ওষুধের বিকল্প যখন কবিতা

মহুয়া দাস চট্টোপাধ্যায়
সেদিন সৌরজিত-কে নামতা পড়াতে গিয়ে দেখি তার কিছুতেই মুখস্ত আর হয় না অথচ বড় বড় ছড়া গুলো কি সুন্দর মুখস্থ করে ফেলে। তখন মনে হল দেখি তো একবার ছড়ার মতো করে নামতা বলে। ওর পরিচিত একটি ছড়ার মত করে নামতা টা ওকে বললাম আর তৎক্ষণাৎ ফল ও পেলাম। অনায়াসেই নামতাটা মুখস্ত করে ফেলল আমার সামনে বসে। সে যুগে পাঠশালায় পণ্ডিতমশাই রা বোধহয় এই কারণেই সুর করে করে নামতা পড়াতেন। সুর তাল ছন্দ এগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিকল্প ওষুধের মত কাজ করে।
আমাদের চোখের সামনে এর অনেক উদাহরন আমরা পেয়ে থাকি। যেমন- একটি ছোট্ট শিশুকে ঘুম পাড়ানোর সময় আমাদের কি ঘুমের ওষুধের প্রয়োজন হয়? তার মায়ের মুখের ওই ঘুম পাড়ানি গান বা ঘুমপাড়ানি ছড়াই তার ঘুমের ওষুধের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি কোন একটি বাচ্চা হয়তো খুব কান্নাকাটি করছে, কারো কথা শুনছে না, সেই সময় যদি একটি ছড়া তার সামনে বারবার বলা হয় হঠাৎ করেই দেখা যায় তার কান্নার গতি কমছে এবং একসময় সে চুপ করে ছড়াটা শুনছে। শুধু তাই নয় কথা বলতে শিখতে বা বানান-এর ধারণা তৈরি হতেও ছড়ার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। কথা বলতে পারে অথচ বলে না বা বলতে চায় না এমন বাচ্চার সামনে যদি বারবার কোন ছড়া বলা হয় তার মধ্যে দেখা যায় কথা বলতে চাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। কারণ ছড়ার মধ্যে থাকে কিছু মজাদার শব্দ যেগুলো সাধারণ কথার মধ্যে থাকেনা আর থাকে ছন্দবদ্ধ পদ যেগুলি ছোটরা শুনলে ওদের ভালো লাগে এবং ওরা বলতে চায়। ছড়ার ছন্দে ছড়ার শব্দগুলি বলার সময় শব্দের দল-ভাগ বা ইংলিশ রাইমস বলার সময় syllebel ভেঙে বানান করার ক্ষেত্রেও অনেক সুবিধা হয়।
কিরকম একটু বলি- “Humpty Dumpty sat on a wall” এই রাইমস-টার কথাই যদি বলি, এর ছন্দটা মনে করলে আমাদের সকলেরই মনে পড়বে কিভাবে এটি বলা হয়—
Hump /ty
Dump /ty
sat on a / wall.
এইভাবে বিভিন্ন ছড়া বা রাইমস বললে বানান শেখার ক্ষেত্রে ছোটদের খুব সুবিধা হয়। নিজেদের অজান্তেই ওরা ভেঙে ভেঙে বানান করতে শিখে যায়। ছড়ার ছন্দ ছড়ার শব্দগুলোকে মনে রাখার ক্ষেত্রেও সাহায্য করে। সুর আর ছন্দ মন ভালো রাখতেও সাহায্য করে। খুব মন খারাপ লাগছে, ডিপ্রেসড লাগছে, ডিপ্রেশন কমার ওষুধ খেতে লাগবে না, ভালোলাগা কোনও ছড়া মনে করার চেষ্টা করুন বা পছন্দের একটা কবিতা পড়ুন, যদি এগুলোর কোনোটাই না পারেন তো কারোর কবিতা আবৃত্তি শুনুন, দেখবেন মনটা ভালো হয়ে গেছে।
পেশাগত কারণে আমাকে দিনের বেশ একটা বড় অংশ কাটাতে হয় ছোটদের সাথে, বিশেষ করে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের সাথে। শিশুরা শিশুই, তা সে স্বভাবিক বা বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন, যেমনই হোক না কেন। তাই ওদের ভালোলাগা, ভালো-না-লাগা পছন্দ অ-পছন্দ সবই এক রকম। আমরা অনেকেই ভাবি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বোধহয় ভালোলাগা, ভালো-না-লাগা পছন্দ অ-পছন্দ ব্যাপারগুলোই নেই। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। তবে ওদের নানা রকম অসুবিধা আছে, যার জন্য ওরা অনেক ছোটোখাটো কাজ করতেও সমস্যায় পরে। ওদের এই অসুবিধাগুলো দূর করতে শেখানোটাই আমাদের মত প্রশিক্ষকদের কাজ। সেই কাজে যেমন কিছু প্রথাগত পদ্ধতি আছে তেমনিই শিশুভেদে নতুন নতুন পদ্ধতির উদ্ভাবনেরও প্রয়োজন আছে। যেমন, আমি নিজে একজন বাচিক শিল্পী। আবৃত্তি শিক্ষার একটি প্রতিষ্ঠান আছে আমার। ছোট বড় সব বয়সের শিক্ষার্থী আছে আমার প্রতিষ্ঠানে, যদিও ছোটরাই সংখ্যায় বেশী। কবিতা আবৃত্তি করতে শেখানোর প্রয়োগগত পদ্ধতির মাধ্যমে ছোটদের উচ্চারণ ও কথা বলার ত্রুটিও শুধরে ফেলা যায়। কিন্তু, বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের ক্ষেত্রে কবিতা বা ছড়া শেখাটা তাদের কথা বলতে শেখার একটা ধাপ। তাদের যে শারীরিক জড়তা তা অনেকটাই কেটে যায় যখন তাদের নানান ভঙ্গির সঙ্গে ছড়া গুলি অভ্যাস করানো হয়। ছন্দে ছন্দে হাত-পা-মাথা-শরীর নাড়ার ফলে যেমন তারা কবিতা বলতে মজা পায়, তেমনই অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নাড়াচাড়ায় সাবলীল হতে থাকে। এটাও তাদের ক্ষেত্রে ওষুধের মতই কাজ করে।
এতো গেল আমার অভিজ্ঞতার কথা, দীর্ঘদিন ছোটদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে কাজ করার ফলে যে বিশেষ বিষয়গুলি অনুভব করেছি তার কথা। কিন্তু কবিতাকে ‘ওষুধ’ মনে করেন এমন অনেক মানুষই আছেন গোটা বিশ্ব জুড়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার এনে দেওয়া ‘গীতাঞ্জলির’ ইংরেজি অনুবাদ ‘সং অফারিংস’ বইয়ের ভূমিকায় উইলিয়াম বাটলার ইয়েটস লিখেছেন, ‘আমি প্রতিদিন রবীন্দ্রনাথ পড়ি, তাঁর কবিতার একটি পঙ্ক্তি পড়লেই জগতের সব দুঃখ ভুলতে পারি।’ অর্থাৎ রবি কবির কবিতা সব দুঃখ দূর করে মনে প্রশান্তি নিয়ে আসে। এও তো এক রকম ওষুধ যা মানসিক শান্তি দেয়। এতো একশো বছর আগের কথা। হাল আমলেও কবিতাকে ওষুধের বিকল্প হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৮ সালে উইলিয়াম স্যাঘার্টের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় একটি কবিতার বই যার নাম ‘দ্য পোয়েট্রি ফার্মেসি, ট্রাইড অ্যান্ড ট্রু প্রেসক্রিপশনস ফর দ্য হার্ট, মাইন্ড অ্যান্ড সোল’। নামটা বেশ বড় হলেও বইটি আকারে ছোট, মানে পকেট বই। বইটি পড়ে মার্কিন অভিনেতা স্টিফেন ফ্রাই এতটাই উচ্ছসিত যে এটিকে বহু রোগের অব্যর্থ ওষুধ বলে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, ‘এটা আত্মার ক্ষত সারানোর মলম, জ্বরের শরীরে জলপটির শীতল স্পর্শ, আহতের জন্য সুস্থ হয়ে ওঠার সান্ত্বনা, নিঃসঙ্গের কাঁধে রাখা আস্থাবান হাতের মত’। অর্থাৎ কবিতা সত্যিই ওষুধের বিকল্প বা বিকল্প ওষুধ হয়ে উঠতে পারে।
ইংল্যান্ডের বিশপস ক্যাসেলে এমন একটি ডাক্তারখানা আছে যেখানে রোগীর প্রেসকিপশনে কোনও ওষুধের নামের বদলে কবিতা লিখে দেওয়া হয়। এই ডাক্তারখানার নাম ‘পোয়েট্রি ফার্মেসী’। নামেই বোঝা যাচ্ছে এটি এমন এক ওষুধের দোকান যেখানে কবিতা পাওয়া যায়। এই ফার্মেসীটি চালান ডেবোরাহ আলমা ও জিম শেয়ার্ড (নীচের ছবিতে)।
যাঁরা একইসঙ্গে মানসিক রোগের চিকিৎসক এবং কবি। এই দুই চিকিৎসক কবি আধুনিক পৃথিবীর চাপ, ভগ্ন হৃদয়ের যন্ত্রণা দূর করে রোগীর মনকে চাঙ্গা করার জন্য কাব্যিক প্রতিকার করছেন। মাত্র চার বছর আগে এই ক্লিনিকটি তাঁরা শুরু করেছেন। রোগ নির্ণয়ের জন্য সাধারণ যন্ত্রপাতি যেমন এখানে আছে তেমনই আছে এই দুই চিকিৎসকের অসাধারণ বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি। ডেবোরাহ বহু বছর ধরে উন্মাদ রোগীদের নিয়ে কাজ করছেন।কাজের সময় তিনি লক্ষ্য করেন, একটি কবিতা মুহূর্তে কারও মেজাজ পাল্টে দেয় এবং কবিতার পঙ্ক্তিগুলো সে মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকে। ‘পোয়েট্রি ফার্মেসী’তে যেসব রোগী আসেন, ডেবোরাহ আলমা ও জিম শেয়ার্ড প্রথমে তাদের সঙ্গে আলাদা ঘরে ‘পোয়েটিক কনসালটেশন’ করেন। এখানে রোগীদের নিয়মমাফিক কিছু প্রশ্ন করা হয়, এরপর খুব সাবধানে কবিতা বাছাই করে রোগীর জন্য ‘প্রেসক্রাইব’ করা হয়। নিজেদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁরা বুঝেছেন পছন্দের কবিতা মানুষের হৃদয়কে সংবেদী করে তোলে। মন তখন আয়নার মতো স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। মানুষ ভুলে যায় তাঁর ব্যক্তিগত দুঃখ-রাগ-ক্ষোভ। এই যে মনের সাময়িক মুক্তি, একেই স্থায়ীত্ব দিয়ে এই দুই মনোরোগ চিকিৎসক রোগীকে সারিয়ে তুলতে চান।