২০২০ টোকিও অলিম্পিক ও প্যারাঅলিম্পিক জাপান বানালো বর্জ্য থেকে পদক বিকল্পের এক অভিনব দৃষ্টান্ত
ডা. সুকান্ত মুখোপাধ্যায়
করোনার গ্রাসে সারা পৃথিবী যখন আক্রান্ত, স্বভাবতই ভাবনা ছিল ২০২০ র অলিম্পিকের আয়োজন আদৌ করা যাবে কি না, সবচেয়ে বেশী দুর্ভাবনা ছিল অবশ্যই আয়োজক দেশ জাপানের কারণ বারবার নানা আলোচনা সত্ত্বেও এবং তারিখ পিছিয়ে দিয়ে এতগুলো দেশের শত শত প্রতিনিধি, খেলোয়াড়, কর্মকর্তা আরও নানাবিধ লোকজনের উপস্থিতিতে কিভাবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় খেলাধুলার আসর বসান যাবে। যাই হোক শেষপর্যন্ত সবকিছু নির্বিঘ্নেই সুসম্পন্ন হয়েছে কড়া নিরাপত্তা ও কোভিড প্রতিরোধ বিধি মান্য করে। অবশ্যই এজন্য সারা পৃথিবী জাপানকে অভিনন্দিত করেছে। কিন্তু যে বিষয়টা গোটা পৃথিবীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে তা হল এবারের অলিম্পিক ও প্যারাঅলিম্পিকের সমস্ত সফল প্রতিযোগীদের সোনা, রূপো বা ব্রোঞ্জ পদক যতগুলো লেগেছে তা জাপান তৈরি করেছে তাদের দেশের ই– বর্জ্য থেকে। অর্থাৎ কিনা বাতিল মোবাইল ফোন বা নানা ইলেকট্রনিক সামগ্রীকে রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহার্য পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে। সেই পদ্ধতিতেই নিষ্কাশিত হয়েছে শুধু সোনা, রূপো বা ব্রোঞ্জ নয় আরও নানা ব্যবহারযোগ্য ধাতু।
হিসেব বলছে মাত্র পঁয়ত্রিশ বা চল্লিশটি মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া যায় এক গ্রাম সোনা। কাজ শুরু হয়েছিল অনেক আগেই কারণ জাপানে রিসাইক্লিং পদ্ধতি খুব একটা প্রচলিত নয় তাই অনেক আটঘাট বেঁধে এগিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। দেশের নাগরিকদের কাছে জাপান সরকারের তরফে আবেদন জানানো হয়েছিল তাঁদের বাতিল ফোন ও অন্যান্য অব্যবহার্য বস্তুগুলি সরকারকে দান করার জন্য। নানা প্রদেশের মিউনিসিপ্যাল কর্তৃপক্ষেরও সাহায্য নেওয়া হয়েছিল এই কাজে। এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে জাপান বাতিল সামগ্রীর অনেকটা কাজে লাগিয়ে নিষ্কাশন করেছিল ১৬.৫ কিলো সোনা, ১৮০০ কিলো রূপো আর ২৭০০ কিলো ব্রোঞ্জ। এটা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্যের জন্য। বি বি সি কে দেওয়া এক সাক্ষৎকারে জানিয়েছিলেন এই প্রকল্পের অন্যতম রূপকার মাসা টাকায়া।
পদক তৈরির জন্য প্রায় ৬.২ মিলিয়ন পুরানো ফোন সংগ্রহ করেছিল জাপানের NTT DoCoMo সংস্থা
এই ঘটনা সারা পৃথিবীতে সঙ্গত কারণেই আলোড়ন ফেলে দিয়েছে কারণ আজকের দুনিয়ায় ইলেকট্রনিক বর্জ্য সব দেশেরই মাথাব্যথার কারণ। জাপানের এই পদ্ধতি দেখার পর একটি নতুন শব্দবন্ধের ব্যবহার চালু হয়েছে “আরবান মাইন” অর্থাৎ শহরের খনি। সকলেই বুঝে গেছেন বিপুল পরিমাণ বিষাক্ত ইলেকট্রনিক বর্জ্যকে ঠিকভাবে পরিবর্তন করতে পারলে শুধু সোনা নয় প্রচুর প্রয়োজনীয় ধাতু যা বিষাক্ত নয় ও নানা বস্তু তৈরিতে কাজে লাগতে পারে। বিজ্ঞানীরা অতঃপর তলিয়ে দেখতে শুরু করেছেন। আমেরিকায় এক সমীক্ষায় দেখা গেছে ২০১৬ সালে গোটা দুলিয়ায় ই- বর্জ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪ কোটি ৪৭ লক্ষ টন। এই হিসেব বাস্তবিকই সঠিক নয় মোটামুটি কাছাকাছি মাত্র কারণ গোটা দুনিয়ার সব দেশের হর কিসিমের ইলেকট্রনিক দ্রব্যাদির হিসেব পাওয়া অত সহজ নয়। সরকারী পথ ছাড়াও বেআইনি পথে প্রচুর সামগ্রী নির্মিত হয় যার তল পাওয়া দুষ্কর। যদি ১৮ চাকাবিশিষ্ট ৪০ টন মালবাহী একটি ট্রাক ভর্তি করে এই ই-আবর্জনা ফেলতে ফেলতে যাওয়া হয় তাহলে মাত্র এক কোটি তেইশ লক্ষ টন আবর্জনাতেই প্যারিস থেকে সিঙ্গাপুর – এই দুই দেশের একটি দুই লেন বিশিষ্ট রাস্তা ভরে গিয়ে উপচে পড়বে – এমনটাই জানিয়েছেন এই বিষয়ের এক বিশেষজ্ঞ দিয়েগো অর্ট্রিজ ।
সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে নানা ধরনের বর্জ্যতে ভরে উঠেছে গোটা বিশ্ব। গত শতকের শেষভাগে কম্পিউটারের অপর্যাপ্ত ব্যবহার ধীরে ধীরে গ্রাস করেছে আমাদের জীবনযাত্রা। গোড়ার দিকে ছিল ফ্লপি ডিস্ক, ক্যাসেট বা ডিভিডি ড্রাইভ। আস্তে আস্তে সেসব বাতিল হয়ে বাজারে এল পেন ড্রাইভ, ল্যাপটপ, হার্ডডিস্ক, নতুন জাতের এন্ড্রয়েড মোবাইল আরও হরেক কিসিমের গ্যাজেট। তার সঙ্গে অজস্র সফটওয়ার। পুরনো যা কিছু ছিল তাদের ঠাঁই হল অনেকটাই আস্তাকুঁড়ে আরও বিপুল পরিমাণে মাটিতে যা মাটির সঙ্গে আদৌ মেশে না তো বটেই উল্টে মাটির উর্বরতা খর্ব করে দেয়। ইলেকট্রনিক সামগ্রীর অনেক অংশ জুড়ে থাকে প্লাস্টিক, পলিমার আর পেট্রোলিয়াম বাই প্রোডাক্ট। এইসব সামগ্রীর ব্যাপক ব্যবহার, প্রাপ্ত সুবিধা আর অভ্যেস মানুষের বিচারবুদ্ধি একেবারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ঠিক এমনটাই ঘটে অন্য ক্ষেত্রেও। যেমন ধরা যাক তেল, গ্যাস বা কয়লার পরিমাণ কমে আসায় মানুষের মাথায় আসে পরমাণু শক্তির ব্যবহার। যাঁহা ভাবা তাঁহা কাজ। নানা দেশে গড়ে উঠল পরমাণু চুল্লীর ভান্ডার। ঠিক যেমন জাপানেও আছে। নিঃসন্দেহে উপকারী কিন্তু তৈরির সময় কেউ বিশেষ ভাবেনি পরমাণু বর্জ্যের কি গতি হবে! তাই যখন ফুকুশিমায় পরমাণু চুল্লীতে গোলমালের কারণে সমুদ্রে পরমাণু বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিল তখন জাপানের মত দেশও চমকে উঠেছিল। এমনকি এমন আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল চুল্লী বন্ধ করে দিতে হবে কি না।
