থেকে, না না, আজ থেকেই আমার খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব তোমাদের। অসময়ে খাবার চাওয়ার জন্য অত্যন্ত দুঃখিত কিন্তু ভোলার নয়। দেরি হলেও নিয়ে এসো। আর একটা কথা, সকালে তো পারিশ্রমিক নিয়ে যাওনি। এখন নিয়ে যেও।

– আচ্ছা ঠিক আছে দাদু।

নিজেদের খাবার থেকেই আবারো খাবার গেল। দাদু ২০০ টাকা পারিশ্রমিক দিলেন। খুশি হয়ে বাড়ি ফেরে। তৃপ্ত মনে বাকি খাবার ভাগকরে খায় দুজনে। আধপেটা খেয়েও শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল রজত আর নন্দিনী।

পরদিন সকালে হঠাৎ কৌস্তুভ হাজির। ব্যাগ ভর্তি অনেক আয়োজন। হড়হড় করে বলতে থাকে,

– পাড়ায় অনেকগুলো করোনা পজিটিভ। আমরা তাদের গৃহবন্দি করতে বাধ্য হয়েছি। তোর তো এখন চাকরিটাও নেই, পরে থাকবে কিনা তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। প্রতিদিন এদের খাওয়ানোর দায়িত্ব তোর। এই লিস্টটা রাখ, প্রত্যেক বাড়ি থেকে যথাসাধ্য সাহায্য পাবি,  আর আমরা ক্লাব থেকে চেষ্টা করবো তোকে সাহায্য করার। চাল ডাল আলু কিছু আনাজ আর মসলা দিয়ে গেলাম। ওভেন, গ্যাস, কড়া নিয়ে হরি আসছে। কাজ শুরু করে দে। আর হ্যাঁ ভাই এখানে স্যানিটাইজার মাক্স আছে। এগুলো অবশ্যই ব্যবহার করিস।

রজতের চোখে জল চলে এলো। জড়িয়ে ধরল কৌস্তুভকে। তার পর আনাজ বাছাই ধোয়া করে কাজ শুরু করে দিলো। প্রথমদিন কৌস্তুভ ওর সাথেই ছিল। দুপুরে সময়মতো লিস্ট ধরে ধরে বাড়িগুলোতে খাবার ডেলিভারি দিতে থাকে সে। পাড়ায় ক্রমে রোগীর সংখ্যা বাড়ে। কয়েকদিন পর আবার কমেও যায়। কিন্তু নন্দিনীর হাতের রান্নার জনপ্রিয়তা কমে না।  খাবার ডেলিভারি করতে করতে হাঁপিয়ে ওঠে নন্দিনী।একটা কাজের মেয়ে রেখেছে তাকে সাহায্য করার জন্য। তাদের জনপ্রিয়তা এখন এতটাই বেড়ে গেছে যে প্রতিদিনের অর্ডার থেকেই রোজ দুবেলা কিছু করোনা আক্রান্ত মানুষকে তারা বিনামূল্যে খাবার দিয়ে সাহায্য করতে পারছে। সমস্ত ধার শোধ হয়ে গেছে। আঁধার কেটে নতুন সূর্য ওঠে তাদের জীবনে। দিনরাত যেকোনো সময় ফোন করে অর্ডার দিলেই সুস্বাদু খাবার মেলে। গ্রাম ছাড়িয়ে বহুদূর তাদের খাবারের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। লোকেরই নাম দেয় ‘অন্নপূর্ণার রান্নাঘর’, আর নন্দিনী হয়ে ওঠে সাক্ষাৎ অন্নপূর্ণা। ভাবতেও অবাক লাগে রজতের। কাজ ছিল না, হাতে টাকা ছিল না, পাহাড় প্রমাণ ধারের বোঝা কাঁধে নিয়ে পোকা মারা বিষ খেয়ে এক রাতে সপরিবারে মরতে বসে ছিল। কিন্তু আত্মহত্যার বিকল্প যে এক নতুন জীবন হতে পারে তা তারা কল্পনা করতেও পারে নি। সবটাই যেন স্বপ্নের মত মনে হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *