কালুকের ডায়েরি – চতুর্থ পর্ব

অংশুমান সরকার :
এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা – রাত প্রায় নটা, পাহাড়ি রাস্তার পাকদণ্ডি, হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা, হঠাৎ আমাদের দুটো বোলেরো গাড়ির একটা গাড়ি খারাপ হয়ে গেল। এরপর, একটা গাড়ি মুখ ঘুরিয়ে আলো ফেলল খারাপ গারিটার দিকে, আর দুই ড্রাইভার মিলে গাড়ির তলায় শুয়ে পড়ে সারাতে চেষ্টা শুরু করল। জানতে চাইলাম, এখান থেকে কতদূর? নির্বিকার ভাবে লাল বাহাদুর জানালো – আরও ঘণ্টা দেড়েক। ‘গাড়ি ঠিক না হলে কি হবে?’ – বিপ্লবের প্রশ্নের উত্তরে দুই ড্রাইভার একগাল হেসে বলল – যে দুটো গাড়ি থাকলে, না কি চিন্তার কিছু থাকে না। যাই হোক, প্রায় আধঘণ্টা পর শেষ পর্যন্ত গাড়ি ঠিক হল, ফিরলাম রিসোর্টে।
২৫ তারিখ সকালে উঠে দেখি – আকাশ একদম ঝকঝক করছে। আর কাঞ্চনজঙ্ঘা তার স্ব-মহিমায় বিরাজ করছে। অসামান্য সেই আলোর খেলা। একপ্রস্থ ছবি তোলার পর রওনা দিতে হল। পথে Dentam এ দাঁড়িয়ে এখানে তৈরি ছোট ছোট ফুছকা খেয়ে প্রথমে গেলাম –
শিংসোর সেতু –
এটি এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম Suspension Bridge আর সিকিমের উচ্চতম। পেলিং থেকে ৫ কিমি দূরে অবস্থিত এই সেতুর উচ্চতা প্রায় ১০০ মিটার এবং এটি ২০০ মিটার দীর্ঘ। হেঁটে পার হতে হয়। উপর থেকে নিচের জলধারার দৃশ্য অসাধারণ। যাবার সময় পেলিং হয়েই যেতে হয়। তাই ফেরার পথে সেখানেই Lunch সারলাম। প্রচুর খাবার জায়গা আর দামও বেশ সস্তা। এরপর –
ছায়াতাল –
এটি পেলিং থেকে ৩২ কিমি দূরে, প্রায় ৬০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটি Lake যার সৌন্দর্য বলে বোঝানো যাবে না। সবুজ জলের উপর চারিদিকের পাহাড়ের ছায়া পড়ে এক অপার্থিব দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। সিকিম সরকার পর্যটকদের জন্য এখন একটা সাজানো Monestry নির্মাণ করছেন যার চুড়োতে একটি বিশালাকার সন্যাসির মূর্তি রয়েছে। এখান থেকে পুরো উপত্যকাটি খুব সুন্দর লাগে। আর আমরা দেখলাম পাহাড়ের সূর্যাস্ত। সন্ধে নেমে আসছে তাই তড়িঘড়ি করে বের হতে হল কারন যেতে হবে –
রিঞ্চেনপং ডাকবাংলো –
শুনেছিলাম রবীন্দ্রনাথ না কি এই ডাকবাংলো তে কিছুদিন ছিলেন আর এর নৈশব্দে মুগ্ধ হয়ে গীতাঞ্জলীর কিছু অংশ লিখেছিলেন। ঐতিহাসিক মত অনুযায়ী – এই ডাকবাংলো তে British শাসনকর্তারা থাকতেন, এর কাছেই ছিল এই অঞ্চলের একমাত্র পানীয় জলাধার। ১৮৬০ সাল নাগাদ স্থানীয় লেপচা রা ইংরেজ সৈন্যদের অত্যাচারে ক্ষুব্ধ হয়ে সেই জলাধারের জলে ভেসজ বিষ মিশিয়ে তাদের হত্যা করে। সেই থেকে জলাধারটির নাম হয় Poison Lake । গিয়ে বুঝতে পারলাম যে সন্ধের মুখে আসাটা একদম সঠিক হয়েছে। এরকম অপার্থিব নৈশব্দ এর আগে একবারই অনুভব করেছিলাম ঘাটসিলায় সুবর্ণরেখার তীরে। তার উপর এরকম একটা আধপোড়ো ডাকবাংলো। মনে হবে যে সত্যজিতের লেখা কোন ভৌতিক গল্প থেকে যেন উঠে এসেছে। কোনও লোকজন কোথাও নেই। অন্ধকার নেমে আসছে দেখে আর আমাদের হাবভাব দেখে ড্রাইভার দুজনও ভয় দেখাতে শুরু করলো – বলে যে ‘এখানে রাতে কেউ আসতে চায় না সাব’। যাই হোক গাড়িতে উঠে পড়তে হল, কারন রিসোর্টের ম্যানেজার বারবার করে অনুরোধ করেছিলেন যেন একটু তাড়াতাড়ি ফিরি। আমাদের honor এ একটা Christmas Party arrange করেছেন তারা।
ফেরার পথে পেলিং থেকে একটু চা খেতে হল কারন ঠাণ্ডা পড়েছে জাঁকিয়ে। রিসোর্টে ফিরেই তৈরি হয়ে ছুটলাম Party তে। কি ভালো যে লাগলো বলে বোঝাতে পারব না। স্থানীয় ছোট ছোট মেয়েরা দারুন নাচল, কত গান যে গাইল তার ঠিক নেই। এর সঙ্গে পরিবেশন করল এদের নিজেদের তৈরি স্থানীয় wine যদিও সে তা ঠিক খেতে ভালো লাগলো না।
সমাপ্ত