কালুকের ডায়েরি – তৃতীয় পর্ব

অংশুমান সরকার :
২৪ তারিখ সকাল পাঁচটা হতে না হতেই যথারীতি স্বরাজ তার ক্যামেরা আর ট্রাইপড নিয়ে তৈরি। সেই সঙ্গে আমি, প্রদীপ আর ভাস্করও। কিন্তু ড্রাইভার রাম
বলে গেছে যে সকাল ন’টার মধ্যে অবশ্যই বের হতে হবে। তাই তাড়াতাড়ি করে রেডি হতে হল। আগে থাকতেই spot গুলো আমরা পছন্দ করে রেখেছিলাম, তাই planning টা একদম ঠিক ছিল।
প্রথম থামলাম Dentam Valley তে –
এটি ১৫০০ মিটার উচ্চতায় একটি সুন্দর ছোট্ট গ্রাম, Varsey থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে। চারিদিকে রডডেনদ্রনের জঙ্গল। উপর থেকে সুন্দর লাগছিল উপত্যকা টা। জানতে পারলাম এটি Birdwatcher জন্য আদর্শ জায়গা। Alpine Gouda Cheese factory টি এখানেই অবস্থিত। এটি মোটামুটি কালুক(১৯ কিমি) আর পেলিং(২০ কিমি) এর মাঝামাঝি জায়গা। এতদিন মিঃ লিম্বুর সঙ্গে কথা বলছি, আজ এখানে এসে জানতে পারলাম যে লিম্বু এখানকার একটা ভাষারও নাম। এই লিম্বু ভাষাতে Dentam মানে হল ছাদের মত সমতল জমি।
এর পরের spot Changey (সাঙ্গে) জলপ্রপাত –
পেলিং থেকে প্রায় ১০ কিমি আগে রাস্তার এক বাঁকে এই জলপ্রপাত। ৩০০ মিটার উঁচু পাহাড়ের গা বেয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা তীব্র গতিতে নেমে এসে রাস্তা পেরিয়ে নিচে নেমে গেছে। এমন দৃশ্য চোখ ভরে দেখেও মন ভরে না। ছবি তোলারও যেন শেষ নেই এখানে। ঠাণ্ডা জলে হাত ঠেকাতে যেন গোটা শরীর জুড়িয়ে গেল।
এরপর কিছুটা এগিয়ে দেখি রাস্তা তৈরি হচ্ছে তাই কিছুক্ষণ দাড়াতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটাহাঁটি করার পর লাল্ বাহাদুর জানালো – ‘সাব, রাস্তা ক্লিয়ার’।
ঘড়িতে তখন প্রায় একটা, আমাদের পরের গন্তব্য Rubdensty Ruins, কিন্তু সেখানে যাবার পথে মাঝে পড়বে পেলিং। তাই ঠিক করলাম যে Lunch টা সেরে নিয়ে এগোনই ভালো। পেলিং এ অনেক মাঝারি/ ছোট খাবার রেস্তরাঁ আছে। মোটামুটি ভালো খাবার, আর দামও খুব বেশি নয়। আমাদের গড়পড়তা একজনের ১০০/১৫০ টাকা করে লাগলো। তবে আলুর পরটা আর মোমোর কোনও তুলনা নেই। খাওয়া সেরে
এগিয়ে চললাম Rubdensty Ruins এর দিকে –
গাড়ি থেকে নামার পর একটু অবাক লাগলো, ছবিতে যে রকম দেখেছিলাম তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র মিল নেই জায়গাটার। ভাবছিলাম ভুল স্পটে নিয়ে চলে এল না কি ! রাম হেসে বলল – ‘ইহা সে পয়দল জানা পড়েগা সাব’। কতদুর জিজ্ঞেস করাতে জানালো – এক কিমি। তখনও বুঝতে পারিনি যে এই এক কিমি এতটা মনে হবে – চড়াই উতরাই এর জন্য। কিন্তু সমস্ত কষ্ট নিমেষে মিলিয়ে গেল পৌঁছেই। সমস্ত range এর অসাধারণ panoramic দৃশ্য মন ভালো করে দিল। এটি সিকিম রাজার দ্বিতীয় রাজধানী ছিল এক সময় (১৬৭০ – ১৮১৪)। গোর্খা সৈন্যরা আক্রমণ করে এটিকে ধ্বংস করে দেয়, পড়ে থাকে শুধু এই ভগ্নস্তূপ। তিনটি শোরতেন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে যেখানে সিকিমের রাজপরিবারের সকলে প্রার্থনা করতেন। জায়গাটা এত ভালো লাগছিল যে ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিল না।
এর পরের spot কাঞ্চনজঙ্ঘা জলপ্রপাত –
শুনেছিলাম গরমকালে নাকি এই জলপ্রপাত দেখার মতো। কিন্তু এই ডিসেম্বরএর শেষে আমাদের খুব একটা সন্তুষ্ট করতে পারলো না। যাই হোক, পথে এক জায়গাতে দেখলাম ছোট ছোট কমলালেবু বিক্রি করছে বাচ্চা মেয়েরা। এক ঝুড়ি কিনলাম মাত্র ৮০ টাকায়। খেতে বেশ মিষ্টি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, একটু মেঘও করছে। তাই জলদি গাড়িতে উঠে পড়লাম।
এবার Khecheopalri Lake –
Wikipedia তে দেখেছিলাম যে এর মানে হল পদ্মস্মভব (বৌদ্ধ গুরু) এর স্বর্গ। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় ৫/১০ মিনিট হাঁটতে হল। একটা অদ্ভুত অপার্থিব পরিবেশ। এই রকম Silence of Nature আর কোথাও পেয়েছি বলে মনে পড়ে না। স্থানীয় লোকেরা একে বলে সো–জো–সো। এ নাকি মনস্কামনা পুরনের হ্রদ। অনেক লোককথা এখানে প্রচলিত – এই জলে না কি গাছের পাতা পড়লে, পাখিরা তা তুলে নিয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেখান থেকে ফিরে গাড়িতে উঠতে উঠতে প্রায় অন্ধকার হয়ে গেল। গাড়িতে প্রায় তিন ঘণ্টার পথ।