টোকিও ২০২০ অলিম্পিকে পদকজয়ী ভারতীয় ক্রীড়াবিদ (বাঁ-দিক থেকে) মীরাবাঈ চানু, পি. ভি. সিন্ধু, নীরজ চোপড়া এবং বজরঙ্গ পুনিয়া-র গলায় সোনা-রূপা-ব্রোঞ্জের পদক
যাই হোক অলিম্পিকের আসরে এবং প্যারাঅলিম্পিকেও বর্জ্য থেকে জাপানের এই পদক তৈরির নিদর্শন সারা পৃথিবীর কাছে নতুন এক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে বর্জ্য থেকে পদক তৈরির এই ভাবনা কিন্তু আগেও ঘটেছে। ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকের আসরে ৩০ শতাংশ রূপো পাওয়া গিয়েছিল ফেলে দেওয়া আয়না, এক্স রে প্লেট আর বাতিল হওয়া ঝালাই এর যন্ত্রপাতি থেকে। ৪০ শতাংশ তামা পাওয়া গিয়েছিল ট্যাঁকশালের বর্জ্য থেকে।
অলিম্পিকে যে সোনার পদক দেওয়া হয় তার একেকটার ওজন মোটামুটি আধ কিলো আর তাতে সোনা থাকে ৬ গ্রামের মত। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে খেলাধুলোর নানা প্রতিযোগীতায় প্রাক্তন অলিম্পিক বিজয়ীরাও তাঁদের নিজেদের বাতিল বর্জ্য দান করে সরকারের এই প্রচেষ্টার পাশে দাঁড়িয়েছেন।
জাপানের বিজ্ঞানী হলুজস্কো এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন তিনি নিজে দীর্ঘদিন ধরে গোটা একটি আধুনিক স্মার্টফোন আপাদমস্তক রিসাইক্লিং করার কাজে যুক্ত এবং তাঁর লক্ষ্য হল শুধু সোনা, রূপো, তামা বা অন্যান্য ধাতু নয় নানা ধরনের অধাতব পদার্থও যেগুলি মাটিতে মিশে বিষক্রিয়া ঘটায় সেগুলিও নিষ্কাশন করে যথার্থ কাজে লাগাতে হবে এবং এইভাবেই ফোনগুলির শেষগতির পথ সুগম করতে হবে। কিন্তু মুখে বলা এক আর কাজে করা আর এক। গোটা দুনিয়ায় অধিকাংশ দেশেই ই- বর্জ্য রিসাইক্লিং করার মত যথেষ্ট পরিকাঠামো বা কারখানা নেই। খোদ জাপানেই হিতাচি, মিৎসুবিশি, প্যানাসোনিক বা সোনির মত কারখানা আছে যারা প্রতিদিন হাজার হাজার ফোন উৎপাদন ও ব্যজারজাত করে। বিজ্ঞানীদের একাংশের বক্তব্য এইসব কোম্পানীরই উচিৎ বাতিল ফোন স্বল্পদামে বা বিনামূল্যে কিনে নেওয়া এবং নিজেদের রিসাইক্লিং কারখানা খুলে তা থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য বার করে নেওয়া। কিন্তু এই ভাবনা কি আদৌ ওইসব ফোন বা ইলেকট্রনিক দ্রব্য উৎপাদনকারী সংস্থা ভাববে। নিজেদের মুনাফা না বাড়িয়ে নতুন করে এই ধরনের কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেবে? প্রশ্নটা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত তাতে কোন সন্দেহ নেই।
তবে একথা অনস্বীকার্য যে জাপানে আয়োজিত অলিম্পিক ও প্যারাঅলিম্পিকে বর্জ্য থেকে পদক তৈরির প্রচেষ্টাকে সারা পৃথিবী কুর্ণিশ জানিয়েছে এবং নতুন করে ই-বর্জ্য নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে।