ধ্যানচাঁদ সম্মানে জলের যুবরাজ — শচীন নাগ

অশোক নাগ
৫ ই জুলাই ১৯২০ সালে বেনারসের এক বাঙালি পরিবারে শচীন নাগ জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ ভাই। ১৯৩০ সালে স্বদেশী আন্দোলনে যখন সারা ভারত উত্তাল, তখন অনুকূল চন্দ্র নাগ ও কুসুমকুমারী দেবীর এই ডানপিটে ছেলেটি পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটতে ছুটতে দশাশ্বমের ঘাটে গঙ্গার বুকে ভাসমান সারি সারি নৌকার ফাঁকে আত্মগোপন করেন। দশাশ্বমের ঘাটে তখন লোকের ভিড়। তারই মধ্যে চলছে পুলিশি তল্লাসি ও ব্যাপক ধরপাকড়। আর কোন উপায় না দেখে ছেলেটি ডুব সাঁতারে কোনও রকমে গঙ্গার ওপারে ওঠে। তখন গঙ্গার বুকে চলছে ১০ কি.মি. সাঁতার প্রতিযোগিতা। নেহাতই আত্মরক্ষার তাগিদে ১৬ জন সাঁতারুর সঙ্গে কিশোর ছেলেটিও তাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে পাল্লা দিয়ে সাঁতরাতে শুরু করে। সবাই অবাক হয় যখন দেখে স্বয়ং কাশীর মহারাজ এগিয়ে আসেন ছেলেটির হাতে তৃতীয় পুরস্কার তুলে দেওয়ার জন্য। জনতা চিৎকার করে জানতে চায় সেই ছোট্ট ছেলেটির নাম, কিন্তু কর্মকর্তারা ছেলেটির নাম বলতে পারে না। কেননা নাম দেওয়া সাঁতারুদের তালিকায় তার নাম ছিল না, তালিকায় নাম হীন এই ছোট্ট ছেলেটিই পরিণত বয়সে ভারতের শ্রেষ্ঠ সাঁতারু হিসেবে দু-দুবার বিশ্ব অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। বার বার নিজের রেকর্ড ভেঙে জাতীয় ও রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায় নতুন নজির গড়ার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে রাজ্য ও জাতীয় স্তরে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী সাঁতারু হিসেবে ও এশিয়ার সবচেয়ে দ্রুতগামী সাঁতারু হিসেবে স্বীকৃতিও লাভ করেন। দিল্লিতে ১৯৫১ তে প্রথম এশিয়ান গেমসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু ও লেডি মাউন্টব্যাটেন তাকে পুলের ধারে বাহবা জানিয়ে বারবার ধ্বনি দিয়েছিলেন Cheer-up ।
শচীন নাগ কাশির গঙ্গাকে ভালবেসে, স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেকে ধাপে ধাপে তৈরি করে সারা ভারতের মধ্যে তিনি শ্রেষ্ঠ সাঁতারুর সম্মান আদায় করেন নিষ্ঠা ও একাগ্রতার জোরে। ৩০ থেকে ৩৬ সালের মধ্যে কাশীতে অনুষ্ঠিত গঙ্গা পারাপারের প্রতিযোগিতায় গঙ্গা পুত্র শচীন নাগের নাম প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে শোভা পেত । এই সময় ৯৪, শোভাবাজার স্ট্রিটে হাটখোলা ক্লাবের যামিনী দাস শচীন নাগের সাঁতারে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে কলকাতা যাওয়ার আমন্ত্রণ জানান তাঁর বাড়িতে থাকা-খাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে । বাবু সারদা প্রসাদ দাসের পুত্র যামিনী দাস নিজে ছিলেন ভালো সাঁতারু ও ওয়াটারপোলো খেলোয়াড় । ১৯৪৮ এর লন্ডন অলিম্পিকে ভারতীয় ওয়াটারপোলো দলের অধিনায়কও ছিলেন। বেনারসের Anglo High School এর পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিধবা মা ও দাদাদের ছেড়ে ১৯৩৭ সালে পাকাপাকি ভাবে শচীন নাগ কলকাতায় চলে এলেন ও সেই বছরেই কলকাতার গঙ্গায় ১০ কিমি প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় ও ১৯৩৮ সালের ৬ কিমি গঙ্গা পারাপারে প্রথম হন।
কলকাতায় তখনও পুকুর কেন্দ্রিক সাঁতার ভালো ভাবে চালু হয়নি। গঙ্গার বুকে দূরপাল্লার সাঁতার ছিল সর্বাধিক জনপ্রিয়। মদন সিং, দুর্গাদাস ও রাজারাম সাহু এই তিনজনই তখন বাংলা ও ভারতীয় সাঁতারের পুরোভাগে বিরাজ করছেন । ১৯৩৮-র পর তাদের নামের সঙ্গে যুক্ত হলো শচীন নাগের নামও ।
অলিম্পিক নিয়মে অর্থাৎ মিটারের হিসেবে পুকুরে সাঁতার প্রতিযোগিতা চালু হওয়ার পর থেকে শচীন নাগ তার প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকেন । ৩৮ এর কলেজ স্কোয়ারে আয়োজিত সমগ্র বাংলার দ্বিতীয় বার্ষিক প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১০০ ও ৪০০ মিটার ফ্রি স্টাইল সাঁতারে শচিন নাগ প্রথম, মদন সিংহ ও রাজারামকে হারান। এই প্রসঙ্গে ‘যুগান্তর’ পত্রিকা (১৫ই কার্ত্তিক ১৩৪৫) জানায় ‘হাটখোলা ক্লাবের নতুন শচিন নাগ প্রতিভার পরিচয় প্রদান করিয়াছেন তা বর্তমান শীত ঋতু পক্ষে অনন্য সাধারণ বলা যাইতে পারে। আলোচ্য বৎসরের শ্রেষ্ঠ সাঁতারুগণের মধ্যে অন্যতম রাজারাম সাহুর সহিত তিনি যে ভাবে প্রতিদ্বন্দিতা করিয়াছেন এবং শেষ পর্যন্ত যে রূপ প্রচেষ্টায় জয়ী হইয়াছেন তাহাতে সাধারণে তাহার প্রতি বিশেষ আকৃষ্ট হইয়াছেন তাতে কোন ভুল নাই’। Hindusthan Standard (Monday, Octobar 31, 1938) পত্রিকাও লেখে – Young Swimmer shines – Nag’s Impressive Display – “He scroed a remarkable success in 100 metres free style by giving the defeat to Raja Ram Sawoo in what may be described as record timing for the distance. It was, however, a close race-the finish being particularly thrilling. Nag looked much the fresher between the two. Prossessed of a fine athletic build the seems to have a bright future as swimmer”. ১৯৩৯ সালের ন্যাশনাল সুইমিং ক্লাব এর ও তালতলা ইনস্টিটিউটের জলক্রীড়ায় শচীন নাগ আবার বাজিমাত করলেন। ‘Statesman’ (11th Sept. 1939) লিখল, “Sachin Nag was the hero of the meeting. He won the open 200 metres free-style beating Madan Sinha (2min. 28.3.5 sec) beating the record timing set by Durga Das (2min 29 sec) Nag beat Dilip Mitra in the 100 metre free style his timing equally the All India record 1 min 4 sec. held by Dilip Mitra”. ১৯৪০-এ ভবানীপুর সুইমিং অ্যাসোসিয়েশন আয়োজিত ২৪ তম বাৎসরিক জলক্রীড়ায় জলের বাগ লড়াকু সাঁতারু শচীন নাগ আবার তার প্রতিভার পরিচয় রাখলেন। তখনকার দৈনিক ইংরেজি পত্রিকা ‘ADVANCE’ লিখল : (3rd Sept 1940) “A new All India record in 100 metres free style was the most brilliant feature of 24th annual aquatic Sports meeting of bhowanipore Swimming Association at the Lansdowne Square Tank on Sunday last. Sachin Nag of Hatkola put up a really commendable performance when he covered the 100 metres in 1 min 2-2/ seconds. Thus he lowered the previous best record of 1 min 4 sec. setup by Dilip Mitra. In this race beat the well known swimmer Raja Ram Sawoo, while in 400 metress Nag defeated the All India Champion Madan Sinha”. সেই বছরেই সেন্ট্রাল ক্লাব এর নৈশ জলক্রীড়ায় শচীন নাগ অভূতপূর্ব সাফল্যের পরিচয় দেন। ১০০ মিটারে জাতীয় রেকর্ডটি আরও উন্নত সময়েই ম্লান করে দিয়ে সময় নেন ১ মি ২-১/৫ সে ‘Amrita Bazar Patrika (8th Sep 1940) লিখল “The outstanding performance of the evening was that of Sachin Nag’s triumph in 100 and 400 metres, In 100 metres Nag battered his won All India record made last look at Bhowanipore Tank. At Bhowanipore Nag covered in 1 minute 2-2/5, second and last night he did it in 1 minute 2-1/5 seconds” শচীন নাগের গড়া এই রাজ্য রেকর্ড দীর্ঘ ৩১ বছর অক্ষত ছিল। ১৯৭২-তে জগৎ জননী ক্লাবের সঞ্জীব সাহা সেটা ম্লান করার কৃতিত্ব দেখান। শচীন নাগের আবির্ভাবের পর থেকে তিনিই একমাত্র সাঁতারু যিনি বারবার ফ্রি স্টাইলে রাজ্য ও জাতীয় রেকর্ড ম্লান করার কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
১৯৪২ ও ১৯৪৩ এই দুই বছর দেশে সাঁতার প্রায় বন্ধ ছিল। ৪৪ -এ লাহোরের Minto Park-এ জাতীয় সাঁতারের আসর বসেছিল। সেই সময়ে বাংলার আরও একজন সাঁতারু রাজারাম সাহু মিলিটারি ব্যারাক থেকে পালিয়ে আসেন বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য। শুধুমাত্র প্রতিনিধিত্ব করা নয়, ১০০ মিটার চিৎ সাঁতারে প্রথম হওয়া ও রিলেতে বাংলাকে চাম্পিয়ন করার লক্ষ্যে মিলিটারি ব্যারাক থেকে পালিয়ে এসে কর্তৃপক্ষের সাজা পেয়েছেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত – জাতীয়তাবোধের। সেই বছর রাজারাম বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব না করলে জাতীয় স্তরে বাংলার জয় হয়তো হাতছাড়া হয়ে যেত। ওয়াটারপোলোতেও বাংলা সেবার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয় । প্রথম চক্রের খেলায় বাংলা তখন ৪-২ গোলে মুম্বাই এর কাছে হারছে। রেফারির বদান্যতায় বাংলার তিন জন খেলোয়াড় সীমানার বাইরে। ফরওয়ার্ড শচীন নাগ জলে বাঘের মতন একাই চারটি গোল দিয়ে ৬ – ৫ গোলে বাংলাকে বিজয়ী করান। শত মিটার, ৪০০ মিটার ও দুটি রিলেতে শচীন নাগ সেই আসরে প্রথম হয়ে বাংলাকে চ্যাম্পিয়নও করেন। ৪৪এ মুম্বাইতে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার ষষ্ঠ বার্ষিক সাঁতার উৎসবে ফ্রি-ষ্টাইল সাঁতারে জয় লাভ করার জন্য তিনি “পশ্চিম ভারত চ্যাম্পিয়ন” – আখ্যা লাভ করেন। এর আগে ১৯৩৯ সালে কলকাতার মদন সিং ও ১৯৪৩ সালে দিলিপ মিত্র সেই সম্মান পান।
১৯৪৫-এর উল্লেখযোগ্য খবর হল, শচীন নাগ রাজ্যভিত্তিক প্রতিযোগিতায় এবং সমস্ত স্থানীয় ক্লাবের প্রতিযোগিতাতেও ১০০, ২০০ ও ৪০০ -তে প্রথম স্থান অর্জন করেন। সেই বছরই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল সুইমিংপুলে এক আমন্ত্রণমূলক আন্তর্জাতিক ওয়াটারপোলো লীগে শচীন নাগের হাটখোলা ক্লাব ১৫ – ১ গোলে ব্রিটিশ টিম কে পরাস্ত করে। শচীন নাগ একাই ৬ গোল করে নিজের ক্লাবকে লীগ চ্যাম্পিয়ন এর পথে এগিয়ে দেন। ১৯৪৬-এ দেশ জুড়ে তখন বিশৃঙ্খলা, দাঙ্গা ও মারামারি। কোনও সাঁতার প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠান করা একেবারেই সম্ভবপর ছিল না। ৪৭-এ দাঙ্গায় গুলির আঘাতে শচীন নাগের ডান পায়ের হাড় ৩৮ খন্ডে ভাগ হয়ে যায় । ভর্তি ছিলেন বালিগঞ্জের লেক মেডিকেল হাসপাতালে। ডাক্তারদের ঐকান্তিক চেষ্টায় তিনি তার পা ফিরে পেলেন, কিন্তু নির্দেশ ছিল দু’বছর মতন জলের সামনে না যাওয়ার । কিন্তু প্রচন্ড মনোবল ও অদম্য সাহসের অধিকারী শচীনের সংগ্রামী মন সমস্ত নির্দেশ উপেক্ষা করে বগলে ক্র্যাচ নিয়ে অবলম্বন করলেন কাশির গঙ্গাকে। এরই মধ্যে মুম্বাইতে হয়ে গেছে All India Swimming Championship. বাংলা শচীন নাগের অভাবে সাঁতারে চ্যাম্পিয়নশিপ হারিয়েছে, ওয়াটারপোলোতেও হেরেছে, সাঁতারে বাংলার ঐতিহ্য একেবারেই তলানিতে। পুরুষ বিভাগে মুম্বাই বাংলাকে ৫৩-৪২ পয়েন্টে হারিয়ে ১৯৪৪ সালে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের শোধ তুলে নেয়। এসে গেল ১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিকের নির্বাচনী ট্রায়াল’। আসর বসল আজাদ হিন্দ বাগের ন্যাশনাল সীমানায়। বাংলার ও মুম্বাইয়ের ৩ জন পুরুষ ও দুজন মহিলা সাঁতারু ছাড়া অন্য কোন প্রদেশের সাঁতারু ট্রায়ালে যোগদান করে নি। আনন্দবাজার (২৪ শে বৈশাখ ১৩৫৫) লিখল “১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে বাংলার তথা ভারতের বিখ্যাত সাঁতারু শচীন নাগ নিজস্ব রেকর্ড অতিক্রম করিয়া ১ মিনিট ৪ সেকেন্ড নুতন রেকর্ড করিয়াছেন। তাঁহার পূর্বের রেকর্ড ছিল ১ মিনিট ৪.২ সেকেন্ড। শচীন নাগ ৫ মাস আকস্মিক দুর্ঘটনার জন্য শয্যাগত থাকিবার পর হাসপাতাল হইতে বাহির হইয়া মাত্র তিন মাস সহজ ভাবে চলাফেরা করিতেছে এই অবস্থায় তাহার পক্ষে রেকর্ড করা খুবই কৃতিত্বের পরিচায়ক”। সেই ট্রায়ালে ৪০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে শচীন নাগ – বিমল চন্দ্রের কাছে হেরে গিয়ে পরে আর ৪০০ মিটারে কোনও দিন নামেন নি। কিন্তু ২০০ মিটারে শচীন নাগকে কেউ কোনদিন হারাতে পারে নি। এই ট্রায়ালের উপর ভিত্তি করেই তৈরি হয়েছিল লন্ডন অলিম্পিকে ভারতীয় সাঁতারু দল। শচীন নাগ, দিলীপ মিত্র , প্রতাপ মিত্র ও বিমল চন্দ্র ( বাংলা ) ও আইজাক মনসুর (মুম্বাই)। ওয়াটারপোলো দলে ছিলেন – গোল ( গোরা নিল) বাংলা, ব্যাক-ডি মোরার জি-মুম্বাই ও সামু চ্যাটার্জি ( বাংলা ) যামিনী দাস, অধিনায়ক ( বাংলা ) দুর্গাদাস ও পি মল্লিক ( বাংলা ), ফরওয়ার্ড – শচীন নাগ, দিলীপ মিত্র, জহর আহির ( বাংলা ) আইজক মনসুর ও কান্তি সাহা (মুম্বাই) । আন্তর্জাতিক আসরে বাংলা থেকে এতজন নির্বাচিত এর আগে বা পরে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান নি। সুতরাং এই পরিসংখ্যান থেকে সহজেই বোঝা যায় যে সেই সময় বাংলার সাঁতারুরা ভারতীয় সাঁতারে কতটা অগ্রণী ছিলেন। যদিও বাংলার সাঁতারুরা ১৯৪৮ -এর লন্ডন অলিম্পিকে কিছুই করে উঠতে পারেনি। কেননা বিশ্ব অলিম্পিক সাঁতার সম্পর্কে কোনও ধারনাই তখনকার ভারতীয় সাঁতারুদের ছিলনা। হাইড্রো ডাইনামিক সম্পর্কে তখন কেউ কিছুই জানত না। দেশবন্ধু পার্কের পুকুরে পানা সরিয়ে ও পাড়ে কাঠের গুঁড়ি লাগিয়ে শচীন নাগ টার্নিং প্যাকটিস করতেন। ভালো কোচের অধীনে ও সুইমিংপুলে প্র্যাকটিস করার সুযোগ থাকলে হয়ত অলিম্পিকে ভালো কিছু করতে পারতেন। কেননা এর তিন বছর পর প্রথম এশিয়ান গেমসে একই ইভেন্টে সোনা জিতে তিনি ভারতীয় সাঁতারকে আন্তর্জাতিক তালিকায় তুলে ধরেন।
১৯৪৮-এর লন্ডন অলিম্পিকের উদ্ধোধন ছিল ২৯ শে জুলাই বেলা তিনটে ওয়েম্বলির এম্পায়ার স্টেডিয়ামে প্রায় ৭০ জন প্রতিনিধি ও ম্যানেজার নিয়ে ভারতীয় দল ৬ ই জুন মুম্বাই হয়ে ভারত ছাড়ে। সদ্য স্বাধীন ভারতের এই প্রথম বিশ্ব অলিম্পিকে যোগদানে আনুমানিক তিন লক্ষ টাকা খরচ হয়। এই টাকার মধ্যে তৎকালীন ভারত সরকার এক লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা লন্ডন অভিমুখে রওনা দেওয়ার আগে হাওড়া স্টেশনে বিদায় সম্ভাষণ জানানোর জন্য অসংখ্য ক্রীড়ানুরাগী ও সাঁতারের ক্লাবগুলি উপস্থিত ছিল। ফুটবল খেলোয়াড় অপেক্ষা সাঁতারুদের সম্বর্ধনা হয়েছিল সবথেকে বেশি। সেই সময় ভারতীয় সাঁতারের জয়জয়কার ছিল বাংলার সাঁতারুদেরই। দুপুর তিনটের সময় ৫৯ টি দেশের প্রায় ৬০০০ প্রতিনিধি আনুষ্ঠানিক “মার্চপাস্টে” অংশগ্রহণ করেন। ভারতের প্রতিনিধিরা স্টেডিয়ামে আসার সময় দর্শকরা বিপুলভাবে সংবর্ধিত করেন। ভারতীয় দলের পিছনেই ছিল কোরিয়া, লিচেনস্টেন ও মেক্সিকোর প্রতিনিধিরা। সবুজ কোট ও সবুজ পাগড়ি পরা পাকিস্তানিরা ছিল এদের পিছনে। সর্বশেষে ছিল ব্রিটিশ প্রতিনিধিরা। দিনটি ছিল ৩০ শে জুলাই, ১৯৪৮ উত্তর লন্ডনে ফিঞ্চলে সুইমিং পুলে ওয়াটারপোলোতে চিলিকে ৭-৪ গোলে হারায় ভারত। সাত গোলের মধ্যে শচীন নাগ একাই করেন চার গোল। জহরলাল আহির দুটি ও সামু চ্যাটার্জী (F.M. Chatterjee) করেন এক গোল। বিশ্ব অলিম্পিকে বাঙালির প্রথম করা গোলের কীর্তি কিন্তু ওয়াটারপোলোতে — ফুটবলে নয়। সেই দিনই লন্ডনের এম্পায়ার পুলে ছিল ১০০ মিটারের হিট। এম্পায়ার পুলটি ছিল ফিঞ্চলে (Finchley) পুল থেকে বেশ কয়েক মাইল দূরে। ওয়াটারপোলোতে চিলির সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে জিতে ও কয়েক মাইল গাড়িতে এসে ক্লান্ত ও অবসন্ন শচীন নাগ হিটে নেমে বাজিমাৎ করতে পারেন নি ।
১৯৪৮ এর লন্ডন অলিম্পিকের মার্চপাস্টে স্বাধীন ভারতের পতাকা কে বইবে সেই নিয়ে অফিসিয়ালদের মধ্যে মতপার্থক্য হয়। প্রথমে স্থির হয়েছিল ভারতীয় হকি টিমের ক্যাপ্টেন কিষেনলালকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। বিশ্ব হকিতে ভারতীয় দলের প্রাধান্য মাথায় রেখে। কিন্তু পাতিয়ালা গ্রুপ এ ব্যাপারে একেবারেই অসম্ভব হয়ে মার্চপাস্টে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মি পঙ্কজ গুপ্তের মধ্যস্থতায় ব্যাপারটা বেশি দূর গড়ায় না। লন্ডন অলিম্পিক থেকে ফিরে আজাদ হিন্দ বাগে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় আবার ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে শচীন নাগ নতুন ভারতীয় রেকর্ডও করলেন। আগের ১ মিঃ ৪ সেঃ কমিয়ে আনলেন ১মি ৩ সেঃ। ১৯৪৯ – ৫০ – ৫১ তেও বাংলা সাঁতারে ও ওয়াটারপোলোতে সর্বভারতীয় স্তরে চ্যাম্পিয়নশিপ নিজের মুঠোয় ধরে রেখেছিল। ১৯৫০- এ কলকাতার ভবানীপুর পদ্মপুকুরে রাজ্য একাদশ বার্ষিক প্রতিযোগিতায় ৩ X ১০ মিটার মিডল রিলে রেসে শচীন নাগ যে ব্যবধান হইতে হাটখোলা ক্লাবকে বাজী জিতিয়াছেন তাহাকে অসাধ্য সাধন ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। তাহার ড্যাস অনেককে স্তম্ভিত করইয়াছে (৭ ই অক্টোবর ১৯৫০, আনন্দবাজার)। বলা হয়, রিলে রেসের ১০০ মিটার দূরত্ব শচীন নাগ সাঁতরে ছিলেন এক মিনিটে ন্যাশনালের দিলীপ মিত্রকে পেছনে ফেলে। যদিও তখন রিলেতে ব্যক্তিগতভাবে আলাদা করে সময় রাখার নিয়ম চালু ছিল না।
ওয়াটারপোলোর সেন্টার ফরোয়ার্ড হিসাবে ও তার দুরন্ত গোলের সুবাদে তার ক্লাব হাটখোলা লীগ যেতে ১৯৪৩, ১৯৪৪, ১৯৫০, ১৯৫১ এবং ১৯৫২ সালে। নকআউট চ্যাম্পিয়ন হয় ১৯৩৯, ৪১, ৪৮, ৫০, ৫২ এবং ৫৩ সালে। ১৯৩৯ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত শচীন নাগ ছিলেন ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সেন্টার ফরওয়ার্ড। ওয়াটারপোলোতে সেন্টার ফরওয়ার্ড হিসেবে তার রমরমা ছিল দেখার মতো।
৭ অক্টোবর ১৯৫০ বাংলার ওয়াটারপোলো নক আউট ফাইনালে হট ফেভারিট ছিল কলকাতার ন্যাশনাল ক্লাব । কেননা দলে ছিলেন গোলে ১৯৫২ হেলসিংকি অলিম্পিক গোলরক্ষক বীরেন বসাক, হাফে, ১৯৫২ অলিম্পিয়ান মানু চ্যাটার্জি ও ফরওয়ার্ড ১৯৪৮ লন্ডন অলিম্পিকের দিলীপ মিত্র ও অজয় চ্যাটার্জী। অপরদিকে হাটখোলা দলে ছিলেন লন্ডন অলিম্পিকের অধিনায়ক যামিনী দাস ও তার শিষ্য শচীন নাগ । পরম শক্তিশালী ন্যাশনাল শচীন ঝড়ে উড়ে গেল । হাটখোলা ১০ – ৩ গোলে ন্যাশনাল কে হারায়। শচীন নাগ একাই আট গোল করেন ও সিনিয়র লীগে ৫৮ গোল করে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন I
এসে গেল ১৯৫১-তে এশিয় প্রতিযোগিতা। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষ তার দায়িত্ব পেল প্রথম সংগঠক হিসেবে। ১৯৫০ -এর অক্টোবরে মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতাই ছিল এশিয়াডের দল নির্বাচনের ট্রায়াল। সেখানেও ১০০ মিঃ ফ্রি স্টাইলে প্রথম হওয়ার সুবাদে সুযোগ পেয়েছিলেন এশিয়াডে। ১০০ মিটার ছাড়াও শচীন নাগ সিলেকশন পেলেন ৪০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল রিলেতে, ৩০০ মিটার ও মেডলি ও ওয়াটারপোলোতে। দিল্লির ন্যাশনাল স্পোর্টস স্টেডিয়ামেই ৪ ঠা মার্চ থেকে ১১ই মার্চ পর্যন্ত ১৯৫১ সালে ১১ টি দেশকে নিয়ে প্রথম এশিয়ান গেমস অনুষ্ঠিত হয়। ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন ও খেলা শুরু হওয়ার আগে ফিতে কাটেন স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। ১৯৫১ -এর মার্চ মাসের এশিয়ান গেমস আরম্ভ হওয়ার আগে ডিসেম্বরেই শচীন নাগ চলে গেলেন দিল্লিতে নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য। দিল্লিতে পৌঁছেই তিনি এশিয়ান গেমসের জনক অধ্যাপক গুরু দত্ত সোন্ধির সঙ্গে যোগাযোগ করেন প্রস্তুতিতে সাহায্য করার ব্যাপারে। সাহায্য তো দূর অস্ত বরঞ্চ শচিন নাগের কাছে কৈফিয়ত চাওয়া হয়েছিল আগে আসার জন্য ও বলা হয়েছিল বাংলায় ফিরে যেতে। কিন্তু অকুতোভয় লড়াকু মানসিকতার অধিকারী শচীন নাগ বাংলায় ফিরে না এসে দিল্লিতেই ৫ নং হনুমান রোডের বন্ধু শ্রী রবীন্দ্রনাথ মিত্রর বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুকে নিয়ে খোঁজ নিতে লাগলেন কোনও একটি সুইমিং পুলের। সবশেষে খুঁজে পেলেন ২০ X ১০ একটি সুইমিং পুল। এই সুইমিং পুলটির মালিক ছিলেন পুরোনো দিল্লির সিসিল হোটেল কর্তৃপক্ষ। হোটেলের ম্যানেজার ছিলেন একজন ইতালীয় মহিলা। তাকে অনেক সাধ্য সাধনার পর কিছু দক্ষিণায় রাজি করিয়ে তাতেই অনুশীলন চালিয়ে যেতে লাগলেন। হোটেলের অন্যান্য বিদেশি বোর্ডাররা শচীন নাগের সঙ্গেই সাঁতার কাটতেন। শচীন নাগের আন্তরিক ব্যবহার, সাঁতারের প্রতি নিষ্ঠা ও এশিয়ান গেমসে কিছু করার জেদী মনোভাব সহৃদয় ইতালিয় মহিলাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে এক সপ্তাহের পর থেকে তিনি আর কোন দক্ষিণা গ্রহণ করেন নি। প্রথম এশিয়ান গেমসে ১১ টি দেশের মধ্যে মূলত পাঁচটি দেশ অংশগ্রহণ করে। বার্মা, ভারত, ইরান, ফিলিপাইনস ও সিঙ্গাপুর। জাপানি সাঁতারুরা ওখানকার প্রচণ্ড ঠান্ডায় অনুশীলন করতে না পারার দরুন প্রথম এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইলে প্রথম হিটে শচীন নাগ হয়েছিলেন তৃতীয়, প্রথম হয়েছিলেন ফিলিপাইনসের নূরহাতাব রাজাব ও দ্বিতীয় হয়েছিলেন সিঙ্গাপুরের ওয়াল্টার্স। দ্বিতীয় হিটে মুম্বাইয়ের ইহুদি সাঁতারু আইজ্যাক মনসুর হয়েছিলেন দ্বিতীয়। তৃতীয় হয়েও শচীন নাগ একেবারেই দমে যান নি। আইজ্যাক মনসুরের সঙ্গে পুরোদমে অনুশীলন চালিয়ে যেতে লাগলেন। শচীন নাগের তখন একমাত্র ভরসা আইজ্যাকের সাহায্য। একদিন কথোপকথনে আইজ্যাককে জিজ্ঞেস করেছিলেন তার জেতার সম্ভাবনা নিয়ে। কিন্তু আইজ্যাকের উত্তর তাঁকে নিরাশ করেছিল। তখন শচীন নাগ আইজ্যাককে অনুরোধ করেন যে আইজ্যাক যদি ফাইনালে তার অবিস্মরনীয় স্টার্ট নেন তবে তিনি আইজ্যাককে তাড়া করে অন্য দেশের সাঁতারুদের থেকে সময় বার করে নেবেন। ভারতের মর্যাদা মাথায় রেখে এই দেশপ্রেমিক ইহুদি সাঁতারু শচীন নাগকে কথা দিয়েছিলেন। ১৯৫১ সালের ৭ ই মার্চ – দুপুর দুটো ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে এক মিনিট ৪.৭ সেকেন্ড সময় নিয়ে শচীন নাগ প্রথম হয়ে ভারতকে প্রথম সোনা এনে দিলেন। প্রথম এশিয়াতে সমস্ত খেলাধুলার মধ্যে বাঙালি ও ভারতীয় হিসাবে প্রথম সোনা সেটিই। সোনার পদকটি সেদিন তিনি গলায় ঝোলাতে পারেন নি। কেননা ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইলে ইভেন্টের পরই ছিল ৪ X ১০০ মিটার ফ্রি স্টাইল রিলে। রিলেতে আবার ভারত ব্রোঞ্জ পদক তুলে আনে। ঐ দলে ছিলেন আইজ্যাক মনসুর, বিমল চন্দ্র, এস সাহা ও শচীন নাগ। ৩ X ১০০ মিঃ মেডলি রিলেতে ভারত ব্রোঞ্জ পদক পায় ও এই রিলে রেসে ছিলেন কে সাহু, জে নইগামওয়ালা ও শচীন নাগ। ১৯৫১ -র প্রথম এশিয়ান গেমসে শচীন নাগ একাই ব্যক্তিগতভাবে একটি সোনা ও দলগতভাবে দুটি ব্রোঞ্জ পদকের অধিকারী। সোনা জেতার পর দিল্লি থেকে হাওড়া থার্ডক্লাসের ভাড়া বাবদ ৩০ টাকা কর্মকর্তারা হাতে ধরাতে চেয়ে ছিলেন কিন্তু তিনি তা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন। কেননা এশিয়াডের তিন মাস আগে থেকে তিনি অনুশীলনের জন্য দিল্লি চলে যান ও ঐ সময় তার অনেক সময় ও অর্থ খরচ হয় তাই কর্মকর্তাদের দেওয়া ঐ ৩০ টাকা তার কাছে ছিল খুবই নগণ্য।
১৯৫২ তে মাদ্রাজ জাতীয় সাঁতারে বাংলা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হলেও ওয়াটারপোলোতে মুম্বাই এর কাছে হেরে যায় । ঐ জাতীয় প্রতিযোগিতাই ছিল হেলসিস্কি অলিম্পিকের নির্বাচনী ট্রায়াল। শচীন নাগ আবার ভারতের সেরা সাঁতারু হিসেবে ভারতীয় দলে নির্বাচিত হন। কিন্তু দুই অলিম্পিকের কোনোটাতেই শচীন নাগ হিট থেকে ফাইনালে উঠতে পারে নি। কেননা ভারতীয় সাঁতারের মান তখনও আন্তর্জাতিক মানের থেকে অনেক নীচুতে। গ্রাম বাংলার পুকুরে সাঁতার কেটে ও উপযুক্ত কোচের ট্রেনিং ছাড়া কখনও আন্তর্জাতিক আসরে যে বাজিমাৎ করা যায় না পরপর দুটি অলিম্পিকে গিয়ে তিনি সেটা উপলব্ধি করেছিলেন। হেলসিঙ্কি অলিম্পিক থেকে ফিরে এসে শচীন নাগ ব্যক্তিগত ইভেন্টে খুব বেশি যোগদান করেন নি। ১৯৫৪ সাল অব্দি কেবল রিলে রেসে বাংলাকে চাম্পিয়নশিপ করার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন। ১৯৩৮ সালে বাংলার সাঁতারে শচীন নাগের আবির্ভাবের পর থেকে এক নাগাড়ে ১৬ বছর বাংলা জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়। সেই জন্য এখনও বাংলার সাঁতারের স্বর্ণযুগ বলতে শচীন নাগের যুগকেই ধরা হয়। শুধুমাত্র ১৯৪৭ -এ গুলির আঘাতে অসুস্থ হয়ে সাঁতারে তিনি যোগদান করতে পারেন নি।
কোন দিনই পরিকল্পনা মাফিক সাঁতার আঙ্গিনায় তিনি অনুশীলন করেননি। ইচ্ছাশক্তিতে ভর করেই গঙ্গাবক্ষে সাঁতার কেটে চলা। তারপরে যামিনী দাসের সহযোগিতায় দেশবন্ধু পার্কে হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে নিয়মিত অনুশীলন। রাজ্য সাঁতার ও সিনিয়র জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতায় অন্য রাজ্যের সাঁতারুরা শচীন নাগকে দেখবার জন্য সুইমিংপুলে ভিড় করতেন। জলপুত্র বা জল মানব হিসেবে তার সাফল্য সংবাদের শিরোনামে উঠে থাকতো। আজকালকার মতো পরিকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা যদি শচীন নাগ পেতেন তাহলে নিশ্চিত ভাবে অন্য উচ্চতায় নিজেকে নিয়ে যেতেন। বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করেও প্রথম বাঙালি তথা ভারতীয় হিসেবে এশিয়ান গেমসে শোনা জিতে আজও অমর হয়ে আছেন এই প্রবাদ প্রতীম সাঁতারু। ১৯৪৭ সালের দাঙ্গার মাঝে পড়ে ডান পায়ে লাগে পুলিশের গুলি। পায়ের হাড় ৩২ খন্ডে বিভক্ত। ২ মাস হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল । ডাক্তার বলেছিলেন দু’বছর সাঁতার কাটা সম্ভব নয়। দীর্ঘদিন ক্র্যাচ নিয়ে হেঁটেছেন ও অনেকেই তাকে অবসর নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু কারো উপদেশ না শুনে চলে যান বেনারস। ওখানকার ঘাটে ম্যাসাজ – – কসরতের সাথে গঙ্গার জলে দিন-রাত সাঁতার কেটে পায়ে শক্তি ফিরে পান।
১৯৪৭ এর ৬ অক্টোবর হেদুয়াতে সেন্ট্রাল সুইমিং ক্লাবের বার্ষিক অনুষ্ঠান ভাষণকালে বাংলার প্রথম রাজ্যপাল শ্রী চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী বলেন, “May Bengali Swim through the troubled water ahead of them as easily cross the Hedua tank this afternoon. To cross the Hedua Tank may be easy but to achieve the “Azadi” is not so eassy. “Azadi” is a troubled pool and it requires much skill to cross. His excellency expressed astonishment at the high standard of swimming in Bengali and said that when he would return to Madras he would remember the skillfull performance of the swimmers of Bengal. He also wished that the rest of India might emulate Bengal’s feat”.
প্রবাদপ্রতিম সাঁতারু শচিন নাগ বাংলা তথা ভারতীয় সাঁতারের ধ্বজাকে প্রায় দেড় যুগ ধরে তুলে রেখেও বেঁচে থাকাকালীন সাঁতারু মহলে উপেক্ষিত ছিলেন। তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, “দেশকে সাধ্যমত অনেক কিছু দেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু দেশের কাছ থেকে কি পেলাম? খেলাধুলা ছেড়ে দেবার পর অনেকেই অনেক উপাধিতে ভূষিত হচ্ছেন কিন্তু আমার নামের সঙ্গে যে ঘটনা জড়িয়ে আছে তার বিনিময়ে তো কিছুই জুটল না। তাই ভাবি, পদ্মশ্রী বা অর্জুন উপাধি আজ বড়ই মূল্যহীন”। সম্ভবত ভারতীয় সাঁতারের ইতিহাস থেকে ১১ বারের রাজ্য চ্যাম্পিয়ন ও তিনবারের All India Champion ও প্রথম এশিয়ান চ্যাম্পিয়ন এবং গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ এই সাঁতারুর নাম সাঁতারের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্রে বাংলা তথা ভারতের সাঁতারের তৎকালীন কর্তারা কোনও দিন জাতীয় পর্যায়ে শচীন নাগের কীর্তিকে যোগ্য সম্মান দিয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেন নি। খেতাব পাওয়ার ব্যাপারে তার নাম কোনদিন উত্থাপিত হয় নি। কিন্তু আমরা জানি, আজ পর্যন্ত কোনও ভারতীয় সাঁতারু শচীন নাগের অবদানকে সাঁতারে ও ওয়াটারপোলোতে এক নাগাড়ে “জাতীয় চ্যাম্পিয়ন” হওয়ার নজির কে টপকাতে পারেন নি।
শচীন নাগ জীবনে টাকার পিছনে কখনও হন্যে হয়ে ছোটেন নি। যদি ছুটতেন তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বড়বাজারের লোহার ব্যবসায়ীদের কাছে দালালি করে অনেক টাকা রোজগার করতে পারতেন। নিজের খরচ, অনুশীলনের খরচ, বিদেশ যাওয়ার এসব তিনি নিজেই যুগিয়েছেন মাঝে মাঝে ফাংশন করে, সাঁতারের কলা কৌশল দেখিয়ে ও রাতের অন্ধকারে বড়বাজারে দাঁড়ানো লরি পরিষ্কার করে। যা এ যুগের কোনও ক্রীড়াবিদের পক্ষে একেবারেই অবিশ্বাস্য ও অকল্পনীয়। শ্রদ্ধেয় শিল্পী হেমন্ত মুখার্জীও শচীন নাগের সাহায্য তহবিলে বিনা পারিশ্রমিকে গান গেয়েছেন লন্ডন অলিম্পিকে যাওয়ার আগে উত্তরা সিনেমা হলে এক অনুষ্ঠানে। বেঁচে থাকতে প্রায়ই বলতেন “অন্যান্য খেলাধুলার সঙ্গে সাঁতারের দিকেও কর্মকর্তাদের নজর রাখতে হবে। কেননা Swimming is the best exercise সাঁতার ছাড়া কোন খেলোয়াড়েরই মানসিক বা শারীরিক বিকাশ হয় না। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কলকাতার এক অভিজাত ক্লাবের সুইমিং পুলের সঙ্গে জড়িয়েছিলেন। তারই হাতে তৈরি আরতী সাহা ও নাফিসা আলি বাংলা তথা ভারতের কৃতি সাঁতারু হিসেবে পরবর্তীকালে স্বীকৃতি লাভ করেন।
১৯৮২-তে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত নবম এশিয়ান গেমসে শচীন নাগ প্রথমে কোনও আমন্ত্রণ পান নি। পরে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের প্রচেষ্টায় শেষ পর্যন্ত আমন্ত্রণ পান ও ওখানে গিয়ে জানতে পারেন যে তাঁর নামে এশিয়াড ভিলেজে একটা ব্লক হয়েছে। ‘Sachin Nag Block’ হিসেবে তার নাম এখনও এশিয়াড ভিলেজ জ্বলজ্বল করে।
১৯ শে আগস্ট ১৯৮৭ সালের এক সকালে আলিপুর কমান্ড হসপিটালে এই খ্যাতিমান দিকপাল সাঁতারুর জীবনাবসান হয়। বিভিন্ন ক্লাব সংগঠন, ( যেমন শিবপুর বিদ্যুৎ স্পোটিং ক্লাব) স্পোর্টস কাউন্সিল, স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া ও একাধিক সমাজ সেবামূলক সংগঠনের সঙ্গে আমৃত্যু তিনি যুক্ত ছিলেন। বাংলা ছায়াছবি অপর্ণা ও কোনি-তেও শচীন নাগকে আমরা দেখতে পাই সু-অভিনেতা হিসেবে। বাঙালি শচীন নাগকে দেখতে পায় ধুতি ও পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় জহরলাল নেহেরুর সঙ্গে করমর্দনরত। যেকোনো অনুষ্ঠানে ধুতি-পাঞ্জাবি স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। এশিয়ান গেমস আসবে আবার, চলেও যাবে শচীন নাগের নাম প্রথম “Asian Champion Swimmer” — বাঙালি হিসেবে আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় চিরকাল যে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে সে কথা অবিতর্কিত সত্য।
একটা সময়ে ক্রীড়া তারকাদের পীঠস্থান হাওড়াতে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অতিবাহিত করেছেন শচীন নাগ। বর্তমান প্রজন্ম হাওড়ার শচীন নাগকে হয়তো স্মরণ করতে ভুলে যান। কিন্তু তার অসাধারণ কৃতিত্বে সব সময়ই ইতিহাস কথা বলবে। শিবপুরে বেনি মিত্র লেনে থাকার সময় ১৯৫২ সালে হেলসিংকি অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব কখনো যাদব দাস লেনে আবার কখনো বা ক্ষেত্র ব্যানার্জি লেনে জীবনের অধ্যায় কাটার পর পরিসমাপ্তি ঘটে হাওড়ার ডুমুর জলা ফ্ল্যাটে। তখন থেকেই বিভিন্ন মহলে দাবি ওঠে শচীন নাগকে মরণোত্তর অর্জুন বা পদ্মশ্রী দেওয়া হোক। এমনকি হাওড়ার নাগরিক হিসাবে সাঁতারু শচীন নাগকে সম্মান জানাতে ও তৎকালীন হাওড়া কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষ বেলিলিয়াস পার্ক এর পুলটি শচীন নাগের নামে করার প্রস্তাব দেন । কিন্তু বাস্তবে এর কোন রূপরেখা আজও হয়ে ওঠেনি । আজ থেকে বেশ কয়েক বছর আগে আমি পূর্বতন হাওড়ার মেয়রের সাথে দেখা করতে যাই হাওড়ার কোন রাস্তার নাম অথবা ওলাবিবি তলায় নবনির্মিত সুইমিংপুলের নাম কিংবা আবক্ষ মূর্তি শচীন নাগের স্মরণে উৎসর্গ বা স্থাপন করার জন্য কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাকে দেখা করতে দেওয়া হয় না মেয়রের সাথে । মেয়রের কাছে অনুরোধের চিঠি গুলো সব ফাইল বন্দী বা হারিয়ে গেছে কী না কেউ জানে না। শচীন নাগ সেইভাবে কদর পান নি বাংলার সাঁতার জগতে। তার মতো এত বড় মাপের সাঁতারু উপেক্ষিত থেকে গেছেন সম্মানের আঙিনা থেকে । এমনকি বেঙ্গল অ্যামেচার সুইমিং অ্যাসোসিয়েশনও নীরব থেকে গেছে । তাই বাবার প্রাপ্য সম্মান আদায়ের জন্য ছেলে হয়ে লড়াইয়ে নেমে পড়লাম । দফায় দফায় কথা বলেছি রাজ্য ও কেন্দ্রীয় ক্রীড়া পর্ষদের অধিকর্তার সঙ্গে । একের পর এক চিঠি লিখেছি । ২০০৯ রাজ্য ক্রীড়া দপ্তর বাবার নাম মরণোত্তর অর্জুন আবার ২০১২ তে সুইমিং ফেডারেশন মরণোত্তর “অর্জুন” ও “ধ্যানচাঁদ” পুরস্কারের জন্য মনোনীত করে । এমনকি আমিও ব্যক্তিগতভাবে চিঠি দিলাম কেন্দ্রীয় ক্রীড়া মন্ত্রী কে । বাংলার থেকে রাজধানী দিল্লিতে ছুটে গেছি ক্রীড়া মন্ত্রকে । চিঠির উত্তর না পেয়ে হতাশ হই নি । দীর্ঘ অনেকগুলো বছর কেটে গেছে প্রয়াতঃ সাঁতারু শচীন নাগের স্বীকৃতি আদায়ে । ২০০৯ থেকে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল তার পরিচালনায় হয়তো কিছু ভুল থেকে যাওয়ায় লড়াইটা দীর্ঘতর হয়ে শেষ হয় ২০২০ তে । মৃত্যুর ৩৩ বছর বাদে জন্মশতবর্ষে “মরণোত্তর ধ্যানচাঁদ” সম্মানে তিনি সম্মানিত হলেন । তাঁর এই সম্মান বাংলার সাঁতার জগতকে আবার নতুন করে চিনিয়ে দিল । আবার প্রমাণ হলো ইতিহাস কথা বলে । তাই বলে বাধা কিছু আসেনি? বাধা এসেছে প্রচুর। ২০০৯ সালে অর্জুন পুরস্কার এর নির্বাচনী কমিটির অন্যতম সদস্য একজন বাংলার মহিলা সাঁতারু থেকেও সচিন নাগের ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেননি । শুধু ই নীরবতা পালন করে গেছেন । ২০১০ রাজ্য ক্রীড়া দপ্তরে শচীন নাগের মরণোত্তর পদ্মশ্রী ব্যাপারে জমা কাগজপত্রের খোঁজ পাওয়া যায়নি । আবার কলকাতা মাঠে দাপিয়ে খেলা একজন ফুটবলার যিনি ২০১২ তে ধ্যানচাঁদ পুরস্কার কমিটিতে ছিলেন, আমায় প্রশ্ন করেন “আপ কা পিতাজী কিতনি বার ইন্ডিয়া রিপ্রেজেন্ট কিয়া”? সত্যিই অবাক লাগে । মাঠের চারকাঠির বাইরে যে একটা বিরাট খেলার জগত আছে সে ব্যাপারে এই ধরনের নির্বাচকরা বিন্দুমাত্র ওয়াকিবহাল নন। ২০১২ সালে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শচীন নাগকে দিয়েছেন “মরণোত্তর পুরস্কার”। শতবর্ষে বাবাকে আরো একটা সম্মান দিলেন শোভাবাজার হাটখোলা ক্লাব । বেনারস থেকে ১৯৩৬ সালে পাকাপাকি ভাবে চলে আসার পর এই ক্লাবেই বাবা প্র্যাকটিস করতেন । এই ক্লাব বাবার একটা মূর্তি বসিয়েছে তাদের ক্লাব প্রাঙ্গণে । বারানসির গঙ্গা দ্বারভাঙ্গা ঘাটে দুরন্ত ও দামাল ছেলেটার সাক্ষী হয়ে আছে । নিস্তরঙ্গ গঙ্গা বহে চলার সময় আজও হয়তো তার মৃদু পদধ্বনি শুনতে পায় আর নিপুন হাত ও পায়ের সঞ্চালনের শব্দে আনমনা হয়ে ওঠে। ১০০ বছর পেরিয়ে বেগবান গঙ্গা খুঁজে বেড়ায় সেই জলের যুবরাজকে যে তার কোলে চড়ে ডুব দিত এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে । সুইমিং পুলের নীল জলে এই শান্ত ভদ্র ও অমায়িক জল মানব যে বরাবরই নক-আউট ছিলেন আজ তিনি বিস্তৃতির অতল গভীরে বেমালুমই আউট হয়েগেছেন ক্রীড়া প্রেমী হাওড়ার মানুষের মন থেকে কিন্তু তিনি আজও অমর হয়ে আছেন ভারতীয় তথা এশীয় সাঁতারের মহাকাশে এক অচেনা ধ্রুবতারা হয়ে।
সমাপ্ত